না-পাকসার জমিন বাদ সাদ

সরকার আবদুল মান্নান

প্রকাশিত : নভেম্বর ৩০, ২০২০

মাহমুদা আমার বড় বোন। ফাইবে পড়ে। মা খুব সুন্দর করে ওর মাথা আঁচড়ে দেয়, দুটা বেনি করে দেয়, বেনির মাথায় লাল ফিতার ফুল করে দেয়। ও যখন সালোয়ার-কামিজ পরে, সাজুগুজু করে স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় তখন ওকে কি যে সুন্দর লাগে। একদম পরী। ও এবং আরও কয়েকজন নাচতে নাচতে স্কুলে যায়।

ওদের স্কুল যাওয়া দেখে আমার খুব ইচ্ছে করে স্কুলে যেতে। বায়না ধরি, আমারে ইসকুলে নিতে অইব। কিন্তু কে শোনে কার বায়না। আমি নাকি পুচকে। বেঞ্চের তলায় পড়ে থাকব। স্যারেরা নাকি আমাকে দেখতেও পাবে না। চাচতো বোন বলে, দেখব ক্যামনে, কালার কালা। কুপি জ্বালাইয়াও স্যারেরা এইডারে দেখব না।

মাহমুদা আপা আমার ওই চাচাতো বোন জ্যোৎস্নার সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়, কালা দেখলি কই? অয় কি কালানি? গোসলটোসল করাইলে কত সোন্দর দেহায়। (অথচ আমার এই বড় বোন কথায় কথায় আমারে বলে কালকুইট্টা।)

দুইজনে যখন হাতাহাতির পর্য়ায়ে তখন অবস্থা সুবিধার না দেখে আমি কেটে পড়ি। স্কুলে যাওয়া দরকার নেই আমার। কিন্তু আসল কাহিনি অন্য। আমাকে নিলে ওদের হৈহৈ রৈরৈ করে বেড়ানোতে অসুবিধা হবে। লেইজারের সময় ওরা স্কুলের পাশের বান্ধবীদের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। এটা খায়, ওটা খায়। আমাকে নিলে ওদের এই স্বাধীনতায় ব্যাঘাত ঘটবে।

আমি ওদের স্কুলে যাওয়া দেখি। ওদের পিছু পিছু উত্তরের খাল পর্যন্ত যাই। ওরা আমাকে তাড়িয়ে দেয়। বলে খবরদার আবিনা কইলাম। ভর্তি না অইলে ইসকুলে যাওন যায় না। স্যারেরা মারে। আমি স্যারদের মাইরের ভয়ে আর যাই না।

অনেক দিন ঘ্যানঘ্যান করার পর মা একদিন বললেন, কী অয় অরে নিলে, যা, লইয়া যা। ত্যক্ত করত না।
ভরসা পেয়ে বড় বোন মাহমুদা আমাকে ওর সঙ্গে স্কুলে নেওয়ার জন্য রাজি হয়। আমাকে গোসল করাতে নিয়ে যায়। প্রথমে সারা গায়ে ভালো করে সাবান লাগিয়ে দেয়। আমার চোখে সাবানপানি ঢুকে গেলে আমি চিৎকার করে কাঁদতে থাকি। ও আমাকে বলে, খবরদার কান্দাকান্দি করলে তোরে কইলাম ইসকুলে নিতাম না।

আমি চুপ হয়ে যাই। ও গামছা দিয়ে আচ্ছা মতো আমার শরীর ডলতে থাকে। আমাকে ফর্সা বানিয়েই ছাড়বে যেন। তারপর শুরু হলো আমাকে সাজানোর পালা। কাসার পাত্রে গরম পানি নিয়ে আমার সার্ট-প্যান্ট ইস্তরি করা হলো। আমার মাথায় ছিল বড় বড় চুল। কিছুতেই আমি চুল ছোট করতে দিতাম না। কপাল ছাড়িয়ে চোখ পর্যন্ত চলে আসা চুলে আচ্ছা মতো সরিষার তেল মাখিয়ে চুবচুবে করে দেওয়া হলো। ছেলেদের চুল বাঁদিক থেকে ডানদিকে নাকি ডানদিক থেকে বাঁদিকে আঁচড়ানো হয় তা জানত না মাহমুদা আপা। সে মেয়েদের মতো আমার চুল ডানদিক থেকে বাঁদিকে আঁচড়িয়ে দেয় অনেক আগে থেকে। আজও আমার চুল বাঁদিক থেকে ডান দিকেই আছে। আমার মুখে ও গলায় একটু পাউডার লাগিয়ে গামছা দিয়ে আলতো করে মুছে দেওয়া হয়। আমাকে ফুলবাবু বানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মায়ের কাছে।

