রক্তকরবী নাটকের একটি দৃশ্য

রক্তকরবী নাটকের একটি দৃশ্য

নাট্য সমালোচনা এবং সমালোচনা গ্রহণ না করবার প্রবণতা

পর্ব ২

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২০

নব্বইয়ের দশকে আশির দশকে অনেক নাটক হয়েছে যার সব নাম এখানে আসেনি। সব নাটক আমার দেখা হয়নি কথাটা সত্যি, যা দেখা হয়েছে সেগুলির মধ্যে সবগুলিকে নাটক হিসেবে উল্লেখ করার যোগ্য মনে করিনি আমি। বহু দল তাদের প্রযোজিত নাটককে শ্রেষ্ঠ মনে করতে পারে, বহু দর্শকের কাছে তা প্রশংসা পেতে পারে; কিন্তু একজন সমালোচক সার্বিক বিচারে সেগুলিকে আলোচিত নাট্য হিসেবে বিবেচনা নাও করতে পারেন। গত শতকের হয়তো আবার কিছু ভালো প্রযোজনা অনিচ্ছাকৃতভাবে আমার দৃষ্টি হারিয়ে গেছে, কিছু প্রযোজনার কথা হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে স্মৃতিতে ছিল না। ঢাকা নান্দনিকের ‘শ্যামলী কেবলই নীল হয়’ বা ভিন্ন আর একটি প্রযোজনা মন্দ ছিল না। ঢাকার পুরানো আর একটি নাট্যদল ‘নান্দনিক নাট্য সম্প্রদায়’ সবসময় নাটক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে উচ্চমান বজায় রেখেছে। যদিও তাদের প্রযোজনার মান সবক্ষেত্রে তারা বজায় রাখতে পারেনি। কিন্তু নাট্যদল হিসেবে নাটক মঞ্চায়নে তাদের মধ্যে একটা আদর্শ লক্ষ্য করা গেছে। বাচিক অভিনয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এদের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। নাটক সম্পর্কে তারা বড় বড় বুলি দেয়নি কিন্তু নাটক বাছাই করার সময় তাদের চিন্তার গভীরতা ধরা পড়েছে। নিজেদের নাট্যকার ছিল না, বিভিন্ন সময়ে অন্য নাট্যকারদের নাটক করেছে। রবীন্দ্রনাথের দুটি গল্পের নাট্যরূপ সহ ঢাকার মঞ্চে ‘রক্তকরবী’ নাটক তারাই প্রথম মঞ্চায়ন করে। ঢাকার মঞ্চে ‘রক্তকরবী’র শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা নান্দনিক নাট্য সম্প্রদায়ের। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটকটিও করে নান্দনিক প্রথম।

নাটকের বিষয়বস্তু যদি মানসম্পন্ন না হয়, বিষয়বস্তু যদি সার্বিক বিচারে নাটক হয়ে না উঠতে পারে; প্রযোজনা যতোই ভালো হোক কিছু যায় আসে না। নাট্যরচনার প্রধান একটি বিষয় হলো কল্পনা শক্তির ব্যবহার। সম্রাট শাহজাহানের নির্মিত ‘তাজমহল’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত দুজনেই কবিতা লিখেছেন কিন্তু দুজনের ভাবসম্পদ ভিন্ন। মহৎ নাটকে এই ভাবসম্পদ থাকতে হয়। কল্পনাশক্তি নাটকে কীভাবে প্রকাশিত হয়? খুন নিয়ে একটি নাটকের নাট্যকার খুনের দৃশ্য এবং খুনীর আত্মিক বর্ণনা যেভাবে করলেন, দেখা যাবে বাস্তবে খুনের অভিজ্ঞতা কিছুই নেই তাঁর। কিন্তু তিনি যে বর্ণনা করতে পারলেন এটা তার কল্পনা শক্তি। মহাভারতের করুক্ষেত্রের যিনি বর্ণনা দিয়েছেন তিনি কি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ নিজ চোখে দেখেছেন? কিন্তু কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করেছেন। মানুষের মনে কল্পনাশক্তি সৃষ্টির নানান কারণ থাকে, যাকে বলা যায় সৃজনশীল শক্তি। মানুষ কিছু রচনা করবার আগেই তার মনে বা চিন্তায় এই সৃজনশীলতা বাসা বাঁধে। মানুষের বিভিন্নভাবে বেড়ে ওঠা, জীবনে চলার পথে নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ, বিভিন্নরকম মনের উৎসুক্য এবং জ্ঞানের সঙ্গে পরিচয়ের দ্বারা এই কল্পনা শক্তি বৃদ্ধি পায়।

ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছিলেন, ‘জ্ঞান’ আর ‘কল্পনা’ এই হচ্ছে মানব সভ্যতার প্রধান হাতিয়ার। নিশ্চয় এর সঙ্গে সর্বাগ্রে যুক্ত মানুষের শ্রম। শ্রমের ইতিহাসের ভিতর দিয়েই মানুষের জ্ঞান আর কল্পনার বিস্তার ঘটেছে। ম্যাকিম গোর্কি সৃষ্টিশীলতার পেছনে শুধু জ্ঞানের কথা বলেননি, বলেছেন কল্পনার কথাও। কল্পনা কী? গোর্কি বলছেন ‘কল্পনা’র কাজ হচ্ছে বিশৃঙ্খলাকে শৃঙ্খলিত করা এবং একটি অবয়ব দেয়া। মানে বহু বছরের নানা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে গুছিয়ে স্বল্পসময়ে প্রকাশ করা। ম্যাক্সিম গোর্কি যা বলেছেন, যদি বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মস্তিষ্ককে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ঠিক সেইরকম উপলব্ধি হবে। মস্তিষ্কই প্রধানত জগতের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে। মস্তিষ্কের মহাকেন্দ্রে অসংখ্য যোগাযোগ পথ, অসংখ্য বিশ্লেষণ কেন্দ্র ও একটি বিরাটাকার স্মৃতিভাণ্ডার রয়েছে। নিদ্রায় ও জাগরণে, চেতন ও অবচেতন অবস্থায়; প্রতিটি মুহূর্তে অসংখ্য স্নায়বিক উত্তেজনা মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলির মধ্যে এক উত্তেজনার নকশা সৃষ্টি করে। ঠিক আবার অনুভূতি বা ভাবাবেগ প্রকাশ বা দমন করার জন্য মস্তিষ্কেই পুনরায় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে। শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি আর তার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাটি এখান থেকেই ঘটে। ফলে মানুষের সকল সৃষ্টিশীলতা একটি বিজ্ঞান, অতিলৌকিক কিছু নয়।

মানুষ যে প্রতিভা সম্পন্ন তার কারণ মস্তিষ্ক থেকে প্রাপ্ত অসাধারণ মানসিক শক্তি মানুষের স্বভাব ও আচরণে বিরাট পরিবর্তন সাধন করেছে, তার ফলে মানুষ অন্যান্য সকল পার্থিব প্রাণী থেকে স্বাতন্ত্র্য লাভ করেছে। পৃথিবীর প্রাণীকুলের মধ্যে মানুষ সবকিছু চেতনার সাহায্যে উপলব্ধি করতে সচেষ্ট। মানুষ সুদূর অনুকল্প নির্মাণ করে ও নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা ও সাধনার মাধ্যমে তার জ্ঞান উন্নত করতে সচেষ্ট হয়। মানুষ তার পারিপাশ্বিক বিশৃঙ্খল অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ-পূর্বক সুপরিকল্পিত শৃঙ্খলা আনয়নে প্রয়াসী হয়। মহাবিশ্বে সবকিছু রয়েছে, মানুষ কি তা সৃষ্টি করছে? মহাবিশ্বে যা কিছু আছে তার মধ্যে যে নানারকম পরিবর্তন চলছে, মানুষ তার মস্তিষ্কের মহাকেন্দ্র দ্বারা দিনেদিনে তাকে আবিষ্কার করছে বা আরো জানার চেষ্টা করছে। মানুষ দিনেদিনে বিশ্বকে জানছে আর নানাভাবে নিজেও যৎসামান্য পরিবর্তন ঘটাচ্ছে তার। বিশাল আকারের মহাবিশ্ব মানুষের দৃষ্টিতে সামান্য পরিসরে ব্যাপ্ত, মানুষ তার পুরোটা দেখতে পায় না। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশকে দেখতে পায়, কিন্তু বছরের পর বছর কল্পনা আর চিন্তার মাধ্যমে মানুষ তার সুশৃঙ্খল নিয়মগুলিকে ধরতে পারছে। মানুষ যতোটা দেখতে পায়, তার কল্পনা শক্তির হিসেব বা গণিত দ্বারা তাকে তার চেয়ে বেশি দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।

