তুহিন খানের গদ্য ‘গ্রামবাঙলায় ইন্টারেস্টিং সব চেঞ্জ আসতেছে’

প্রকাশিত : মার্চ ২০, ২০২২

বাড়ির মসজিদে গেলাম শবে বরাতের নামাজ আদায় করতে। ফরজের খবর নাই, অথচ শবে বরাত উপলক্ষে ব্যাপক উৎসব উৎসব আমেজ নিয়া নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার এই ব্যাপারটারে হালকা বেদয়াত বেদয়াতই ভাবতে চাইলাম মনে মনে। তাও গেলাম, কী আর করা!

মসজিদের আগের ইমাম সাহেব ছিলেন আব্দুস সাত্তার। ইমাম হওয়ার আগে উনি পেশায় ছিলেন পুলিশ। সবাই ডাকতো, সাত্তার পুলিশ। তো সাত্তার সাহেবের এন্তেকাল হয়ে গেছে। উনি জীবিত থাকাকালীন আমিও এই মসজিদে নামাজ পড়াইছি বেশ কিছুদিন।

সাত্তার সাহেবের আমলে এলাকায় মিলাদ মাহফিল হইত অনেক। সাত্তার সাহেব তার সুললিত গলায় ইয়া নবি সালামু আলাইকা বইলা টান দিলেই লোকজনের শরীরে একটা জোশ আসত। অবশ্য, এই দরুদের ফাঁকে ফাঁকে সাত্তার সাহেব যেসব উর্দু-ফার্সি কাসিদা বা শের পড়তেন, সেগুলা প্রায়শই খুব দুর্বোধ্য লাগত। মনে হইত, ভুলভাল বকতেছেন উনি। বাঙলাগুলা বুঝতাম অবশ্য।

তো, সাত্তার সাহেবের এন্তেকালের পর এই মসজিদে ইমাম হয়ে আসছেন একজন অল্পবয়স্ক নবীন হুজুর। সেভাবে দাঁড়ি ওঠে নাই ওনার এখনো, কিন্তু বক্তিমা দ্যান সুন্দর। ‘সুন্দর’ এই অর্থে যে, ওনার বক্তিমা বা ওয়াজে, ইসলামি ভাষাব্যবস্থার সাথে বরিশালের আঞ্চলিক ডায়ালেক্ট মিলামিশা বেশ ইউনিক একটা ব্যাপার তৈরি হইছে। শুনতে খুবই আনন্দ লাগে।

গ্রামের আরেকটা মসজিদেও দেখলাম, ইমাম একজন কমবয়সী হুজুর। ইদানীং গ্রামগঞ্জের মসজিদগুলায় কী কমবয়সী হুজুরদের নিয়োগ বাড়তেছে? কমবয়সী ইমামের ফায়দা আছে একটা। ইমাম সাহেবরে সহজেই হাতে রাখতে পারে এলাকার ময়-মুরুব্বিরা। যদি আশলেই গ্রামগঞ্জে কমবয়সী ইমাম বাইড়া থাকে, তাইলে এইটা তার একটা ভালো কারণ হইতে পারে। আরেকটা কারণ হইতে পারে, প্রবীণ হুজুরদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইমামতিতে পোষায় না আশলে এখন। ফলে, এসব জায়গায় সাধারণত তরুণরাই ইমাম হইতে আসে। আর পুরান যুগের সাত্তার পুলিশটাইপ হুজুরদের দিয়া এলাকার বেদয়াত খেদানোও মুশকিল আছে। সেটাও তরুণদের অ্যাপয়েন্টমেন্টের একটা কারণ হইতে পারে। কে জানে!

যাই হোক, নতুন হুজুর আইসা নাকি মিলাদ-মহফিলের ব্যাপারে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করছিলেন। কিন্তু মিলাদের কনোটেশন তো নানা রকমের। ধর্মীয় ব্যাপার আছে, পাশাপাশি গরিব খাওয়ানো ও প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারও আছে। গ্রামের পয়সাঅলা লোক যদি মিলাদ খাওয়াইতে না পারে, তাইলে তার চলবে কেন? ফলে মিলাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা টিকল না। তবে, মিলাদের ফর্মে একটা বড়সড় চেঞ্জ আসছে দেখলাম। আগে ইয়া নবি সালামু আলাইকা বইলা সুর কইরা যে মিলাদ পড়া হইত, তা আর হয় না। বরং আনুষাঙ্গিক সুরা-কালামের পর নরমাল দরুদ শরিফই পড়ে সবাই, নামাজের দরুদ শরিফ যেটা আরকি। বাড়িতে আমার মিলাদের স্মৃতি হইল সাত্তার সাহেবের আমলের মিলাদ। তো, দাদির মিলাদে ইমাম সাহেব ইয়া আয়্যুহাল্লাজিনা আমানু সাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা বলার সাথে সাথেই আমি সেই পুরান সুরে ইয়া নবি বইলা টান দিতে যাব, তখনই পুরা ব্যাপারটা আবিষ্কার করলাম।

তো এই নতুন হুজুর মিম্বরে বসে শবে বরাতের ফজিলত নিয়া ওয়াজ করতেছেন। এক পর্যায়ে হুজুর বললেন, এবাদতের রাতে বাড়ির মা-বোনদের হালুয়া-রুটি বানানোয় ব্যস্ত রাখা যাবে না। এইটা তাদের ওপর জুলুম। আপনেরা একদিন আগে/পরে এই জিনিশ খাইতে পারবেন। বাট এই রাতে না। এই রাতে শুধু এবাদত করবেন।

মুসল্লিদের একজন, আমার বড় চাচা, বললেন— হুজুর, যারা আগেই বানাইছে? অনেকেই তো বানাইছে। হুজুর বললেন, যারা বানাইছে, তারা বানাইছে। সেইটা ধর্তব্য না। আমি নিজেও দুইটা দাওয়াত খাইয়া আসছি। কিন্তু যারা বানায় নাই, তারা যেন না বানায়।

বেদয়াতি কাজে অংশ নেওয়ায় হুজুরের ওপরে রাগ করব ভাবছিলাম প্রথমে। পরে ভাইবা দেখলাম, এলাকার হুজুর হওয়ার আশলে অনেক জ্বালা। বেদয়াতি কাজে অংশও নিতে হয়, আবার বেদয়াতের বিপক্ষেও কইতে হয়। যদিও এলাকার তরুণরা মুরুব্বিদের নিষেধাজ্ঞা তেমন মানতেছে বইলা মনে হইল না। কিন্তু তারাও মসজিদে যায়, হুজুরের বয়ান শোনে। তাই হালুয়া-রুটির বদলে, এবার শবে বরাতে ফার্স্ট টাইম দেখলাম বার্বিকিউ পার্টি। মা-বোনদের উপর জুলুম না কইরা, হালুয়া-রুটি না বানাইয়া, এই তরিকায় বেদয়াত থেকে বেঁচে থেকে শবে বরাত পালন করতে দেখলাম অনেকরেই। গ্রামবাঙলায় ইন্টারেস্টিং সব চেঞ্জ আসতেছে।