তুহিন খানের গদ্য ‘মহৎ মানুষের কাপে জমিনেরও হক থাকে’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২১

শরহে বেকায়া জামাতে একটা কিতাব পড়ছিলাম, মুখতসারুল মা`আনি। এক বইয়েই অলঙ্কারশাস্ত্র, লজিক আর ইলমুল কালাম কীভাবে মিলেমিশে একাকার হয়, ওই বই না পড়লে আমি বুঝতাম না। যাহোক, বইটা পড়ছিলাম আমার শ্রদ্ধেয় উস্তাদ মাওলানা ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভির কাছে; বেফাকে ৯১ পাইছিলাম মুখতাসারে।

কঠিন বই হিশাবে মুখতাসারের বেশ খ্যাতি আছে। বইটার লেখক বিখ্যাত কালামবিদ, উসুলবিদ, ব্যাকরণবিদ, ফকিহ ইত্যাদি, আল্লামা সা`দুদ্দিন তাফতাযানি (মৃ. ৭৯১/৯৭ হি.)৷ ইসলামি জ্ঞানচর্চার হিস্ট্রিতে সাদুদ্দিন তাফতাযানি খুবই পলেমিক ফিগার ছিলেন; তার যেকোন বই পড়লেই আপনি এর নজির পাবেন।

মুখতাসার নিয়া আজ আলাপ করব। মজার স্মৃতি দিয়াই শুরু করি। আল কাওসারে থাকতে সকালবেলা ফজরের পরে আমরা চা খাইতে যাইতাম দোকানে। আমার সারাজীবনের অভ্যাস, চা পুরাটা খাই না, শেষেরদিকে একটু মাটিতে ফেলে দিই। অভ্যাসটা হইছিল আল কাওসারে থাকতেই। তো, চা ফেলে দেওয়ার পর কোন কোন জুনিয়র বা দোকানদার জিগেশ করতেন, কী ভাই চা ফালাই দিলেন যে? ভাল হয় নাই? আমি তখন মুখতাসারুল মা`আনির বেশ বিখ্যাত একটা কবিতার লাইন কইতাম— `ওয়া লিল আরদি মিন কা`সিল কিরামি নাসিবু!` অর্থাৎ, মহৎ মানুষের কাপে জমিনেরও হক থাকে! এত সুন্দর একটা কথা, কতবার যে আমি বলছি চা ফেলে দিতে দিতে, ইয়ত্তা নাই। সেইসব চায়ের আসরে অংশ নেওয়া আমার কোন কোন বন্ধু বা জুনিয়রের হয়ত ঘটনাটি স্মরণ থাকবে।

কবিতাটার পেছনের কাহিনীও বেশ ইন্টারেস্টিং। কবিতাটা এক নাম না জানা বেদুইন কবির। একদিন কোন এক আমিরের দরবারে অনেক লোক দাওয়াতে আসল। এদের মধ্যে ওই কবিও ছিলেন। তো, আমির ও তার ঘনিষ্ঠ মেহমানরা একই দস্তরখানে খানাপিনা করতেছিলেন। বেচার কবিরে বসায়ে রাখছিলেন একটু দূরে, সামনে একটা শরবতের গেলাশ দিয়ে। তো শরবত খাইতে গিয়া এই বেদুইন কবি, কিছুটা শরবত মাটিতে ফালাই দিলেন। সবাই টুক করে তার দিকে ফিরে তাকাল। আমির হালকা গরম। কীসব গাইয়া লোকজন দাওয়াতে আসছে, ম্যানারলেস কোথাকার— এমন একটা ভাব।

আল্লাহু আকবার! আমাদের এই বেদুইন কবি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার তাগিদে চট করে আবৃত্তি করে বসলেন তৎক্ষনাত রচিত চারটা পঙক্তি। আহা, কী মধুর সেই পঙক্তি:
شربنا شرابا طيبا عند طيب
كذاك شراب الطيبين يطيب
شربنا و ألقينا علي الأرض فضلة
و للأرض من كأس الكرام نصيب!

অর্থাৎ, এক মহান মানুশের দাওয়াতে খাচ্ছি মজাদার এই শরবত, মহৎ মানুশদের শরবত তো এমন মধুরই হয়! খেতে খেতে তাই, যমিনেও একটু ফেলেছি, মহান মানুশের গেলাশে তো যমিনেরও হক আছে, তাই না! (আহা! কী লেভেলের পামপট্টি!)

