তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ২৩

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৫, ২০২১

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী সোনালি কোলহাৎকরের লেখা থেকে জানতে পারছি, পশ্চিমা ফেমিনিস্টরা অনেকেই ‘রেভোলুশনারী উইমেন এসোসিয়েশন অফ আফগানিস্তান’-এর সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী নয়। কারণ ‘রেভোলুশনারী উইমেন এসোসিয়েশন অফ আফগানিস্তান’-এর মুখপাত্ররা বলেছে, পশ্চিমা ফেমিনিস্টদের আমাদের অধস্তনতা সম্পর্কে সবকিছু শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়ার দরকার নেই। আফগান নারীরা নিজেরাই নিজেকে সাহায্য করতে পারবে, যদি পশ্চিমারা সহিংস অস্ত্রের মোতায়েন আর ঝনঝনানিটা বন্ধ করে। স্পষ্টই তারা বলে, যে গুলবদন হেকমতিয়ারকে যুক্তরাষ্ট্রই অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল, সেই লোকটাই এসিড দিয়ে নারীর মুখ ক্ষতবিক্ষত করতে দ্বিধা করেনি যদি কেউ ঠিকঠাক শরীর ঢেকে না রাখতো।

ক্যাথারিনা ফিনার বলেন, অনেক মুসলিম নারী পশ্চিমা ধারার নারীবাদ সম্পর্কে সন্দিহান। পর্দা খুলে ফেললেই সর্বময় স্বাধীনতা আসবে এটা একটা গল্প, পশ্চিমা নারীবাদের এই বিষয়টা বুঝতে পারা খুবই জরুরি। ফিনার জানান, আরব নারীরা পশ্চিমা ধাচের নারীবাদকে প্রত্যাখান করেছে। তার মানে এ নয়, তারা পুরুষের অধীনতা মেনে নিয়েছে। কিন্তু নারীমুক্তির অর্থ তাদের কাছে এমন নয় যে, নিজের পরিচয়, ধর্ম ও সংস্কৃতি নির্মূল করতে হবে। তারা অনেকে নিজেরাই পর্দা করতে চায়। ফলে মুসলিম নারীদের স্বাধীনতা লাভের একটা নির্দিষ্ট ধরন গড়ে উঠেছে, তারা না চায় পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতা, না চায় অতি সনাতন ইসলামপন্থা। পশ্চিমা নারীবাদ আসলে ফলাও করে মেয়েদের রক্ষার ভান করে, কিন্তু আদতে কিছুই করে না।

বুশ যখন নারীবাদের বুলি আওড়ান, তখন নারীবাদই তার শক্তি হারায়। ফিনার মন্তব্য করেন, আজকাল সবকিছুতেই চলছে নারীবাদ। শুধু সত্যিকারের সাম্যের জন্য কোনো যুদ্ধে তাকে পাওয়া যায় না। মার্কিন আগ্রাসন সম্পর্কে ক্যাথারিনা ফিনার ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, যেন আফগানিস্তানে বোমা মারা হয়েছে নারীদের বোরখা থেকে মুক্তি দেবার জন্য। তিনি সামান্য্য পরেই লিখেছেন ‘নিজের দেশে বুশ কিন্তু মোটেই নারীবাদী লোক নন’। ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম কার্যদিবসেই গর্ভপাত বিষয়ে পরামর্শদানকারী সকল আন্তর্জাতিক পরিবার পরিকল্পনা সংস্থার বরাদ্দ কমানো হয়েছে।

বহুজন বলবেন, আমানুল্লাহ নারীর মুক্তির জন্য পর্দা বাতিল করতে চাইছিলেন। কথাটা শুনতে ভালো। কিন্তু চাওয়াটাই কি বড়? আফগানিস্তানের নারী নিজে কি ভাবছে সেটা কি জানতে চাওয়া হয়েছিল? আমানুল্লাহ যা চেয়েছিলেন, সেটা অবশ্যই প্রগতিশীলতার লক্ষণ। কিন্তু প্রগতিশীলতা চাপিয়ে দেয়া যায় না, সেটাকে সংক্রামিত করতে বহু ধৈর্য আর সময়ের প্রয়োজন। বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ, নারীর শিক্ষা প্রচলনের জন্য কাজ আরম্ভ করেছিলেন সেই কবে? কিন্তু সেটা সামগ্রিকভাবে কার্যে পরিণত হতে একশো বছরের বেশি সময় লেগেছে। তারপরেও সারা ভারতে তা এখনো সেভাবে ঘটেনি। মানুষের কুসংস্কার বা তার ঐতিহ্য থেকে বের হয়ে আসতে সময় লাগে। চাপিয়ে দিতে গেলেই বিপদ।

