তুহিন খানের গদ্য ‘কবিতা নিয়া আলাপ’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১১, ২০২০

কবিতা লেখা আর কবিতা নিয়া কথা বলা— দুইটা তো দুই কাজ। এই দুই কাজ একই ব্যক্তি করতে পারে, আবার ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি করতে পারে; একজনে একটা কম, আরেকটা বেশিও তো করতে পারে। আবার কবিতার গ্রেটনেস তো `অনেক লেখা`র উপরেও ডিপেন্ড করে না মনে হয়। যদিও কবি শহীদ কাদরীর মতে, শামসুর রাহমান আল মাহমুদের চাইতে গ্রেট, কারণ তার কবিতার বিষয়বস্তু অনেক বেশি ওয়াইড। কিন্তু আমি তা মানতে নারাজ। এই নারাজির পক্ষে উদাহরণ হিশাবে এলাকার বড় ভাই জীবনানন্দ দাশরে হাজির করতে চাই।

অনেক কবিতা লেইখা তারপরে কবিতা নিয়া আলাপ করা লাগবে, বা যে অনেক কবিতা লেখতে পারে না, সে-ই কবিতা নিয়া আলাপ করে বেশি— এই ধরনের ধারণা বা আলাপ বা তর্ক প্রচলিত আছে। হইতে পারে, কিন্তু উল্টাটাও সত্য হইতে পারে: অনেক কবিতা লেখতে পারলেই কবিতা নিয়া আলাপের সক্ষমতা নাও থাকতে পারে অনেকের। অনেক কবিতা লেখতে পারা, আর কবিতা নিয়া আলাপ করতে পারা— সম্পূর্ণই আলাদা আলাদা ফ্যাকাল্টি। আমি যেহেতু সমাজসচেতন, `পলিটিক্যাল` মানুশ— অন্তত তাই মনে করতে চাই নিজেরে—, তাই কবিতারে আমি ঐশ্বরিক কোনো ব্যাপার ভাবতে চাই না, সেক্রেড কিছু ভাবতে চাই না। ভাবিও যদি, ইভেন ঐশ্বরিক বাণী নিয়াও তো কত শতশত আলাপ, আলোচনা, ব্যাখ্যা, তফসির! তাতে ঈশ্বর রাগ হন না, খুশিই হন বোধহয়। কিন্তু কবি সম্ভবত এইখানেই ঈশ্বরের কাছে ধরা খান: কবির সৃষ্টি নিয়া আলাপে কবিরা প্রায়শই নারাজ। কারণ, সমালোচকের আলাপে যা থাকে তা কবিতা না; তা সমাজ, তা রাজনীতি, তা দর্শন। যে রহস্যটুকু বা যে এক্সপ্রেশনটুকু কবিতা, একটা সনেটের মধ্যে যে সংহতিটুক কবিতা, বা একটা ওয়ান লাইনারে যে পরিমিতিটুক কবিতা— কবি চান সেইখানে কেউ হাত না দিক, কেউ ওই ভাঁজটুক না খুলুক। তারে ন্যাংটা না করুক।

কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের একটা ঘটনা এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল। একবার এক অনুষ্ঠান কেউ একজন তারে তার কবিতার অর্থ জিগেশ করলে, উনি নাকি স্টেজেই ন্যাংটা হয়ে হাঁটা দিছিলেন! কবিতা আর ঐশীবাণীর তফাতও বোধহয় এখানেই— ঐশীবাণীর ভাঁজ বা রহস্যে লুকিয়ে থাকার সীমাবদ্ধতা নাই, কারণ মানবসমাজের কাছে তার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা আছে; বিপরীতে কবিতার জন্য এ এক বিশাল লিমিটেশান। কিন্তু, মানুশ কবির আবদার শুনবে কি আদৌ? শোনা উচিত না। কবির আবদার মানুশ শুনলে কবিরই ক্ষতি। আর কবি তো ওই সত্তাই, যে নিজের ক্ষতি করতে হামেশা প্রস্তুত। যেকোন কিছু নিয়াই আলাপ জরুরি আসলে। কবির কবিতা নিয়া আরো বেশি জরুরি, কারণ এর কাজ করার ধরন ও শক্তি অনেক ভিন্ন, তীব্র, প্রখর, গুপ্ত, অবচেতন। কবিতা যেহেতু খুবই শক্তিশালী ব্যাপার, তাই যতই মহার্ঘ্য হোক, যতই কঠিন হোক, যতই মহাকালীন হোক, এরে বারবার মানুশের ভাষায়, মানুশের চিন্তায়, মানুশের জীবন ও যাপনে ধরার চেষ্টা করা লাগবে। মানবসভ্যতার স্বার্থেই, কারণ কবি বা কবিতা যত মহানই হউক, মানবজীবনের উর্ধ্বের কিছু না।

