নাট্য সমালোচনা এবং সমালোচনা গ্রহণ না করবার প্রবণতা

পর্ব ১

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১২, ২০২০

বাংলাদেশে বহু নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে পঞ্চাশ বছরে, বহু নাটক লেখা হয়েছে। সব নাটক আমার পড়া হয়নি যেমন, আবার সব নাটক আমার দেখা হয়নি। বাহাত্তর সাল থেকে উনিশশো নিরানব্বই সাল পর্যন্ত লেখা বা ঢাকার মঞ্চে মঞ্চস্থ বেশির নাটক দেখা বা পড়া হয়েছে সে কথা বলতে পারি। বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রথম ত্রিশ বছরে বিভিন্নভাবে প্রকাশিত নাটকগুলি প্রায় পড়ে ফেলার চেষ্টা করেছি। বাহাত্তর সাল থেকে উনিশশো নিরানব্বই সাল পর্যন্ত নাটকের গতি-প্রকৃতি নিয়ে যথেষ্ট ধারণা রয়েছে। দু-হাজার সালের পর থেকে সে-রকম দাবি করতে পারবো না। বিভিন্ন কারণেই নাটক দেখার সুযোগ কম ছিল। সবসময় নাটকগুলি পাঠ করার সুযোগ ঘটেনি। কিংবা কিছু নাটক পড়তে আরম্ভ করে আর শেষ করার ইচ্ছা হয়নি। দুই হাজার সালের আগেও বহু প্রকাশিত নাটক পাঠ আরম্ভ করে, কিছু পরেই পাঠ করার আগ্রহ হারিয়েছি কিন্তু তা সত্ত্বেও পাঠ সম্পন্ন করেছি। বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে যতো নাটক লেখা হয়েছে এখানে তার মধ্যে চারটি নাটক আমার কাছে অসম্ভব প্রিয়। সে চারটা নাটক হলো মান্নান হীরার ‘আগুনমুখা’, মলয় ভৌমিকের ‘হত্যার শিল্পকলা’, মাসুম রেজার ‘নিত্যপুরাণ’ আর সেলিম আল দীনের ‘বনপাংশুল’। মাসুম রেজার নিত্যপুরাণ বাংলাদেশের মঞ্চের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক।

বনপাংশুল নাটকের বিষয়বস্তুর চেয়ে শিল্পরূপকে নাসির উদ্দীন ইউসুফ তাঁর আলোচনায় অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন, তিনি মন্তব্য করেছেন, নাটকের বিষয়বস্তুর চেয়ে তার শিল্পরূপকে তিনি অধিক গুরুত্ব দেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে বনপাংশুলের বিষয়বস্তু বহুকাল গভীর মনোযোগের সঙ্গে আলোচিত হবে। বনপাংশুল নিয়ে দীর্ঘ একটি লেখা আছে আমার। হত্যার শিল্পকলা নিয়ে কিছুদিন আগে একটা লেখা লিখেছি যা রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘আনর্ত’ পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছে। বলতে গেলে এটা আমার একটা অপরাধ যে, নিত্যপুরাণ আর আগুনমুখা নিয়ে লিখলাম না কেন। বহু অজুহাত দিতে পারি, কিন্তু শেষ বিচারে না লেখাটা আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে দায়িত্ব অবহেলা করা।

বাংলাদেশের আরো কিছু নাটক বা প্রযোজনা আমার পছন্দের তালিকায় রয়েছে। পরে সেগুলি নিয়ে কথা বলবো। কিন্তু খুব দুঃখজনক যে হত্যার শিল্পকলার মতো একটি নাটক ঢাকায় মঞ্চস্থ হয়নি। নাটকটার মঞ্চায়ন দেখতে যাই কলকাতায়। কলকাতার বন্ধুরা নাটকটা মঞ্চায়ন করে, ঢাকা থেকে কলকাতায় নাটকটা দেখতেই গিয়েছিলাম। বহুসময় দেখি নাট্যবোদ্ধারা মন্তব্য করে বসেন যে, বাংলাদেশে ভালোমানের নাটক লেখা হয় না। কথাটা তাঁরা যে মিথ্যা বলেন বা ভুল বলেন তা নয়। কথাটা সঠিকই বলেন। কিন্তু সব নাটক হয়তো তারা পড়েন না। ফলে মাঝে মধ্যে যে খুবই উন্নতমানের নাটক লেখা হয় সেটা তাঁরা জানতে পারেন না। কখনো জানতে পারলেও প্রশংসা করার মতো বা পৃষ্ঠপোষকতা দেখানোর উদারতা তাঁদের থাকে না। বর্তমান শতকে নাট্যাঙ্গনে কয়েকজন তরুণ নির্দেশক চমৎকার সব নির্দেশনা দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে যেমন আছে ইউসুফ হাসান অর্ক, সুদীপ চক্রবর্তী; তার বাইরে সাইফ সুমন, বাকার বকুল প্রমুখ। নিশ্চয় তাদের মতো তরুণ না হলেও আছেন আজাদ আবুল কালাম, মাসুম রেজা। কিছু নাম হয়তো হঠাৎ এখন মনে করতে পারছি না। কিন্তু তাঁদের নিয়ে সেভাবে ব্যাপক আলোচনা হয়নি। বয়োজ্যেষ্ঠ নাট্যব্যক্তিত্বরা অনেকক্ষেত্রেই তরুণদের কাজকে সেভাবে মূল্যায়ন করেননি বা উৎসাহ জোগাননি।

