ওসামা বিন লাদেন

ওসামা বিন লাদেন

তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ১৪

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২১

বহু আফগান ছেলেমেয়েকে আমানুল্লাহ লেখাপড়া শিখতে ইউরোপে পাঠিয়ে দিলেন। শাসন ব্যাপারেও বহু সংস্কার তিনি ঘটাতে আরম্ভ করলেন। তিনি পারস্য, তুর্কি আর সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চমৎকার সব কুটনৈতিক সন্ধি স্থাপন করলেন, তাতে তার রাজ্যের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেল। ভিন্ন দিকে এর ফলে আফগানিস্তানে ব্রিটিশদের প্রতিপত্তি প্রচণ্ড ধাক্কা খেলো। ব্রিটিশ সরকার এসব সন্ধিতে আপত্তি প্রকাশ করলেন। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সন্ধি কিছুতেই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ মেনে নিতে পারলো না। ১৯২৮ সালে আমানুল্লাহ রানী সৌরিয়াকে নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে বের হলেন। দীর্ঘ এই ভ্রমণের ভিতর দিয়ে বিভিন্ন দেশে আমানুল্লাহর মর্যাদা বৃদ্ধি পেল, কিন্তু দেশের ভিতরে নতুন করে বিদ্রোহ আরম্ভ হলো। ব্রিদ্রোহকে ইন্ধন যুগিয়েছিল ব্রিটিশ শক্তি। ধর্মীয়ভাবে যাঁরা কট্টর, যাঁরা আমানুল্লাহর একচ্ছত্র সংস্কার মেনে নিতে পারেনি, বিদ্রোহ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো তারাই, আর ব্রিটিশ শক্তি তাঁদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিল। ব্রিটিশ শক্তি ব্যাপক অর্থ আর অস্ত্র সাহায্য দিয়ে কট্টর-ধার্মিকদের দাঁড় করিয়ে দিলেন আমানুল্লাহর সংস্কারকাজের বিরুদ্ধে। বাচ্চা-ই-সাকো নামের এক ভিস্তিওয়ালা ছিলেন এই বিদ্রোহের নেতা।

১৯২৯ সালে বিদ্রোহীরা জয়ী হলো, আমানুল্লাহ রানী সৌরিয়াকে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলেন। ব্রিটিশ শক্তির ষড়যন্ত্রে আফগানিস্তান আবার অন্ধকারে আটকে রইলো। পাঁচমাস ধরে বাচ্চা-ই-সাকো কাবুলে রাজত্ব করলন। আমানুল্লাহর একজন মন্ত্রী ও সেনাপতি নাদির খাঁ তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিলেন। তিনি নিজেই এরপর রাজা হলেন নাদির শাহ নাম ধারণ করে। তিনি ইংল্যান্ডের মিত্র ছিলেন এবং তাদের কাছ থেকে সাহায্য লাভ করলেন। ১৯৩৩ সালে নাদির শাহ আততায়ীর হাতে নিহত হলেন এবং ক্ষমতায় বসলেন তাঁর তরুণ পুত্র মুহাম্মদ জাহির শাহ। জাহির শাহ দীর্ঘ চল্লিশ বছর রাজা হিসেবে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিলেন। জাহির শাহর শাসনে সেখানে গণতন্ত্র ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুপক্ষই আফগানিস্তানকে অর্থ সাহায্য দেয়। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চুক্তি হলে আফগানিস্তানের শাসকরা সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ১৯৬০ সালে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে সমাজতন্ত্র চর্চার জায়গা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মেধাবী ছাত্ররা পড়াশুনা করতে চলে আসতেন কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই তাঁরা শুনতেন মুক্তির মন্ত্র।