কল্পনা শক্তির এই হিসাব করবার যে ধারা, সেটা হচ্ছে কল্পনা শক্তির বিশৃঙ্খল অবস্থাকে ধীরে ধীরে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে পারা। যুগের পর যুগ বহু মানুষের চিন্তার ভিতর দিয়ে তা হয়েছে, বিশেষ কোনো দেশ-জাতির মধ্যে সে চিন্তা আবদ্ধ নয়। চিন্তা থেকে চিন্তা সংক্রামিত হয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল মানুষের মধ্যে কিন্তু সেটা সবার ক্ষেত্রে একরকম ঘটে না। ফলে মানুষের চিন্তাশক্তি, মানুষের যুগের পর যুগ ধরে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা আর সমগ্রকে একটি বিশেষ মূর্তচিন্তার মধ্যে আনবার জন্য মানুষ তার কল্পনাশক্তির প্রয়োগ ঘটায়; সকল সৃষ্টির কারণ এগুলিই। বিজ্ঞান বা শিল্পকলা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মূলগতভাবে তা একইভাবে কাজ করে। নানান বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা আমাদের জ্ঞান ও চেতনার সীমাকে প্রসারিত করে। মস্তিষ্ক ও চেতনার গুণাগুণ, কার্যপ্রণালী ও কার্যকারণ সম্বন্ধ প্রক্রিয়ার সবটা বিজ্ঞানের কাছে এখনো সম্পূর্ণ বোধগম্য নয়। কিন্তু অন্য সব জটিল প্রাকৃতিক রহস্যের মতো মস্তিষ্ক ও চেতনার রহস্যাবলীও ক্রমাগত উদ্ঘাটিত হচ্ছে। ম্যাক্সি গোর্কি যখন বলেন, কল্পনার কাজ হচ্ছে বিশৃঙ্খলাকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে এসে সম্পূর্ণ একটি অবয়ব দেয়া, কথাটার ব্যাখ্যা হলো বিশ্বের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা ঘটনাবলী যা সকল মানুষের বোধগম্য নয়, সম্পূর্ণভাবে না হলেও তার কিছু কিছু অংশকে মানুষের বোধগম্য করে তোলা। কল্পনাশক্তি সেক্ষেত্রে বিষয়কে প্রকাশের একটি বড় অস্ত্র।

