দুজন পিতার পুত্র-কন্যার বিচার না চাওয়া এবং কার্ল মার্কস

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৩, ২০২২

দুটো খবর আমার দৃষ্টি কেড়ে নেয়। প্রথমটা হলো, শহজাহানপুরে নিহত প্রীতির বাবা কন্যার হত্যার বিচার চাননি রাষ্ট্র্রের কাছে। তিনি বলেছেন, তিনি বিচার চাইবেন আল্লার কাছে। মনের মধ্যে বহুদিন ধরেই কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। ঠিক এমনি অবস্থায় ক’দিন আগে নিউমার্কেটে নিহত নাহিদের পিতাও বলেছেন, তিনি পুত্রের হত্যার বিচার চান না। দুটা খবর খুবই গুরুত্ব বহন করে। কারণ এটা বিচারহীন সমাজের দিকে আঙুল তুলে দেখায়, বর্তমান সমাজের চেহারা আমাদের কাছে স্পষ্ট করে তোলে। ইতালির একজন বিচারক ছিলেন, তার নাম উগো বেত্তি। তিনি নাটকও লিখেছেন। তার একটি নাটকের নাম ‘ন্যায়বিচারের প্রাসাদে বিচারহীনতা’ বা ‘করাপশন ইন দ্য প্যালেস অব জাস্টিস’। কার্ল মার্কস বিচারহীন এই সমাজটাকে খুব ভালো করে চিনতেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইটিডি অভিসন্দর্ভ লিখেছেলেন আইন বিষয়ে। দুজন পিতা কেন তাদের সন্তানদের বিচার চাইছেন না রাষ্ট্রের আদালতে, বহু আগে এ প্রশ্নের উত্তর রেখে গেছেন তিনি। তিনি যে কত বড় সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন, সেটা আমরা ধারণায় রাখি না। রাখলে দেখতাম, মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন মহৎ আর সত্যিকারভাবেই দরিদ্রদের বন্ধু।

বহুজন মনে করেন, কাল মার্কস শুধু ধর্মের বিরোধিতাই করে গেছেন। কথাটা ঠিক নয়। তথাকথিত মার্কসবাদীরাও কার্ল মার্কস সম্পর্কে এসব ভুল ধারণা ছড়ানো বাদ রাখেননি। সন্দেহ নেই, কার্ল মার্কস ধর্মে বা অলৌকিক কিছুতেই বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন না বলে অন্যের বিশ্বাস করাটাকে কখনো উড়িয়ে দেননি। বরং যুক্তি দিয়ে মানুষের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে চমৎকার সব যুক্তি দিয়েছেন। তিনি গভীরভাবে মানুষের ধর্মানুভূতিকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। মার্কসবাদী বা প্রগতিশীলরা প্রায় ধর্মকে আক্রমণ করার জন্য মার্কসের একটা উদ্ধৃতি খণ্ডিতভাবে ব্যবহার করেন। সেটা হলো, ‘ধর্ম হচ্ছে জনতার আফিম’। মার্কস সেখানে কী বলতে চেয়েছেন সেটা উপলব্ধি না করেই উদ্ধৃতির পুরোটা বাদ দিয়ে বা না জেনে নিজের বিশ্বাস মার্কসের ওপরে চাপিয়ে দেন। কথাটার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা তারা দেন না বা জানেন না।

