আফগানিস্তানে আফিম চাষ

আফগানিস্তানে আফিম চাষ

তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ১১

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২১

হাশেমী সেদিন আফগানিস্তানে তালিবানদের অর্জন নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, প্রথমে আমরা যা করেছি তা হচ্ছে এই খণ্ড বিখণ্ড দেশটাকে একত্রিত করা। আফগানিস্তান আগে পাঁচ ভগ্নাংশে বিভক্ত ছিল। আমরা একে জোড়া লাগিয়েছি, এমন সময়ে যখন এ কাজ আর কেউ করেনি। দ্বিতীয় যে কাজটা আমরা করেছি, যাতে সবাই বিফল হয়েছে, তা হলো মানুষজনকে নিরস্ত্র করা। যুদ্ধের পর প্রতিটি আফগানের কাছে একটা কালাশনিকভ ছিল, এমনকি আরো অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র যেমন স্টিংগার মিসাইল, এমন কি তাদের ফাইটার প্লেন এবং ফাইটার হেলিকপ্টার ছিল। এই লোকগুলিকে নিরস্ত্র করা প্রায় অসম্ভব মনে হচ্ছিলো। দ্বিতীয় যে কাজটা আমরা করেছিলাম, দেশের পঁচানব্বই শতাংশ অস্ত্র উদ্ধার। তৃতীয় যে কাজটা করেছি, আফগানিস্তানে একটা একক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা, যা দশ বছর ধরে ছিল না। চতুর্থ অর্জনটা সকলের কাছেই বিস্ময়কর যে, আমরা বিশ্বের আফিম চাষের পঁচাত্তর শতাংশ কমিয়ে এনেছি। আগে আফগানিস্তান বিশ্বের পঁচাত্তর শতাংশ আফিম উৎপাদন করতো। এই বছর জাতিসংঘ মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ইউএনডিসিপি এবং তাদের প্রধান বার্নার্ড এফ সগর্বে ঘোষণা করেন যে, আফিম চাষ শূন্য শতাংশ। মানে গোল্লায় গেছে। প্রসঙ্গত এটা জাতিসংঘের জন্য খুব ভালো খবর ছিল না। কারণ তাদের অনেকেরই এতে চাকরি খোয়া গেছে। ইউএনডিসিপিতে তথাকথিত সাতশো বিশেষজ্ঞ কাজ করতেন, মাইনে পেতেন কিন্তু একজনও কখনো আফগানিস্তানে যাননি। ফলে আমরা যখন এই ডিক্রি জারি করলাম, যাতে মানুষজন যেন আর আফিম চাষ না করে, তখন এসব বিশেষজ্ঞরা খুশি হননি এবং এই বছরে তারা চাকরি হারিয়েছেন।

হাশেমী আরও বলেন, পঞ্চম সাফল্য হচ্ছে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। এখন আপনারা ভাবতে পারেন যে, আমরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে যুক্ত আছি। বাস্তব হচ্ছে একেবারেই উল্টো। আমাদের আগে আফগানিস্তানে কেউই শান্তিতে বসবাস করতে পারতো না। আমরা প্রথম যে কাজটা করেছি তা হলো, মানুষজনকে একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জীবন দান করা। দ্বিতীয় বড় যে জিনিসটা আমরা নিশ্চিত করেছি তা হচ্ছে মানুষজনের জন্য অবাধ ও নিরপেক্ষ ন্যায়বিচার। ওখানে আপনাদের মতন না, বিচার কিনতে হয় না। আফগানিস্তানে বিচার হচ্ছে মুক্ত এবং অনায়াসলভ্য। নারী অধিকার লঙ্ঘনের দায়ে আমাদের সমালোচনা করা হচ্ছে। আপনারা কি জানেন আমাদের আগে কী ঘটতো? এখানে কিছু আফগান দেখতে পাচ্ছি, তাঁরা নিশ্চয় আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, আফগানিস্তানের গ্রামদেশে নারীদের জীবজন্তুর মতো করে ব্যবহার করা হতো। অক্ষরিক অর্থেই তাদের বিক্রি করা হতো। এই ঘৃণ্য রেওয়াজ আমরা বন্ধ করেছি। স্বামী বাছাই করার বেলায় তাদের মতামতের কোনো দাম ছিল না। প্রথম আমরা যেটা করলাম তা হচ্ছে তাদেরকে নিজ ভবিষ্যত বেছে নিতে দিলাম। আফগানিস্তানে আরেকটা ব্যাপার ঘটতো যে, উপঢৌকন হিসেবে নারীদের বিনিময় চলতো। অবশ্যই এতে ধর্মীয় কিছু নেই, এটা সাংস্কৃতিক। দুটা বিবাদমান গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে রফা করতে চাইলে তারা নারী বিনিময় করতো। এটা এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।


