ফাহিম (ফাইল ছবি)

ফাহিম (ফাইল ছবি)

তুহিন খানের গদ্য ‘জঙ্গিদমনের গল্প’

পর্ব ১

প্রকাশিত : মে ০৮, ২০২১

২০১৬ সালের জুন মাস। অ্যাডমিশন টেস্টের প্রস্তুতি নিতেছি তখন। হঠাৎ দেশে শুরু হয় সিরিয়াল কিলিং। জুনের সেকেন্ড উইক থেকেই শুরু হয় এই সিরিজ হত্যাকাণ্ড।
 
৫ জুন, চিটাগাংয়ে খুন হন এসপি বাবুলের বৌ মাহমুদা খানম মিতু। ওইদিনই নাটোরে খুন হন খৃস্টান ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজ। ৭ জুন ঝিনাইদহে খুন হন হিন্দু পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলি। ঝিনাইদহে ওই বছরই খুন করা হয় আরো দুইজন ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে। ৭ জানুয়ারি খুন হন খৃস্টধর্মে দীক্ষিত হোমিও চিকিৎসক ছামির আলী; এরপর ১৪ মার্চ খুন হন শিয়া নেতা আব্দুর রাজ্জাক।

পুলিশ এই খুনগুলারে একই কায়দার খুন হিশাবে শনাক্ত করে। সুনীল গাঙ্গুলির খুনের দায় আইএস স্বীকার করে; কিন্তু পুলিশ বলে আইএস না, স্থানীয় জঙ্গিরাই এরসাথে জড়িত। ৯ জুন প্রথম আলোতে খবর ছাপা হয়, `তদন্তে অগ্রগতি নেই` শিরোনামে। সেই রিপোর্টে খুনগুলা নিয়া পুলিশের রহস্যজনক গা-ছাড়া ভাবের ব্যাপারটা তুইলা ধরা হয়।

তদন্তে অগ্রগতি না থাকলেও, ৯ জুন থেকে সারাদেশে `জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান` শুরু করে পুলিশ ও র‍্যাব। ১১ জুনের বাংলা ট্রিবিউনের তথ্যমতে, ২ দিনে পুলিশ ও র‍্যাবের ক্রসফায়ারে, `জেএমবির জঙ্গিসহ`, মারা যান মোট ৯ জন। যেসব ঘটনারে কেন্দ্র করে এই খুন, সেসব ঘটনায় ১১ জুন পর্যন্ত মাত্র ৩ জনরে গ্রেফতার করে পুলিশ, কিন্তু তাদের থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায় নাই।

এই অভিযান চলাকালেই, ১০ জুন খুন হন পাবনার হেমায়েতপুরের শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র সৎসঙ্গ আশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পান্ডে। পুলিশ জানায়, পান্ডের খুন তাদের অভিযানের জন্য কোন চ্যালেঞ্জ না। সেসময় ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (আইক্ল্যাডস)-এর নির্বাহী পরিচালক স্ট্র্যাটেজি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ পুলিশ ও র‍্যাবের এই ক্রসফায়াররে সমর্থন করেন, এবং `জঙ্গি আর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরে এক করে দেখা লাগবে` মর্মে মতামত দেন।

এরই মধ্যে ১৫ জুন, মাদারিপুরের এক কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর উপর হামলা করতে গিয়া এলাকার লোকজনের হাতে ধরা পড়ে গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম (১৮)। ফাহিম উত্তরার এক কলেজে ইন্টারে পড়ত। পুলিশ তারে হিজবুত তাহরিরের সদস্য দাবি করে, এবং এই হামলাচেষ্টারে দেশব্যাপী চলমান সিরিয়াল কিলিংয়ের অংশ দাবি করে।

আক্রান্ত শিক্ষক রিপনের পরিবার এ ঘটনায় কোন মামলা করে নাই; মামলা করে পুলিশ। একমাত্র ফাহিম ছাড়া মামলার অপর ৬ আসামীর পিতার নাম ও ঠিকানা ছিল অজ্ঞাত। আদালতে ফাহিম `উচ্চকণ্ঠে` নিজেরে নির্দোষ দাবি করে। ফাহিমের ভাষ্যমতে, `ঢাকা থেকে কক্সবাজার (নানাবাড়ি) বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে মাদারিপুর এসেছি। এখানকার স্থানীয় এক নেতা আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।`