এতদিনকার অভ্যাস, সংস্কার আর বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তির, চিন্তার, ভাবনার বাধতো বিরোধ। সেই বিরোধ থেকেই তাঁরা ঝুঁকতেন সমাজতন্ত্রের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্ররা ছিলেন সমাজতন্ত্রের অনুসারী। নাজিবুল্লাহ, রাব্বানি, হেকমতিয়ার প্রমুখ সকলেই তখন প্রগতিশীল ধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৬৪ সালে রাজা জাহির শাহ ‘লয়া জিরাগা’র সভা ডাকেন। সেখানে সমস্ত উপজাতির নেতারা হাজির হন। তিনি রাজনৈতিক দল গঠন করার অধিকার দিলেন কিন্তু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুমতি দিলেন না এবং রাজার ক্ষমতা ছাড়লেন না।  ১৯৬৪ সালে তবুও সংবিধান প্রবর্তিত হলো। প্রতিষ্ঠিত হলো সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। ১৯৬৫ সালে অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজ শুরু হয়। পরিবহন এবং স্বাস্থ্য খাতকে গুরুত্ব দেন রাজা জাহির শাহ। বাঁধ, জলাধার, খাল কাটা হয় সেচ ও জল বিদ্যুৎ এর লক্ষ্যে।  দল গঠনের ক্ষমতা লাভ করার পর ১৯৬৫ সালে গঠিত হয় পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান। দলটি ছিল মার্কসবাদ আর লেনিনবাদে বিশ্বাসী। ১৯৬৭ সালে দলটি দুভাগে ভাগ হয়ে যায় ‘পরচাম’ এবং ‘খালক’ নামে। পরচাম শব্দের অর্থ পতাকা আর খালক শব্দের অর্থ জনগণ। পরচামদের সমর্থক বাহিনীর মধ্যে ছিল নাগরিক জনগণ, শিক্ষিত পশতুন এবং অন্যান্য উপজাতিরা।

খালক গোষ্ঠীর সমর্থক ছিল শিক্ষিত গ্রামীণ আফগান। পশতুনদের মধ্যে এদের আধিপত্য ছিল। ১৯৭৩ সালে জাহির শাহ ক্ষমতাচ্যুত হলেন আত্মীয় দাউদ খানের দ্বারা। নতুন এই রাজা জোট বাঁধলেন পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান দলের সঙ্গে। ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পর দাউদ চেষ্টা করলেন পরচামদের সরিয়ে দিতে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সঙ্গে দূরত্ব গড়ে তুলতে। কিন্তু ১৯৭৭ সালে সাম্যবাদীদের দুটি গোষ্ঠী পরচাম আর খালক নিজেদের মধ্যকার বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হলো আর ১৯৭৮ সালের ২৭ এপ্রিল এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এলো সাম্যবাদীরা।

সমাজতন্ত্রীরা ক্ষমতায় এসে দেশের অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন সাধনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। শিক্ষিত গ্রামীণদের দল ‘খালক’দের নেতৃত্বে ভূমিসংস্কার শুরু হলো। ভূমিহীন কৃষককে জমি দেওয়া, খেতমজুরের মজুরি বৃদ্ধি করা, বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার, নারী শিক্ষার বিস্তার, বহু নতুন নতুন উচ্চ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করে সমাজতন্ত্রীরা। এসব কাজে ব্যাপক সহায়তা দেয় সোভিয়েত রাশিয়া। এই সময়ে গ্রেফতার হলেন কট্টর রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় গুরু, শিক্ষক ছাত্ররা। ইসলাম ধর্মীয় সংগঠনগুলির নেতৃত্বও ধৃত হতে থাকলেন দলে দলে। এই সময়ে ভূমি সংস্করণের চেষ্টা ক্ষুব্ধ করে উচ্চবিত্তদের, যদিও দরিদ্ররা খুশি হয়েছিলেন। ধর্মীয় নেতারা তখন যুক্তরাষ্ট্র আর পাকিস্তানের মদতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি তখন হাফিজুদ্দিন আমিন। তিনি ছিলেন মার্কসবাদী। তিনি দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। তাঁর স্বপ্নে বাধা দেয় মার্কিন আর পাকিস্তানের সহযোগিতা প্রাপ্ত মুজাহিদিনরা। এই মুজাহিদিনদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন পেশওয়ারে গুলাবউদ্দিন হেকমতিয়ার, পঞ্জশির উপত্যকায় বসে মাসুদ । ফলে আফগান সেনাবাহিনী বিপর্যস্ত হলো। ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ‘খালক’ রাষ্ট্র্রপতি হাফিজুল্লাহ আমিন খুন হলে বারবাক কারমাল রাষ্ট্রপতি হলেন। বহুজন সন্দেহ করেন এই ঘটনার পিছনে সোভিয়েত গোয়েন্দাদের হাত রয়েছে। বারবাক কারমালকে সাহায্য করার জন্য দেশের ভিতরে ঢুকে পড়লো সোভিয়েত সেনাবাহিনী। ১৯৭৯ সালে পঁচাশি হাজার সৈন্য পাঠায় সোভিয়েত রাশিয়া। রাশিয়ার সেনাদের আফগানিস্তানে প্রবেশের অনুমোদন দেন বারবাক কারমাল নিজেই। ঠিক এর পরেই যুদ্ধ শুরু হলো সোভিয়েত সেনা আর মার্কিন মদতপুষ্ঠ ইসলামি মুজাহিদিনদের মধ্যে।

