তুহিন খান

তুহিন খান

তুহিন খানের গদ্য ‘বিশেষ মহলের এজেন্ডা ও মিডিয়ার কারসাজি’

প্রকাশিত : এপ্রিল ১০, ২০২২

সাম্প্রতিক তিনটা ঘটনার ফলস রিপ্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে সারাদেশে যে এক ধরনের সেক্টারিয়ান ঝামেলা তৈরি করা হইল, এটা আশঙ্কাজনক। নির্বাচন, দ্রব্যমূল্য এসব রাজনৈতিক ব্যাপার তো আছেই। পাশাপাশি এসব ঘটনার মিডিয়া রিপ্রেজেন্টেশন এবং সেসব রিপ্রেজেন্টেশনের ব্যাপারে পাবলিক পার্সেপশনগুলাও বেশ চিন্তার। সমাজে বিদ্যমান নানামুখী চিন্তার দ্বন্দ্ব ও ক্ষতগুলারে কখন কেন কীভাবে খোঁচা দিয়া রক্তাক্ত করা হয়, তার একটা ভাল কেস স্টাডি হইতে পারে সাম্প্রতিক তিনটা ঘটনা।

এক নম্বর ঘটনা লতা সমাদ্দার বনাম নাজমুল তারেক। এই ঘটনার ব্যাপারে আমাদের ইউজুয়াল কমনসেন্স কী বলে? রস্তাঘাটে একজন নারীর টিপ নিয়া হুট করে এ ধরনের মন্তব্য কোনো পুলিশ কর্মকর্তার করার কথা না। কিন্তু শুরুতে অভিযোগটা সেরকমই ছিল। মিডিয়ার লোকজনের অ্যাক্টিভিজম এই টিপকাণ্ডরে নেসেসারিলি একটা ‘ধর্ম বনাম কালচার; যুদ্ধে রূপ দেওয়ার পর জানা গেল, ঘটনা আসলে ভিন্ন কিছু৷ নাজমুল তারেক উলটা দিক থেকে বাইক চালায়ে আসায় লতা সমাদ্দার তারে কিছু একটা বলেন৷

তাদের মধ্যে প্রথমে অন্য কোনো একটা ইস্যুতে কথা কাটাকাটি হয়, যেটা পরে টিপ প্রসঙ্গে গড়ায়। এ প্রসঙ্গে ডিএমপি কমিশনার জানাইছেন যে, তারা প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাইছেন৷ কীভাবে পাইছেন? তারেক নিজে এ ধরনের মন্তব্যের কথা স্বীকার না করলেও, ‘তার আচরণ দেখে মনে হয়েছে আপত্তিকর কোনো কিছু বলে থাকতে পারে’। এর আগেও পুলিশের বক্তব্যে দেখা গেছে যে, শুরুতে অভিযোগটা যেমন ছিল, ঘটনাটা আসলে সেভাবে ঘটে নাই।

রাস্তায় একজন মহিলার সজ্জা নিয়া কটু কথা কেউ যদি বলেই থাকে, তার তদন্ত অনুযায়ী বিচার হবে। কিন্তু মিডিয়ার অবস্থান কী ছিল? দেখা গেল, তারা নাজমুল তারেকের সাসপেক্টেড ‘জঙ্গি’ লাইফস্টাইল নিয়া রিপোর্ট শুরু করলেন। সে আগে গান-বাজনা নিয়ে ‘মেতে থাকত’, হুট কইরা দাড়ি রেখে হুজুর হয়ে গেছে, গম্ভীর হয়ে থাকে ইটিসি। সেম শিট। অর্থাৎ, ঘটনাটারে অবধারিতভাবে একটা সেক্টারিয়ান রুপ দিয়া এ ব্যাপারে একটা উত্তেজনা তৈরি করার ট্রাই করা হইল।

দেখা গেল, টিপকাণ্ডে অনেকেই মিডিয়ার বক্তব্য নিতে রাজি না। নাজমুল তারেকের গর্ভবতী স্ত্রীর গল্প তৈরি হইল, আরো নানা ঝামেলা। শেষমেশ ব্যাপারটা দাঁড়াইল ‘ধর্ম বনাম বাঙালি কালচার’। আর এই মেশিনে যখন পড়ে গেল ঘটনা, তখন সামনে কী হবে— তা অনুমেয়।

