তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

শেষ পর্ব

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৮, ২০২১

মনে রাখতে হবে, প্রতিটা মুক্তিকামী লড়াইয়ের অনেকগুলি স্তর থাকে। ইউরোপে সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণের মাত্র একটা স্তর ছিল না। বহু স্তর ছিল। একটা যুদ্ধ বা একটা ঘটনা বা একটা বিপ্লব দিয়ে তা সম্পন্ন হয়নি। রেঁনেসার আগমনের ভিতর দিয়ে মানবতাবাদের কথা বলা হলেও, চার্চের কর্তৃত্ব খতম হয়নি। ব্রুনো, কোপারিনিকাস, গ্যালিলিও প্রমুখ চার্চের ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন রেঁনেসার পরেই। পরের আরো চারশো বছর ছিল গির্জার ক্ষমতা, রেঁনেসার ফলে কিছুটা কমলেও তা তখনো যথেষ্ট কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা রাখতো। কারণ খ্রিস্টধর্মের হাজার বছরের গেড়ে থাকা শেকড় উপরানো সহজ ছিল না। ফরাসী বিপ্লব রাজতন্ত্র আর গির্জার উপর একটা চরম আঘাত হানলেও, শেষপর্যন্ত ঘটনা পরম্পরায় বিপ্লবীরা নিজেরাই ধ্বংস হলো অন্তর্দ্বন্দ্বে। ক্ষমতা চলে গেল সামরিক শক্তি নেপোলিয়নের হাতে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী নেপোলিয়ন নিজের মনোজগতে বয়ে বেড়াতো ফরাসী বিপ্লবের বাণী, সে-কারণেই সে যেসব রাজ্য জয় করেছিল, সেখানে গির্জার ক্ষমতা কমিয়ে শাসকের ক্ষমতাকে বাড়িয়েছিল। ফলে নেপোলিয়ন নামের এই ব্যক্তিটি ছিলেন একদিকে ভীষণ প্রতিক্রিয়াশীল, ভিন্নদিকে আবার প্রগতিশীলতার এক বড় উদাহরণ। সাধারণ কৃষকরা তাঁকে ঘৃণা করলেও তারচেয়ে বেশি তাঁকে ভালো বেসেছিল। সেজন্যই ক্ষমতাচ্যুত নির্বাসিত নেপোলিয়ন পুনর্বার ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর নানারকম প্রগতিশীল ভূমিকার ভিতর দিয়েও তার কর্তৃত্ব টের পাওয়া যাচ্ছিলো। নেপোলিয়ন যতোই কিছু কিছু প্রগতিশীল সংস্কার কর্মসূচী হাতে নিক না কেন, ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে রাজি ছিল না। ফলে সকলের মিলিত সংগ্রামে নেপোলিয়নকে পরাভূত হতে হয়েছিল।

ইতিহাসের এসব দ্বান্দ্বিকতা না বুঝলে, তালিবানদের প্রগতিশীলতা আর প্রতিক্রিয়াশীলতাকে একসঙ্গে মাপা যাবে না। আফগানিস্তানের মানুষের মুক্তির যে লড়াই, তার একটা স্তর তালিবানরা সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। সে কারণেই সে ইতিহাসের এক প্রগতিশীল শক্তি। লড়াইয়ের দ্বিতীয় স্তর অর্থনৈতিক মুক্তি আর তৃতীয় স্তর জনগণের পুরানো চিন্তা আর সংস্কৃতির মুক্তি। তালিবানরা পরের লড়াইগুলিতে কেমন ভূমিকা রাখবে এখনো তা নিশ্চিত হয়নি। পরের সে লড়াইতে তালিবানরা টিকে থাকতে পারবে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন। কিন্তু এই মুহূর্তে, তারা যে প্রথম কাজটি সম্পন্ন করেছে তার কৃতিত্ব তাকে দিতেই হবে। না দেয়াটা হবে ইতিহাসের বিরুদ্ধে যাওয়া। ইতিহাসে দেখা গেছে, সবগুলি স্তরের লড়াই সবসময় একপক্ষ লড়তে পারে না। ভিন্ন পক্ষ এসে তার জায়গা দখল করে। কখনো সে ইতিহাসকে সামনে এগিয়ে নেয়, কখনো কিছু সময়ের জন্য ইতিহাসকে পিছিয়ে দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের দিকে তাকালে এরকম বহুকিছু টের পাওয়া যাবে। ফলে নিজের ব্যক্তিগত আবেগ আর চাওয়া পাওয়া দিয়ে তালিবানদের বিচার করা যাবে না, তাদের বিচার করতে স্থান কাল পাত্রের পরিপ্রেক্ষিতে, সময়ের প্রেক্ষাপটে।

