দীপঙ্কর মণ্ডলের আত্মগদ্য ‘আইসোলেশনের দিনরাত্রি’

পর্ব ২

প্রকাশিত : জুলাই ১৪, ২০২০

অনেক কিছুই বাচ্চাদের শেখাতে হয় না। নিধি নিজে থেকেই চা তৈরি শিখেছে। এটা ওর জীবনের তিন নম্বর চা। ওই যে ফ্লাস্ক, ওতে সবসময় গরম জল থাকে। তেষ্টা, চা এবং গারগলের জন্য। পাশেই গ্লাস। জল ঢালো আর টি-ব্যাগ ডোবাও। ব্যাস চা তৈরি। তবু ওইটুকু মেয়ে এই কায়দা শিখে নিয়েছে! কাল থেকে নিজেই চা এগিয়ে দিচ্ছে। এটা আমার কাছে খুব বড় ঘটনা। সাতদিন একটা ঢাকনা দেয়া গামলাও আমাদের নতুন সঙ্গি। আদা, রসুন, লবঙ্গ, দারুচিনি, তেজপাতা আর এলাচ মেশানো জল। প্রতিদিন অন্তত বার চারেক এটি ফুটিয়ে আমরা ভাপ নিচ্ছি। এর বাইরে এক কুচিও ওষুধ লাগছে না। লাগবেও না।

কয়েক দিনে প্রচুর ফোন, মেসেজ এবং হোয়াটসঅ্যাপ পেয়েছি। সবাই জানতে চান আমরা কি করছি। কি খাচ্ছি। কেমন আছি। মনে হলো, এই পরিস্থিতি হলে কি হয়, তারপরে কি করা দরকার, আমরা কি করছি তা লিখে ফেলা ভালো। অনেকেই এই লেখা পড়ে খুশি হবেন। টিভিতে বা খবরের কাগজে কোভিড সংক্রান্ত প্রচুর খবর হচ্ছে। কিন্তু তা অনেক ক্ষেত্রে `ওভার রেটেড`। দেখে বা পড়ে আতঙ্ক আসছে। আমি নিজে সংবাদকর্মী। তবু বলছি, করোনা সংক্রান্ত টিভি বা কাগজের নেগেটিভ খবরকে পাত্তা দেবেন না। আমার শিশুসন্তান কোভিড পজিটিভ। আমরা দুজন নেগেটিভ। প্রাথমিকভাবে একটা ধাক্কা তো ছিলই। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি।

আমি, আমার স্ত্রী এবং মেয়ে তিনজন এক জায়গায় আছি। বাইরে বেরোচ্ছি না। তবে একসঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া করছি। এক সঙ্গেই ঘুমোচ্ছি। সকালে গরম জলে লেবু নিংড়ে খাওয়া। তারপর চিনি ছাড়া লিকার চা। প্রাতরাশে কোনও দিন হাতে গড়া রুটি-আলু ভাজা, কখনো নুডলস আবার কখনও বা মুড়ি-চানাচুর। দুপুরে ভাত-ডাল-তরকারি। বিকেলে চা-বিস্কুট। রাতে আবার অল্প ভাত। এই হচ্ছে প্রতিদিনের রুটিন। স্নানের সময় আগে একটু গরম জল নিতাম। এখন তা বন্ধ হলেও ডেটলটা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি বা মোমো ফিনাইল দিয়ে স্নানের আগে যতটা সম্ভব ঘরটা মুছে নিচ্ছি। মেয়ের সবকিছু নরমাল। ঘুম থেকে একটু দেরিতে উঠছে। কারণ রাতে ঘুমোচ্ছে দেরিতে। নেটফ্লিক্সে ওর জন্য বেশ কয়েকটা বাচ্চাদের সিনেমা ডাউনলোড করা আছে। এছাড়া টিভিতে ছোটা ভিমসহ নাম না জানা হরেক কার্টুন আছে। এই মরশুমে দেয়ালে ছবি আঁকার বহরও বেড়েছে।

ঘরে কোভিড ঢুকেছে জানার পর প্রথম কাকে জানালাম? কোন ডাক্তারের সঙ্গে কথা হলো? বিরাট বড় জাম্বো ব্যাগে প্রায় ১৫ দিনের যাবতীয় রেশন কে পাঠালো?