এবার পরের ঘটনাটা দেখি৷ আমোদিনী পালের কাহিনিটাও একটা ফলস এজাম্পশন দিয়া শুরু হইছে৷ এখানেও কমনসেন্স আমাদের বলে যে, হিজাব নিয়া নানা ধরনের স্টিগমা সেক্যুলার প্রতিষ্ঠানগুলাতে থাকলেও, সেটা সাধারণত ব্যক্তি পর্যায়েই থাকে। হিজাব পরে আসায় পিটানোর ঘটনা দেশে বিরল। তবু মিডিয়াগুলা নিউজ করল যে, হিজাব পরায় ছাত্রীকে মারধোর। দেখা গেল, টিপকাণ্ডে যারা মিডিয়ার নিউজ বিশ্বাস করতে চান নাই, তারা এবারে বেশ মিডিয়াভক্ত। অন্যদিকে টিপকাণ্ডে মিডিয়া নিউজে বিশ্বাসীরা এবার বেঁকে বসলেন। পরে জানা গেল যে, ঘটনাটা ইউনিফর্মকেন্দ্রিক, এবং এই ঘটনায় বেশকিছু ছেলে ও হিন্দু শিক্ষার্থীও শাস্তি পাইছে। মিডিয়াগুলা আলগোস্তে তাদের ওই হিজাবকেন্দ্রিক নিউজগুলা সরায়ে ফেলল। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। ‘হিন্দু ভার্সেস মুসলিম’।

হৃদয় মণ্ডলের ঘটনাটা নিয়া নানা ধরনের থিওরি শোনা যাচ্ছে। এগুলা সত্য হওয়া অস্বাভাবিক না। কিন্তু বিজ্ঞান আর ধর্ম যে এক নয়— এই বেসিক প্রিমাইজটা তো আমাদের মানা লাগবে। দুইটার পদ্ধতিও এক না। ওহি কোনো আকললব্ধ ব্যাপার তো না। ওহি যদি আকললব্ধ ব্যাপার হইত, তাইলে পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়াই ওহির নির্দেশনা বোঝা যাইত। সেটা কি যায়? মুসলিন স্কলাররা সেরকম কথা তো বলেন না। তারা বলেন, পঞ্চইন্দ্রিয় বা আকল যে ফয়সালা করতে অক্ষম, সেই ফয়সালাই হাজির করে ওহি। ফলে, বিজ্ঞান আর ধর্মের বাছবিচার প্রসেস আলাদা। আর তাই, কোনো ধর্মে বিশ্বাস না কইরাও বড় বিজ্ঞানী হওয়া যায়, আবার কইরাও হওয়া যায়। এগুলা হিউম্যান ক্যাপাবিলিটি, হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স। ইমরাউল কায়েস যেমন মুসলিম না হইয়াও আরবি ভাষা ও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতমদের একজন, অনেকটা সেরকমই ঘটনা এসব৷

হৃদয় মণ্ডলের কথোপকথনে এই ধরনের কিছু আলাপ ছিল, যদ্দুর দেখলাম। তবে, বিজ্ঞান পড়তে গেলে ধর্ম ত্যাগ কইরা আসা লাগবে, এ ধরনের একটা অ্যাক্টিভিজম এদেশের বিজ্ঞানবাদীদের ছিল। ব্লগযুগে সেই অ্যাক্টিভিজম খুব জোরেশোরেই চলছে। প্যারাডক্সিকাল সাজিদ নামের বই এবং তার লেখক ওই ব্লগ যুগের স্নায়ুযুদ্ধেরই বাই প্রোডাক্ট। সাইন্স দিয়া ধর্ম প্রমাণের হাজারটা বিপদ আছে, অনেক ইসলামি স্কলার সেসব নিয়া বিস্তর আলাপ করছেন। কিন্তু সাইন্স মানতে হইলে ধর্ম ত্যাগ করা লাগবে— এই ধরনের এজাম্পশন যখন একটা সমাজে শক্তিশালী হয়, তখন সাইন্স দিয়া ধর্মরে জাস্টিফাই করাই মানুশের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হবে। সাইন্সরে যদি আমরা একটা টোটাল জীবনদর্শন হিশাবে দেখতে চাই, তাইলে সাইন্সের সাথে শুধু ধর্মের না, সমাজে বিদ্যমান আরো বহু জিনিশেরই সংঘর্ষ অনিবার্য।