বাংলাদেশে বহুসময় প্রশংসা বা উৎসাহ দেখানোটা পারিবারিক বা দলীয় গণ্ডীর মধ্যে আটকা পড়ে থাকে। নিজ দলের বাইরে অন্য দলের কাজকে খোলা মন নিয়ে প্রশংসা করার উদাহরণ কম। ফলে দেখা যায়, যা প্রশংসা পাবার নয় তা খুব প্রশংসা পেয়ে যায়, যা বহুগুণ প্রশংসা পাবার কথা তার ভাগ্যে সেটা জোটে না। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, প্রশংসা পাবার ক্ষেত্রে কর্মের চেয়ে ব্যক্তি-পরিচয় বড় হয়ে দাঁড়ায়। বহুজন হয়তো আমার এসব বক্তব্যে আহত হবেন। কমবয়সে যখন এসব নিয়ে কথা বলতে দ্বিধা করিনি এখন করার প্রশ্নই ওঠে না। কথাগুলি লিখবার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু পঞ্চাশ বছরকে সামনে রেখে মনে হচ্ছে কিছু কথা বলা দরকার। কারণ নাট্যগবেষক হিসেবে কিছু সত্য বলার দায় আমার রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার পছন্দের চারটি নাটক নিয়েই কথাটা আরম্ভ করেছিলাম। চারটি নাটকের তিনটি ঢাকার মঞ্চেই মঞ্চস্থ হয়েছে। নির্দেশনার মানও যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ছিল। কিন্তু নাটক তিনটি নিয়ে যে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা হওয়া দরকার ছিল তা হয়নি। নিঃসন্দেহে ‘থিয়েটারওয়ালা’ কিছু কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। দুর্ভাগ্য এই যে, প্রায় সময় সেখানে দেখা গেছে আলোচকরা বিষয়বস্তু থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে নিজেদের ভালো লাগা আর মন্দ লাগা নিয়ে কথা বলেছেন।

ব্যাপারটা প্রায় সেই ঋষিদের মতো, যারা উপনিষদ নিয়ে বছরের পর বছর তর্ক করে করে বিতর্কের পরিসর বাড়িয়েছে কিন্তু উপসংহারে পৌঁছাতে পারেননি। থিয়েটারওয়ালা পত্রিকার সম্পাদকীয়টা বরং বেশি উপভোগ করতাম। বিভিন্ন উচ্চমানের নাটকের ব্যাপক পরিচিতি না পাবার কারণ যে শুধুমাত্র অন্যদের পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়া তা কিন্তু নয়। নিশ্চয় কখনো কখনো সেটাও একটা কারণ। ধরা যাক ‘নিত্যপুরাণ’ নাটক নিয়ে বছরখানেক আগে একটা আলোচনা অনুষ্ঠান হয়েছিল। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের নাট্যঙ্গনের বয়োজ্যেষ্ঠ প্রধান ব্যক্তিত্বরা প্রায় কেউই ছিলেন না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, সকলের উপস্থিত থেকে এরকম একটা নাটককে বাহবা দেয়া দরকার ছিল। সকলে বাহবা না দিলেও সমস্যা নেই, কারণ নাটকটা বাহবা যা পাবার দর্শকের কাছ থেকেই পেয়েছে। সমালোচকরা বা বিদগ্ধ জনরা কেউই বলেননি যে নাটকটা উচ্চমানের নয়। ফলে নাটকটার সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন নেই।

বাংলাদেশে রচিত বিশ্বমানের নাটকগুলি নিয়ে যে ব্যাপক আলোচনা হয় না তার কারণ সবসময় ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধতা নয়, সবসময় যে অন্যরা ইর্ষা প্রদর্শন করেন তাও নয়। কারণ বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে নাট্য-সমালোচক নেই। বাংলাদেশের নাট্যজগতের পিছিয়ে পড়া বা পিছিয়ে থাকার ক্ষেত্রে চারটি কারণ খুব উল্লেখিত হওয়া দরকার। প্রথম কারণটি হলো, বাংলাদেশের নাট্যজগতের মানুষদের ব্যাপকভাবে পড়াশুনা করার আগ্রহ খুবই কম। দ্বিতীয় কারণটি হলো, সত্যিকারের নাট্য সমালোচকের অভাব। তৃতীয় কারণটি হলো, সমালোচনা সহ্য করতে না পারা। চতুর্থ কারণটি হলো, উচ্চমানের নাটক সেভাবে লিখিত না হওয়া বা যে-কয়টা লিখিত হয়েছে তা আবার নাট্য ব্যক্তিত্বদের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়া। ভিন্নদিকে আবার যা ঘটেছে, নাটক বলেই বিবেচিত হতে পারে না, তেমন কাউকে নানাভাবে বিরাট নাট্যকার বানিয়ে তোলা। কিছু কিছু মানুষের পক্ষপাতিত্ব এসব ক্ষেত্রে কাজ করে।

বাংলাদেশে এখন নাট্য নির্দেশক বা অভিনেতা-অভিনেত্রী কম আছে সেটা আর বলা যাবে না। বিশেষ করে বর্তমান শতকে কয়েকজন গুণী নির্দেশক এবং সেইসঙ্গে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য নাট্য অভিনেতা-অভিনেত্রী পাওয়া গেছে। বিনয়ের সঙ্গে মামুনুর রশীদ সম্পর্কে কয়েকটি কথা প্রসঙ্গক্রমে বলে ফেলি। গত শতকে মামুন ভাইর মঞ্চ-নাট্য নির্দেশনা তেমনভাবে আমাকে আকর্ষণ করেনি। কিন্তু বর্তমান শতকে তাঁর কয়েকটি নির্দেশনা আমাকে খুবই মুগ্ধ করেছে। বাংলাদেশে যে নাট্য-সমালোচকের অভাব রয়েছে সেটা নিয়েই কথা বলা যাক। বাংলাদেশে পরিচিত দলগুলির উদ্বোধনী নাটক মঞ্চায়নের পর কিছু কিছু পত্রিকায় ছবিসহ তার সমালোচনা ছাপা হয়। সত্যিকার অর্থে কি সেটাকে সমালোচনা বলা যাবে? নাট্যদলটি যদি ব্যাপক পরিচিত হয়, দলের সদস্যরা যদি তারকা বা বড় নাট্য ব্যক্তিত্ব হন তখন সমালোচনার ধরন হয় সাধারণত প্রশংসামূলক। নাটকের প্রচারটাও বেশি হয়। কিন্তু পত্রিকাগুলির যা করা উচিৎ তাহলো, নতুন দলগুলি কখনো ভালো প্রযোজনা করলে সেটার প্রচারণা জোরেশোরে চালানো যাতে তারা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারে। কিন্তু সেটা হয় না। বরং বলা সঠিক হবে, বাংলাদেশে নাট্য দলগুলিই সার্বিকভাবে পত্রিকাগুলির কম প্রচার পায়, বরং খেলা বা খেলোয়ারদের নিয়ে তার চেয়ে বহুগুণ মাতামাতি করা হয়।

