তুহিন খানের গদ্য ‘স্বামী’
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২১
গোলাম মোস্তফাই প্রথম ঝামেলাটা তৈয়ার করেন। আমার তখন সেই বয়স, যে বয়সে আমরা ভাবি যে, একটা শব্দের খালি একটাই অর্থ। গরু অর্থ গরু। সন্ধ্যা মানে সন্ধ্যাই। ভুল মানে ভুল। হিংসা মানে হিংসা।
তো, ওই সময়ই একদিন হুট কইরা গোলাম মোস্তফার কবিতাটা পড়া লাগল। `অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি/বিচার দিনের স্বামী!` অ্যাঁহ! ঠিক পড়লাম তো? `বিচার দিনের স্বামী?` এইটা আবার কেমন স্বামী? তখন পর্যন্ত জানি যে, স্বামী মানে স্বামী। আমার আব্বা আমার আম্মার স্বামী। কিন্তু আল্লাহও যে কারও `স্বামী`, এইটা ভাইবাই আঁতকায়ে উঠলাম। তাও আবার `বিচার দিনের স্বামী!` এই লাইনটা নিয়া বেশ অস্বস্তিতে পড়লাম।
শব্দার্থ জানার পরে বুঝলাম যে, স্বামী মানে আসলে মালিক। প্রভু। আল্লাহ বিচার দিনের স্বামী, মানে মালিক। আর আমার আব্বা আমার আম্মার স্বামী। `স্বামী` শব্দের এই অদ্ভুত অর্থ আর প্রয়োগ আমারে অবাক করছিল। আমি মাইনাই নিতে পারতেছিলাম না যে, স্বামী মানে মালিক।
একটু বড় হওয়ার পরে মাদ্রাসায় আইসা পড়লাম। এসো আরবি শিখি পড়ি। তুমুল আনন্দ। দুইটা বছর আমার জীবনের, পুরাপুরি আরবি ভাষার সাথে। তখন আমরা সারাদিন আরবি কইতাম। দোকানদার রিকশাওয়ালাদেরও। পরে বাঙলায় অনুবাদ কইরা দিতাম আবার। মসজিদে আরবের জামাত আসলে তাদের লগে আরবিতে কথা কইয়া আরব খেজুর আর তসবি গিফট পাইতাম। কড়া দিনকাল।
তো, এসো আরবি শিখিতে পড়লাম— زوج মানে স্বামী, زوجة মানে স্ত্রী। কিন্তু কোরআন তরজমা করতে গিয়া পড়লাম বিপদে। দেখি যে, `যাওজুন` মানে জোড়া। কোরআনে বহু জায়গায় এই অর্থেই শব্দটা ব্যবহৃত হইছে। শব্দ যে তার মূল অর্থে আবদ্ধ থাকে না অলটাইম, মূল অর্থের বাইরে গিয়া সে নয়া নয়া অর্থ বানায়, এইগুলা তখন বোঝা আরম্ভ করছি মাত্র। শব্দের হাকিকি অর্থ আর মাজাযি বা রূপক অর্থ বোঝা শুরি করছি। যেমন: `সাইর` মানে চলাচল করা, ঘোরাফেরা করা। সেইখান থেকে `সাইয়ারাহ`, মানে গাড়ি। অদ্ভুত আনন্দদায়ক ব্যাপারস্যাপার।
তো, কোরআন তরজমা পড়ার সময় দেখলাম, `যাওজাতুন` শব্দটা কোথাও নাই। সবখানে `যাওজুন`। স্বামী বুঝাইতেও যাওজুন, বউ বুঝাইতেও যাওজুন। খটকা লাগলো। হুজুর আমাদের বললেন যে, আরবদের ব্যবহারে `যাওজুন`ই চলে। `যাওজাতুন` শব্দ আছে, বাট ব্যবহারে অত নাই। আরবরা `যাওজ` বা `জোড়া` শব্দটারেই স্বামী ও স্ত্রী বুঝাইতে ইন্টারচেঞ্জেবলি ইউজ করে।