মনে রাখতে হবে, যার অন্যরা বন্ধু নয়, আল্লার উপরই তার শেষ ভরসা। কাল মার্কসের সেই জনতার আফিম তত্ত্বের মতো। দরিদ্র মানুষ যখন ধনীর দ্বারা অত্যাচারিত হয়, কাউকে পাশে পায় না। না গ্রামের মাতব্বর, না ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, না থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। জেলা প্রশাসকের কাছে তো ফরিয়াদ জানাবার জন্য পৌঁছাতেই পারে না। যখন সে কোথাও বিচার পায় না, বুকের ভিতর হাহাকার আরম্ভ হয়। তখন সে দুহাত তুলে তার শেষ ভরসার জায়গা ‘স্রষ্টার কাছে আবেদন জানায়, ‘ হে প্রভু দয়াময়, তুমি এই অন্যায়ের বিচার করো। হয় আজ, না হয় রোজ হাশরের দিনে।’ সত্যি বলতে দরিদ্র মানুষের আর কে আছে তার সবচেয়ে আপনজন, তার মনের কল্পিত ইশ্বর ছাড়া? আফগানদের সম্পদ নেই, ক্ষমতা নেই: দরিদ্র ক্ষমতাহীন আফগানদের বন্ধু হবে কে? ফলে তাদের অন্তরের বিশ্বাস স্রষ্টার উপরেই, তার নির্ভরতা কল্পনার সেই সর্বশক্তিমানের প্রতি; এটাই হলো নিম্নবর্গের ইতিহাস রচয়িতা গৌতম ভদ্রের ভাষায় ‘ইমান’। যার অন্তরে ইমানের জোর থাকে তাকে হারানো কঠিন। তালিবানদের নেতা বিরাট কেউ নন, কিন্তু তাদের মধ্যেই যোগ্য একজন। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেরকম দোদুল্যমান নেতারা ছিলেন, তালিবানদের নেতা তেমন কেউ হলে এ যুদ্ধে তারা জিততে পারতো না। তাদের নেতারা ভারতের কংগ্রেস নেতাদের মতো হলে, বারবার দখলদারদের সঙ্গে আপস করার চেষ্টা করতো। তাদের নেতা গান্ধীর মতো অহিংসার প্রচারক হলে তো, আর কথাই ছিল না, দখলদারদের সঙ্গে আপস করে বহু আগেই লড়াই খতম হয়ে যেতো। ইমানের জোরেই মেরুদণ্ড সোজা রেখে প্রাণপণে লড়াই করতে পেরেছে তালিবানরা। আমরা অনেকেই তালিবানদের অনেক নীতির সঙ্গে একমত না হতে পারি, আমাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তারা তাদের বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে। সেকারণেই আমরা ইর্ষান্বিত হয়ে পড়েছি, মার্কিন পরাজয় আমাদের যাদের কাছে কাম্য ছিল না। সাম্রাজ্যশক্তির এখন কাজ হবে, সকল রকম প্রভাব খাটিয়ে তালিবানদের ঐক্যে ফাটল ধরানো।

ভবিষ্যতে কী ঘটবে চট করে বলা যায় না। কারণ আফগান সমাজের ভিতরে এখন কী কী দ্বন্দ্ব কাজ করছে, তাদের কার শক্তি কতোটা, বাইরের শক্তি কী ভূমিকা রাখবে তার উপরে সবটা নির্ভর করছে। কিন্তু তালিবানরা সব সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে এমন ভাবার কারণ নেই। ইতিহাসে সবগুলি সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার মতো মানুষ পাওয়া যায় না বললেই চলে। ইতিহাস হচ্ছে ভুল আর শুদ্ধ, ভুল আর শুদ্ধ, এই পদ্ধতিতে সামনে এগিয়ে যাওয়া। স্বভাবতই তালিবানরা ভুল করবে আবার শুদ্ধ করবে। কিন্তু চারপাশের প্রভাবকে সে সম্পূর্ণ এড়িয়ে একা কিছুই করতে পারবে না। এটাই ইতিহাসের ট্রাজিডি; সকলেই এখানে কখনো ক্রীড়ক, কখনো ক্রীড়নক। নারীর আসল মুক্তি যে বর্তমান তালিবানদের হাতে ঘটবে না ইতিমধ্যে সেটাও টের পাওয়া যাচ্ছে। স্মরণ রাখতে হবে, সকল মানুষের মুক্তি না ঘটা পর্যন্ত নারীর মুক্তি ঘটে না। কিন্তু পুরুষশাসিত সমাজে নারী দুইভাবে শোষিত হয়, নারী সেখানে পুরুষের চেয়ে পশ্চাদপদ থাকে। নারী মুক্তির প্রথম লড়াইটা হলো পশ্চাদপদ নারীকে শিক্ষাদীক্ষা কর্মের স্বাধীনতা দিয়ে তার পশ্চাদপদতা দূর করা। নারী যেন নিজেই এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারে সে ব্যবস্থা করা। বর্তমান তালিবান সরকার নারীর প্রাথমিক মুক্তির প্রশ্নে কিছু পদক্ষেপ অবশ্যই নেবে। কিন্তু সেটা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হবে। ভবিষ্যতে আবার নতুন সংগ্রামের ভিতর দিয়ে আরো নতুন কিছু পাওয়া যাবে। কিন্তু নারীকে তালিবানরা সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা না দিলেও, প্রাথমিক নিরাপত্তা দিতে পেরেছে বলেই মনে হয়। সবকিছু একসঙ্গে পাওয়াও যায় না। একটু একটু লড়াই করে, একটু একটু অর্জন করতে হয়। ইতিহাসে সর্বদা তাই ঘটে আসছে।