ব্যবসায়িক লক্ষ্য মাথায় রেখেই তারা এটা করে। ফলে সে প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে ভিন্ন একটি প্রশ্ন করা যাক, পত্রিকাগুলি নাট্য-সমালোচনা করার দায়িত্ব যাদেরকে দেন সত্যিই কি তাঁরা সে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা রাখেন? নাট্য সমালোচনা করতে বসেন তাঁরা কী যোগ্যতা নিয়ে? ধরা যাক, বনপাংশুল বা আগুনমুখা কিংবা নিত্যপুরাণ নাটক নিয়ে কথা বলা বা সমালোচনা লেখা কি যার-তার পক্ষে সম্ভব? না, মোটেই না। সমালোচকের নাট্যবোধ বা জ্ঞান অবশ্যই নাট্যকার, নিদের্শক এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চেয়ে উর্ধ্বে হতে হবে। মঞ্চকর্মটি সম্পূর্ণ সমালোচকের দখলে থাকতে হবে। সেরকম মানুষরা কি নাট্যসমালোচনা লেখার কাজটি করেন?

পশ্চিমবঙ্গের নাট্যকার, নাট্যবোদ্ধা, নাট্য-সমালোচক দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, সমালোচনা প্রকৃত মানদণ্ড নিরূপণ মোটেই সহজ কাজ নয়, সমালোচককে আসলে শিক্ষকের ভূমিকাই গ্রহণ করতে হয়। একদিকে লেখক বা শিল্পীর ভুলত্রুটিগুলো দেখিয়ে দিয়ে সমালোচক যেমন তাঁকে সতর্ক করে দেবেন, আর একদিকে তিনি পাঠক বা দর্শকের দৃষ্টি খুলে দেবেন যে কীভাবে সাহিত্য পড়তে বা শিল্প দেখতে হয়। শিল্প বা সাহিত্যের কঠিন আবরণ দেখে অচেতন ও অনুন্নত রুচির পাঠক বা দর্শকরা সৎ সাহিত্য বা সু-শিল্পের প্রতি বিমুখ হতে পারেন। সমালোচকের কর্তব্য সেই কঠিন আবরণ ভেঙে ভেতরের মুক্তোটি বার করে দেখানো। সেইজন্যেই সমালোচকের মানদণ্ডটি সঠিক হওয়া দরকার। প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য-শিল্পকলা সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। বিভিন্ন যুগে ইতিহাসকে অবলম্বন করে কীভাবে শিল্প-সাহিত্যের জন্ম হয়েছে আর সমসাময়িক শিল্প-সাহিত্যই বা ইতিহাসের কোন্ শর্ত পালন করছে এই পূর্বপর ধারণা থাকা উচিত যিনি সমালোচনা করবেন তাঁর। শিল্প-সাহিত্যে প্রতিটি যুগের সামাজিক প্রতিফলন থাকে বলেই প্রত্যেক যুগেরই শিল্প-সাহিত্য মূল্যায়ন করার সময়ে সেই যুগের সামাজিক ইতিহাস জানতে হয়। সমাজের কোন্ ধারণা শিল্পে প্রতিফলিত হয়েছে আবার সেই শিল্পের প্রভাব সমাজের ওপর কীভাবে কতখানি পড়েছে তা বিশ্লেষণ ও বিচার করে রায় দেবার দায়িত্ব সমালোচকের। সেইজন্যেই সমালোচক শুধু একজন মামুলী আলোচক নন, তিনি ভাষ্যকার।

দিগিন্দ্রচন্দ্র খুব সঠিক কথাটি বলেছেন। ধরা যাক রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটকটি। সাহিত্য বা নাট্যকর্মের উপর দখল রয়েছে সেইরকম কেউ একজন খুব সহজেই বিসর্জন নাটকটির সমালোচনা করতে পারবেন। নাটকের দর্শন বা তার সাহিত্য মান নিয়ে কথা বলতে সামান্য অসুবিধা হবে না তাঁর। প্রতিটি চরিত্রের যথাযথ ব্যাখ্যা করে দেবেন নির্দ্বিধায়। কিন্তু নাটকের বিষয়বস্তু নিয়ে তিনি সামগ্রিক-আলোচনা করতে পারবেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের দিকে ফিরে না তাকাবেন। কারণ নাটকটির বিষয়বস্তুর সঙ্গে ভারতের প্রাচীন যুগের ইতিহাসের একটি অধ্যায় জড়িত। সেটা হলো ব্রাহ্মণ্যধর্মের সঙ্গে জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মের লড়াই। রবীন্দ্রনাথ নিজে মাংস খেতেন কিনা জানি না। কিন্তু তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাংস খেতে বারণ নেই। তিনি তাহলে বলির বিরুদ্ধে নাটক লিখতে গেলেন কেন? বৈদিকধর্মের বিভিন্ন পূজার সঙ্গে বলির সম্পর্কটি খুব ঘনিষ্ঠ। সবচেয়ে আশ্চর্য বিসর্জন নাটকে একজন বৈদিক রাজা বলির বিরুদ্ধে কথা বলছেন। বিসর্জন নাটকটির বিষয়বস্তু নিয়ে তিনি একটি বড় গল্প লিখেছেন ‘দেবর্ষি’ নামে, সেখানে ঘটনাটা আরো কিছুটা বিস্তৃত। ভারতে পশুবলির বিরুদ্ধে প্রথম কথা বলেন মহাবীর আর পরে বুদ্ধ প্রায় সমসাময়িককালে। ইতিহাসের সে অধ্যায়টি ব্যাপকভাবে না জানলে রবীন্দ্রনাথের এ নাটকের বিষয়বস্তুকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা কঠিন।

