তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ২৫

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ১০, ২০২১

বাংলাদেশে বা বিশ্বে যারা তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণে ভীত, তাদের প্রধান ভয়টা নারী বোধহয় গৃহবন্দি হয়ে পড়বে। ইসলামের আদর্শে বা কট্টর পন্থায় সবকিছু চলবে। সম্ভবত, এটাই তাদের তালেবান বিরোধিতার প্রধান একটা কারণ। নিশ্চয় সেটা যুক্তিসঙ্গত মনে হবে অনেকের কাছে। কথাটা হলো, সারা বিশ্বের সব শাসন যদি ধর্মহীন আর বিজ্ঞানমনস্ক হতো বহু মানুষ খুশি হতো। যদি তালেবানরা ধর্মহীন আর বিজ্ঞানমনস্ক হতো, পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ মানুষ যেমন খুশি হতো কিন্তু ভিন্ন দিকে আবার বিরাট সংখ্যক মানুষ খুশি হতো না। সকলকে একসঙ্গে খুশি করবে এমন ক্ষমতা তালেবানদের নেই। তালেবানদের বিচার বিশ্লেষণ করে গ্রহণ করবে, এমন মানুষ কম। বেশির ভাগ মানুষ সব সমাজকে দেখতে চায় তার নিজস্ব চিন্তা বা রুটির আদলে। ফলে তালেবানরা বহুদিন ধরে সাম্রাজ্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করেও, আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীলদের মন জয় করতে পারেনি। সকলে তাদের প্রশংসা করবার আগে দেখতে চায়, আফগানিস্তানের তালেবানরা ঠিক তার মনের মতো ছাঁচে গড়া কিনা। সাম্রাজ্যবাদকে হটিয়ে দেয়ার জন্য তাদের সামান্য প্রশংসা করার দরকার নেই, যদি তালিবানরা তাদের মনের মতো না হয়। ব্যাপারটা এমন যে, আগে আমার মনের মতো হও, তারপর আমার সন্তানের বউ হয়ো। আমার সন্তানের মনের মতো নয়, আগে আমার মনের মতো হও; তাহলেই বিয়ের অনুমতি মিলবে।

যারা তালিবানদের বিজয়ে ক্ষুব্ধ, তাদের বক্তব্য এমন যে, তালেবানদের যেন আফগানিস্তানে কোনো জনপ্রিয়তাই নেই। ভবিষ্যৎ বক্তার মতো তারা ধরে নিয়েছেন আফগানরা নারীকে পাথর ছুঁড়েই মারবে। নারী ব্যাভিচার না করলে কেন তালিবানরা তাদের পাথর ছুড়ে মারবে? শরীয়া আইনই হচ্ছে এটা, নারী ব্যাভিচার করলে পাথর ছুড়ে মারতে হবে। কারো সে আইনটা পছন্দ নাই হতে পারে, কিন্তু সেটা তাদের আইন। বাংলাদেশে যেমন অনেকে দাবি করেছিলেন, যারা ধর্ষণ করবে, সেইসব পুরুষদের লিঙ্গ কেটে দেয়া হোক। অনেকেরই সেটা পছন্দ না হতে পারে। বহু জনের কাছে মনে হতে পারে, পাথর ছুড়ে মারার মতো লিঙ্গ কেটে নেয়াটাও নৃশংস। ধর্ষণের মূল কারণ না খুঁজে, লিঙ্গ কেটে নিলে কি সমস্যার সমাধান হবে? পাথর ছুড়ে নারীকে মেরে ফেললেই কি ব্যাভিচার বন্ধ হবে? হবে না। কিন্তু তালিবানদের পছন্দ না করা বা তাদের জঙ্গি ভাবার কারণ কি সেটাই? কাশ্মীরের মুসলমানরা তো নারীকে পাথর ছুঁড়ে মারছে বলে শোনা যায়নি। নারীকে বরং সঙ্গে নিয়েই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে, ঠিক যেমন ফিলিস্তিনিরা। ফিলিস্তিন নারীরা স্বয়ংক্রিয় সব অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করছে, সৈনিকের পোষাক পরিধান করছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা নারীকে এতটা সম্মান দিয়েও কি জঙ্গি অপবাদ ঘোঁচাতে পেরেছে? পারেনি। কাশ্মীরের মুসলমানরা যে নারীর প্রতি অবিচার করেনি, সে কারণে কি তারা জঙ্গী অপবাদ থেকে মুক্তি পেয়েছে? না পায়নি। যদি তালিবানরা নারীকে পাথর ছুড়ে না মারতো, তাহলে তাদের সম্পর্কে কি সন্ত্রাসী কথাটা বাদ হয়ে যেতো? মুসলমানরা যখন যেখানেই স্বাধীনতা দাবি করবে, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে; জঙ্গী বলে প্রথমেই তাদের কোণঠাসা করা হবে। ভয়াবহ এক নোংরা পরিকল্পনার শিকার এখন প্রতিবাদী মুসলমানেরা। ভালো মুসলমান কারা? যারা পুঁজিবাদী সরকারের দালালী করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দালালী করে। খেলাটার চরিত্র সকলকে বুঝতে হবে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকার কাশ্মীরে মুসলমানদের নিধন করলেও সরকার জঙ্গী নয়, কিন্তু মুসলমানরা নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করতে চাইলে, তারাই শুধু জঙ্গী।


নারীদের উপর তালিবানদের নিয়ন্ত্রণ বা নিপীড়নকে সবাই খুব সমালোচনা করছে। নিশ্চয় সেটা ঠিকই আছে। সমালোচনা করাটাই যৌক্তিক। কিন্তু সেই সমালোচনা করতে গিয়ে যদি কেউ মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান দখল সঠিক ছিল সেটা মেনে নেয়া যায় না। বা যদি কেউ মনে করে তালিবানরা সন্ত্রাসী সেটাও গ্রহণযোগ্য নয়। সকলেই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটা সংবিধান বা যেকোনো একধরনের ‘রাষ্ট্রচিন্তা’কে ধারণ করে। হতে পারে গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র বা রাজতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র বা ধর্মীয় বিধিবিধান। তালিবানরা তাদের রাষ্ট্রে ধর্মীয় বিধান বা শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ক্ষমতায় বসে তার যে-কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় বিধান গ্রহণ করতেই পারে। যদি তাদের জনগণ সেটা পছন্দ না করে, তাহলে সেটা তারাই বলবে। যদি আফগানিস্তানের মানুষ রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে একদা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে শরীয়ার বিধান বাতিল করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রও তৈরি করতে পারবে। যখন আফগানিস্তানে রাজতন্ত্রকে হটিয়ে সমাজতন্ত্র ক্ষমতায় আসে, তখন সারা বিশ্বের মানুষের সহযোগিতা ছাড়াই, একদল আফগান তা করেছিল। যদি এখন শরীয়া আইন বাতিল করতে চায়, তাদের জনগণকেই সেটা করতে দেয়া হোক। দূর থেকে আমাদের মায়াকান্না দেখাবার কী আছে? আফগানরা আমাদের খায় না পরে? যখন আফগানিস্তানে না খেয়ে লক্ষ লক্ষ বয়স্ক মানুষ আর শিশুর মৃত্যু হয়েছে, তখন তো আমরা মায়াকান্না দেখাতে যাইনি। তবে এখন এত মায়াকান্না কীসের! এ মায়াকান্নার একমাত্র অর্থ যুক্তরাষ্ট্র্রের দখলদারিকে সমর্থন করা। আফগান জনগণের স্বাধীনতায় বিশ্বাস না করা। চলবে