মা দেহেন, আমনের পুতেরে কেমন দেহায়?
মা দেখে বলেন, সোন্দর। এত সাজাইছস কিলিগা। মানুষের মুখ লাগব না। কপালে কালির একটা টিপ দিয়া দে।
আপা বলে, আমনের পুতে কত সোন্দর না, মাইনসের মুখ তো লাগবই— কালা শইলো কালির টিপ— বলে আমাকে নিয়ে স্কুলের দিকে হাঁটা দেয়। সঙ্গে আরও চার-পাঁচজন ছেলেমেয়ে।

আমার বয়স তখন চার বছর। গ্রামে চার বছরের ছেলে-মেয়েরা ছোট না। আমরা অনেকে সাঁতার কাটতে পারি, গাছে উঠতে পারি, গোরু-ছাগল নিয়ে মাঠে যেতে পারি, ঘুড়ি বানাতে পারি, বাড়িতে মাঠে ঘাটে সারাক্ষণ ঘুড়ি উড়ানো নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতে পারি। এমনকি চুরিদারিও করতে পারি। আরও কত কি যে করতে পারি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বাড়ির উত্তরের এই খালটি পাড় হয়ে কখনোই সর্দারদের দীঘির পাড়ে আসা হয়নি। অথচ সাঁতার কেটে পুকুর খাল বিল পাড় হয়েছি কতবার।

সরদারদের দীঘির পাড়টা বাগানবাড়ির মতো বিশাল। সেই পাড়ের পশ্চিম দিকটায় দক্ষিণমুখী স্কুল। এই পশ্চিম পাড়ে খেলার মাঠও আছে। বাকি তিনটি পাড়ে গাছ আর গাছ, জঙ্গল আর জঙ্গল। এমন একটি রহস্যময় জগৎ থেকে কেন এতদিন বঞ্চিত ছিলাম তা ভেবে মনখারাপ লাগছিল। আবার সর্বত্রই গা ছমছম করা নির্জনতা আছে। স্কুলের সময় বলেই এখন দীঘির পশ্চিম পাড়টিতে ছেলেমেয়েদের কোলাহলে মুখর। সেই মুখরতার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি দীঘির পাড়ের বিস্তৃত বনাঞ্চল জুড়ে বিরাজমান। কিন্তু স্কুল ছুটি হয়ে গেলে চারদিক সুনশান নীরবতা। সেই নির্জনতার মধ্যে ভৌতিক ও আধিভৌতিক কত কিছুর যে আর্বিভাব ঘটবে এবং কত জিনপরী দৈত্য দানোর রাজত্ব শুরু হবে তার কি কোনো ঠিকঠিকানা আছে! সুতরাং স্কুল ছুটি হলে এখানে আসা নিরাপদ নয়।

দীঘির দক্ষিণ পাড়ের যে সংকীর্ণ পথটি দিয়ে স্কুলে যেতে হয় সেই পথটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদসংকুল পথ বলে আমার মনে হচ্ছিল। দুই দিকে উঁচু জঙ্গল। আর ভেতরে অন্ধকার। সেই জঙ্গলের ভেতরে বিশাল একটি দানোর মতো দাঁড়িয়ে আছে পত্রপল্লবহীন একটি গাছ। বিশাল বিশাল শিকর বেরিয়ে এসেছে শরীর থেকে। আর শরীরময় মোটা মোটা কাঁটা। শুষ্ক স্তনের বোঁটার উপরে কাঁটাগুলো আটশাট বসে আছে। মাহমুদা আপা আমাকে ধরে নিয়ে হাঁটছে। তবুও আমার ভয় লাগছিল। সেই ভয়কে পাত্তা না দিয়ে আমি আপাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপা ওইডা কী গাছ? বলল, তুলা গাছ। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে বললাম, এই গাছের তুলা দিয়া বালিশ বানায়, লেপ বানায়?
হ, বানায়।
তুলা পাড়ে কেমনে?
চুপ কর। পাড়ে ক্যামনে জানি না।

আসলে আপাও জানেনা এত উঁচু গাছ থেকে পালকের মতো হালকা তুলাগুলো কীভাবে পেরে আনে। আমি আর কথা বাড়াই না। সরু পথ দিয়ে হাটঁতে থাকি। কিন্তু সেই পথ খুব সোজা না। পথে উঁচিয়ে আছে গাছের শিকড়। একটু বেখেয়াল হলে শিকড়ের সঙ্গে উষ্ঠা খেয়ে পড়ে যেতে হবে কিংবা শরু শিকড়ের সঙ্গে পা জড়িয়ে যাবে। আবার পথের দুইদিক থেকে ডালপালা আর লতাহগুল্ম ঝুলে আছে পথের দিকে। এমন কি বেতের মতো ভয়ংকর কাঁটাজাতীয় লতাও ঝুলে আছে। খুব সাবধানে পথ চলতে হয়। আমি আপাকে বলি, আমনেরা এনদিয়া যান ডর করে না?
ডর করব কিলিগা। এনোতো বাঘভাল্লুক নাই। হাপ আছে। আর জোঁক আছে, চিনা জোঁক। তোর কি ডর করতেছে?

