তুহিন খানের গদ্য ‘করুণ, সকরুণ’

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৮, ২০২১

সোহরাওয়ার্দীর গেট পুরাটা ছবির হাটের মতো ন্যাংটো কইরা ফেলা হইছে দেখলাম। এই গেটটা একটা নস্টালজিক জায়গা ছিল। চা-আড্ডার কথা বাদই দিলাম, দুপুর বা রাইতে উদ্যানের গেটে খাওয়া-দাওয়াগুলাও তো ছিল সেরা। কত মানুষ খাইত! উদ্যানের গেটটা ছিল ক্যাম্পাসের অনেকগুলা পছন্দের জায়গার একটা। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান, অনেক মানুষের আত্মার খোরাক।

কাজটা `বহিরাগত খেদানো`র নামে করা হইল? উদ্যানের গেট রাতে দেখলাম পুরা খালি। ছবির হাটের মতো ফকফকা। আড্ডা নাই, আলাপ নাই, উচ্চস্বরে কথাবার্তা নাই। এদিক ওদিক কাপলশ্রেণি কয়েকজনরেই শুধু বইসা থাকতে দেখলাম। যাহোক, ভার্সিটি বা ভার্সিটির বাইরের পাবলিক স্পেসগুলা, অর্গানিক আড্ডা-আলাপের জায়গাগুলা দখল করার হিস্ট্রি যারা জানেন না, জানলেও অনুধাবন করেন না, তারা এই বহিরাগত খেদানোর মাজেজা বুঝবেন খুব শীঘ্রই৷

আমি অবাক হই যে, ক্যাম্পাসে বহিরাগত ঢুকানোর অভিযোগে যে দলের নেতাকর্মীরা একদা ছাত্রলীগের হাতে মাইর খাইছে, আজ তাদেরই ঢাবি শাখার নেতাকর্মীরা এই আন্দোলনের অ্যাক্টিভ সাপোর্টার। বহিরাগত দেখলে `তুলে ফেলে দেওয়া`র কথাও বলতেছেন তাদের নেতা-নেত্রীরা। আশ্চর্য! পাবলিক স্ফেয়ার দখল হয়ে যাওয়ার বিষয়টা কি ওনারা বোঝেন না? সোহরাওয়ার্দীর খালি গেটটা কি উনাদের কোনো বার্তা দ্যায় না? নাকি উনারা ঢাবিতে রাজনৈতিকভাবে পপুলার হইতে গিয়া অরাজনৈতিকই হয়ে উঠতেছেন বরং, স্বতন্ত্র জোটের মতো?

জানি না। তবে, বুইঝা বা না বুইঝা বা ভুল বুইঝা বা অল্প বুইঝা তারা যে কাজটা করতেছেন, এর সুদূরপ্রসারী ফলাফলগুলা তারা মেবি টের পাইতেছেন না। নিজেদের দলের প্রয়োজনে তারাও ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের নিয়া আসবেন ঠিকই, কিন্তু মাঝে দিয়া কী হবে? ক্যাম্পাসের অর্গানিক আড্ডাগুলা ভাইঙা যাবে। উচ্চস্বরেই মনের কথাগুলা বলার জায়গাগুলা কইমা আসবে। থাকবে শুধু নিখিল মেট্রোর তলে টুকরা টুকরা `শিক্ষার পরিবেশ` সম্বলিত জায়গা। আয়রনি কত প্রকার ও কী কী, তা এই বহিরাগত খেদাও আন্দোলনে দেখা গেল।

ভার্সিটির এই জায়গাগুলায় তাইলে কী হবে? খালি পইড়া থাকবে? অনেক সুন্দর পড়ার পরিবেশ তৈয়ার হবে সেখানে? মোস্ট প্রবাবলি, সেসব জায়গা চইলা যাবে কর্পোরেটদের দখলে। যেমন উদ্যান। উদ্যানের নির্মিতব্য ফাস্টফুডগুলায় খাইতে আসবে যারা, তারাও বহিরাগতই হবে, গাড়িওয়ালা বহিরাগত। এই গাড়িওয়ালা বহিরাগতদের আবার খুব কদর টিএসসিতে, এদের জন্য পুরা একদিন বা দুইদিন টিএসসিতে ভার্সিটির শিক্ষার্থীরাও ঢুকতে পারে না। এদের আনাগোনা আরো বাড়বে, মেবি।

পূর্বাচলে ঢাবির ক্যাম্পাসটা হইলে, এই অদ্ভুত, মেট্রোরেলের শব্দে দূষিত, পাবলিক আড্ডার প্লেসহীন ক্যাম্পাসের কী দশা হইতে পারে? এমন দিন কি আসতে পারে, যখন ঢাবির পশ ক্যাম্পাস হবে পূর্বাচলেরটা, কর্পোরেটের টাকায় চকচকা ওই ক্যাম্পাসে ঘুরতে যাওয়ার নেশাই হবে ফ্রেশারদের প্রধান আকর্ষণ, আর এদিকে, ঘিঞ্জি, মেট্রোরেলের চাকায় পিষ্ট তবু সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকজন বহিরাগত খেদাইতেই থাকবে, খেদাইতেই থাকবে, খেদাইতেই থাকবে... হায়, তবু বহিরাগত খেদাইতে পারবে না, নানা বাহানায় বহিরাগত আসতেই থাকবে, মেট্রোরেলে চইড়া পুরা শহরের সব বহিরাগত উপর থিকা থুথু ফেলতে ফেলতে চইলা যাবে এই ধু ধু ক্যাম্পাসটা ছাড়াইয়া, বহিরাগত আসবে কনসার্টে, প্রোগ্রামে, পলিটিকাল মিছিল মিটিংয়ে, শুধু নতুন নতুন জায়গা হাতছাড়া হবে শিক্ষার্থীদের কয়দিন পরপর, সেখানে চলবে ভার্সিটি প্রশাসন আর যারা তাদের চালায় তাদের রাজত্ব? করুণ, সকরুণ!