যখন ১৯৭৯ সালে বারবাক কারমাল আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি তখন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার তিরিশ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য করেন মুজাহিদিনদের। মুজাহিদিনদের হাতে টাকাটা পৌঁছায় আইএসআই-এর মাধ্যমে। ১৯৮০ র দশকে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং অন্যান্য দেশ থেকে কিছু মুসলিম জেহাদ করার নামে মুজাহিদিনদের পক্ষে যোগ দেয়। মুজাহিদিনরা পরিচালিত হচ্ছিলেন বিভিন্ন গোষ্ঠীর দ্বারা। সেখানে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ, অস্ত্র ও রসদপুষ্ট এবং পকিস্তান ও সৌদি আরবের পক্ষভুক্ত গুলাবউদ্দিন হেকমতিয়ারের ‘হিজব-ই-ইসলাম` দল আর অবদুল রসুল সয়াফের ‘ইত্তিহাদ-ই-ইসলাম’ গোষ্ঠী। দুটোতেই ছিল পশতুন অভিজাত জমিদার ও ধর্মীয় মোল্লাদের প্রাধান্য। এদের মধ্যেই ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। ইনি ১৯৮০ শুরুতেই আফগানিস্তানে আসেন ধর্মযোদ্ধা হিসেবে। এসে কট্টরপন্থী জেহাদীদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। তিনি আরব দেশ থেকে প্রচুর স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে আসেন আফগানিস্তানে। যদিও আফগান মুজাহিদিনরা প্রথম দিকে তাঁকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। নিজেদের মধ্যে তারা এই বলে হাসাহাসি করতো যে, লোকটা ডলার দেয় আর বিনিময়ে শ্রদ্ধা চায়। সেই শ্রদ্ধা শেষ পর্যন্ত লাদেন ঠিকই আদায় করে নিয়েছিলেন বিরাট এক সাহসী এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ব্যক্তিত্ব হিসেবে।

লাদেনের বাবা ছিলেন বিরাট ব্যবসায়ী। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুশের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল তার পিতার ব্যবসা। লাদেনরা ছিলেন চল্লিশ ভাই আর তেরো বোন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি পিতার কাছ থেকে অগাধ সম্পত্তি লাভ করেন। যদি তিনি যুদ্ধে না জড়াতেন, বিশাল সম্পত্তির মালিক হিসেবে সারাটা জীবন বিলাসিতার মধ্যে কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। লাদেনের কোনো ধর্মীয় শিক্ষা বা সনদপত্র ছিল না। তিনি পড়াশুনা করেন ব্যবস্থাপনা, কৃষি আর অর্থনীতি নিয়ে। নিজেকে তিনি বলতেন কৃষিবিদ আর স্থপতি। তিনি আফগানিস্তানে এসে নিজ অর্থে তৈরি করেন অসংখ্য সুরঙ্গ, রাস্তা আর বাঙ্কার। তিনি বখতিয়ার প্রদেশের জাজি পর্বতে প্রচুর সরঙ্গ কেটে গেরিলা হাসপাতাল আর অস্ত্রাগার তৈরি করেন। সরল, অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন তিনি। অগাধ ছিল তাঁর পাণ্ডিত্য আর কবিতা লেখার চমৎকার হাত। কবিতা আর অস্ত্র; দুই ঝলসে ওঠে তাঁর হাতে। তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং সরাসরি মন্তব্য পশ্চিমি দুনিয়ার কাছে আদায় করেছে সমীহ। যখন তিনি সোভিয়েতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, তখন তাঁর সঙ্গে পশ্চিমের বিবাদ ছিল না, সকলে তাঁকে সমীহ করতো। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর সাফ কথা ছিল, পৃথিবীর সব থেকে বড় ডাকাত আর সন্ত্রাসবাদী হচ্ছে আমেরিকা। চলবে