নাটকের সমালোচনা করা তাই খুব সহজ কাজ নয়। মহাভারত পাঠ না করা থাকলে কি নিত্যপুরাণের বিষয়বস্তু সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে সমালোচনা করা সম্ভব? দিগিন্দ্রচন্দ্র তাই বলছেন, শিল্প-সাহিত্যের সমালোচনার মানদণ্ডের ভিত্তি হওয়া উচিত সমাজবিজ্ঞান সম্মত। সমাজবিজ্ঞান রহিত সমালোচনার নিন্দা বা প্রশংসা মূল্যহীন। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিরহিত চিন্তা ও খণ্ডিত বোধ থেকেই অনেক সময় রচনার বিষয়বস্তু ও ভাবসম্পদকে বাদ দিয়েই তার রূপকর্ম, শৈলী ও আঙ্গিকের দোষগুণ বিচার করা হয়। শিল্পে যে কথা বলা হলো এবং যা বলার জন্য বিষয়বস্তু আনা হলো তার দোষগুণই প্রথমে বিচার্য। তারপর বিচার করতে হয় যে ভাবটি বা যে অনুভূতিগুলি প্রকাশ করতে চাওয়া হয়েছে সেটির; দেখতে হবে তা পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পেয়েছে  কি না। পরবর্তী বিবেচ্য হলো, ভাবপ্রকাশের জন্য যে বিষয়বস্তু আনা হয়েছে তা ভাব প্রকাশের সহায়ক কি না এবং বিষয়বস্তুর রচনা কাঠামো সঠিক পথ ধরে চলেছে কি না। নাটকে আখ্যান রচনা বা গল্পবলার ক্ষেত্রে ঘটনাপরম্পরা রক্ষা করাটা জরুরি। দিগিন্দ্রচন্দ্র মনে করেন, শিল্প-সাহিত্যের প্রকৃত বিচার করতে হলে যে সমাজ থেকে তার উৎপত্তি সেই সমাজের সমগ্র কাঠামোটি সম্পর্কে সমালোচকের স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। শিল্পস্রষ্টা সমাজের একটা বিশেষ অবস্থার ভাব প্রকাশ করতে এবং চিত্র তুলে ধরতে পারেন; কিন্তু সমালোচকের দায়িত্ব সমাজের অন্যান্য অঙ্গের সঙ্গে সেই অবস্থার আপেক্ষিক সম্পর্কটি কী তা তুলে ধরা। তখন দর্শকের, এমন কি শিল্পস্রষ্টারও আপেক্ষিকবোধ জন্মায়।

ফলে নাটকের সমালোচনা করাটা শুধুমাত্র ইচ্ছার ব্যাপার নয়, সামর্থ্যেরও ব্যাপার। সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ কি না, সমাজ-বিশ্লেষণে তিনি পারদর্শী কি না এবং সমাজবিজ্ঞানের প্রেক্ষাপটে মানবমনের মনস্তত্ত্ব বিচারে তিনি দক্ষ কি না; সবকিছুই সেখানে বিচার্য। বাংলাদেশে যাঁরা পত্রপত্রিকায় নাট্য-সমালোচনা লেখেন, সকলে কি সেই যোগ্যতা রাখেন? বা কজন আছেন যাঁরা  দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিচারে সমালোচক হবার যোগ্য? সমাজে অসংখ্য উপাদান ছড়িয়ে রয়েছে। তা থেকে উপাদান সংগ্রহ করে কোনো শিল্পী বা সাহিত্যিক যখন কিছু রচনা করেন তখন তাতে স্রষ্টার নিজের কল্পনা, আবেগ, মতাদর্শ, জীবনদৃষ্টি, চিন্তাভাবনার প্রভাবও পড়ে। সমাজ সম্পর্কে স্রষ্টার মনোভাব তার দ্বারা প্রতিফলিত হয়। সেজন্য সমালোচককে শুধু রচনার উপাদান সমূহ বিশ্লেষণ করলেই চলে না; সে-সব উপাদান ব্যবহারে স্রষ্টার যে মনটি কাজ করেছে তাও খুঁজে বার করতে হয়। নিশ্চয় তা করতে গেলে সমাজের কোন্ অংশের প্রতি নাট্যকারের সমর্থন বা বিরূপতা সেটা বুঝতে হয়। সে-কারণে কোনো যুগের শিল্প-সাহিত্যের যথার্থ মূল্যায়ন করতে হলে সে-যুগের সামাজিক কাঠামো, ধারণা, প্রধান প্রবণতা ও লক্ষণগুলো সম্পর্কে সমালোচকের সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকা দরকার।

ইউরোপে খ্রিষ্টধর্মের একাধিপত্য, কনস্টানটিনোপলের পতন, পাশ্চাত্যের নবজাগরণ এবং গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার উন্মেষ সম্পর্কে না জেনে শেক্সপিয়ারের নাটকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। শিল্পের বিশেষ ও নির্বিশেষ রূপ থাকে এবং সেই অনুুসারে তার আবেদনে পার্থক্য ঘটে। সমালোচকের দায়িত্ব শিল্পের বিশেষ আর নির্বিশষ রূপ সম্বন্ধে সচেতন থাকা। যাঁরা শক্তিমান শিল্পী তাঁরা জটিল সমস্যা এবং কঠিন বিষয়বস্তুকে অসাধারণ শিল্পচাতুর্যের দ্বারা সহজবোধ্য করে তুলতে পারেন। লক্ষ লক্ষ লোকের কাছে তার আবেদন অনায়াসে পৌঁছে যায়। ভিন্ন দিকে এমন স্রষ্টাও আছেন যিনি একটি সাধারণ বস্তুকে অনন্য শিল্পনৈপুণ্যের দ্বারা লক্ষ লক্ষ লোকের হৃদয়গ্রাহী করে তোলেন। চলচ্চিত্রের জগতে চার্লি চ্যাপলিন দুটি ক্ষেত্রেই সেরকম ক্ষমতা রাখতেন। সর্বসাধারণের কাছে ছিল তার চলচ্চিত্রের আবেদন, সমাজের বিশেষ কোনো ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কাছে নয়। পাশাপাশি এ কথাও সত্য, সমাজের সর্বস্তরের শিল্পরুচি ও চেতনা সমান নয়; তাতে স্তরভেদ বা পার্থক্য রয়েছে। সমাজের অগ্রসর মানুষের কাছে শিল্পের বিশেষ যে রূপটি গ্রহণযোগ্য, বাকি পশ্চাদপদ মানুষের কাছে তা বোধগম্য নাও হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন রক্তকরবী, মুক্তধারা, রাজার মতো গভীর ভাবোদ্দীপক নাটক। সকল মানুষের পক্ষে সেদিন তার রস গ্রহণ করার মতো উন্নত রুচি বা চেতনা ছিল না, বর্তমানেও নেই। কিন্তু সে-সব নাটকের বিরাট আবেদন ছিল বিদগ্ধ মানুষের কাছে, বর্তমানে তাদের সংখ্যা কিছু বেড়েছে।