মার্কস বাস্তবিকপক্ষে বলেছিলেন, “ধর্ম হচ্ছে জগতের এক সামগ্রিক তত্ত্ব, বৃহৎ সংক্ষিপ্তসার, জনপ্রিয় আঙ্গিকে সে-জগতের যুক্তি, তার আধ্যাত্মিক সম্মানের আস্ফালন, তার উদ্দীপনা, তার নৈতিক অনুমোদন, তার দুঃখাপনোদন ও সমর্থনের ব্যাপক ভিত্তি। যেহেতু মানবসত্তার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই ধর্ম হচ্ছে সেই সত্তার কাল্পনিক বাস্তবায়ন।” তিনি সামান্য পরেই বলছেন, “ধর্মীয় দুঃখবাদ হচ্ছে বাস্তব দুঃখের প্রকাশ ও বাস্তব দুঃখের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ধর্ম হচ্ছে নির্যাতিত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন জগৎ-পরিবেশে কল্পিত আত্মা। এ হচ্ছে জনতার আফিম।” কী দাঁড়ায় তাহলে? ইতিহাসের একটি বিশেষ স্তরে, বিশেষ শক্তি সমাবেশের ফলে ধর্মও প্রতিবাদের একটা রূপ হয়ে ওঠে, সামাজিক দুঃখের ক্ষতিয়ান আর শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে। নাট্যকার উৎপল দত্ত লিখেছেন, “এ না হয়ে উপায় নেই। অত্যাচারীর শক্তিকে যখন বাস্তব সমাজে রোখা যায় না, বুদ্ধিজীবীদের বৃহদংশ যখন সেই অত্যাচারীর পক্ষেই নকীবী করে, তখন নেতৃত্বহীন জনগণ ধর্ম ছাড়া প্রথম কোথায় আশ্রয় নেবে?” বিশেষ করে পরাধীন দেশে বা বিচারহীন দেশে।

কথাটার বিরাট তাৎপর্য আর ভয়াবহভাবে এটা সত্য। দুজন পিতার রাষ্ট্রের কাছে তাদের নিহত কন্যা আর পুত্রের বিচার না চাওয়ার ব্যাপারটা কী প্রমাণ করে? প্রমাণ করে, তারা বুঝে গেছেন রাষ্ট্রের কাছে বিচার পাওয়া যাবে না। কী করবেন তাহলে তারা? কার কাছে নিহত কন্যা আর পুত্রের বিচার চাইবেন? কারো কাছে বিচার চাইতে না পারলে তো তাদের মনে শান্তি আসবে না। ফলে তারা বিচার চাইছেন তাদের দৃষ্টিতে বা তাদের বিশ্বাসে যিনি সর্ব শক্তিমান সেই স্রষ্টার কাছে। এটাই কি রাষ্ট্র্রের বিচার ব্যবস্থা প্রতি শোষিত মানুষের চরম অনাস্থার প্রকাশ নয়? বিচার তিনি রাষ্ট্রের কাছে চাইছেন না, চাইছেন স্রষ্টার দরবারে। কারণ তিনি বুঝে গেছেন, রাষ্ট্র এসব ক্ষমতাবানদের বিচার করে না। বিচার করবার ক্ষমতা রাখে না। ফলে তার বিচার চাইবার শেষ ভরসাস্থলটি হলো স্রষ্ট বা আল্লাহ। মার্কস কি ওপরে সেই কথাটাই যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাখ্যা করেননি? তিনি কি বলেননি, “ধর্মীয় দুঃখবাদ হচ্ছে বাস্তব দুঃখের প্রকাশ ও বাস্তব দুঃখের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ধর্ম হচ্ছে নির্যাতিত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন জগ’-পরিবেশে কল্পিত আত্মা। এ হচ্ছে জনতার আফিম।”

