
দারিদ্র মানুষকে একা হতে দেয় না
পর্ব ১৮
প্রকাশিত : মে ১০, ২০২১
কথাসাহিত্যিক মারুফ ইসলাম ‘দহনদিনের লিপি’ শিরোনামে আত্মজীবনীর মতো করে গদ্য লিখছেন ছাড়পত্রে। আজ প্রকাশিত হলো ১৮ পর্ব
৪ মে ২০২১ মঙ্গলবার
কতগুলো ঘটনা ঘটে গেছে আজ। কোনো ঘটনার সঙ্গেই আমার জীবনের কোনো যোগ নেই। তবু সেসব ঘটনার অভিঘাত এসে লাগে এই ছোটলোক মাথায়, ছোটলোকী ভাবনায়। ঘটনা এক. বিল গেটস দম্পতির বিচ্ছেদ। ঘটনা দুই. স্পিডবোট ডুবে ২৬ জনের মৃত্যু।
একটি ঘটনা ঘটেছে গভীর রাতে, আরেকটি ভোরে। সকাল হতে হতে ফেসবুকে শুরু হয়ে যায় ওই দুই ঘটনার মাতাল হাওয়ার প্রবাহ। বয়ে চলে সারাদিন। বিল গেটসের ঘটনা সম্ভবত আমেরিকায় ঘটেনি, ঘটেছে বাংলাদেশে। কিছু কিছু প্রতিক্রিয়া দেখে এমনই মনে হলো আমার।
এক ফেসবুকার লিখেছেন, বিল গেটস অন্য সব শীর্ষ ধনীর মতো ছিলেন না। তিনি প্রচুর দান খয়রাত করতেন। বিশ্বের স্বাস্থ্যখাতে তার প্রচুর অনুদান আছে। গেটস মহোদয় আফ্রিকার গরীব দুঃখীর জন্যও অনেক দান ধ্যান করেছেন। তিনি আমেরিকার হাজী মুহম্মদ মোহসীন।
এমন একজন দানবীরের সংসার ভেঙে যাওয়ায় তিনি যারপর নাই দুঃখ পেয়েছেন। তার হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কত টুকরো হয়েছে তা গুণে শেষ করা যাবে না!
অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝেই ফেসবুকে ঢুঁ মারলাম আর সারাদিন এইসব কান্না-হাহাকার-আহাজারি মেশানো পোস্ট পড়লাম। আমার মনে পড়ল, রাবেয়া খালার কথা। রাবেয়া খালা থাকতেন কামরাঙ্গীরচরে। আমি তখন ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ার, এই এলাকায় টিউশনি করি এবং টিউশনি শেষে এখানেই এফটি ফাউন্ডেশন নামের একটি এনজিওতে কাজ করি।
এনজিও বলতে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিস্তির টাকা আদায় করা আমার কাজ। রাবেয়া খালা ছিলেন আমার ক্লায়েন্ট। মানুষের বাড়িতে বুয়ার কাজ করতেন। অল্প কিছু টাকা লোন নিয়ে একটা ছাগল কিনেছিলেন। সেই লোনের কিস্তি নিতেই আমি যেতাম। খালার কাছ থেকে একদিন জানলাম, তার স্বামীর সংসারে ছিল সীমাহীন দারিদ্র। স্বামী ভদ্রলোক তেমন কাজকর্ম করত না। হঠাৎ হঠাৎ একদিন দুই দিন বাজারে কুলির কাজ করত আর সেই টাকা দিয়ে জুয়া খেলত। খাবার খেত বাইরে বাইরে। সংসারের জন্য কোনো বাজার করত না। রাবেয়া খালা না খেয়ে থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে কোলের বাচ্চাকে নিয়ে চলে এসেছিলেন ঢাকায়। আর কোনোদিন ফিরে যাননি। এভাবেই স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় তার।
গরীব মানুষদের বিচ্ছেদের একটা অন্যতম কারণ দারিদ্র। কিন্তু ধনীদের বিচ্ছেদের কারণ কী? তাদের তো টাকার অভাব নেই। ফেসবুকেই দেখলাম, কেউ কেউ লিখছেন, একঘেয়েমি। দিনের পর দিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে একঘেয়েমি চলে আসে। তাই তারা আলাদা হয়ে যায়। তাহলে কী দরিদ্রদের জীবনে একঘেয়েমি নেই? নিঃসঙ্গতা নেই? একাকিত্ব নেই? তাহলে তো বলতেই হয়, দারিদ্র একাকিত্বনাশিনী। দারিদ্র মানুষকে একা হতে দেয় না। নিঃসঙ্গ হতে দেয় না।
নিজের দিকে তাকাই। আমি কী একাকী মানুষ? খুব নিঃসঙ্গ মানুষ? আমার তো হতদরিদ্র অবস্থা। হতদরিদ্রদের নিঃসঙ্গ হওয়ার কথা নয়। আমি গর্বিত ভঙ্গিতে আকাশের দিকে তাকাই। নাম না জানা দুটো পাখি উড়ে যেতে দেখি বৈশাখের সুনীল আকাশে। সন্ধ্যার ছায়া নেমে এসেছে। আমি নিজেরই দীর্ঘ ছায়া মাড়িয়ে মাথা নিচু করে হাসপাতালে ঢুকে পড়ি।
হাসপাতালের ফিনাইলের গন্ধ আর ব্লিচিং পাউডারের গন্ধ উজিয়ে, ব্যক্তিগত শোক ও সন্তাপ উজিয়ে আমার অন্তরে তবু বিল গেটসের জন্য বিরহ লেগে রইল। মেল্ডার জন্য মন খারাপ হলো। একটা স্পিডবোটে কী করে ২৫-৩০ জন মানুষ উঠতে পারে তা ভেবে গভীর দুঃখে নিমজ্জিত রইল মন। চলবে