বিশ্বের কিছু চিরায়ত সৃষ্টি আছে যা সাধারণের কাছে দুর্বোধ্য হলেও বোদ্ধার কাছে দুর্বোধ্য নয়। সমালোচকের দায়িত্ব হচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে যা দুর্বোধ্য বলে মনে হয়, সেই তথাকথিত দুর্বোধ্যতার পাচিল ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করা এবং তার অন্তর্নিহিত রস এবং তত্ত্বটি বার করে আনা। তখন হয়তো দেখা যাবে সেই রস ও তত্ত্বের সঙ্গে বৃহত্তর সমাজজীবনের সংস্পর্শ রয়েছে। ফলে নাট্য স্রষ্টার যেমন উদ্ভাবনী শক্তি থাকা দরকার, সমালোচকেরও তেমনি অনুধাবনযোগ্য কল্পনাশক্তির প্রখরতা থাকা আবশ্যক। সমালোচককে অনুভূতিশীল হতে হবে। কল্পনা আর অনুভূতির অভাবে সমালোচকের কাছে অনেক সময় শিল্পের মুখ্য দিকটাই প্রধান হয়ে ওঠে, গৌণ দিকটা দৃষ্টিরা বাইরে থেকে যায়। কিন্তু সেগুলি বাদ দিলে বহু সময় শিল্পের বিচারে ভুল হয়, মহৎ শিল্পের নানা দিক থাকে; বহু ভাবের সমাবেশ ঘটে তাতে। সমালোচকের সবকিছুর উপরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলা চাই। বাংলাদেশের কয়টি নাটকের সমালোচনায় এ-সকল বিষয় লক্ষ্য করা যায়? কজন সবদিকে গভীর মনোনিবেশ করে নাট্য সমালোচনা করেন? বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় বা নাট্যপত্রে প্রায় সময়েই সংক্ষিপ্তভাবে নাটক নিয়ে যা লেখা হয়, সেগুলিকে নাট্য সমালোচনা না বলে বরং নাট্যসংবাদ বলা যুক্তিযুক্ত।

নাটক নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কিছু লেখালেখি আমি করেছি। পত্রপত্রিকায় নয়, গ্রন্থে বা গবেষণাপত্রে। সম্ভবত নাটকের সমালোচনা বা মঞ্চস্থ নাটক নিয়ে প্রথম লিখি “থিয়েটার” পত্রিকায় উনিশশো পঁচানব্বই সালে। ফ্রিতস বেনিভিৎস ব্রেশটের মান ইস্ট মান নাটকটির বাংলা অনুবাদ ঢাকায় নির্দেশনা দিয়েছিলেন ‘লোক সমান লোক’ নামে আইটিআই বাংলাদেশের হয়ে। নাটকটি মঞ্চস্থ হবার পর থিয়েটার পত্রিকার সম্পাদক রামেন্দু মজুমদার কথা প্রসঙ্গে আমার কাছে জানতে চাইলেন, নাটকটি আমার কেমন লেগেছে। বললাম যথেষ্ট ভালো; বিষয়বস্তু আর নির্দেশনা দুটোই। রামেন্দুদা বললেন, থিয়েটার পত্রিকায় নাটকটার একটা সমালোচনা ছাপাতে চাই কিন্তু পাচ্ছি না। রামেন্দুদা জানতে চাইলেন, নাটকটা সম্পর্কে আমি কিছু লিখতে ইচ্ছুক কি না। বললাম, যদি আপনি বলেন লিখতে পারি। রামেন্দুদাকে আরো বললাম, গবেষণার খুব চাপে রয়েছি, যদি অন্যের কাছ থেকে লেখা এর মধ্যে পেয়ে যান খুব ভালো। না পেলে তখন আমি লিখবো। রামেন্দুদা কিছুদিন পর আমাকেই লিখতে বললেন। রামেন্দুদাকে তখন জানালাম, আমার লেখাটা প্রথাগত সমালোচনার মতো হবে না, হয়তো দীর্ঘ হবে। রামেন্দুদা তাই মেনে নিলেন। নাটকটা নিয়ে যখন লিখবো ঠিক করেছি, কয়েকজন বললেন নাটকটা দর্শকদের মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে। কথাটা শুনে বিস্মিত হইনি মোটেও।

নাটকটার প্রকাশভঙ্গিই এমন যে, কারো কারো কাছে দুর্বোধ্য লাগতেই পারে। কারণ নাটকটার বিষয় পুঁজিবাদের চরিত্রকে প্রস্ফুটিত করা। যদি একটা সমাজের শিক্ষাধারা বা আলোচনা-সমালোচনায় পুঁজিবাদের মুনাফার চরিত্র নিয়ে খুব বেশি আলাপচারিতা না হয়, সেখানে চট করে মান ইস্ট মান নাটকের বিষয়বস্তুকে বুঝে ফেলা কঠিন। প্রথম মহাযুদ্ধের আঘাতে পর জার্মানীর সমাজ ব্যবস্থায়, বিভিন্ন আড্ডায় পুঁজিবাদের নগ্ন রূপ যেভাবে ধরা পড়েছিল কিংবা বিরাট পরিমণ্ডলে তা নিয়ে নিত্যদিনের কথাবার্তা চলছিল; বাংলাদেশের অবস্থাটা তেমন ছিল না। নাটকটা নিয়ে সমালোচনা করা বা কিছু লিখবার জন্য বন্ধুদের বা বিভিন্ন দর্শকদের মন্তব্যগুলি আমার কাজে লেগেছিল। ভাবলাম নাট্য সমালোচনায় ব্রেশটের নাটকের চিন্তা-ভাবনা আর ‘মান ইস্ট মান’ বা ‘লোক সমান লোক’ নাটকের বিষয়বস্তু নিয়ে প্রধানত কথা বলবো। নাট্যকার বিষয়বস্তুর মধ্যে কীসব ধারণা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন সেটা নিয়েই আলোচনা করবো। নাট্য প্রযোজনার চেয়ে নাটকটাই হয়ে উঠুক আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু। মাথার মধ্যে তখন আর একটা বিষয় কাজ করছিল। বাংলাদেশে ঢাকার মঞ্চে আর ভারতের কলকাতার মঞ্চে ব্রেশটের বিভিন্ন নাটকের মঞ্চায়ন হয়েছিল। মঞ্চায়িত সেসব নাটক নিয়ে নানারকম সমালোচনা ছিল। বহুজনই আবিষ্কার করেছিলেন, মঞ্চায়িত নাটকগুলির অনুবাদে মূল বিষয়বস্তু থেকে সরে গিয়ে নাটকের হাসির জায়গাগুলিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। সত্যিকারভাবে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ব্রেশটের মতাদর্শগুলি সেখানে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নিঃসন্দেহে সে-অভিযোগগুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সত্যি ছিল। বহুজনের সঙ্গে উৎপল দত্ত এই ভয়াবহ অভিযোগটি তুলেছিলেন। থিয়েটার পত্রিকায় সেই লেখাটিতে এ প্রসঙ্গটি বা সেই সমালোচনাটির কথা আমি উত্থাপন করে বলার চেষ্টা করেছিলাম যে, সত্যিকারভাবে ব্রেশটের নাটক দেখার স্বাদ পাওয়া গেল লোক সমান লোক নাটকে।  

যদিও ঢাকা এবং চট্টগ্রামে মঞ্চস্থ ব্রেশটের দুটো নাটকের প্রশংসা করেছিলাম রচনাটিতে। রচনাটি ছিল বিশ পৃষ্ঠার বেশি। সেখানে নাটকটা রচনার সময়কাল, নাটকটা রচনা করার পর কতোবার পরিবর্তন করা হয়েছে, নাটকটার ভিতর দিয়ে ব্রেশট পুঁজিবাদের কোন্ দিকগুলিকে তুলে ধরতে চান; ইত্যকার নানা বিষয়ে আলোচনা করা হয় বিষয়বস্তুর নানা ব্যাখ্যা সহ। নাটকটার সমালোচনা থিয়েটার পত্রিকায় যখন প্রকাশিত হয় তার কিছুদিন আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত ফ্রিতস বেনেভিৎস মারা যান। থিয়েটারে লেখাটি প্রকাশিত হবার কিছুদিন পর ঘটনাচক্রে আমি সেদিন দুপুরের খাবারের পর ঝুনা চৌধুরীর কার্যালয়ে বসে রয়েছি। হঠাৎ ঝুনার কাছে ফোন এলো নাট্য জগতের এক মহারথীর কাছ থেকে। ঝুনা আমাকে ইঙ্গিত করলেন কথা না বলতে। ব্যাপারটা হলো, যিনি ঝুনাকে ফোন করেছেন, তিনি ফোন করেছেন থিয়েটারে প্রকাশিত আমার লেখাটা নিয়ে। ঝুনাকে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার বন্ধু রাহমান চৌধুরী থিয়েটার পত্রিকায় একটা লেখা লিখেছেন। ফ্রিতস বেনেভিৎসের নির্দেশিত ‘লোক সমান লোক’ নাটক সম্পর্কে লিখতে গিয়ে সেখানে আমাদের দলের ব্রেশটের প্রযোজনা নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে। কাজটা সে মোটেই ভালো করেনি। তোমার বন্ধুকে বলবে এর জন্য ক্ষমা চেয়ে আর একটি লেখা পাঠাতে।’ ঝুনার সঙ্গে মহারথীর ফোনালাপের এটাই ছিল সারমর্ম।

ঝুনা চৌধুরী তাঁকে জবাবে বলেছিলেন, ‘যার সম্পর্কে বলছেন সে না বুঝে শুনে বা যুক্তি ছাড়া কিছু লেখে না বলেই আমি জানি। যদিও তার লেখাটা আমি এখন পর্যন্ত পড়িনি। নিশ্চয় আপনি যদি চান আমার বন্ধুকে আপনার কথাটা আমি জানিয়ে দেবো। রাহমানকে আপনার কথাগুলি পৌঁছে দিতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু সে আপনার কথাকে কতোটা পাত্তা দেবে সে নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। বরং উল্টো কিছু না ঘটে যায়।’ তিনি ঝুনার কাছে জানতে চাইলেন ‘সেটা কী রকম’। ঝুনা তাঁকে বললেন, ‘রাহমান তো লোক সমান লোক সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কয়েক লাইনে সমালোচনা করেছে আপনাদের নাটকের। কিছু প্রশংসাও করেছে। কিন্তু যখন রাহমানকে বলবো আপনি তাঁকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন বা ক্ষমা চেয়ে একটি লেখা লিখতে বলেছেন, তখন সে সত্যিই একটা লেখা লিখে বসতে পারে। কিন্তু ক্ষমা চেয়ে নয়। দু লাইনে যে সমালোচনাটা লিখেছে এবার সেটা বিরাট আকারে এত বড় করে লিখবে এবং এমন যুক্তি দিয়ে, হয়তো তার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে কিছুই লেখার থাকবে না আপনাদের। বলেন, এখন কী করবো, রাহমানকে কি আপনার কথাটা বলবো? তিনি তখন ঝুনাকে বললেন, না থাক কিছু বলার দরকার নেই। যা বলছিলাম কিছু আগেই, বাংলাদেশের নাটকের খুব অগ্রগতি না হবার সঙ্কট সম্পর্কে; ভালো সমালোচক যেমন নেই আবার সমালোচনা শুনবার বা সহ্য করবার সংস্কৃতি নেই নাট্য জগতের মানুষদের। নিজে আমি আইটিআই-এর সদস্য না হয়ে বিনা পারিশ্রমিকে কয়েকদিন পরিশ্রম করে বিশ পৃষ্ঠার একটা লেখা লিখলাম আইটিআই প্রযোজিত নাটক সম্পর্কে, সেটার জন্য ধন্যবাদ দেয়া তো দূরের কথা; বরং প্রসঙ্গক্রমে ব্রেশটের দুটা নাটকের দু-তিন লাইন সমালোচনা করার জন্য ক্ষমা চাইতে বলছেন নাটকের এক মহারথী। নাট্য সমালোচনা তাহলে এখানে আগাবে কী করে? বহু জনের মুখে শুনেছি, সত্যমিথ্যা জানি না, ঢাকার বিশেষ একটি দলের নাট্য মঞ্চায়ন শেষে দর্শকরা সমালোচনা করলে সে দলের কর্মী এবং অভিনেতারা খারাপ ব্যবহার করতেন দর্শকদের সঙ্গে। নাটকের মঞ্চে বিপ্লবী, মঞ্চের বাইরে পেশীশক্তি! যতি সত্যি এমনটা হয়ে থাকে সেখানে কেমন করে নাট্য-সমালোচনা দাঁড়াবে? ঝুনা চৌধুরীর কক্ষে সেদিনের সেই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, নাটক নিয়ে আর সমালোচনা লিখবো না। রামেন্দুদা পরে দু-এবার দু-একটা নাটক সম্পর্কে আমাকে লিখতে বললে আমি আর রাজি হইনি। ঝুনার কক্ষের ঘটনাটা কখনো তাঁকে আমি বলিনি। বাংলাদেশের নাট্যপত্রিকায় কখনো লিখবো না প্রায় তেমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু রামেন্দুদার কারণেই আবার তিনবছর পর থিয়েটার পত্রিকায় লিখতে হলো ব্রেশটকে নিয়ে।

যখন রামেন্দুদা লিখতে বলেন, প্রথম আপত্তি করেছিলাম। প্রথমত লিখবার ইচ্ছা ছিল না, দ্বিতীয়ত গবেষণা নিয়ে খুবই ব্যস্ত তখন। রামেন্দুদা বললেন, থিয়েটার পত্রিকায় ব্রেশটের শততম জন্মবার্ষিকীতে কিছুতে একটা লিখতে হবে ব্রেশট সম্পর্কে। কিন্তু কারো কাছ থেকে লেখা পাচ্ছি না। রামেন্দুদাকে তারপর না বলার ধৃষ্টতা আমার ছিল না। রামেন্দুদাকে নানা কারণেই ভিতরে ভিতরে সবসময়ই আমি পছন্দ করি। রামেন্দুদার মুখের উপর স্পষ্ট কথা বলি কিন্তু মানুষ হিসেবে তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করি। ফলে লিখতে হলো। থিয়েটার পত্রিকাটার প্রতিও আমার বিশেষ একটা দুর্বলতা ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপর তখন চমৎকার একটা নাট্যপত্রিকা বের করছিলেন রামেন্দুদা। পরে যদিও সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেননি। জানি না কেন। হতে পারে লেখার অভাব, হতে পারে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, হতে পারে পাঠকের অভাব। থিয়েটার পত্রিকাটা যে সেভাবে আগাতে পারলো না সে নিয়ে আমার মনে একটা দুঃখ আছে। কলকাতা থেকেও তখন এই মানের পত্রিকা বের হতো না। নৃপেন্দ্র সাহা বহু পরে কলকাতা থেকে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ প্রকাশ করতে শুরু করেন। থিয়েটারের প্রথম দশ বছর বলতে হবে খুবই কার্যকর সময়। স্বাধীনতা পরবর্তী নাটক নিয়ে গবেষণা করতে চাইলে এ পত্রিকার সহযোগিতা নেয়া আবশ্যক। নিজে আমি সে সহায়তা নিয়েছি ঢাকার বাইরের নাট্যচর্চা সম্পর্কে জানতে গিয়ে এবং সত্তর দশকের নাট্যচর্চাকে বুঝতে গিয়ে।