বহুজন মনে করেন, সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝি ধর্ম উঠে গিয়েছিল। ভুল ধারণা এটা। কাউকে জোর করে ধর্ম ত্যাগ করতে বলা হয়নি। মনে করা হয়েছে, শিক্ষার ভিতর দিয়ে মানুষ তা ধীরে ধীরে ত্যাগ করবে। লেনিন ধর্মের নানারকম সমালোচনা করেছেন, রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক থাকবে না খুব স্পষ্ট করে তা বলেছেন। সেই সঙ্গে বলেছেন, ধর্মীয় অবশেষগুলি অতিক্রম করা যায় শুধু মাত্র ধৈর্য ধরে লাগাতার ভাবাদর্শগত তালিম শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে, মার্কসবাদী বিজ্ঞানসম্মত বিশ্ববীক্ষার ব্যাপক প্রচার দিয়ে।’ তিনি সেই সঙ্গে বলেন, ‘মানুষের ধর্মীয় আবেগের অবমাননা করা চলবে না, কেননা তার ফলে তাদের বদ্ধধারণা শুধু বদ্ধমূলই হতে পারে আরো বেশি।’

লেনিন স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন, ধার্মিক মানুষের কাছে ধর্ম আরো বেশি বদ্ধমূল হয় কী করে, কখন মানুষ ধর্মকে আরো বেশি আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। সেকারণে বারবার তিনি ধর্মকে অবমাননা করতে না করেছেন। মানুষের ঐতিহ্য বা বিশ্বাসগুলিকে হঠাৎ আক্রমণ না করার কথা বলেছেন সকল মার্কসবাদী ব্যক্তিত্বরা। রাশিয়ার বলশেভিক কমিউনিস্ট পার্টির খসড়া কর্মসূচীতে ধর্ম প্রসঙ্গ বিভাগে লেনিন বহু কথা লিখে পরে বলেছেন, ‘ধর্মীয় বদ্ধ ধারণাগুলি থেকে মেহনতী মানুষকে বাস্তবিক মুক্ত করাই পার্টির লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যে সবচেয়ে বহুবিস্তৃত বৈজ্ঞানিক শিক্ষা এবং ধর্ম বিরোধী প্রচার পার্টিকে সংগঠিত করতে হবে। তবে ধর্মবিশ্বাসীদের ধর্মীয় আবেগে আঘাত পড়াটা সযত্নে এড়িয়ে চলা আবশ্যক, কেননা অমন আঘাত পড়লে অন্ধ ধর্মোন্মাদনা শুধু বাড়াতেই আনুকূল্য হয়।’

খুব স্পষ্ট নয় কি, লেনিন কী বলতে চেয়েছেন? ফলে যারা মনে করেন, সমাজতান্ত্রিক দেশ জোর করে ধর্মপালন করার অধিকার কেড়ে নেয় সেটা ভুল। চীনে যেখানে ধর্মহীনের সংখ্যা ৭৪ শতাংশ, রাশিয়াতে সেখানে বর্তমানে ধর্মহীনের সংখ্যা ১৫ শতাংশ। পাশাপাশি ফ্রান্সে প্রায় ৩২ শতাংশ মানুষ ধর্মহীন। যুক্তরাষ্ট্রে ২৮ শতাংশ মানুষ ধর্মহীন। জার্মানীতে ৩৮ শতাংশ। ভিন্ন দিকে রোমানিয়ায় ৫ শতাংশ আর পোলাণ্ডে ৬ শতাংশ মানুষ ধর্মহীন। সুইজারল্যাণ্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক এসব দেশে ধর্মহীন মানুষের সংখ্যা ২০ শতাংশের অধিক। চীন ছাড়া সমাজতান্ত্রিক দেশে ধর্মহীনের সংখ্যা পুঁজিবাদী দেশগুলির চেয়ে কম। কারণ কী তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে।