বিজ্ঞানবাদের সমস্যাও সেখানে। ফলে তার সংঘর্ষ কেবল ধর্মের সাথে না; বরং কালচার, আর্ট ও একটা হিউম্যান সোসাইটির আরো বহু জিনিশের সাথেই তার সংঘর্ষ অনিবার্য। একসময়ের মার্ক্সিজমরে বৈজ্ঞানিক মতবাদ বলা হইত; মার্ক্সবাদের উপর এই বিজ্ঞানবাদের আছর কী ভয়াবহ হইছে, তা আমরা অতীতে প্রত্যক্ষ করছি। ‘ইসলাম একটা সাইন্টিফিক মতবাদ’— এই প্রচারণার ফলাফলও ভিন্ন হবে বইলা মনে হয় না।

যাই হোক, হৃদয় মণ্ডলের ঘটনার পিছনে যদি রাজনৈতিক বা অন্য কোনো ইন্টার্নাল পলিটিক্স থাকেই, তাইলে তো ব্যাপারটা পরিষ্কার। কেন সেখানে ‘ধর্ম বনাম সাইন্স’ ইস্যু হইল তাইলে? সেখানে তো ওই ইন্টার্নাল পলিটিক্সটারেই ফোকাস করা দরকার, তাই না? কিন্তু সব ছাপাইয়া এ প্রসঙ্গে গুরুতর হয়ে উঠল প্যারাডক্সিকাল সাজিদ। যদি ছাত্ররা ইচ্ছাকৃত শিক্ষকরে ফাঁসায়, তাইলে ওই বইটার নাম নেওয়াই তাদের প্ল্যানের অংশ। সেক্ষেত্রে ধর্ম বনাম সাইন্সের লড়াই কইরা কি হৃদয় মণ্ডলদের বাঁচানো যাবে? ধরা যাক, দেশের সব লোক যদি সাইন্টিফিক হয়ে যায়, তাইলেও কি পাওয়ার পলিটিক্সের কোনো সুরাহা হবে? সাইন্স কি পারে সেই সুরাহা করতে? বা ধর্মভিত্তিক সাইন্স কি পারে?

মোদ্দাকথা, এই যে সমাজে বিদ্যমান মতগুলার মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, যে কোনো কারণেই হোক, এগুলারে প্রাসঙ্গিক ও রক্তাক্ত রাখা এখন বিভিন্ন মহলের একটা এজেন্ডা। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলায় আমরা দেখলাম যে, মিডিয়াগুলা এই এজেন্ডায় বেশ ভালভাবে ঘি ঢালল। টিপ আর হিজাব— দুইটা পাবলিক ডিস্পুটের ঘটনায় এই পরিচয়বাদী চিহ্নগুলাই হইল তাদের প্রধান নিউজ আইটেম। অথচ দেখা যাচ্ছে, দুইটা ঘটনায়ই এগুলা সেকেন্ডারি ইস্যু ছিল।

আমি এইসব ঘটনায় অভিযুক্তদের মুক্তি চাই। যদি তারা কোনো দোষ কইরাও থাকেন, সেটা এতবড় কোনো দোষ না, যতটা মিডিয়ার কারসাজি ও দুই পক্ষের তৌহিদি জনতার ইডিওলজিকাল ওয়রের কারণে মনে হইতেছে। এদের অতিদ্রুত মুক্তি দিয়া বা লঘু সাজা দিয়া স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ দেওয়া হউক, এটাই আপাতত আমার দাবি।

লেখক: কবি