তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ২৭

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ১২, ২০২১

ফরিদা আখতারের একটা লেখা থেকে জানা যায়, আফগানিস্তানের নারীদের বোরখা নিয়ে যখন তুমুল হৈ চৈ হচ্ছে তখন যুক্তরাষ্ট্রের দুজন লেখিকা জোয়ান জেকবস ও জেকুলিন জ্যাকস ‘দি বোরকা এ্যান্ড দি বিকিনি নামে একটি লেখা লিখেছিলেন ২০০১ সালে ২৩ নভেম্বর। দুজনে যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের প্রেক্ষিতে আফগান নারীর বোরখা ও মার্কিন নারীর বিকিনি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। দুজনে বলেন, তালিবানরা আফগান নারীদের রাস্তায় বের হতে দেয়নি, বিদ্যালয়ে যেতে দেয়নি, কোনো প্রকার সামাজিক কার্যকলাপে অংশ নিতে দেয়নি, এটা অত্যন্ত খারাপ কাজ। কিন্তু মার্কিনীরা নিশ্চয় আফগান নারীকে মুক্ত করার জন্য সেখানে যায়নি। বরং এখন বোঝা দরকার, মার্কিন দেশের উলঙ্গ সংস্কৃতিতে নারীর শরীর থেকে কাপড় সরিয়ে সেখানে কিভাবে নারীকে দিনে দিনে আরো বড় ধরনের শোষণ আর নির্যাতনের শিকার বানানো হচ্ছে। দুজনে মন্তব্য করেন, তালিবানরা মেয়েদের শরীর ঢাকতে বাধ্য করছে আর মার্কিনীরা নারীকে উলঙ্গ করছে। প্রচার মাধ্যমের বিজ্ঞাপনে নারীকে প্রায় উলঙ্গ করে দেখাচ্ছে।

যদি এখন জোয়ান আর জ্যাকুলিন  দুজনের লেখাটাকে সামনে রেখে প্রশ্ন করা হয়, সঙ্কট আসলে কে তৈরি করেছে? যুক্তরাষ্ট্র না তালিবানরা? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগান নারীর বোরখা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, নানারকম সমালোচনা করছে; তালিবানরা কিন্তু তখন যুক্তরাষ্ট্রের বিকিনি নিয়ে কিছুই বলছে না। যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগান নারীকে বোরখা থেকে মুক্ত করার কথা বলছে, তখন তালিবানরাও বলতে পারতো, আমি যুক্তরাষ্ট্র্রের নারীদের বিকিনি পরা বন্ধ করতে চাই। যুক্তরাষ্ট্রের যেমন বোরখা পছন্দ নয়, মুসলিমরা তেমন বিকিনি পরা সমর্থন করেন না। কিন্তু তালিবানরা তো যুক্তরাষ্ট্রের নারীদের বিকিনি পরা নিয়ে হস্তক্ষেপ করেনি। সে তার নিজরাষ্ট্রের মধ্যেই, তার শাসন সীমাবদ্ধ রেখেছে। বাইরের রাষ্ট্র কীভাবে দেশ চালাবে তা নিয়ে কথা বলতে যায়নি। তখনো না, আজকেও না। তালিবানরা অন্যের ঘরোয়া ব্যাপারে কখনো নাক গলাতে যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র যখন নারীমুক্তির অভিভাবক সেজে বসে আছে, তখন তার নিজদেশে নারীর নিরাপত্তা নেই, বহু নারী পথেঘাটে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। তালিবান সরকারের বিরুদ্ধে বা তার শাসনে এ ধরনের নারী ধর্ষণের উদাহরণ নেই। তাহলে নারীকে যুক্তরাষ্ট্র আর তালিবানদের মধ্যে কে বেশি মর্যাদা আর নিরাপত্তা দিয়েছে? নারীকে যে নানাভাবে যখন তখন উলঙ্গ করা হয়, সেটা কি নারীকে মর্যাদা দেয়া? মার্কিনী পুঁজিবাদে বিশ্বাসী নারীবাদীরা মনে করে, যখন তখন উলঙ্গ হয়ে শরীর দেখাতে পারাটাই নারী স্বাধীনতা। সকলের বিশ্বাস সেটা নাও হতে পারে।