বিকেল সাড়ে তিনটে। উপুড় হয়ে শুয়ে একটা ওয়েব সিরিজ দেখছিলাম। মেয়ে ডাকলো, বাবা তোমাকে ডাকছে।
আমাকে! আমাকে আবার কে ডাকবে? দুনিয়াশুদ্ধু জানে, আমরা কোয়ারেন্টাইনে। মাস্কের উপরও নাক টিপে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের ভাড়াবাড়ির সামনেটা পেরিয়ে যায় লোকজন। কোনও সেলসম্যান হতে পারে। খানিকটা বিরক্তি নিয়ে খালি গায়ে বাইরে এলাম। দেখি গেটের ওপারে একটা বাইক দাঁড়িয়ে। হেলমেট পরা।
কাকে চাই? কত নম্বরে যাবেন?
আরে আসুন না মশাই। আপনাকেই চাই। বলতে বলতে হেলমেট খুললেন বাইক চালক।
মনোজ! আমার সিটি কলেজের বন্ধু। বলল, ফেসবুকে তোর মেয়ের ছবি দেখলাম। দেখা করতে চলে এলাম। এই নে একটু চকলেট আর ফ্রুট জুস। এই বুড়ি শোন। কেমন আছিস?

আরে দাঁড়া দাঁড়া, চাবি খুলি।
ও আচ্ছা আচ্ছা। তাই তো। ঠিক আছে তুই বাইরেই দাঁড়া। মামমাম এদিকে এসো। এদিকে এসো। তোমার মনোজ কাকু। আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়তাম। মোমো বাইরে এসো। দেখো। এ হচ্ছে মনোজ। আমার বন্ধু। আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। তুই এলি কি করে মনোজ? কুড়ি বছর আগে একবার এসেছিলি। উত্তর কলকাতার এই এঁদো গলি তোর মনে ছিল?
পুলিশ চাইলে সব পারে গুরু। শহরের যেকোনোও প্রান্তে আমরা পৌঁছে যেতে পারি। যে কোনো সময়।
ও হ্যাঁ তাইতো, তুই তো কলকাতা পুলিশে আছিস। তা কি করলি? গিরিশ পার্ক থানায় জিজ্ঞেস করলি নিশ্চয়ই? উত্তরে পুলিশ সুলভ রহস্যময় হাসি। মেয়ের সঙ্গে, মোমোর সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কাটিয়ে বাইকে স্টার্ট দিল মনোজ।

আমাদের পাড়ার বিমল দা, গদাদার বৌদি, পার্থ দা, প্রসেনজিৎ দা, পাল্লু, সনুসহ অনেকেই গেটের বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে গল্প করে। খোঁজ নেয়। তারা জানে, দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে কোনো অসুবিধা নেই। সবচেয়ে বৈপ্লবিক কাজ করছে কাল্টুদা। প্রদীপ শ্রীমানি। আমাদের প্রত্যেক দিনের দুধ আর বাজার ওই এনে দেয়। তবে শুরুটা করেছিলেন আমার বস। সৃঞ্জয় বোস। স্বাস্থ্য ভবন থেকে যেদিন ফোনটা এলো। প্রথম ফোনটা করেছিলাম টুম্পাইদাকে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বিরাট এক জাম্বো ব্যাগে বাপ্পাদার হাত দিয়ে অন্তত ১৫ দিনের সবজি চলে এলো। কি না ছিল তাতে। আলু, পিঁয়াজ, দুধ, ডিম, পটল, ঝিঙে, কাঁচালঙ্কা, টমেটো, পাতিলেবু, স্যানিটাইজার, মাস্ক। ওরে ব্বাবা এত! আমার মতো চুনোপুঁটি এক সাধারণ কর্মীর জন্য বস এত কিছু পাঠিয়েছে! অবিশ্বাস্য! ভালোবাসায় এবং শ্রদ্ধায় আমার আর মোমোর চোখের কোণে আনন্দের জল। চলবে

 

সিনিয়র রিপোর্টার সংবাদ প্রতিদিন, কলকাতা