তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ২৬

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ১১, ২০২১

বাইরের দেশের মানুষরা যারা আফগানিস্তানের নারীর প্রতি মমতায়, নারীর মঙ্গল চিন্তায় ঘুম হারাম করেছে, তারা কি জানে আফগান নারীরা তালিবানদের বিজয় নিয়ে কী ভাবছে? মার্কিন হামলার পর যেদিন প্রথম কাবুলের পতন ঘটলো এবং নর্দার্ন এল্যায়েন্স কাবুল দখল করলো, তখন বিশ্বের বহু মানুষের আগ্রহ ছিল আফগান নারীদের মুখ দেখা যায় কিনা সেটা পরখ করা। যুদ্ধে মানুষের ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে বোরখাহীন নারীর মুখটাই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। বহু জনই মনে করেছিল, মার্কিনীরা কাবুল দখল করার সঙ্গে সঙ্গে সকল আফগান নারীরা বোরখা ফেলে খুশিতে পথে নেমে আসবে আর মার্কিনীদের এজন্য ধন্যবাদ জানাবে!

মার্কিনিদের হাতে নারীদের এমন মুক্তিতে সকল আফগান নারী সুখের ঢেঁকুর তুলবে। যখন বিদেশে অবস্থানরত আফগান নারীদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল, জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তারা এখন খুখি কিনা, কারণ আফগান নারীরা এবার বোরখা ছুড়ে ফেলে দেবার স্বাধীনতা পেয়েছে। না, বিদেশে অবস্থানরত সব আফগান নারীরা পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমের হাতে নিজেদের সেদিন সঁপে দেয়নি। তারা বলেছে, তালিবানরা নারীদের উপর নিপীড়ন করেছে ঠিকই কিন্তু পশ্চিমা মদতপুষ্ট নর্দান এলায়েন্স এখন তাদের কব্জা করবে, এটা কোনো মতেই কাম্য নয়। স্মরণ রাখতে হবে, নর্দান এ্যালায়েন্স যখন তালিবানদের আগে তাদের প্রভাব বলয় তৈরি করে, তখন আফগানিস্তানে প্রচুর নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। তালিবানরা নারীকে পর্দার মধ্যে থাকতে বলেছিল, কিন্তু তাদের হাতে কোনো নারীর ইজ্জত নষ্ট হয়নি।

বহু আফগান নারী পশ্চিমের কাছে জানতে চাইছিল, নারীমুক্তির জন্যই কি তারা সাধারণ মানুষের উপর ক্লাস্টার বোমা নিক্ষেপ করছে? বিপ্লবী আফগান নারী সংগঠন বা রেভোলুশনারী আফগান উইমেনস এসোসিয়েশন সংক্ষেপে ‘রাওয়া’ পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল, তারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে চায়, কারো খবরদারী চায় না। যখন তালিবানরা প্রথমবার ক্ষমতায় আসে ‘রাওয়া’ তখন বারবার বলেছে, আফগান নারীর মূল সঙ্কট শুধু বোরখার সঙ্কট নয়। রাওয়া একথাও স্বীকার করেছে, সত্যি যে আফগানিস্তানে তালিবান সরকারের সবচেয়ে খারাপ ঘটনার মধ্যে ছিল নারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু তারা সেটাকে তখন একমাত্র সঙ্কট হিসেবে দেখিনি আর সঙ্গে সঙ্গে তালিবান শাসন বাতিল করেনি। নিজেরা তারা পুরো সঙ্কটটাকে এবং সেই সঙ্গে তালিবানদের শাসনকে ভলো করে প্রথম বুঝতে চেয়েছিল।

