তুহিন খানের গদ্য ‘দুর্যোগমুহূর্তে সবার আগে মানুষ`

প্রকাশিত : জুন ১৮, ২০২২

যে কোনো দুর্যোগে, চাই তা মানবসৃষ্ট হোক, ন্যাচারাল হোক, বা পলিটিকাল হোক, প্রধান ও প্রথম ফরজ হইল সাহায্য, সহায়তা, মানুশের জীবন বাঁচানো। তারপর বাদবাকি ব্যাপার। কেন দুর্যোগ হইল, দায় কার, দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপগুলা কতটুক ইফেক্টিভ ছিল, আদৌ ছিল কিনা, না থাকলে কেন ছিল না, এমন দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের সক্ষমতা কতটুকু— এই সবই গুরুত্বপূর্ণ কোশ্চেন, কিন্তু এগুলা আসবে পরে৷ ফার্স্ট অ্যান্ড ফরমোস্ট— আমাদের মানুশ বাঁচাইতে হবে। যতবেশি মানুশরে পারা যায়, বাঁচানোর ট্রাই করা লাগবে।

যারা ভলান্টারি অ্যাক্টিভিটিজের সমালোচনা করছেন, তারা বেসিক হিউম্যান নেচার ভুইলা গেছেন। রাষ্ট্র বা স্টেটরে তারা পুজা করা শুরু করছেন। দুনিয়ায় স্টেট বা রাষ্ট্র একসময় ছিল না। এইটা ইন-এভিটেবল না, একসময় হয়ত থাকবেও না। স্টেট মানুশেরই বানানো একটা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মানুশ প্রধানত নিজেরাই নিজেদের সাহায্য করছে; আপদে বিপদে মানুশ যথাসাধ্য মানুশের পাশে দাঁড়াইছে, কোন স্টেট বা সরকারের জন্য ওয়েট করে নাই।

এতে কি সরকাররে বা স্টেটরে দায়মুক্তি দেওয়া হয়? একদমই না। কালই আমরা দেখলাম যে, ৩০ লাখ টাকার একটা কী যেন ঘোষণা করছে সরকার। সরকারের উদ্যোগগুলা তো আমরা দেখতেছি, এগুলার হিশাব থাকতেছে। একটা দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের অবদান কতটুকু, আর সাধারণ মানুশের অবদান কতটুকু— তা তো এস্টিমেট করা যায়। ফলে সরকারের সমালোচনা করা বা জবাবদিহি চাওয়ার জন্য নিজেদের পারস্পরিক সাহায্য সহায়তা বন্ধ রাখার কোন অর্থ নাই। রোহিঙ্গাদের পালার পুরা ক্রেডিট নিছে সরকার। কিন্তু শুধু সরকারই কি রোহিঙ্গাদের পালছে?

সাধারণ মানুশ, শত শত এনজিও, ভলান্টারি গ্রুপ, বুদ্ধিজীবী ও লেখক— এরাও কি পাশে দাঁড়ায় নাই রোহিঙ্গাদের? এখন রোহিঙ্গা পালার ক্রেডিট নিয়া শেখ হাসিনা যদি সত্যিই নোবেল পাইয়া যান— এই ভয়ে আমরা কি দশ লাখ রোহিঙ্গার জীবন শঙ্কার মুখে ফালায় দিতে পারি? একদমই পারি না।

এখন দেখেন, সিলেটের কী অবস্থা। ট্রলারওয়ালারা পশুর মত ভাড়া হাঁকতেছে। যে কোন দুর্যোগেই কিছু পার্টি আঙুল ফুইলা কলাগাছ হইতে চায়। তারা জানে, এখন লোকে গাইলাইলেও, ভাল এমাউন্টের টাকা কামাইয়া লইতে পারলে ফিউচার ফকফকা। এই ট্রলারওয়ালাদের কাছে আমরা যে ট্রলারের ভাড়া কমাইতে বলি, বা বিনা ভাড়ায় ট্রলার দিতে বলি, কিসের ভিত্তিতে বলি? স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে, মানবতার ভিত্তিতে। এখন ট্রলারওয়ালারা যদি পালটা কোশ্চেন করে বসে যে, আপনাদের উদ্ধারের দায় তো সরকারের, আমাদের না। তো সরকার আমাদের টাকা দিক। ট্রলারের ভাড়া সরকার দিক। আপনারা সরকাররের বলেন, তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। তাইলে কি হবে? হবে না।

এই দুর্যোগ যে একটা ম্যানমেইড দুর্যোগ, একটা পলিটিকাল দুর্যোগ, অপরিকল্পিতভাবে প্রাণ ও পরিবেশের উপর মেগাপ্রজেক্ট চাপায়ে দেওয়ার দুর্যোগ, প্রতিবেশী দেশের লগে দাসবৃত্তিমূলক পররাষ্ট্রনীতি থেকে সৃষ্ট দুর্যোগ— এটা অলরেডি গবেষকরা বলতেছেন। ইটনা-মিঠামইন সড়ক নিয়া আলাপ উঠছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের অপ্রস্তুতি আর এই দুর্যোগরে দেশের প্রধান কনসার্ন বানানোয় দেশি মিডিয়ার অনীহাও পষ্ট। তারপর আর কী কী করা লাগবে সরকারের দুর্বলতা প্রমান করতে? সবাই স্বেচ্ছাসেবা বন্ধ কইরা দেবে? আপনি ভুক্তভুগী হইলে এইরকম কথা বলতে পারতেন না। একজন ভুক্তভুগীই জানে, এইরকম দুর্যোগে সামান্যতম, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র সাহায্যের ফজিলত।

রাষ্ট্ররে জবাবদিহিতার দায় থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য `দেশ আমার দায় আমার`টাইপের জাতিবাদী কচকচানিগুলা মানুশের মনে ভলান্টারি অ্যাক্টিভিটিজের প্রতি অসন্তোষের জন্ম দিছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অনেকের ফটোসেশন-সর্বস্ব ত্রাণ কর্মসূচিও মানুশের মনে এইসব ত্রাণ কর্মসূচির প্রতি ক্ষোভের জন্ম দিতে পারে। কিন্তু আমাদের সবার আগে মানুশের পাশে দাঁড়াইতে হবে, মানুশ বাঁচাইতে হবে। সরকার একটা মানুশরে যদি বাঁচাইতে না পারে, না চায়, তাইলে অবশ্যই আমরা সরকারের কাছে জবাব চাইব৷ কিন্তু মানুশটারে মরতে দিয়া না; যদি সুযোগ থাকে, মানুশটারে বাঁচাইতে হবে আমাদের। দেশের বিরোধি দলগুলা এই দুর্যোগে সত্যিকারার্থে মানুশের পাশে দাঁড়াইলে, মানুশ তা মনে রাখবে। সরকারের উপর সব দায় দিয়া বইসা থাকলে, ক্রেডিটের ভাগও সবটাই সে নেবে।

দুর্যোগমুহূর্তে মানুশের জান মাল রক্ষায় আগায়ে আইসাও সরকারের সমালোচনা করা যায়। সরকারের কাছে জবাব চাওয়ার জন্য সবকিছু থেকে হাত গুটাইয়া ঘরে বা ফেসবুকে বইসা থাকা লাগবেই, এমন না আরকি।

লেখক: কবি