নারীকে শরীর থেকে চর্বি ঝরিয়ে সুন্দর হতে হবে, তার নামেও কতোরকম ব্যবসা চলে সেখানে। রাস্তায় রাস্তায় বিজ্ঞাপন দেখা যাবে মোটা শরীর চিকন করার, সেখানে নারীকে উপস্থিত করা হয় প্রায় উলঙ্গ করে। পাশ্চাত্যের চাহিদায় নারীকে ফর্সা হতে হবে নানা ক্রীম মেখে, ফর্সা হওয়াটা তাদের কাছে নারীর সৌন্দর্য। নারীর সৌন্দর্য বাড়াবার জন্য নানা রকম অস্ত্রোপচার তো আছেই। এসব বাণিয়ারা প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে প্রথম নারীর সৌন্দর্য সম্পর্কে একটা রূপকল্প তৈরি করে। সকল নারীকে বুঝিয়ে দেয় সৌন্দর্য্য রক্ষা করতে হলে সে দিকেই ধাবিত হতে হবে। পশ্চিমা বিজ্ঞাপন ঠিক করে দেয় নারীর সৌন্দর্য আসলে কোনটা। প্রকৃতির সৃষ্ট নারীকে হতে হবে বিজ্ঞাপনের ঢং বা নকশার মতো নারী, তবেই না সে সুন্দর! বিজ্ঞাপন ঠিক করে দেয় নারী বা পুরুষ কীরকম পোষাক পরবে। নারীর পোষক পরার নামেও, নারীকে যৌন আবেদনময়ী করে নগ্নতার পথে টেনে নেয়া হয়। সভ্য সমাজ তখন মনে করে, এরকম পোষাক পরাটাই আধুনিকতা এবং আভিজাত্য। প্রচারমাধ্যম এভাবেই নারীকে উলঙ্গ করছে।  

নারী যদি মুনাফাযোগ্য হয় তার চেয়ে আর ভালো কী আছে বাজার সংস্কৃতির কাছে? প্রথম বোরখা খুলবে তারপর সমস্ত পোষাক খুলবে। চূড়ান্ত পর্বে অপরকে আনন্দ দান করা ছাড়া তার আর কোনো পথ নেই। নারী কামনার বস্তু মাত্র, শরীর ছাড়া তার আর কিছু নেই; এমন করেই কি অনেক সময় পাশ্চাত্যের নানা মাধ্যমে দেখানো হয় না? নারীর শরীরকে আবেদনময়ী করে তোলার একটা ফাঁদ কি তৈরি করা হয় না? কখনো কখনো কি সেসব প্রচারে বা বিজ্ঞাপনে নারীকে রগরগে যৌনতার প্রতীক করে তোলা হয় না? নারীর প্রশ্নে বর্বর কে, যে নারীকে পণ্য বানায় না যে নারীকে বোরখা পরায়? যারা মোটা নারীকে চিকন করে সুন্দর বানাতে চায়, বা যারা বিজ্ঞাপন দিয়ে বলে নারীকে সুন্দর হতে হবে বা ফর্সা হতে হবে, তারা কি নারীর সত্যিই মুক্তি চায়?

বিশ্বের সকল মানুষ যদি তার মূল শত্রুকে চিনতে পারতো, তাহলে এর চেয়ে বেশি আনন্দের আর কিছু কি ছিল? কিন্তু দুর্ভাগ্য! মানুষ কে তার বন্ধু আর আর কে  তার শত্রু সবসময় বুঝে উঠতে পারে না। ফলে নিশ্চিতভাবে চট করে বন্ধু আর শত্রু বিচার করা যায় না। মানুষের বিচারবোধের একটা সীমাবদ্ধতা থাকে। মানুষের সবচেয়ে মহৎ কাজেরও সীমাবদ্ধতা থাকে, মহৎ মানুষরাও সব কাজ সঠিকভাবে করতে পারেন না। মহাভারতের সেই বিখ্যাত কথা, ‘সম্পূর্ণ খারাপ মানুষ বলে কিছু নেই, সম্পূর্ণ ভালো মানুষ বলে কিছু নেই’। মার্কস-এঙ্গলস বা মার্কসবাদীরাও তাই মনে করেন। সেই বিচারে তালিবানরা সম্পূর্ণ খারাপ বা ভালো মানুষ হতে পারে না। মানে তারা সম্পূর্ণ খারাপও নয়, আবার সম্পূর্ণ ভালোও নয়। হ্যাঁ, এটাই হলো সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি কাউকে বিচার করবার। ঘৃণার ব্যাপারটা হয় সর্বদা একপেশে, মানুষ সম্পর্কে  সত্যিকারের বিশ্লেষণ কখনো একপেশে হয় না।