বহুজন খণ্ডিতভাবে বলে থাকেন, মার্কস বলেছেন, ‘ধর্ম হচ্ছে আফিম’। কথাটার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা তাঁরা দেন না বা জানেন না। মার্কস বাস্তবিকপক্ষে বলেছিলেন, ‘ধর্ম হচ্ছে জগতের এক সামগ্রিক তত্ত্ব, বৃহৎ সংক্ষিপ্তসার, জনপ্রিয় আঙ্গিকে সে-জগতের যুক্তি, তার আধ্যাত্মিক সম্মানের আস্ফালন, তার উদ্দীপনা, তার নৈতিক অনুমোদন, তার দুঃখাপনোদন ও সমর্থনের ব্যাপক ভিত্তি। যেহেতু মানবসত্তার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই ধর্ম হচ্ছে সেই সত্তার কাল্পনিক বাস্তবায়ন।’ তিনি সামান্য পরেই বলছেন, ‘ধর্মীয় দুঃখবাদ হচ্ছে বাস্তব দুঃখের প্রকাশ ও বাস্তব দুঃখের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ধর্ম হচ্ছে নির্যাতিত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন জগত-পরিবেশে কল্পিত আত্মা। এ হচ্ছে জনতার আফিম’।

কী দাঁড়ায় তাহলে? ইতিহাসের একটি বিশেষ স্তরে, বিশেষ শক্তি সমাবেশের ফলে ধর্মও প্রতিবাদের একটা রূপ হয়ে ওঠে, সামাজিক দুঃখের ক্ষতিয়ান আর শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে। উৎপল দত্ত লিখেছেন, ‘এ না হয়ে উপায় নেই। অত্যাচারীর শক্তিকে যখন বাস্তব সমাজে রোখা যায় না, বুদ্ধিজীবীদের বৃহদংশ যখন সেই অত্যাচারীর পক্ষেই নকীবী করে, তখন নেতৃত্বহীন জনগণ ধর্ম ছাড়া প্রথম কোথায় আশ্রয় নেবে?’ বিশেষ করে পরাধীন দেশে। উৎপল দত্ত পুনরায় তাই বলছেন, ‘ধর্মের সম্মান রক্ষা মানেই, বলদর্পী সাম্রাজ্যবাদীর পরাজয় সুনিশ্চিত করা।’ ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে ভারতবাসী ধর্মের সম্মান রক্ষার কথাই বলেছিলেন। লড়াইয়ের আলখাল্লাটা ছিল ধর্মীয়, কিন্তু ঘৃণাটা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে।

তিতুমীর, শরীয়তউল্লাহ ধর্মের একটা আলখাল্লা গায়ে দিয়ে লড়েছেন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। মার্কস ‘ধর্ম প্রসঙ্গে’ গ্রন্থে তাই দেখিয়েছেন নির্যাতন আর শোষণের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যেও বহু কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে খ্রিস্টান ধর্মের আল্লাখাল্লা গায়ে দিয়ে। নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন গৌতম ভদ্র, তিনি চমৎকার বিশ্লেষণ দিয়েছেন ভারতের সাম্রাজ্যবাদী এসব বিদ্রোহের। তিনি নতুনভাবে জেহাদী তত্ত্বকে আলোয় এনেছেন। তিনি দেখাচ্ছেন, এশিয় সংস্কৃতির গ্রহণ ও বর্জন নির্ধারিত হচ্ছে প্রতীচ্যের আদর্শয়ায়িত আইনের কাঠামোয়। এশিয়ার বিভিন্ন বিচার ব্যবস্থাকে পর্যন্ত পাশ্চাত্য গড়ে নিয়ে চায় তাদের আদলে। ধর্মভাব বা যৌথ সমাজের মধ্যে ভারতের নিম্নকোটির মানুষ তার অস্তিত্বকে খুঁজে পেত।