আমির তো কবিতা শুইনা পুরাই ফিদা! সে নিজের গেলাশ থেকেও একটু শরবত মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল: ওয়া লিল আরদি মিন কা`সিল কিরামি নাসিবু! সুবহানাল্লাহ! গল্পকথক হিশাবে আমি খুব ইমোশনাল, কেউ কেউ জানেন। কই থেকে কই যাই, হুঁশ থাকে না। বলতেছিলাম, মুখতাসারুল মা`আনির কথা। মুখতাসারের রসজ্ঞ ও মনোযোগী পাঠকমাত্রেরই সেই বিখ্যাত উদাহরণটা মনে থাকার কথা— أنبت الربيع البقل।

মুখতাসারের ছাত্রদের নিশ্চয়ই মাথায় আসছে, এইটা কিসের উদাহরণ? হ্যাঁ, এইটা মূলত `হাকিকতে আকলিয়্যা`র উদাহরণ। সাধারণ পাঠকদের জন্য আলাপটা একটু ছোট করে বলে দিই। `ইসনাদ` বলে একটা জিনিশ আছে আরবি ব্যাকরণে ও অলঙ্কারশাস্ত্রে। `ইসনাদ` মানে হল, একটা বাক্যে কর্তা ও কর্মের মধ্যকার সম্পর্ক। বা সাবজেক্ট ও অবজেক্টের মধ্যকার সম্পর্ক। যেমন: যায়েদ গেল। এখানে, যায়েদ ও যাওয়ার মধ্যে যে সম্পর্ক, তাকেই বলে ইসনাদ। এখন, এই ইসনাদ মৌলিকভাবে দুই ধরনের হতে পারে। হাকিকতে আকলিয়্যা ও মাজাযে আকলিয়্যা।

হাকিকতে আকলিয়্যা হল, একটা এক্টিভ ভার্বের যে মূল কর্তা, বা প্যাসিভ ভার্বের যে মূল কর্তা, তার দিকেই ভার্বটাকে সম্পর্কীত করা। যেমন: যায়েদ আমরকে মেরেছে। এখানে এক্টিভ ভার্বকে তার মূল কর্তা যায়েদের সাথে সম্পৃক্ত করা হল। আবার, `আমরকে মারা হইছে`। এখানে `মারা হইছে` প্যাসিভ ভার্বটা তার মূল কর্তার দিকেই সম্পৃক্ত হইছে। এবার আসেন, মাজাযে আকলি। মাজায মানে রুপক। তো এটা কী জিনিশ? কোন ভার্বরে তার মূল কর্তা বা কর্মের দিকে সম্পৃক্ত না কইরা, ওই ভার্বের সাথেই সংশ্লিষ্ট অন্য কোন নাউনের দিকে সম্পৃক্ত করারে বলে মাজাযে আকলি। তবে এই সম্পৃক্তকরণের শর্ত হইল, ভার্বটারে ওই নাউনের দিকে সম্পৃক্ত করার জন্য একটা কারণ বা চিহ্ন লাগবে, যার মাধ্যমে বোঝা যাবে যে, ওই নাউনটা এই ভার্বের মূল কর্তা বা কর্ম না। সেটা কেমন?

ধরেন, কোরানে আছে, `ইশাতুন রাদিয়াতুন`। মানে, সুখময় জীবনযাপন। এখানে, `রাদিয়াতুন` শব্দটা মূলত কর্তাপদ, এর অর্থ হল: সুখী বা আনন্দিত। আর `ইশাতুন` মানে জীবনযান। এখন, জীবনযাপন তো আর আনন্দিত হতে পারে না; আনন্দিত হয় যে জীবনযাপন করে সে। আর জীবনযাপন হয় সুখদ বা `মারদিয়্যা`, যেটা মূলত কর্মপদ। তো, এখানে কর্মপদের জায়গায় কর্তাপদকেই ক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত করা হইছে।

আরেকটু সোজা উদাহরণ দিই। `বানাল আমির আল মাদিনা`। অর্থ হল, আমির এই শহরটি গড়েছেন। কথা হইল, শহর তো বানায় শ্রমিকরা। আমির না। বাট উনি নির্দেশ দেন। যেহেতু উনি নির্দেশদাতা, অর্থাৎ, ভার্বটা ঘটার কারণ বা সবব, তাই উনারেই ভার্বের কর্তা বানায়ে দেওয়া হইছে। ফলে এটা মাজাযে আকলি। এখন, এই হাকিকতে আকলিয়্যা আর মজাযে আকলি, দুইটারই আবার চারটা করে প্রকার আছে। হাকিকতে আকলিয়্যার প্রকারগুলা হইল:

১. বক্তার বিশ্বাস এবং বাস্তবতা, উভয়ের সাথেই তার ইসনাদের মিল থাকা। যেমন: কোন মুমিন বলল: أنبت الله البقل, মানে আল্লাহই এই ফসল সৃষ্টি করেছেন৷ এখানে `সৃষ্টি করা`র কর্তা আল্লাহ, এবং এটা মুমিনের বিশ্বাস ও বাস্তবতাও।

২. বক্তার বিশ্বাসের সাথে মেলে, বাট বাস্তবতার সাথে মেলে না। যেমন: নাস্তিক কোন লোক বলল: أنبت الربيع البقل অর্থাৎ, ফসলাদি বসন্তের সৃষ্টি। এইখানে `বসন্ত` বা ঋতুকে বা প্রকৃতিকে সে ফসলের স্রষ্টা বানাইল, এটা তার বিশ্বাস অনুযায়ী ওকে, বাট এটা বাস্তবতা না।

