তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ২১

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ০২, ২০২১

বহুজন বলবেন, বায়ান্নটা শক্তি একটা কথার কথা। না, তা নয়। বিরাট বিরাট শক্তিসহ বায়ান্নটা শক্তির মানসিক সমর্থন ছিল যুক্তাষ্ট্রের পক্ষে। সেটা কম কথা নয়। ভিন্ন দিকে আফগানিস্তানের পক্ষে ছিল সত্যিকার অর্থে তালিবানরা একা। মানসিক দিক দিয়ে তো একাই। সেকারণেই তার লড়বার দৃঢ়তা সব সময়ে চাঙ্গা ছিল। জয়ী হবার পরেও সে একা এখন পর্যন্ত। কারণ কেউ তাকে স্বীকৃতি দেয়নি এখনো। এই অবস্থায় সে যে দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছে সেটা বিরাট মানসিক শক্তির পরিচয়।

মানসিক দৃঢ়তাই শুধু নয়, যুদ্ধ শেষে একটা রাজধানী একটা দেশে সেরকম কোনো অঘটনই ঘটেনি। পৃথিবীর সকল যুদ্ধে বা যুদ্ধ শেষে নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ কতো কিছুই ঘটে। কিন্তু তালিবানদের হাতে তা ঘটেনি। যারা পালাতে চাইছিল বিমানবন্দরে, চাইলেই সেই সব শত্রু পক্ষকে তালেবানরা নিশ্চিহ্ন করতে পারতো। কিন্তু সেরকম করার পরিকল্পনাই তাদের ছিল না। কিন্তু তবুও তারা সন্ত্রাসী। তালিবানদের বিরুদ্ধে কখনো ধর্ষণের অভিযোগ নেই। বরং সেরকম চেষ্টা করেছে যারা, তাদের প্রাণদণ্ড দিয়েছে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের বিজয়টা পর্যন্ত মেনে নিতে রাজি নয় ভদ্রলোকরা। বলছে এটা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাতানো খেলা, সমঝোতা বা চুক্তির মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে গেছে। সমঝোতা বা চুক্তি কখন করে সাম্রাজ্যবাদ? ভারতে সমঝোতা করেই চলে গিয়েছিল ব্রিটিশ শক্তি কিন্তু কখন? যখন দেখেছে সে আর টিকতে পারবে না। দেখতে পাচ্ছিলো জনগণের মধ্যে প্রবল প্রতিবাদ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে ভারতীয়দের নৌবিদ্রোহে ইংরেজরা বুঝতে পারে, যে ভারতীয় সৈন্যদের উপর নির্ভর করতো, তারাই এখন ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে।

ব্রিটিশরা তখন কম রক্তপাত ঘটিয়ে পালাবার পথ খোঁজে, ফলে চুক্তির ভিতর দিয়ে সরে দাঁড়ায় নিজেদের দুর্বলতার জন্যই। মার্কিনরা নিজেদের দুর্বলতা আবিষ্কার করে দুভাবে। প্রথমত তালিবানদের মরণপণ জেহাদের সামনে টিকতে পারছিল না, দ্বিতীয় দেখছিল এই যুদ্ধ বা দখলদারী চালাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছে। সেই দুই যুগে চীন যুদ্ধ না করে বিরাট অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত। মার্কিন বাহিনীর টনক নড়লো এই ঘটনায়। ক্ষমতায় এলো তালিবানরা।

ক্ষমতা এখন তালিবানদের হাতে মানে, এটাই ইতিহাসের শেষ কথা নয়। তার মানে এ নয় যে তারাই টিকে থাকবে, ইতিহাস জানে এর পরে কী ঘটবে। কিন্তু আফগানিস্তানের ইতিহাসে এ কথা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখতে হবে, তালিবানরাই আফগানিস্তানকে শত্রু মুক্ত করেছিল। নিজেদের জানপ্রাণ দিয়ে যুদ্ধ করেছে বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে। নিজেরা নানারকম কষ্টের ভিতরেও কখনো আত্মসমর্পণ করার কথা ভাবেনি। সারা পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্র, বুদ্ধিজীবীদের বিরাট অংশ যখন তার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তখন সেই একা দৃঢ়তার সঙ্গে লড়ে গেছে এবং দীর্ঘ সংগ্রামে জয়ী হয়েছে।

সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র নিয়ে ইতিহাসে এরপর বহুকাল ঘৃণা প্রকাশ করা হবে। যখন তালিবান শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পিএইচডি বা এইসব শিক্ষার দরকার নেই, তখন ভুল কী বলেছেন? ইংরেজদের প্রবর্তিত ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিলেন গান্ধী, তিনি বলতেন এসব হচ্ছে বুদ্ধির লাম্পট্য। মিথ্যা বলেছিলেন কী? ইংরেজ শিক্ষায় শিক্ষিতরা বর্তমানে কী দিচ্ছে জনগণকে? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের অবদান কী? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয় শতাংশ ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন? মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তার পঁচাশি শতাংশ ছিলেন নিরক্ষর বা সামান্য শিক্ষিত কামার, কুমার জেলে; নিম্নকোটির মানুষ। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সুরে কথা বলেছেন তালিবান শিক্ষামন্ত্রী।

পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষায় শিক্ষিতরা ভদ্রলোকরা নিজেদের শুধু বিকিয়ে দেয়। বাংলাদেশে কি ঠিক তাই ঘটছে না? ফরাসি বিপ্লবের পর জ্যঁ-জাক রুশো কৃষকদের মুখপাত্র হয়ে লিখেছিলেন, ‘দরিদ্রদের শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। তার সামাজিক অবস্থানের জন্য যে শিক্ষা প্রয়োজন তা এমনিতেই তার ওপর বলপূর্বক চাপানো রয়েছে।..প্রকৃতির কাছে শিক্ষালাভ করলে মানুষ যে কোনো কর্মে দক্ষ হতে পারে।’ চলবে