দহনদিনের লিপি

পর্ব ২১

মারুফ ইসলাম

প্রকাশিত : মে ১৯, ২০২১

কথাসাহিত্যিক মারুফ ইসলাম ‘দহনদিনের লিপি’ শিরোনামে আত্মজীবনীর মতো করে গদ্য লিখছেন ছাড়পত্রে। আজ প্রকাশিত হলো ২১ পর্ব

৭ মে ২০২১ শুক্রবার
আরও একটি শুক্রবার চলে গেল। হিসাব করে দেখলাম, চাকরিজীবনে প্রবেশ করার পর থেকে এ পর্যন্ত ৪৩২টি শুক্রবার পার করে ফেলেছি। যদি বেঁচে থাকি আরও কিছু দিন, আরও কিছু শুক্রবার পাড়ি দেব নিঃসন্দেহে।

শুক্রবার নিয়ে এই হিসেবের কারণ কী? কারণ আহামরি কিছু নয়, যখন থেকে চাকরিজীবনে প্রবেশ করেছি তখন থেকেই শুক্রবার বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ওই এক দিনই ছুটি পাওয়া যায় বলে।

আজকের শুক্রবার সারাদিন বাসাতেই কাটল। এটা লিখব, ওটা লিখব, এটা শেষ করব, সেটা শেষ করব বলে নানা কিছু ভেবে রেখেছিলাম। আদতে কিছুই উদ্ধার করা হলো না। অলস অকর্মণ্য অবস্থায় দিন গেল। হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল, পার কর আমারে…। না, কেউ পার করল না।

সন্ধ্যার পর কিছু ওষুধ পত্তর কিনতে বেরুলাম। ওষুধের দোকানদার পূর্ব পরিচিত। দেখলাম, ইফতার-উত্তর অলস সময়ে কয়েকজন ইয়ারদোস্ত নিয়ে দোকানের ভেতরেই আড্ডায় মেতেছেন। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিলেন, ‘ভাই ভালো আছেন নি?’ বললাম, কেমনে ভালো থাকি! ওষুধ কিনতে কিনতে জান শেষ। তিনি এবার সহায়তাকারী ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললেন, আশিক, ভাইয়ের কী কী মেডিসিন লাগব, দ্যাখ। তারপর তিনি আবার আড্ডায় মাতলেন।

ওষুধ নিতে নিতে তাদের আড্ডায় কান পাতলাম। একজন বলছেন, তছলিমের অবস্থা দেখছনি? আঙুল ফুলে ঢোল। আরেকজন বলছেন, দেখমু না আবার? হ্যারে আমরা ছোডুকাল থেইকা দেখতাছি। আমাগো বাপ চাচার কাছে চা-বিড়ি চাইয়া খাইত। হেই এখন ঢাহা শহরে দুইডা বাড়ি কইরা ফালাছে। বেশি দিন কিন্তু হয় নাই।

‘হ, সবই তো চক্ষের সামনে দেখতাছি। তয় যা-ই বলিস না ক্যান, তছলিম্যা কিন্তু দুই তিন বছর খুব খাটছে। দিন রাইত কমিশনারের লগে পইড়া থাকত। হারা দিন হের পিছে পিছে ঘুরত। পরে কমিশনার না তারে কয়ডা টিকাদারির কাম দিলো।’

‘ওই ঠিকাদারি দিয়াই তো কামাইতেছে। হ্যায় খালি একলা কামাইতেছে না, জ্ঞাতি গোষ্ঠী মিল্যা কামাইতেছে। তসলিমের এক ভায়রা ভাই আছে না? জামশেদ। কালো কইরা, মোটা কইরা, ভোম্বলের মতো, হ্যায় তো এবার আমগো বাজার লিজ নিছে।’

‘কোন বাজার? ভোলা বাজার নাকি ওই উত্তুর দিকের বাজার?’

‘আরে আমগো বাড়ি থেইকা হাতের বা দিয়া একটা রাস্তা গেছে না, ওইটার শেষ মাথায় একটা নয়া বাজার হইছে। ওই বাজার এবার জমশেদ ডাক নিছে ১২ লক্ষ ট্যাকা দিয়া।’

‘কস কী? এত ট্যাকা কেমনে করল?’
‘বোঝ তাইলে। ক্যামনে করল।’

তারা নিজেদের মধ্যে বোঝাবুঝি করতে লাগলেন। আমি আর এ গল্পে আগ্রহবোধ করলাম না। বুঝলাম, এদের সবার আদি নিবাস ভোলা শহরে। কর্মের তাগিদে ঢাকায় এসে হয়তো ফেঁসে গেছেন। আর ফিরে যেতে পারেননি। কেউ ওষুধের দোকান দিয়েছেন, কেউ অন্যকোনো ব্যবসা করছেন হয়তো। একটু অবসর পেয়ে আড্ডায় মেতেছেন নিজেদের ফেলে আসা শিকড় নিয়ে। সেখানে কেউ কেউ তাদের চেয়েও বিত্তশালী হয়েছে, যাদের অবস্থা এক সময় বড্ড করুণ আর শোচনীয় ছিল। ছিল তাদের চেয়েও খারাপ অবস্থায়। তারা আজ প্রভূত টাকাকড়ির মালিক হয়েছে। ক্ষমতাবান হয়েছে। তাদের ক্ষমতার আঁচ, অর্থবিত্তের উত্তাপ এই আলোচকদের মর্মে মর্মে পুড়িয়ে দিচ্ছে।

আমি মনে মনে হাসলাম। ক্ষুধার্তরা কালেভদ্রে অন্যের খাওয়া দেখলে সুখ পায়। কিন্তু এই ক্ষুধার্তরা সেই সুখও পাচ্ছে না! চলবে