ভয় পাচ্ছিলাম একটু একটু। কিন্তু সেটা বলা ঠিক হবে না। বীরপুরুষের মানসম্মাস থাকবে না। বললাম, না আপা। ভয় পাই না। বাঘভাল্লুকেরেও ভয় পাই না। হাপেরেও না। ছোড কাকু একদিন হাপের লেজ ধইরা ঘুরাইয়া হাপটারে মাইরালাইছে। ভয় পাই নাই।

আমার কথা শুনে আপা এবং ওর দলের লোকেরা খুব মজা পায়। সবাই হাহা করে হাসতে থাকে। জ্যোৎস্না আপা বলে, তুই বাঘভাল্লুকেরে ভয় পাস না বুঝলি কেমনে। তুই কোনোদিন বাঘভাল্লুক দেখছস। আর হাপের লেজ ধইরা ঘুরাইয়া মারছে কাকু। তোর কি? তুই বীরপুরুষ অলি কেমনে?

জ্যোৎস্না আপার কথা কিছু বুঝতে না পেরে আমি বোকার মতো হাসতে লাগলাম। কিন্তু আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা। ওই সরু পথ থেকে দীঘির একটি খালি জায়গা বোঝা যায় কিন্তু দীঘিটা দেখা যায় না। কখন ওই দীঘিটা দেখব, ওর জল দেখব, জলের ঢেউ দেখব, মাছ দেখব, তীর দেখব— এইসব চিন্তা নিয়ে আছি। জ্যোৎস্না আপার প্যাঁচের কথায় আমার মনোযোগ নেই।

স্কুলে গিয়ে দেখি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা দক্ষিণমুখো টিনের একটা ঘরের নাম স্কুল। লম্বা ঘরটির মধ্যে পাঁচ-ছয়টি রুম। রুমের ভেতরটা আরও আজব। দরজা দিয়ে ঢুকতেই টেবিল-চেয়ার। তারপর সারে সারে সাজানো লো বেঞ্চ, হাইবেঞ্চ। টিনের পার্টিশনে ঝুলানো ব্লাকবোর্ড। একদম পুবদিকের ঘরটি আবার অন্যরকম। ওই ঘরটিতে লোবেঞ্চ-হাইবেঞ্চ নেই। একটি টেবিলের চারদিকে চারটি চেয়ার এবং আরেকটি টেবিলের সঙ্গে একটি চেয়ার। সব টেবিলের উপরে চক ডাস্টার আর বেত। একটি চেয়ারওয়ালা টেবিলটার পেছনে কাঠের দুটি আলমারি। খোলা। আলমারির ভেতরে বাঁধাই করা খাতা, পরীক্ষার খাতা, নেকড়া, ভাঙা কাঠ, ভাঙা বেত, পুরনো ডাস্টার, বোতল, পাটের রশি, পুরনো তালা, কয়েকটি বই, মোড়ানো পোস্টার, ভাঙা গ্লোব যাচ্ছেতাই জড় হয়ে আছে। ওই ঘরটিতে কত কি যে ঝুলানো আছে তার ইয়ত্তা নেই।

স্কুল ঘরটির মাঝে বারান্দায় ঝুলানো আছে পিতলের ঘণ্টা এবং তার সঙ্গে কাঠের একটি হাতুড়ি। আমি ভেবেছিলাম স্কুল মসজিদ-মক্তবের মতোই একটা ঘর হবে। কিন্তু এই স্কুল ঘরটি আমার ভাবনার ধারেকাছেও না। একদম অন্যরকম। সামনে ছোট একটি মাঠ। পুবদিকে আরেকটি মাঠ। বিশাল একটি দীঘি। লাগোয়া আর কোনো ঘরবাড়ি নেই। বুঝলাম স্কুল একদম অন্যরকম। বাবার সঙ্গে বাজারে গিয়েছিলাম একবার। দেখলাম স্কুল বাজারের মতো নয়, দোকান ঘরের মতো নয়, গ্রামের ঘরবাড়ির মতো নয়, মসজিদ-মক্তবের মতোও নয়। স্কুল একদম অন্যরকম। আমার ভীষণ ভালো লাগল। আর এত এত প্রশ্ন মাথার মধ্যে জমতে লাগল। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি কাকে। আপাকে দুটার বেশি তিনটা প্রশ্ন করলেই বলবে, চুপ কর। কিন্তু আব্বা কখনোই বলে না চুপ করো। একশোটা প্রশ্ন করলেও আব্বা বিরক্ত হন না। সব প্রশ্নের উত্তর দেন। ভাবলাম, সব প্রশ্ন আব্বাকেই করতে হবে। আপাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। শুধু শুধু ধমক খেতে হয়।