মানুষ যখন বাস্তব জগতের ক্ষমতাবান মানুষের মধ্যে হৃদয় দেখতে পান না, হৃদয়হীন সেই নিষ্ঠুর সমাজের কাছে বিচার চাইবেন কোন ভরসায়? যখন গ্রামের বা শহরের দরিদ্র একজন মানুষের কন্যা ধর্ষণের শিকার হয় বা ক্ষমতাবানদের দ্বারা নিহত হয়, তখন সে কী করে? প্রথম সে থানায় যাবে বিচার চাইতে বা মামলা করতে। সেখানে বিচার না পেলে সে আরো একটু ক্ষতাবানের কাছে যাবে। সেখানে বিচার না পেলে সকল কষ্ট সত্ত্বেও যাবে আদালতে। কিন্তু আদালতে দরিদ্র ফরিয়াদির কি আসামীর ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়বার শক্তি আছে? সমাজে বা রাষ্ট্রে সে যার কাছেই বিচার চাইতে যাবে। ধরা যাক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, এসপি, জেলা প্রশাসক বা এমপি; সেইসব বিচারকরা কি ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে দরিদ্র মানুষটির কথায় কান দেবে? সত্যিই কি দরিদ্র মানুষটি বিচার পাবে তাদের কাছে? দরিদ্র মানুষটি বিচারের জন্য দিনের পর দিন এর-ওর দ্বারে ঘুরে বেড়াবে, আর দেখবে যাদের কাছে সে বিচারের জন্য যাচ্ছে তারা কত হৃদয়হীন। শ্যাম বেনেগালের ‘নিশান্ত’ ছবিটির কথা মনে করা যেতে পারে। স্ত্রীকে হরণ করার পর বিদ্যালয় শিক্ষক স্ত্রীকে ফেরত পাবার জন্য বা বিচারের জন্য ক্ষমতাবানদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু সমাজের যে মানুষগুলি তার স্ত্রীকে হরণ করেছে তারা সবার নাকের ডগায় চলাফেরা করছে, কারো কিছু বলবার ক্ষমতা নেই। সামন্ত পিতা পর্যন্ত এ ঘটনার জন্য তিন পুত্রকে কিছুই বলে না। স্ত্রীর সঙ্গে মন্দিরে একবার শিক্ষকের দেখা হলেও ক্ষমতাবানদের রক্ষচক্ষুর ভয়ে সে সাহস করে তাকে ফেরত নিতে পারে না।

সবসময় অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সমাজের দরিদ্র বা ক্ষমতাহীন মানুষটি দেখবে কেউই তার পক্ষে নেই। ধনীদের বা ক্ষমতাবানদের কেউ ঘাটাতে চায় না। দিনের পর দিন এর-ওর দ্বারে ঘুরে ঘুরে তার ধারণা হবে, দরিদ্রের পক্ষে জগতে কথা বলবার মানুষই নেই। তাদের কারো হৃদয় বলে কিছু নেই। যখন এসব অভিজ্ঞতা লাভ করে সে হতাশায় ভেঙে পড়বে, হঠাৎ তখন তার স্রষ্টা বা ইশ্বরের কথাই মনে পড়বে। বিচার তো তাকে পেতেই হবে জুলুমের বিরুদ্ধে, তখন সে দু-হাত তুলে ইশ্বরের কাছে বলবে, হে ইশ্বর, এই জগতের কেউ ন্যায়বিচার করলো না। হে ইশ্বর, তুমি আমার পুত্র-কন্যার হত্যাকারীর বিচার করো।

ক্ষমতাহীন মানুষটির এই বলা বা বিশ্বাস করাটাই সমাজের একটা বিজ্ঞান। ধর্ম এখানে সমাজবিজ্ঞানের একটি রূপ। সমাজে নয়, সে বিচার পাবে মহান স্রষ্টার কাছে; এটাই অসহায় মানুষকে পরের দিনগুলিতে বাঁচতে সাহায্য করে। স্রষ্টা ছাড়া আর কেউ বিপদের দিনে তার পাশে নেই। স্রষ্টাই আছে তার সঙ্গে, এইটা বিশ্বাস করে বলেই সে চরম অপমান আর কষ্টের দিনগুলিতে দিনের পর দিন বেঁচে থাকে। নাহলে সে হতাশায় মরে কবেই মরে যেত। দুঃখে শেষ হয়ে যেত তার জীবন। মার্কস মনে করেন, তাই ধনীদের ইশ্বর না হলেও চলে। কারণ ধনীদের ইশ্বর হলো টাকা। আর দরিদ্রদের ইশ্বর হলো তার কল্পনার সর্বশক্তিমান। মানুষ তার সাময়িক যন্ত্রণা দূর করতে পারে আফিম খেয়ে। ঠিক একইভাবে ইশ্বরের কাছে বিচার চাইবার পর, চরম অসহায় দরিদ্র মানুষটি মনের অশান্তি বা কষ্টকে লাঘব করে। যখন সমাজে বিচার পাওয়া যাবে না এই ধারণা বদ্ধমূল হয়, তখন রাষ্ট্রের কাছে কেন দুই পিতা বিচারা চাইবে? বরং ইশ্বরের কাছে ন্যায়বিচার পাবার আশা নিয়ে সান্ত্বনা লাভ করবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক