দু`মুঠো ভাতের গল্প

জেবা

প্রকাশিত : মে ১৭, ২০২০

সকিনার আজকাল দিন কাটে ঘরের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে। সকাল বেলা অলস পায়ে বাড়ির বারান্দায় যেয়ে বসে। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারে না। আচ্ছা, এত অসহায় কী সে আগে কখনও বোধ করেছে? সেই যে বছর ঘুরতেই তার সংসারটা ভেঙে গেল! স্বামীরূপী পিশাচটার নির্মম আঘাতে সাত মাসের বাচ্চাটা গর্ভেই মরে গেল!

দুনিয়ার আলো হাওয়ায় চোখ মেলেও দেখতে পেল না... অথচ কত স্বপ্ন বুনেছিল তার এই অনাগত সন্তান নিয়ে। চোখটা কেমন ঝাপসা হয়ে আসে... দিন আনে দিন খায় বাবার ঘরে যেখানে নিজেদের দু`মুঠো অন্ন সংস্থান করাই বড় দায়, সেখানে স্বামী পরিত্যক্ত সখিনাদের যে দুর্দশা, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু না, এক ভাইয়ের সংসারে কেউ তাকে ফেলে দেয়নি।

এরপরের সুখ অবশ্য তার কপালে বেশি দিন সয়নি। ট্রাকের হেল্পার ভাইটি এক্সিডেন্টে যমের দুয়ার থেকে ফিরলেও চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলে। ভাইয়ের জীবন বাঁচাতে বাবার শেষ সম্বল জমিটুকুরও মালিকানা বদল হয়। তবে ক্ষুধা তো এত কিছু বোঝে না। এর মধ্যেই একটা গার্মেন্টস কারখানায় কাজ পেয়ে যায় সে। নতুন করে আশার আলো দেখতে পায়।

বাড়ি থেকে অনেক অনেক দূরে হাজারটা অসুবিধা মেনে নিয়ে কাজ করে যায় অবিশ্রান্ত। দেশের অর্থনীতির চাকা যে তাদের হাতে! তবে মাঝে মাঝে কী যে হয়, ঘরপোড়া সকিনার ঘরের জন্য মন কেমন করে। ক‘দিন ধরে সবাই কী যেন বলাবলি করছে, মহামারি, দুর্ভিক্ষ, করোনা, লকডাউন..। সে এতকিছু বোঝে না। বোঝে শুধু বাড়ির তিনটি প্রাণীর অন্ন জোগানোর দায়িত্ব তার।

হঠাৎ বিনা নোটিশে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। শূন্য হাতে ফেরত আসে বাড়িতে। কিন্তু সর্বগ্রাসী ক্ষুধা যে বড় দায়! ত্রাণের সামান্য সাহায্য, সেওতো তাদের হাত পর্যন্ত পৌঁছেনি। মুখ ফুটে চাইবে কারও কাছে?  না না, সে যে ভারি লজ্জার। মাঝে মাঝে উড়ো খবর আসে হাত ধোয়া, মহামারি, মৃত্যু, আন্দোলন, বিক্ষোভ বেতনের দাবিতে ধর্মঘট, ঘরে থাকা, আরো সব জটিল শব্দ।

সেতো এতকিছু জানতে চায় না। তার চাওয়া খুব সামান্য, দুবেলা পেট পুরে দুমুঠো ফকফকে সাদা ভাত। রাতের বেলা জানতে পারে, না পাওয়া মজুরি নিতে তাদের ফেরত যেতে হবে, নইলে চাকরি থাকবে না। অজানা আশংকা ভর করে মনে, আবার আনন্দও হয়, গেলেই তবে বেতন পাবে! একদিকে অজানা অসুখ, আবার অন্য দিকে যানবাহন বিহীন শূন্য রাস্তা।

ঘুম আসতে চায় না। আধো ঘুম, আধো জাগরণে স্বপ্ন দেখে, তার সামনে একথালা শুকনো কড়কড়ে ভাত। ধড়মড়িয়ে জেগে ওঠে। ভারি মধুর মনে হয় স্বপ্নটা। সকল দ্বিধা কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। জয় হয় ক্ষুধার। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই অজানার ভরসায় প্রাণ সঁপে দিয়ে পথে নামে সকিনারা।

১২.৫.২০২০