শিল্পকলা বা সাহিত্য সম্পর্কে ম্যাক্সিম গোর্কি বলছেন, জীবনকে পর্যবেক্ষণ ও জীবন থেকে উপাদান সংগ্রহ করার পর ‘কল্পনা’ তাকে তাৎপর্যপূর্ণ এক সামাজিক রূপ দিয়ে জীবন্ত করে তোলে। বস্তু সম্পর্কে অভিজ্ঞতা বা নানান ঘটনাকে ঝাড়াই বাছাই করে কল্পনার দ্বারা এই যে রূপ দেয়ার প্রয়াস, রুশ দেশের কন্স্তান্তিন ফেদিন বলেছেন, এটাই হচ্ছে সৃষ্টি প্রক্রিয়া। কিন্তু ঝাড়াই বাছাইয়ের কাজটা খুব সহজ নয়। কল্পনা যে যুক্তি-বুদ্ধির বাইরেকার বিলাস মাত্র নয়, সকল রকম সৃষ্টিশীরতার ক্ষেত্রে সে বিষয়ে সতর্ক থাকাটা খুবই আবশ্যক। বস্তুত মানুষের কল্পনার দুইরূপ; বস্তুবাদী আর ভাববাদী। ভাববাদী কল্পনার সৃষ্টিশীলতার দিক রয়েছে, ভাববাদী কল্পনা মানুষকে ভাবিয়েছে; কিন্তু মানুষের বহু প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি। ফলে ভাববাদী কল্পনার সৃষ্টিশীলতা যখন মানুষের বহু প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি, মানুষ নতুন করে আবার সেসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে খুঁজতে বস্তুবাদের দেখা পেয়েছে। ফলে ভাববাদী সৃষ্টিশীলতার সবকিছু বাতিলযোগ্য বা মূল্যহীন নয়, ভাববাদ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড আর মানুষ নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছে, সেটা তার প্রগতিশীলতার দিক। ভাববাদ সেইসব প্রশ্ন তুলে বস্তুবাদকে এগিয়ে চলার পথ তৈরি করে দিয়েছিল। ভাববাদের নানা প্রশ্নের উপর দাঁড়িয়ে বস্তুবাদ নতুন সব চিন্তার আমদানী করেছে, ভাববাদের নানা ধারণা সেখানে বাতিল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই বাতিল হয়ে যাওয়া মানে মানব সভ্যতায় তার অবদানকে অস্বীকার করা নয়। ফলে বর্তমান যুগের নাট্য রচনা বা সাহিত্য সৃষ্টিতে মানব সভ্যতার পুরো ইতিহাসকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে পাঠ করা আর মূল্যায়ন করা শিখতে হয়। নাহলে মহৎ কিছু সৃষ্টির পথে তা হবে অন্তরায়।

মানুষের প্রকৃত জীবনবোধ এবং সামগ্রিক বোধ গড়ে ওঠে তার পূর্বাপর মানবসভ্যতার সকল ইতিহাসকে আত্মস্থ করার ভিতর দিয়ে। ইতিহাসবোধে গোঁজামিল থাকলে জীবনবোধে অস্পষ্টতা আসবে। মানুষের জীবনবোধকে স্পষ্ট করার দায়িত্ব শিল্প-সাহিত্যের। শিল্প-সাহিত্যের কাজ মানুষকে গভীর জীবনবোধে ভাবিয়ে তোলা, মানুষের চেনাজানা ঘটনাকে পুনরায় তার সামনে হুবহু উপস্থাপন নয়; যদি সেখানে নতুন-ধরনের উপলব্ধি বা নতুন-বোধ না থাকে সেটার আর গুরুত্ব নেই। পুরানো ঘটনাকে নতুন বোধে বা নতুন উপলব্ধিতে যদি ভরিয়ে তোলা যায় তাহলেই সেটা হবে সৃষ্টিশীল কিছু, নাটক বা সাহিত্য পুরানো গল্প বা ঘটনাকে ধারণ করেও নতুন ভিন্ন কিছু যোগ করার মধ্যে দিয়েই সৃষ্টিশীলতা বা সার্থকতা লাভ করে। কিন্তু যদি তা হয় শুধু পুরানো ঘটনার চর্বিতচর্বন, লাভ নেই। বরং শিল্প-সাহিত্যের জগতে তাতে নতুন আবর্জনা বাড়ে। শিল্প-সাহিত্য সাংবাদিকতা নয় যে, সাংবাদিকদের মতো শুধুমাত্র ঘটনাকে হাজির করবে। ধরা যাক আশির দশকে সামরিক শাসক এরশাদকে নিয়ে নানারকম ব্যঙ্গ-কৌতুক করা হয়েছে বহু নাটকে; সেগুলি ব্যঙ্গধর্মী সাংবাদিকতার চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। কখনোই সেসব নাটক, সামরিক শাসকের দীর্ঘদিন টিকে থাকার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিতে পারেনি। ব্যাখ্যা দিতে পারেনি সামরিক শাসক আর তাদের চাহিদা সম্পন্ন গণতান্ত্রিক সরকারের পার্থক্য সম্পর্কে। সামরিক শাসন হটে গেলেও শাসক এরশাদ যে পুনরায় তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের ছত্রছায়ায় নিজের স্থান করে নিয়েছিল, পাশাপাশি এরশাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়েছিল গণতন্ত্রের দাবিতে যে দলগুলি তারা যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবার ক্ষমতা রাাখে না, তা পূর্বে জানা যায়নি নাটকগুলি দেখে।

নাটকগুলি সস্তা ঘৃণা প্রকাশ করেছে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, না পেরেছে তার উত্থানের ব্যাখ্যা দিতে না পেরেছে সরকার উৎখাতের পর তার ভবিষ্যত নিয়ে কিছু বলতে। না পেরেছে বাহ্যিক এরশাদের চরিত্রের বাইরে তার ভিন্ন কোনো অন্তর্গত চরিত্রকে প্রকাশ করতে। সমাজ-রাজনীতি আর শ্রেণী চরিত্র বাদ দিয়ে, রাষ্ট্রের চরিত্রের বিশ্লেষণে না গিয়ে বারবার ব্যক্তি এরশাদ চরিত্র হয়ে এসেছে, সেটাও অর্ধচরিত্র। যারা এরশাদের বিরুদ্ধে নাটক দিয়ে লড়তে চেয়েছে বা নাটক রচনা করেছে তাদের কাছে সমাজের গতিপ্রকৃতি জানা ছিল না, রাষ্ট্রের চেহারা স্পষ্ট ছিল না, জনগণ সম্পর্কে পর্যন্ত সামান্য ধারণা রাখতো না। ফলে কী দেখা গেল, সামরিক শাসক এরাশাদের পতনের পরের নির্বাচনে এরশাদ প্রতিটি আসনে জয়লাভ করে। প্রধান যে দুটি দল নানাভাবে এরশাদকে হঠাবার আন্দোলনে যুক্ত ছিল, পরে তারা আবার এরশাদকে নিজেদের সঙ্গে পাবার চেষ্টা করেছে। জনগণ এসব দেখে বিভ্রান্ত হয়েছে। কিন্তু আশির দশকের মঞ্চস্থ নাটকগুলি এ ব্যাপারে দর্শককে সামান্য ইঙ্গিত দিতে পারেনি। নাট্যকারদের রাজনীতির জ্ঞান, সমাজবিশ্লেষণের ক্ষমতা কতটা দুর্বল ছিল তা এসব ঘটনায় স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। নব্বইয়ের দশকে যখন এরশাদের পতন ঘটে তখন বহু নাট্যকাররাই আরো দিশেহারা হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রকে ঘিরে নাটক রচনার সংখ্যা কমতে থাকে। কারণ এরশাদের পতনের পর সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গী নাটক লিখবার জন্য আর একজন খলনায়ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না।

দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার নাটক দেখার পর লিখেছিলেন, যিনি শিল্প-সাহিত্যের স্রষ্টা তাঁর নিজের চিন্তা যদি স্বচ্ছ না থাকে, তবে তাঁর সেই অস্পষ্টটা তারই সৃষ্টিতে প্রতিফলিত হয়ে মানুষকে আরো বিভ্রান্ত করে দেয়। বাংলাদেশে সেটা ঘটে যেমন এরশাদ বিরোধী নাটক রচনার ক্ষেত্রে, তেমনি ঘটে শ্রেণীসংগ্রামের নাটক রচনার ক্ষেত্রে, একইভাবে তা ঘটে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে নাটক রচনায় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নাটক সৃজনে। বহু নাট্য ব্যক্তিত্ব তাই নব্বইয়ের দশকের শেষে এসে স্বীকার করেছেন বাংলাদেশের নাট্য রচনার মান দুর্বল। বহুজন বলেছেন, নাট্যচর্চার অন্যান্য ক্ষেত্রে নাটকের যে সাফল্য তা নাট্য রচনার ক্ষেত্রে ঘটেনি; নাট্য রচনার মান ভয়াবহ রকম দুর্বল। কথাটা নাট্যঙ্গনের অন্যতম প্রধান তিন ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফের কণ্ঠে বারবার শোনা গেছে। বর্তমানে যদি কেউ আঙ্গুল গুণে গত পঞ্চাশ বছরের বা প্রথম ত্রিশ বছরের নাটক নিয়ে হিসেবে করতে বসেন, কথাটার প্রমাণ পেয়ে যাবেন। খুব বেশি উল্লেখ করার মতো নাটকের নাম বলা যাবে না, যা বহুকাল টিকে থাকবে। বিশ্বের সব বড় বড় ধ্রুপদী নাটকের কথা বাদ দিয়ে যদি মধুসূদনের বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ বা দিজেন্দ্রলাল রায়ের সাজাহান নাটকের কথা বলি, সেগুলি এখনো মঞ্চস্থ হচ্ছে। বাংলাদেশের কটা নাটক আছে যা পঞ্চাশ বছর পর মঞ্চস্থ হবে বা জিজ্ঞেস করা যায়, এখনি কি হচ্ছে?

