তিতুমীর

তিতুমীর

তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ২০

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ০১, ২০২১

নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন গৌতম ভদ্র। তিনি চমৎকার বিশ্লেষণ দিয়েছেন ভারতের সাম্রাজ্যবাদী এসব বিদ্রোহের। তিনি নতুনভাবে জেহাদি তত্ত্বকে আলোয় এনেছেন। তিনি দেখাচ্ছেন, এশিয় সংস্কৃতির গ্রহণ ও বর্জন নির্ধারিত হচ্ছে প্রতীচ্যের আদর্শয়ায়িত আইনের কাঠামোয়। এশিয়ার বিভিন্ন বিচার ব্যবস্থাকে পর্যন্ত পাশ্চাত্য গড়ে নিয়ে চায় তাদের আদলে। ধর্মভাব বা যৌথ সমাজের মধ্যে ভারতের নিম্নকোটির মানুষ তার অস্তিত্বকে খুঁজে পেত। দেবদেবী, পীর, সন্তকে দেখতেন তাঁরা সমাজের রক্ষক হিসেবে। কিন্তু এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি ছিল না। সবটাই ছিল সহজ সরল অনাড়ম্বর। কিন্তু ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের খবরদারির সামনে প্রজার ধর্মবোধ হয়ে ওঠে তার অন্যতম প্রধান পরিচয়। এই পরিচয় ব্যক্তি-নাগরিকের নয়, এই পরিচয় গোষ্ঠীর এবং গোষ্ঠীর সদস্য সমূহের চিহ্ন। দূর থেকে বহুজনের কাছে মনে হতে পারে পশ্চাদপদতা। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটে? তুলশী শালগ্রাম আর গঙ্গার নামে হিন্দুরা ইংরেজদের মোকাবিলা করে এবং আল্লা ও কুরআনের নামে লড়ে মুসলমানরা। জেহাদের এই প্রকল্পে হিন্দু আর মুসলিম তাদের স্বতন্ত্র মর্যাদা রক্ষাকল্পে তারা ফিরিঙ্গি বিরোধী লড়াইয়ে সামিল হয়। যতই বিদেশি শাসন প্রগতির দাবি মেটাতে এসব মানুষের চেনা জগতটাকে বদলে দিতে চায়, সে কট্টরভাবে ফিরে যেতে চায় তার পুরানো পরিচয়ে। এই অভিজ্ঞতার মধ্য থেকে জন্ম নিয়েছে দেশজ বুদ্ধিজীবীদের নানা দাবি এবং তাদের দ্বিচারিতার । বারবার ‘সভ্যতা’ ও ‘প্রগতি’র দোহাই দিয়ে, বিদেশী শাসনকে তারা হালাল করতে চায়, ভিন্ন দিকে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে।

তিতুমীরের লড়াই নিয়ে ইংরেজ পক্ষের কলভিন বলেছিলেন যে, বাংলার গ্রামে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট সাধারণ লোকের কাছে হেরে গেছে। ব্যাপারটা অভাবনীয়। সাধারণ মানুষরা চিরকাল হার মানে। এবার জমিদার, সরকার আর নীলকর সবাই তাদের কাছে হার মানলো। কথাটা হলো, জেহাদীদের দেশ যেখানে জোলা বা নিকারিদের মতো অন্ত্যজরা কেবল গামছা বোনে না বরং মৌলভী হয়, তাঁদের সামনে কোনো সাহেব দাঁড়াতে পারে না। তাই গভর্নরও ভয় পেয়ে যান। এখানে ঘৃণ্য আর অপাংক্তেয়র ধর্মই শোষণের বিরুদ্ধে নিজেকে জাহির করে, বামুন আর আশরাফদের মান রাখে না। তিতুমীরের বাদশাহী আর হিদায়েতী ও জোলাদের রাজত্ব তাই ত্রাশ সৃষ্টি করে যেভাবে হুনানের কৃষক বিদ্রোহও উচ্চকোটির মানুষের কাছে ত্রাসের বার্তা নিয়ে এসেছিল। স্পষ্টই তা তাদের ক্ষমতা হারাবার ভয়। সরকারি কর্মকর্তারা তখন থতমত খেয়েছিলেন, নিম্নকোটির মানুষের এত সাহস আসে কোত্থেকে? খোদ ম্যাজিস্ট্র্রেটকে আক্রমণ করে বসে! পুলিশ বরকন্দাজ তাদের কিছুই করতে পারলো না। সাহেব বুঝতেই পারলো না, গরীব অন্ত্যজ মানুষদের এতটা সাহস হয় কী করে, তারা এত জোর পায় কী করে? গৌতম ভদ্র লিখেছেন, ধর্মীয় সংস্কারকে খোঁচালে বা আঘাত দিলে অজ্ঞ আর ধর্মোন্মাদ মানুষেরা উৎসাহিত হয়ে চূড়ান্ত সীমায় চলে যেতে পারে।


সীমাহীন ঐদ্ধত্যই তো হচ্ছে বিদ্রোহের আসল রূপ। নিম্নবর্গের হিন্দুরাও তিতুমীরের এই জেহাদে অংশ গ্রহণ করেছিল। কারণ তা ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে আর জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে আর নিজ ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে আক্রমণের জবাব।