তাছাড়া, জগতে আলাপ ছাড়া কোনকিছু টেকেও না। সেইজন্য `ধূসর পাণ্ডুলিপি`র মত বই লেইখাও দুইটা রিভিউর আশায় দৌড়াইতে হইছে জীবনানন্দের। লেখা নিয়া কেউ যদি আলাপ না করে, তাইলে কেবলমাত্র `পাঠকের হৃদয়ের মনিকোঠা`য় আপনি টিকা থাকতে পারবেন না। কারণ পাঠক খুব নিষ্ঠুর একটা জিনিশ। কালের মত। যে পাঠক একসময় কোন রচনা নিয়া গদগদ হইত, কালের প্রভাবে সেই পাঠকই আর সেই রচনা পড়ে না। নিন্দামন্দ করে উল্টা। কারণ, কবিতা সামটাইমস মহাকালীন হইলেও, সাধারণ পাঠকের রুচি ও পছন্দ-অপছন্দ খুব `কালিক` জিনিশ। অবশ্য কবিতা লেইখা অমর হইতে চাওয়ার আইডিয়া বা বাসনা কতটুকু সত্য, তা নিয়াও তর্ক আছে— সে ভিন্ন আলাপ। ফলে, আমি মনে করি, কবিতার আলাপ হওয়াই উচিত। এমনকি কবিতা কম লেইখা হইলেও। জগতের অনেক বড় বড় কবিতা সমালোচক অতিক্রান্ত হইছেন, যারা জীবনে কবিতাই লেখেন নাই। প্রবোধ সাহেব বা হালের মোহাম্মদ আজমের কথা তো বলতেই পারি। কবিতা না লেইখা বা `কম` স্বার্থক কবিতা লেইখাও, কবিতা নিয়া কত এফেক্টিভ আলাপ করা যায়, তার বড় উদাহরণ বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিমই প্রথম লোক, যিনি বাঙলাভাষায় গদ্যকবিতা প্রস্তাব করছিলেন। মানে, ছন্দ মানেই কবিতা না, এই ব্যাপারটা বলতে চাইছিলেন। নিজে লেইখা কিছু নমুনাও দেখাইছিলেন। সেগুলা কবিতার বিচারে খুব ভাল কিছু হয়ত না, কিন্তু তার আলোচনাটার গুরুত্বটা কত, তা তো একালের পাঠকরে আর বলার দরকার নাই।

তখনকার কবিরা যদি বঙ্কিমরে বলতেন, ব্যাটা কবিতা লেখার নাম নাই, আমরা কেমনে কবিতা লেখব তা শিখাইতে আসছ— তাইলে কিন্তু ভারী বিপদ হইত। ফলে কবিতা অনেক লেইখা তারপর আলোচনায় নামা লাগবে, বা কবিতার চাইতে বেশি আলোচনা করা যাবে না— কবিতা নিয়া আলাপে, প্রবন্ধে কবির এমন অনীহা থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের সেই অনীহারে সম্মানের সাথে এড়াইতে পারতে হবে। কবিতা জগতে খুব বেশি থাকবে না। বরং উল্টাটাই স্বাভাবিক: জগতে কবিতা থাকবে খুবই কম, কিন্তু আলোচনা থাকবে অনেক অনেক বেশি।