কাবুল বা আফগানিস্তান দখল করার পর তালিবানদের কার্যধারাকে কেউ শুধুই খারাপ বলে চিহ্নিত করতে পারে না। সকল আফগানকে তারা বিদেশি শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করেছে, ভিন্ন দিকে আবার সকল আফগান নারীকে তারা শরীয়া আইনের বিধানে বেঁধেছে। ব্যাপারটা শুধু নারীর ক্ষেত্রে নয়, পুরুষের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। পুরুষরাও ধর্মের বিধানের বাইরে যেতে পারবে না। ব্যাপারটা ভালো কি মন্দ তার চেয়ে বড় ব্যাপার, এটা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ফলে আফগানিস্তানের মানুষ নিজেরাই সে সঙ্কটের সমাধান করুক। মার্কস লেনিন সকলেই বিশ্বাস করতেন, বিপ্লব রপ্তানী করা যায় না। চল্লিশ বছরের আফগানিস্তানের সঙ্কটটা হলো, তারা কী চায় সে সিদ্ধান্ত তারা নিজেরা নিতে পারেনি। আফগানিস্তানের ভিতরে যে ধরনের রাজনৈতিক পালাবদল হওয়া দরকার ছিল, বাইরের শক্তির উপনিবেশ হতে গিয়ে সেটা সঠিকভাবে করার সুযোগটাই তারা পায়নি।

ষাট-সত্তরের দশকে কাবুলের বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতান্ত্রিক শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল, দরকার ছিল ধৈর্য ধরে সেটাকে বাড়তে দেয়া। সমাজতান্ত্রিকদের শক্তিকে সুসংহত করা। সমাজতন্ত্রের প্রতি একটা সমর্থন থাকার কারণেই সেখানে দাউদ সরকারকে উৎখাত করা গিয়েছিল এবং সমাজতান্ত্রিকরা ক্ষমতায় এসেছিল। দরকার ছিল তারপর ধীরে ধীরে কর্মসূচী দিয়ে সমাজতন্ত্রের পথে আগানো। কিন্তু সরকার তা করলো না। নতুন সরকার রাতারাতি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে, বাইরের শক্তিকে ডেকে আনলো। ভয়াবহ ক্ষতি সাধিত হলো এই ঘটনার ভিতর দিয়ে। যারা সমাজতান্ত্রিক ছিলেন বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আর সমাজতান্ত্রিক থাকতে পারলেন না। সমাজতান্ত্রিক সরকারের দরকার ছিল বিদেশী শক্তির সহায়তা নেয়া, তাকে ঘরের মধ্যে ডেকে আনা নয়। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে সমাজতান্ত্রিক চেতনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা হলো। যখন সমাজতান্ত্রিক সরকার রাশিয়াকে আফগানিস্তানে উপনিবেশ বানাতে দিল, বিদেশী শক্তিকে রুখতে গিয়ে আফগান জনগণ আরো বেশি খাঁটি মুসলমান হতে চাইলো। ফলে মুসলমান হতে হতে ‘শরীয়া আইন’কে রাষ্ট্রের সংবিধান বানিয়ে ফেললো।

শামুক বা কচ্ছপ কখনো নিজের খোলসে মুখ লুকিয়ে ফেলে? যখন বাইরে থেকে আক্রমণ আসে? তালিবান বা প্রায় সমগ্র আফগানরাই বাইরের কঠিন আক্রমণে ধর্মের খোলসে বা ধর্মের বর্মে নিজেদের আচ্ছাদিত করে নিয়েছিল। চলবে