বিদ্রোহীরা যে যুদ্ধের জিগির তোলে তা হলো দীনের লড়াই। গৌতম ভদ্র স্পষ্টই সে কথা জানান। তিনি জানান, লক্ষণ বিচারে ইমানের ধারণা ও যুক্তির ধারণা পরস্পরের বিপরীত বিন্দুতে অবস্থিত। যুক্তিবাদী বুর্জোয়া রাষ্ট্র্রের সাধ আছে ধর্মনিরপেক্ষতার। কিন্তু তার বিপরীতে রয়েছে নিম্নবর্গের ‘ধার্মিক’ প্রতিবাদের ঐতিহ্য যার সঙ্গে যুক্ত ধর্মবোধের বর্ম। কিন্তু উচ্চকোটির বিরুদ্ধে নির্ধারিত তার মূল ঘৃণা শাসক কিংবা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ ঠিক তাই। কিছু মানুষ ধর্মকে আশ্রয় করে, ধর্মই সেখানে প্রধান আশ্রয়; মঠ মন্দির সেখানে প্রধান বিষয়; শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে নামে একদল সন্ন্যাসী জীবন বাজী রেখে। আধ্যাত্মিক মুক্তি বা ইমানের ধারণাই এই লড়বার শক্তি জোগায়। তিতুমীর নারকেল বেড়ে যে জঙ্গ আরম্ভ করে, সেখানে চির-অন্ত্যজ জোলারা হিদায়েত আর মুমিন বলে চরম আত্মবিশ্বাসে জমিদার, দারোগা, কুঠিয়াল, জেলা প্রশাসক সবার শক্তিকে তুচ্ছ করে। কিন্তু সকলেই জানে এই জোলারা হলো সমাজে তুচ্ছ, সমাজের অন্তেবাসী। তিতুমীর জোলাদের নিয়ে এমন এক নতুন সম্প্রদায় গড়েছেন; দাড়ি রাখা, তহবন্ত পরা, নিজের মসজিদে নামাজ পড়া আর সাম্প্রদায়িক ভোজে অংশ গ্রহণ করা তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব। তি
তুর বাণীর মধ্য দিয়ে যারা বিশ্বাস করে তাদের ধর্ম অত্যন্ত মূল্যবান; আর এই ধর্ম রক্ষা করতে হলে বিদেশী শাসন হটানো খুব জরুরি। বিদেশীদের শাসন হটানো মানেই তার কাছে আর এক অর্থে ধর্মরক্ষা। তালিবানদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একই রকম। ধর্মই তাকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রাণ দেবার ইমান তৈরি করে দেয়। ইমান দিয়েই সে তার বিজয়ের নিশান ওড়ায়। ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা তখন তার কাছে গুরুত্ব পায় না।

ইতিহাসের এই অধ্যায়কে মনে রেখেই বিচার করতে হবে তালিবানদের। ধর্মের দিক থেকে কট্টর হোক আর যাই হোক, তালিবানরা নিজ দেশের ভূখণ্ড শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করার জন্যই লড়াইয়ে নেমেছিল। কিছুই তাদের রুখতে পারেনি। কথা হলো, আফগানিস্তানে অন্য ধর্মের লোক ছিল না। যদি অন্য ধর্মের লোক থাকতো, তাহলে কী দাঁড়াতো? আসলে ধর্মের বাধাটা বড় হতো না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তখন সব ধর্মের মানুষরা এক হতো। ঠিক যেমন মুসলমান বাহাদুর শাহর নেতৃত্বে হিন্দু মুসলমানরা এক হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। ঠিক যেমন হিন্দু নানা সাহেবের পতাকার নীচেও এক হয়েছিল হিন্দু মুসলমানরা। কারণ লড়াইটা ছিল বিদেশী শত্রুর বিরুদ্ধে। নিজেদের দীন রক্ষার নামে, নিজেদের সম্মান রক্ষার লড়াই ছিল তা। তিতুমীরের বাহিনী সম্পর্কে বর্ণনা দিচ্ছেন স্মিথ, ‘যারা আমাদের আক্রমণ করে তারা সবাই শক্ত সমর্থ ব্যক্তি। বোধহয় তাদের ধারণা হয়েছে তারা মন্ত্রপুত। তারা আমাদের বন্দুকের সামনে অত্যন্ত দৃঢ়তা আর সাহসের সঙ্গে দাঁড়ালো। আমাদের গুলি তাদের একটু বিরত করতে পারলো না।’ যাদের এসব ইতিহাস জানা নেই, তারা তালেবানদের লড়াইকে ব্যাখ্যাই করতে পারবে না। স্মিথ বুঝেছিলেন, এদের দমন করতে হলে সামরিক বাহিনী দরকার।

পুলিশ ম্যাজিস্ট্র্রেট আর আর কেউ এদের দমন করতে পারবে না। মার্কিন শক্তি বুঝেছিল, তালিবানদের দমন করতে কতোটা শক্তি দরকার। বায়ান্নটা দেশকে সে নিজের পক্ষে নিয়ে যায়। মহাযুদ্ধে যা ব্যবহার করা হতে পারতো, তাই ব্যবহার করা হয়েছে আফগানিস্তানের তালিবানদের বিরুদ্ধে। বলতে গেলে আফগানিস্তানরা একা লড়ছে বায়ান্নটা শক্তির বিরুদ্ধে। চলবে