দেবদেবি, পির বা সন্তকে দেখতেন তাঁরা সমাজের রক্ষক হিসেবে। কিন্তু এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি ছিল না। সবটাই ছিল সহজ সরল অনাড়ম্বর। কিন্তু ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের খবরদারির সামনে প্রজার ধর্মবোধ হয়ে ওঠে তাঁর অন্যতম প্রধান পরিচয়। এই পরিচয় ব্যক্তি-নাগরিকের নয়, এই পরিচয় গোষ্ঠীর এবং গোষ্ঠীর সদস্য সমূহের চিহ্ন। দূর থেকে বহুজনের কাছে মনে হতে পারে পশ্চাদপদতা। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটে? তুলশী শালগ্রাম আর গঙ্গার নামে হিন্দুরা ইংরেজদের মোকাবিলা করে এবং আল্লা ও কুরআনের নামে লড়ে মুসলমানরা। জেহাদের এই প্রকল্পে হিন্দু আর মুসলিম তাদের স্বতন্ত্র মর্যাদা রক্ষাকল্পে তারা ফিরিঙ্গি বিরোধী লড়াইয়ে সামিল হয়।

যতই বিদেশী শাসন প্রগতির দাবি মেটাতে এসব মানুষের চেনা জগতটাকে বদলে দিতে চায়, সে কট্টরভাবে ফিরে যেতে চায় তার পুরানো পরিচয়ে। এই অভিজ্ঞতার মধ্য থেকে জন্ম নিয়েছে দেশজ বুদ্ধিজীবীদের নানা দাবি এবং তাদের দ্বিচারিতার। বারবার ‘সভ্যতা’ ও ‘প্রগতি’র দোহাই দিয়ে, বিদেশি শাসনকে তারা হালাল করতে চায়, ভিন্ন দিকে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে। তিতুমীরের লড়াই নিয়ে ইংরেজ পক্ষের কলভিন বলেছিলেন যে, বাংলার গ্রামে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট সাধারণ লোকের কাছে হেরে গেছে। ব্যাপারটা অভাবনীয়। সাধারণ মানুষরা চিরকাল হার মানে। এবার জমিদার, সরকার আর নীলকর সবাই তাদের কাছে হার মানলো।

কথাটা হলো, জেহাদীদের দেশ যেখানে জোলা বা নিকারিদের মতো অন্ত্যজরা কেবল গামছা বোনে না বরং মৌলভী হয়, তাঁদের সামনে কোনো সাহেব দাঁড়াতে পারে না। তাই গভর্নরও ভয় পেয়ে যান। এখানে ঘৃণ্য আর অপাংক্তেয়র ধর্মই শোষণের বিরুদ্ধে নিজেকে জাহির করে, বামুন আর আশরাফদের মান রাখে না। তিতুমীরের বাদশাহী আর হিদায়েতী ও জোলাদের রাজত্ব তাই ত্রাশ সৃষ্টি করে যেভাবে হুনানের কৃষক বিদ্রোহও উচ্চকোটির মানুষের কাছে ত্রাসের বার্তা নিয়ে এসেছিল। স্পষ্টই তা তাদের ক্ষমতা হারাবার ভয়। সরকারি কর্মকর্তারা তখন থতমত খেয়েছিলেন, নিম্নকোটির মানুষের এত সাহস আসে কোত্থেকে? খোদ ম্যাজিস্ট্র্রেটকে আক্রমণ করে বসে! পুলিশ বরকন্দাজ তাদের কিছুই করতে পারলো না। সাহেব বুঝতেই পারলো না, গরীব অন্ত্যজ মানুষদের এতটা সাহস হয় কী করে, তারা এত জোর পায় কী করে?

গৌতম ভদ্র লিখেছেন, ধর্মীয় সংস্কারকে খোঁচালে বা আঘাত দিলে অজ্ঞ আর ধর্মোন্মাদ মানুষেরা উৎসাহিত হয়ে চূড়ান্ত সীমায় চলে যেতে পারে। সীমাহীন ঐদ্ধত্যই তো হচ্ছে বিদ্রোহের আসল রূপ। নিম্নবর্গের হিন্দুরাও তিতুমীরের এই জেহাদে অংশ গ্রহণ করেছিল। কারণ তা ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে আর জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে আর নিজ ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে আক্রমণের জবাব। চলবে