তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ২২

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৪, ২০২১

কার্যকারণ ছাড়া কিছুই ঘটে না। ইতিহাস ঘটনাকে এভাবেই বিশ্লেষণ করে। মানুষের সভ্যতা বা স্বভাব গড়ে ওঠে কার্যকারণ দ্বারা। ভিয়েতনাম বহু বছর লড়াই করেছে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, ভারতীয়রা লড়াই করেছে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। যদি ভিয়েতনাম ফরাসিরা দখল না করতো বা ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শক্তি, তাহলে এই সংগ্রামের কারণ সৃষ্টি হতো না। ফলে আফগানিস্তানে যা ঘটেছে তা ভালো কি মন্দ তার আগের কথা হলো, যা ঘটেছে তার পেছনে কার্যকারণ রয়েছে। কিছু মানুষের বহু কাজের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে ক্ষমতার, আর বিশাল সংখ্যক মানুষের বহু কাজের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে অক্ষমতার। ঠিক একইভাবে সামর্থ থাকলে যুক্তরাষ্ট্র যখন তখন যেকোনো দেশ আক্রমণ করতে পারে। ঠিক বিপরীত দিকে সামর্থের অভাবে আফগানিস্তান তার স্বাধীনতা হারায়। ন্যায়-অন্যায় এসব অনেক পরের কথা।

যখন যে কেউ ভিন্ন দেশ দখল করে, প্রথম তার কাজ হয় সেই দেশকে অসভ্য আর বর্বর প্রমাণ করা। সঙ্গে সঙ্গে এটা বুঝানো সেই দেশকে সভ্য করতে তিনি দখল নিয়েছেন। বিশেষ করে পাশ্চাত্য দখলদারদের এটাই কৌশল। ফরাসীরা এই কথা বলেছিল ভিয়েতনাম দখলের পর, ব্রিটিশরা এই কথা বলেছিল ভারত দখলের পর। যুক্তরাষ্ট্র এই একই কথা বলেছে আফগানিস্তান দখল করার পর। কিন্তু বর্তমান যুগে চট করে আর একটা দেশকে বর্বর বা অসভ্য বলাটা খুব গ্রহণযোগ্য হয় না বিশ্বের কাছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র্র আরেকটু বেশি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। প্রথম প্রমাণ করতে চাইলো আফগানিস্তানের তালিবানরা জঙ্গি, হামলাকারী, সন্ত্রাসী। দ্বিতীয়টা হলো, আফগানিস্তানের নারীর মুক্তি। যুক্তরাষ্ট্রে নারী প্রার্থী ভোটে জিততে পারে না, সেখারে আফগানিস্তানের নারীর মুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মায়াকান্না।

নারীবাদী এই যুগে এটা খুব ভালো চিকিৎসা। সারাবিশ্বের নারীবাদীদের মন জয় করার এর চেয়ে বড় অস্ত্র আর কী থাকতে পারে? ফলে এটাই হয়ে দাঁড়ালো, সারাবিশ্বের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান দখলের পক্ষে বিরাট যুক্তি। সবাই এই প্রশ্নটাই ভুলে গেলাম যে, যুক্তরাষ্ট্র ভিন্ন একটা দেশ দখল করেছে অন্যায়ভাবে। বরং আমরা আমাদের ঘৃণা বর্ষণ করলাম যারা অবিচারের শিকার সেই তালিবানদের প্রতি। কারণ তালিবানরা নারীর মুক্তি চায় না। কীসের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো? যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে হামলা চালানোর জন্য যে রূপকল্পটি তৈরি করলো তা হচ্ছে, মুসলিম পুরুষদের হাতে নারী নির্যাতনের চিত্রকল্প। পশ্চিমা প্রচারযন্ত্রে তালিবানদের দুঃশাসন আর নারী বিষয়ে তাদের কট্টর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বহু কথা বলা হয়েছে, পত্রিকাগুলিতে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা তা নিয়ে লেখা হয়েছে।

এ সবকিছুর লক্ষ্য মানুষের মনোজগতে উপনিবেশ গড়ে তোলা এবং এতে তারা সফল। খুব লক্ষ্য করলেই এটা স্পষ্ট হবে, সেখানে বারবার এসেছে আফগান নারীর বোরখা পরার দৃশ্য। এর থেকে বোঝানো হয়েছে তালিবানরা কতোটা রক্ষণশীল। বহুকাল ধরে আফগানিস্তানে নারীরা গৃহবন্দী আর পর্দা মানতে বাধ্য ছিল। নতুন করে তারা বোরখা পরছে না তালিবানদের আমলে। তালিবানরা কি সেই আগের অবস্থা থেকে নারীকে আরো খারাপ জায়গায় নিয়ে গেছে? নারীর বোরখা হলো, পশ্চিমা প্রচারকদের আফগান তালিবানদের বিরুদ্ধে বিরাট এক প্রচারণা। ভাবখানা যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান দখল করতে যাচ্ছে সেই বোরখা তুলে নারীকে মুক্তি দেয়ার জন্য। ভাবখানা এমন যে, আফগান নারীর একমাত্র দাবি, বোরখা থেকে বের হয়ে আসা। এটা কি সত্যিই আফগান নারীরা চাহিদা, নাকি পশ্চিমারা তাদের মতো করে দেখছে নারীকে?

নারীর বোরখা নেই, এটা পশ্চিমের সংস্কৃতি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ শুধু বোরখা দিয়ে নির্ধারিত হয় না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে কীভাবে পণ্য বানায় তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নারী কি সেখানে সখ করে পর্ণ ছবিতে শরীর দেখাতে যায়? নাকি অর্থনৈতিক নানা কার্যকারণের ভিতর দিয়ে নারীকে সেখানে যেতে বাধ্য করা হয়? নারীর মুক্তি তবে কোথায়? বিশ্বাস করতে হবে কি আমাদের, যেখানে পর্দা নেই সেখানকার নারীর মুক্তি ঘটে গেছে? যখন প্রথমবার তালিবানরা কাবুলের ক্ষমতা গ্রহণ করে, তার বহু আগে কাবুলের শিক্ষিত মহিলারা জানিয়েছেন, পর্দা নিয়ে তাদের কোনো সমস্যা নেই। হতে পারে তাঁরা বোরখা চান না কিন্তু নিজেরা অর্ধউলঙ্গ হতে চান না। প্রথমবার তালিবানরা কাবুল দখল করার পর হাসপাতালের এক মহিলা চিকিৎসক জানান, মাথা না ঢেকে রাখবার জন্য তিনি তালিবানদের আক্রোশের শিকার হয়েছেন, তথাপি তিনি বলেন মেয়েরা কী পড়বে না পড়বে সেটা অনেক দূরের ব্যাপার।

সবার আগে দরকার শান্তি। সবার আগে দরকার একটা কেন্দ্রীয় সরকার। প্রয়োজন শিক্ষার। তারপর আমরা বোরখা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারবো। রাতারাতি কিছু ঘটবে না সেটা তিনিও বোঝেন। সবকিছুর জন্য সময় দরকার। বরং আফগান অনেক নারী সন্দেহ প্রকাশ করেন, পশ্চিমাদের নারীবাদ ধারণা নিয়ে। পাশ্চাত্য চিন্তায় বোরখার সাথে নারীমুক্তির সম্পর্ককে যেভাবে অনিবার্য করে তোলা হয়, সেটা তাদের দৃষ্টিতেও রহস্যজনক। চলবে