৩. বিশ্বাসের সাথে মেলে না, বাট বাস্তবতার সাথে মেলে। যেমন ধরেন, কোন ক্রিশ্চান আইসা বলল, ঈসা আল্লাহর পুত্র না। এবং যারে বলল সে জানে না যে ওই লোক ক্রিশ্চান। তাইলে জিনিশটা ওই বক্তার বিশ্বাসের সাথে মিলল না, বাট বাস্তবতার সাথে মিলল।

৪. বিশ্বাস বা বাস্তবতা কোনটার সাথেই মেলে না। যেমন: আপনি বললেন: কালকেই আওয়ামী সরকারের পতন হবে। এইটা আপনি বিশ্বাসও করেন না, আর এইটা হবেও না।

মাজাযে আকলিরও এমন চারটা প্রকার আছে। সেগুলা আমাদের আলোচ্য না। আমাদের আলোচ্য হইল, হাকিকতে আকলিয়্যার দ্বিতীয় উদাহরণটা।

এইটা কীভাবে ইসনাদে হাকিকি বা বাস্তবিক সম্পৃক্তকরণ হয়? কারণ, আপন যদি বলেন যে, `বসন্ত ঋতু আমাদের ফসল দিল`, তাইলে তো আপনি সঠিক ইসনাদ করলেন না। কারণ, ফসল দেন আল্লাহ, `দেওয়া` বা `সৃষ্টি করা` ভার্বের মূল কর্তা আল্লাহ। আপনি যখন বলতেছেন যে, `ফসল দেয় বসন্ত ঋতু`, তখন আপনি বসন্ত ঋতুরে কর্তা বানাইলেন। তো এইটা তো রুপক হইল, না? এইটা হাকিকত তো হইল না!

এখানেই মূল প্যাঁচটা মারতেছেন লেখক। উনি বলতেছেন, এই ধরনের বাক্য, যে বাক্যে আমরা মূল কর্তার বদলে রুপক কর্তা নিয়া আসি, এই ধরনের বাক্যে ইসনাদটা হাকিকি (বাস্তব) না মাজাযি (রুপক), তা নির্ধারিত হবে বক্তার বিশ্বাস ও নিয়তের মাধ্যমে। যেমন: أنبت الربيع البقل বা বসন্ত ঋতুই শস্য ফলিয়েছে। এটা যদি কোন নাস্তিক বলে, তাইলে এখানে ইসনাদটা হাকিকিই হবে, কারণ নাস্তিক আল্লাহয় বিশ্বাস করে না। সে বিশ্বাস করে যে, ন্যাচারই ফসল ফলায়। অন্যদিকে এই একই বাক্য যদি কোন আস্তিক বা মুসলিম বলে, সেক্ষেত্রে ইসনাদটা হবে রুপক। অর্থাৎ, কোন মুমিন যদি বলে যে, `বসন্ত আমাদের কত শস্য দিল`, এর অর্থ হবে: `বসন্তে আল্লাহ আমাদের কত শস্য দিলেন!` অর্থাৎ, তার ক্ষেত্রে, শস্য ফলানোর কর্তা হিশেবে বসন্তের উল্লখকে রুপক ধরে নিতে হবে, কারণ সে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহই ফসল ফলান।

এমনিভাবে, ধরা যাক, আমিই কবিতাটা লিখেছি। নাস্তিকের ক্ষেত্রে এখানে `কবিতা লেখা`র কর্তা হিশেবে `আমি`র উল্লেখ বাস্তবিক, কারণ সে বিশ্বাস করে যে সেই এটা লিখেছে। ফলে, ইসনাদটা এখানে হাকিকি হবে। বাট আস্তিকের ক্ষেত্রে এই বাক্যে ইসনাদটা হবে রুপক, কারণ তার বিশ্বাসমতে, সে এই ভার্বের মূল কর্তা না, মূল কর্তা আল্লাহ, ঈশ্বর বা গড।

এখন কথা হইল, এই আলাপটা কেন করলাম? করলাম এইজন্য যে, এখানে দেখানো হচ্ছে, বক্তার বিশ্বাস ও নিয়ত অনুযায়ী দুনিয়ার সবচাইতে সহজতম বাক্যটিও কুফুরি হইতে পারে, আবার নাও পারে। আবার, এও দেখানো হচ্ছে যে, আমরা দৈনিক যত সাধারণ কথা বলি, রুপকের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া, এর ৮০%-ই কুফরি হইত। কারণ, আপনি যখন বলেন, আমি করছি, সে করছে, তুমি খাইছ, ও তো পরীক্ষায় প্লাস পাইছে— এই সবই রুপক ছাড়া ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। ভাষার সিস্টেমটাই এমন জটিল, তাই তো ভাষা নিয়া মানুশের এত আগ্রহ, উত্তেজনা। এইটা বালাগাতশাস্ত্র ও কালামশাস্ত্রের একটা বেসিক রুল। আফসোস যে, কিতাব তো আমরা পড়ি, কিন্তু অনুধাবন করি না। আল্লাহ আমাদের অনুধাবনের তৌফিক দান করুন। আমিন।