তুমুল আনন্দ পাইলাম সেদিন। হুট কইরা গোলাম মোস্তফা মাথায় আসলো। আল্লাহ বিচার দিনের স্বামী, আব্বা আমার আম্মার স্বামী। মাথায় আসলো, হিন্দি সিরিয়ালগুলাতে স্বামীরে `পতি পরমেশ্বর` বলতে শুনছি। উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণ কালচারে স্বামীরে `পতি` বা `প্রভু` ভাবার চল আছে নাকি? ভাবলাম। মাথায় আসলো, `স্বামী` মূলত সংস্কৃত শব্দ, ফলে উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণ কালচারের সাথে এর যোগাযোগ থাকা একদমই অস্বাভাবিক না। আরো ভাবলাম, আরবিতে স্বামী-স্ত্রী বুঝাইতে যে শব্দটা ব্যবহার হয়, তার আদি অর্থ `জোড়া`। এইটাই তো মূলত স্বামী-স্ত্রীর আসল সম্পর্কটারে ডেস্ক্রাইব করে। `মালিক`, `প্রভু`, `পরমেশ্বর` এসব শব্দ তা করে না।
ভাষার মধ্যে জেন্ডার-পলিটিক্স তখনও বুঝি না কিছুই। একটা পুরা ভাষারে কোনোদিন জেন্ডার বায়াসনেস থেকে মুক্ত করা যায় কিনা, সেইটা ভাষার বিকাশ ও উদ্ভব সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক তর্কগুলার সাপেক্ষে ভাবছি, কোনো উত্তর পাই নাই। মনে হয়, যায় না। কিন্তু একজন মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ভাষা কীভাবে কাজ করে, তা বুঝছি সেদিন। ওইসময় থেকে ধীরে ধীরে এমন হইল, `স্বামী` শব্দটা শুনলে বা কোথাও দেখলেই আমার অস্বস্তি লাগে। আল্লাহ স্বামী, আমার বাপও স্বামী। রিজনিংটা পুরাপুরি ক্লিয়ার না, কিন্তু মানবমস্তিষ্কের অবচেতন রিজনিং এইভাবেই হয়। আমি মিলাইতে পারি না। পরে দেখলাম যে, দুনিয়ার অন্য একটা প্রমিনেন্ট ভাষায় এই `স্বামী`র প্যারাপট্টি তো নাই। তার মানে, ভাষাগঠনের পেছনে মানবিক অভিজ্ঞতার একটা সাধারণ মূল্য আছে অবশ্যই। এবং, আমার যে ধর্ম, যে ভাষায় আমার ধর্মের স্ক্রিপচারগুলা আছে, সেই ভাষাভাষীরা নিজেদের `মালিক` না ভাইবা, `জোড়া` ভাবে। নাইস।
মূলত `স্বামী`কেন্দ্রিক এই অস্বস্তি কাটানোর জন্যই আমি `স্বামী` শব্দটা পারতে লেখি না বা লিখতে চাই না। সাধারণত শব্দের ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব একটা পালটায় না। পলিটিকাল কারেক্টনেস দিয়া আমাদের ভাষিক অভিজ্ঞতায় খুব বেশি চেঞ্জ আসে না। কিন্তু, `স্বামী` সেই বিরল শব্দগুলার একটা, যে শব্দের ব্যাপারে আমার ভাষিক অভিজ্ঞতা চেঞ্জ হইছে। শব্দটা দেখলেই আমি এখন অস্বস্তিতে পড়ি। মনে হয় যে, এইটা আল্লাহর সাথে খাস শব্দ, কারণ উনিই বিচার দিনের স্বামী।
ফলে, আমি `জামাই` ব্যবহার করি। `বউ` ব্যবহার করি। এখন জামাইয়ের ডিকশনারিগত অর্থ কী আছে, তা নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই। বাঙলাদেশে গইড়া উঠতে থাকা কমন ভাষার ভোকাবুলারিতে জামাই শব্দের এই অর্থ এখন মোটামুটি স্টাব্লিশড। কোনো কোনো অঞ্চলে হয়তো এখনও `জামাই` মানে `মেয়ের জামাই`, এইটা খুব স্ট্রিক্টলি মেইন্টেইন্ড হয়। বাট, কমন বাঙলায় এইটা লুজলি ইউজড ফর দ্যাট মিনিং। ভাষার অভিজ্ঞতা যে আসলে মানুষেরই অভিজ্ঞতা, এবং অভিজ্ঞতার হেরফেরে যে ভাষার সোশাল কন্সট্রাকশনরেও টপকানো যায়— আমার অভিজ্ঞতায় `স্বামী` শব্দটার ব্যবহার ইত্যাদি, সেইটাই প্রমাণ করে।
