আদালত ফাহিমের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। রিমান্ডে থাকা অবস্থায়ই, ১৮ জুন ফাহিমরে ক্রসফায়ারে খুন করা হয়। পুলিশ `বন্দুকযুদ্ধ`র পুরান গল্প ফাঁদলেও শেষরক্ষা হয় না; কারণ প্রত্যক্ষদর্শীরা নিহত ফাহিমের হাতে হ্যান্ডকাফ এবং বুকে বুলেটের চিহ্ন দেইখা ফ্যালে।

ফাহিম খুন হওয়ার পরে এই নিয়া বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়। ফাহিমের স্কুল টিচাররা বিশ্বাসই করতে পারেন না যে, তার মত মেধাবী ছেলে এমন কাজ করতে পারে। মোস্তফা সরোয়ার ফারুকি পোস্ট দেন: `বন্দুক তুমি যুদ্ধ বোঝ, তদন্ত বোঝ না?` সাংবাদিক ফজলুল বারি লেখেন, যে স্থানীয় নেতার কথা আদালতে বলছিল ফাহিম, তারে আড়াল করতেই কি এই ক্রসফায়ার? আরেকজন ফেসবুক ইউজার পোস্ট দেন: `ফাহিম বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার কারণ দুটি হতে পারে। এক. সে অনেক কিছু জানত। দুই. সে কিছুই জানত না।` প্রফেসর আনু মুহাম্মদও ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এই খুনের সমালোচনা করেন। তার পোস্টের কমেন্টবক্সে বেশিরভাগ প্রগতিবেনিয়ার কমেন্ট ছিল আফসোসমূলক; `পুলিশকে আরো ধৈর্যশীল হতে হবে`, `এত তাড়াতাড়ি মেরে ফেলা ঠিক হয় নাই` ইত্যাদি।

আসকের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়েচে ভ্যালেরে দেওয়া এক ইন্টারভিউতে প্রশ্ন তোলেন: `এই জঙ্গিদের কাছে কী এমন তথ্য ছিল, যা পুলিশকে বিপদে ফেলতে পারত?` ওদিকে, ফাহিমের ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশান চলতে থাকে মিডিয়ায়। `নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক` প্রতিবেশিরদের বরাতে `ফাহিম খুব চুপচাপ থাকত`, `একা একা চলত`, `নামাজ পড়ত`, এসব নিয়ে `অনুসন্ধানী` নিউজ করতে থাকে পত্রিকাগুলা৷ সরকারি দালাল ও প্রগতিবেনিয়ারাও বইসা ছিল না। লন্ডনে বাঙলাদেশ হাই কমিশনের প্রেস মিনিস্টার নাদীম কাদির `বন্দুকযুদ্ধ ও জামিন` নামের এক লেখায় দাবি করেন, জঙ্গিরা আদালতে খুব সহজেই জামিন পাইয়া যায় বিধায়ই পুলিশ রাগের মাথায় তাদের খুন করে। ওই লেখায় উনি লেখেন: `ধরা পড়ে গেলে বেঁচে থাকা, আর মরে যাওয়া সমান।`

এই ঘটনার পরে পুলিশ উলটা আরো তিনটা মামলা দেয় অজ্ঞাতনামা আসামীদের নামে। ১৯ জুন বিকালে ফাহিমের পরিবারের কাছে গোপনে তার লাশ হস্তান্তর করে পুলিশ। এসময় তাদের সাংবাদিকদের সাথে আলাপ করতে দেওয়া হয় নাই।

এই তো গল্প। `জঙ্গিবিরোধী` অভিযানের চিরচেনা ছায়াছবি। ফাহিমের খুনের পর আওয়ামী দালালেরা সরাসরি খুনরে সমর্থন করছিল। আর প্রগতিবেনিয়াদের মূল কথা ছিল, `এত তাড়াতাড়ি মারা ঠিক হয় নাই` বা `এর ফলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে` বা `এই খুনে জঙ্গিদেরই উপকার হল` ইত্যাদি।

ওই মাসেই, মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এক লাখ আলেমের ফতোয়া নিয়া জাতিসংঘে পাঠান। এবং এর পরের মাসেই, বিখ্যাত হলি আর্টিজেন হামলার ঘটনা ঘটে। ফাহিম নামে ১৮ বছরের সেই ছেলেটা চিরতরে হারায়ে যায় আমাদের দিল ও দেমাগ থেকে। সে আসলেই দোষী ছিল কিনা, কেন তারে খুন করা হইল, দেশজুড়ে সিরিজ খুনগুলা কারা করতেছিল সেসময়, তা নিয়া আর কোন আলাপ জনপরিসরে বা মিডিয়ায় দেখা যায় নাই। ওই খুনের মামলাগুলা কীভাবে নিষ্পত্তি হইছিল, বা আদৌ হইছিল কিনা, আমরা আজও তা জানি না। চলবে