থিয়েটার পত্রিকায় প্রথম পাঁচ সাত বছরে চমৎকার একটা সমালোচনার ধারা গড়ে উঠেছিল। খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটা। বশির আল হেলাল, মমতাজউদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান, শাহরিয়ার কবির, আনু মুহাম্মদ, নুরুল করিম নাসিম, আলী আনোয়ার, হাসান ফেরদৌস, অসীম সাহা, মাহবুব জামিল, মনোরঞ্জন বিশ্বাস, ফারুখ ফয়সল, উর্মি জাহাঙ্গীর, আসাদুজ্জামান নূর এরকম অনেকে লিখতেন।  কিন্তু সেই ধারাটা হারিয়ে গেল। স্পষ্টবাদী এবং সাহসী সেই ধারাটা না হারিয়ে গেলে, বাংলাদেশের নাটক হয়তো আজ ভিন্ন দিশা খুঁজে নিতে পারতো। সমালোচনা গ্রহণ করতে বা আত্মসমালোচনা করতে যেন তখন আর কেউ রাজি ছিলেন না। সকলেই নিজ নিজ দলের প্রচার আর প্রসারে মনোযোগ দিলেন। সমালোচনা করবার সাহস আর সক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে যাচ্ছিলো ধীরে ধীরে। ভিন্ন দলের সমালোচনা গ্রহণ করলেও, নিজ দলের সমালোচনা গ্রহণ করতে রাজি নন অনেকে। ইত্যকার নানান ঘটনার মধ্যেই গত শতকে যথেষ্ট প্রশংসা করার মতো কয়েকটি নাট্য প্রযোজনা পাওয়া গেল বিভিন্ন দলের। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় আর থিয়েটারের যৌথ প্রযোজনা ‘ম্যাকবেথ’, নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের ‘ গ্যালিলাই গ্যালিলিও’, থিয়েটারের ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’, ঢাকা থিয়েটারের ‘বনপাংশুল’, আরণ্যক ‘আগুনমুখা’, ঢাকা পদাতিকের ‘বিষাদ সিন্ধু’, নাট্যকেন্দ্রের ‘ক্রুসিকল’, প্রাচ্যনাটের ‘এ ম্যান ফর অল সিজন’, থিয়েটার আর্ট ইউনিটের ‘কোর্ট মার্শাল’, কণ্ঠশীলনের ‘পুতুল খেলা’ ইত্যাদি। গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়ের শেষ সংলাপ নাটকটিও খুব মানসম্পন্ন ছিল। নাটকের বিষয়বস্তু আর প্রযোজনা মিলিয়ে যেগুলিকে সেরা মনে হয়েছে তার নাম উল্লেখ করলাম নিজের ব্যক্তিগত অভিমত থেকে। সকলের একমত হবার কিছু নেই। নিঃসন্দেহে এর মধ্যে গত শতকের সর্বশ্রষ্ঠ প্রযোজনা ছিল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের গ্যালিলিও।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এসব নাটকগুলি নিয়ে যে খুব বড়মাপের সমালোচনা লেখা হয়েছে তা নয়। নাটকগুলি সম্পর্কে ভবিষ্যতে আগ্রহী গবেষকদের খুব জানবার সুযোগ নেই। কিন্তু সবগুলিই নাটকই খুব উল্লেখযোগ্য ছিল। নাটক বিচারের এখানে আমার প্রধান শর্ত নাটকটা দর্শকের চেতনাকে কতোটা ঘা দিতে পেরেছে কতোটা দর্শককে ভাবাতে পেরেছে। সবসময় যে সেটা রাজনৈতিক নাটক হতে হবে তা নয়, সামাজিক নানা দ্বন্দ্ব বা মানবিক নানা প্রশ্নেও সেটা হতে পারে। কিন্তু নাটকটা বক্তব্য প্রকাশে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছে কি না, সেটা বক্তব্যগুলির মধ্যে যুক্তি পরম্পরা রক্ষিত হয়েছে কি না তা অবশ্যই বিচার্য। যুক্তি পরম্পরা রক্ষা না করে খাপছাড়াভাবে কিছু সুন্দর কথা বললে বা অসংলগ্নভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করলে সেটা শক্তিশালী নাটক বলে বিবেচিত হতে পারে না, সে নাটকের অভিনয় আর মঞ্চায়ন পরিকল্পনা যতো ভালো হোক। দর্শককে জনগণের পক্ষে কতোটা ভাবাতে পেরেছে, ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে নতুনভাবে দর্শকের চিন্তাচেতনাকে কতোটা শানিত করতে পেরেছে সেটা নাটক বিচার করার সময় বিবেচনায় রাখতেই হবে। ঠিক তার পরেই আসবে অন্যান্য কথা, নান্দনিকবোধ, অভিনয় বা নাটকের সার্বিক মঞ্চায়ন প্রসঙ্গ। নাটক যদি সামগ্রিকভাবে দর্শকের চেতনাকে আপ্লুত করতে না পারে, তাহলে তার মঞ্চসজ্জা, অভিনয়, আবহসঙ্গীত বা শব্দ পরিকল্পনা, পোষক-পরিচ্ছদ আর আলোকসজ্জার সাফল্যে খুব বেশি কিছু যায় আসে না।

যখনকার কথা বলছি তখন আরো কিছু ভালো মানের প্রযোজনা পাওয়া গিয়েছিল। ঢাকা পদাতিকের ‘জনতার শত্রু’, পদাতিকের ‘মা’, নাট্যচক্রের ‘ককেশিয়ান চক সার্কল’, ঢাকা থিয়েটারের ‘কিত্তনখোলা’, ‘হাতহদাই’; থিয়েটারের ‘স্পর্ধা’, নন্দনের ‘কন্যাদান’, ঢাকা ড্রামার ‘ভাঙ্গা মানুষের পালা’, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’, ‘নূরুলদীনের সারা জীবন’, নাট্যকেন্দ্রের ‘জেরা’, দেশ নাটকের ‘দর্পণে শরৎশশী’, চট্রগ্রামের তীর্যকের প্রযোজনা ‘সমাধান’। কিছু নাটকের নাম হয়তো স্মরণে না আসতে পারে। কয়েকটি নাটকের নাম প্রযোজনা হিসেবে উল্লেখ না করলেও সেসব নাটকে কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয় ছিল প্রশংসনীয়। সকলকে বলে রাখি, নাটকগুলি বাছাই করার সময়ে সবার আগে গুরুত্ব দিয়েছি নাটকের বিষয়বস্তুকে আর সত্তর দশকের নাটকগুলিকে এর মধ্যে ধরা হয়নি। নব্বই আর আশির দশকের নাটক সম্পর্কে বলা হচ্ছে। সত্তর দশক নিয়ে হয়তো আলাদা ভাবে লিখতে পারি। বর্তমান এই আলোচনার ক্ষেত্রে আর একটি কথা স্মরণ করতে চাই, ঢাকার অনেক দল খুব লড়াই করে নাটক প্রযোজনা করার চেষ্টা করেছে সেই সময়কালে। সেই সব দলে তারকা ছিল না, হয়তো সেভাবে অভিনেতা-অভিনেত্রী জোগাড় করার সুযোগ ছিল না, সেরকম আর্থিক সঙ্গতি ছিল না, নিজ দলের নাট্যকার বা উপযুক্ত নির্দেশক ছিল না, পত্র-পত্রিকার প্রচার সেভাবে পায়নি; ফলে তাদের নাটকের মান দুর্বল হওয়া স্বাভাবিক ছিল। বর্তমান শতকে সেরকম কয়েকটি দল কিন্তু উঠে এসেছে। পরের পর্বে তা নিয়ে লিখবো। চলবে