লম্বা, ফর্সা দেখতে খুব সুন্দর একজন লোক ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন। আর হুড়মুড় করে সবাই মাঠে এসে যার যার লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। আমাকে আপা ওর কাছেই রেখেছিল। কিন্তু ওই লোকটা এসে আপার কাছ থেকে আমাকে নিয়ে গেল। নিয়ে গেল খুব আদর করে। তোমার নাম কী ছেলে? আমি নাম বললাম। লোকটি বলল, না বাবা, তোমার নাম মন্নান না, মান্নান। ঠিক আছে? তোমার বাবার নাম কী। বললাম, আবদুল হাকিম সরকার। বাহ্! খুব সুন্দর করে বলেছ। গুড। তোমার বাবাকে আমি চিনি। এইসব বলে বলে আমাকে ছোটদের লাইনে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন।

দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে সবার সামনে মুখোমুখি দাঁড়াল। আমি খুব এক্সাইটেড। কিছু একটা হবেই। দেখলাম ওরা গাইছে ‘পাকসার জমিন সাদ বাদ’। ওদের সঙ্গে সবাই গাইছে। গাওয়া শেষ হলে কিছুক্ষণ পিটি-প্যারেড হলো। তারপর যে যার ক্লাসে চলে যায়। আমি দাঁড়িয়ে আছি। কোথায় যাব বুঝতে পারছি না। আমার পিছনের ছেলেটি ঝটপট আমার সামনে এসে হাঁটা দিল। আমিও হাঁটতে লাগলাম। একদম পশ্চিমের রুমটিতে গিয়ে যার যার সিটে সবাই বসে গেল। এর মধ্যে ওই স্যার এসে আমাকে সামনের বেঞ্চে বসিয়ে দিয়ে গেলেন। সবার সামনে বইখাতা আছে। আমার সামনে কিছু নেই। স্যার বলে গেলেন, নিধিরাম সরদার।

আমার মাথায় সারাক্ষণ ওই গানটি ঘুরছে— পাকসার জমিন সাদ বাদ। কী গান? একটি শব্দেরও অর্থ বুঝতে পারছি না কেন। কোন ভাষায় লেখা? কেউ বুঝে বলেও মনে হলো না। তা হলে কেন এই গান গাওয়া হয়? পাশে বসা ছেলেটার দিকে কয়েকবা তাকালাম। আমি ওর দিকে তাকালে ও হাসে। কথা বলে না। ওকে যে আমি ওই গানটির বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করব, সেই ভরসা পাই না। এর মধ্যেই ছোটদের স্কুল ছুটি হয়ে গেল। মাহমুদা আপা কয়েকটি ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। একটি ছেলেকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এইডা কী গান গাইল জানছ?
ও বেশ ভাবসাব নিয়ে বল, জানি তো, আরবি দিয়া লেহা। হুনলে ছোয়াব অয়।
আমি বললাম, তয় বুঝলাম না যে?
তুই যে মক্তবে সুরা পড়ছ, কায়দা পড়ছ— বুঝছ? বুঝবি কেমনে, আরবি দিয়া লেহা যে।

আমি আর ওর সঙ্গে কথা বাড়ালাম না। আমার বড় ভাই রুহুল মমিন। কলেজে পড়ে। ভাইকে জিজ্ঞাসা করলে সব জানা জাবে। কিন্তু মুসকিল হচ্ছে তাকে সবসময় পাওয়া যায় না। কিসের মিছিল মিটিং স্লোগান নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত। গ্রামের রাস্তাঘাটে, খেলার মাঠে, হাটে-বাজারে সর্বত্র কিসব নিয়ে বেশ উত্তেজনা আর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান চারদিকে। স্কুল-কলেজে পড়ুয়া বড় ভাইদের মুখে স্লোগান আর স্লোগান— তোমার নেতা আমার নেতা/শেখ মুজিব শেখ মুজিব, তুমি কে আমি কে/বাঙালি বাঙালি, তোমার দেশ আমার দেশ/বাংলাদেশ বাংলাদেশ, জেলের তালা ভাঙব/শেখ মুজিবকে আনব, শপথ নিলাম শপথ নিলাম/মুজিব তোমায় মুক্ত করবো, শপথ নিলাম শপথ নিলাম/মাগো তোমায় মুক্ত করবো, জাগো জাগো/বাঙালি জাগো, পদ্মা মেঘনা যমুনা/তোমার আমার ঠিকানা, জেলের তালা ভেঙেছি/শেখ মুজিবকে এনেছি, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/বাংলাদেশ স্বাধীন করো... এরকম অসংখ্য স্লোগানে তখন গ্রামীণ জনপদ মুখরিত।