হাশেমী বলেন, সাধারণত যা বলা হয়ে থাকে আফগানিস্তানে তার উল্টোটাই ঘটে, নারীরা কাজ করে। এটা সত্য যে, ১৯৯৬ সালে রাজধানী কাবুল দখল করার আগপর্যন্ত আমরা নারীদের ঘরের ভিতরে থাকতে বলতাম। এর মানে এ নয় যে, আমরা চেয়েছি তারা চিরকালই ঘরের ভিতরে থাকুন। আমরা তখন বলেছি কোথাও আইন নেই, শৃঙ্খলা নেই, আপনাদের আপাতত ঘরের ভেতরে থাকতে হবে। আমরা মানুষজনকে নিরস্ত্র করলাম, আইন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করলাম এবং এখন নারীরা কাজ করছেন। সত্য নারীরা এখানকার মতো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন না। আমরা চাই না যে আমাদের নারীরা যুদ্ধ-বৈমানিক হন, কিংবা তাঁরা বিজ্ঞাপনে দর্শনীয় বস্তু আকারে ব্যবহৃত হন। তাঁরা কাজ করেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে এবং এরকম। আমরা বলেছি যে আমরা শিক্ষা চাই এবং শিক্ষিত আমরা হবোই, তা কারো চাপ থাকুক আর নাই থাকুক। কারণ, তা আমাদের বিশ্বাসের অংশ। যখন আমরা পৃথক বিদ্যালয় থাকার কথা বলি, তার মানে এই নয় যে, আমরা চাই না আমাদের নারীরা শিক্ষিত হোক। এটা সত্য যে আমরা সহশিক্ষার বিপরীতে। কিন্তু এটা সত্য নয় যে আমরা নারী শিক্ষার বিপরীতে।

হাশেমী আরও বলেন, এমন কি আমাদের এখনো বিদ্যালয় আছে, কিন্তু সমস্যা সহায়-সম্পদের। সেজন্য আমরা এই কর্মসূচিগুলি বাড়াতে পারছি না। আমাদের সরকারের আগে নানান ধরনের পাঠ্যপুস্তক ছিল। রাজাদের বন্দনা করে, এমন পাঠ্যসূচী ছিল। কমিউনিষ্ট বন্দনা করে, এমন পাঠ্যসূচী ছিল এবং সাতটা দলের পক্ষের পাঠসূচী ছিল। সে কারণে কী পড়া উচিত, তা নিয়ে শিক্ষার্থীরা দোটানায় পড়ে যেতো। আমরা পাঠ্যসূচী একত্রীকরণের কাজে হাত দিয়েছি এবং সেটা চলছে। সম্প্রতি আমরা আফগানিস্তানে সব বড় শহরে এবং কান্দাহারে চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুষদ পুনরায় চালু করেছি। চিকিৎসা অনুষদে ছাত্রদের থেকে বেশি ছাত্রীরা লেখাপড়া করছে। তবে তারা পৃথক শিক্ষায়তনে পড়ছে। আমি জানি তা যথেষ্ট নয়, কিন্তু এটুকু পর্যন্তই করার সামর্থ্য হয়েছে আমাদের।

হাশেমী যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ ঘোষণা এবং যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা তালিবান রাষ্ট্রের পতনের আগে এই বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই সময় পর্যন্ত তালিবানরা মাত্র পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল। বারবার চাপিয়ে দেয়া বিরাট যুদ্ধ, তেইশ বছরের একটানা নানারকম বিপর্যয়ের পার পাঁচ বছর একটা সরকারের জন্য কতোটা সময়? সেই সামান্য সময়কালে তারা যে সফলতা লাভ করেছিলেন আর যা পারেননি তা অকপটে স্বীকার করেছেন হাশেমী। বক্তব্যের মধ্যে আস্ফালন নেই, রয়েছে জবাবদিহিতা। তিনি যা বলেছেন, মাখমালবাফের দেখার সঙ্গে তার প্রায় সবকিছুই মিলে যায়। যখন আফগানিস্তানের এগিয়ে যাবার পথযাত্রা আরম্ভ হলো, যুক্তরাষ্ট্র তখন অন্যায়ভাবে আক্রমণ চালায় আফগানিস্তানের উপরে। ভদ্রসমাজ সেই আক্রমণের বিরুদ্ধে কথা বলছেন না, সাম্রাজ্যশক্তির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে নিজেদের মনগড়া এক গল্প তৈরি করেছেন তালিবানদের সম্পর্কে। চলবে