নারীকে কখনো তালিবানরা অসম্মান করেনি, নারীর উপর তারা কেবলমাত্র শরীয়া আইন চাপিয়ে দিয়েছিল। মূলত তা ছাড়া, তালিবানরা সকল ক্ষেত্রেই অসম্ভব প্রশংসা পাবার মতো নানান কাজ করেছিল। কিন্তু তাদের এই গৃহীত শরীয়া আইন নারীর বিপদ কিছুটা হলে আগের চেয়ে বাড়িয়ে দেয়। কারণ অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করার বিধান ছিল নারীকে পাথর ছুড়ে মারা। প্রশ্নটা হলো, তবে পুরুষকে নয় কেন? সচেতন একজন প্রগতিশীল মানুষের পক্ষে এরকম আইনকে সমর্থন করার যুক্তি নেই। কিন্তু এরকম দু-একটা কাজকে সমালোচনা করা মানে, জনগণের মুক্তির জন্য তালিবানদের পুরো লড়াইটাকে নাকচ করে দেয়া যায় না। সভ্যজগত এক্ষেত্রে মোটেই যৌক্তিক আচরণ করেনি। তালিবানদের ভালো কাজগুলিকে প্রশংসা করে খারাপ কাজগুলিকে সমালোচনা করেনি। যদি সেটা করা হতো, তালিবানরা নিশ্চয় সচেতন হতো।

তালিবানরা যে তাদের প্রথমবারের শাসনে আফগান জাতিকে মোটামোটি ঐক্যবদ্ধ করে এনেছিল, কারণে অকারণে অস্ত্রের হানাহানি বন্ধ করেছিল, ধর্ষণ করার অপরাধ হিসেবে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছিল, মাদক উৎপাদন কমিয়ে এনেছিল; এর জন্য কি তাদের প্রশংসা প্রাপ্য ছিল না? বাংলাদেশে অনেকে ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে, তালিবানরা সেই কাজটাই করেছিল তাদের শাসনে। কিন্তু তাকে আখ্যায়িত করা হলো, সন্ত্রাসী হিসেবে। নারীর প্রশ্নটাই যদি সামনে আনা হয়, তালিবানরা নতুন কোনো আইন সৃষ্টি করেনি; মুসলমান হিসেবে ইসলামের শরীয়া আইনকে রাষ্ট্রের আইন বানিয়েছিল। ব্যক্তিগত বিদ্বেষে নারীকে তারা নির্যাতন করেনি। যদি শরীয়া আইনের বিধানের শাস্তির ভিতরে কেউ আটকে যায়, তাকে শাস্তি পেতে হয়েছে। কিন্তু একটা দেশের আইন কারো পছন্দ না হলে, অবশ্যই সেটার সমালোচনা করা চলে, কিন্তু সেই দেশ আক্রমণ করা চলে না।

যুক্তরাষ্ট্র বলবে, তারা আফগানিস্তানে আক্রমণ চালিয়েছে লাদেনকে আশ্রয় দেয়ার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র নিজে কি বিভিন্ন দেশের অপরাধীদের তার দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয় না? তখন যদি কেউ যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করে? সেটা কি যুক্তরাষ্ট্র যৌক্তিক মনে করবে? ভিন্ন দিকে যুক্তরাষ্ট্র লাদেনের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র্র বা পশ্চিমা বিশ্ব আফগানিস্তানে তালিবানদের শরীয়া আইন নিয়ে সমালোচনায় মুখর। কিন্তু কতো যুগ ধরেই সৌদি আরবে শরীয় আইন চলছে। যুক্তরাষ্ট্র কি তার সমালোচনা করছে? সৌদির সঙ্গে নানারকম দহরদ মহরম মার্কিন সরকারের। সৌদিতে চুরি করলে হাত কেটে নেওয়া হয়, কিছু কিছু অপরাধে শিরশ্ছেদ করা হয়। নারীর জন্য বিধান একই। কিন্তু কই, পশ্চিমা বিশ্ব তা নিয়ে কি কখনো হৈ চৈ করেছে? বাংলাদেশ বা ভারতের মানুষ কি কখনো তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে? না তোলেনি?

বাংলাদেশ, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সকলের স্বার্থ আছে সৌদি আরবে। কিন্তু আফগানিস্তানে সেটা নেই বলেই, তাদের প্রতি আক্রোশ দেখাতে কারো লজ্জা হয় না। সৌদি আরবের শরীয়া আইন নিয়ে হৈ চৈ না করলে তালিবানদের শরীয়া আইন নিয়ে এত হৈ চৈ করার কারণ কী? চলবে