আমরা যারা খুব ছোট, পাকা পাকা কথা বলতে শিখেছি; আমরাও একত্র হলে স্লোগান দিতে শুরু করতাম। বাড়িতে স্লোগান দিলে এক দাদি লাঠি নিয়ে আসতেন। আমাদের ধাওয়া দিতেন আর বলতেন, গোলামের ভাই গোলামেরা, বাইত আইছে স্লোগান দিতে। কান জ্বালাপালা কইরা লাইল। যা যা রাস্তায় যা, বিলো যা। যত চিল্লাইতে পারস চিল্লা গা।

আমাদের এই স্লোগানের গুরু ছিল স্কুল-কলেজ পড়ুয়া বড় ভাইয়েরা। তাদের কাছ থেকে শুনে শুনে আমরা স্লোগানগুলো শিখে নিতাম। আর আমার ছোট কাকু ছিলেন আমাদের সবচেয়ে আপনজন। সারাক্ষণ হৈহৈ রৈরৈ করে বেড়াতেন আর আজব আজব গল্প বলেতন। ইয়ার্কি ফাজলামি করা, রসিকতা করা, গল্পগুজবে মেতে থাকা এইসব ছিল তার স্বভাবের অংশ। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কাকু পাকসার জমিন সাদ বাদ দিয়া কী অয়? এইডা স্কুলে গায়। সবাই মিললা গায়।

কাকু বলল, এইডা তোগো স্যারেরা ভুল গাওয়ায়। এইডা অইব ‘না-পাকসার জমিন বাদ সাদ’। বুঝলি, পাকিস্তানিগো দিন শেষ— বাদ সাদ।

কাকার কথা আমি কিছুই বুঝিনি। কী পাকিস্তান, কী দিন শেষ আর বাদ সাদই বা কী। আমার জন্ম ১৯৬৪ সালে। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার নেই। বিশেষত বাঙালি জাতির উপর তারা কী ধরনের অন্যায় অত্যাচার অবিচার শোষণ ও নির্যাতন করেছে তার সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নেই। পাকিস্তান শাসিত পূর্ব বাংলায় আমার জন্ম, জোর করে তারা যার নাম দিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। সেই পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষাভাষী শিশুদের সামনে এমন একটি জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হতো যেটি কোন ভাষায় লেখা তাও জানত না শিশুরা। আমার বোন মাহমুদা জানত যে ওটি আরবি ভাষায় লেখা। আবার কেউ কেউ মনে করত ফার্সি ভাষায় লেখা। এক সময় জেনেছি এটি ছিল উর্দু ভাষায় লেখা পূর্ব বাংলার জাতীয় সংগীত। এই জাতীয় সংগীতের বর্ণবিসর্গও আমাদের বোধগম্য ছিলনা। এর চেয়ে দুর্ভগ্যের আর কী হতে পারে।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে অবরুদ্ধ তখনই সংগঠিত হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুথ্থান। সেই অভ্যুথ্থানের ঢেউ পৌঁছে গিয়েছিল বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে, মাঠে-ময়দানে, হাটে-বাজারে, স্কুলে-কলেজে- এমনকি প্রতিটি ঘরে। আমরা শিশু ছিলাম। রাজনীতির কিছুই আমাদের বোধগম্য ছিলনা। কিন্তু তাই বলে আমরা সেই বিপুল আলোড়নের বাইরে ছিলাম না। আর আমার কাকা তো ছিলেন পরিণত বয়সের যুবক। সুতরাং তখনো- সেই ১৯৬৯ সালেও স্কুলে ‘পাকসার জমিন সাদ বাদ’ শুনানো হচ্ছে -এই ক্ষোভ তিনি কোথায় রাখবেন। তাই ওই উক্তি- ‘না-পাকসার জমিন বাদ সাদ’। এরপর সত্যি বাদ হয়ে গিয়েছিল ‘পাকসার জমিন সাদ বাদ’।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