গত তারিখে ‘নাট্য সমালোচনা এবং সমালোচনা গ্রহণ না করবার প্রবণতা’ লেখাটির প্রথম পর্ব যাবার পর নাট্য জগতের আমার একজন প্রিয় মানুষ আমাকে লিখেছেন, নব্বইয়ের দশকের আরো অনেক নাটক ছিল উল্লেখ করবার মতো। হয়তো ছিল, সেটা হতে পারে আমার জানা নেই। কিন্তু সামগ্রিকভাবে নব্বইয়ের দশক বা আশির দশকের নাটক নিয়ে আমি কী মনে করি, আমার প্রিয় মানুষটির মন্তব্যে আমি উপরের কথাগুলি বিনয়ের সঙ্গে লিখতে বাধ্য হলাম। নিজের কথাগুলিকে যদি আমি শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করি, সেটা হবে একটা সম্পূর্ণ নিজস্ব মতামত যা অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। সে কারণে গত শতকের নাটক রচনা নিয়ে রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ কী ভাবছেন সেটাও বলা গেল। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকে সামরিক শাসক এরশাদের পতনের পর নাট্যচর্চার জগতে বিভ্রান্তি দেখা গিয়েছিল নানাভাবে। বিভাস চক্রবর্তী ঢাকায় তার নির্দেশিত ‘মাধব মালঞ্চী কন্যা’ মঞ্চস্থ করার পর সবাই যেন তার দ্বারা বিভ্রান্ত হলেন। সকলেই মনে করলেন, ময়মনসিংহ গীতিকার নাটকগুলি করলেই বুঝি মঞ্চসাফল্য পাওয়া যাবে। বহু দলই তখন একের পর এক ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে নানারকম নাটক করতে আরম্ভ করলো। সঙ্গে সঙ্গে নার্ট্যচর্চার নতুন ‘দর্শন’ প্রচারিত হতে থাকলো নাট্যচর্চার ‘শেকড়’ খুঁজতে হবে। ময়মনসিংহ গীতিকা নাকি বাংলার নাট্যচর্চার শেকড়? নাট্যাঙ্গনের মানুষ একদিকে মোল্লাদের নানা ফতোয়ার বিরুদ্ধে উচ্চস্বরে প্রতিবাদ জানালো, ভিন্নদিকে ভূত-পেত্নী সহ নানারকম কুসংস্কার নিয়ে লেখা ময়মনসিংহ গীতিকার মঞ্চায়ন চললো। নিঃসন্দেহে নিজদেশের লোকসাহিত্য রক্ষা করতে হবে, নিজ দেশের অতীত ঐতিহ্য যতোটা সম্ভব জাদুঘরে সংরক্ষিত রাখতে হবে। কিন্তু তারমানে এই নয় যে, সেগুলিকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাহলে আধুনিক শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান বাতিল করে পুরানো যুগের সবকিছু টেনে আনতে হয় আর লেংটি পরিধান করতে হয়।

সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা, কিছু করবার আগে মাথায় প্রশ্ন জাগছে না কারো যে, সেটা ঠিক না কি ভুল; সকলে হুজুগে মেতে উঠছে। বিভাস চক্রবর্তী ময়মনসিংহ গীতিকা করলে সকলকে কি তাই করতে হবে! নিজের বিচারবোধ বলে কিছু থাকবে না? যদি নাট্যধারা নির্মাণে মাথায় প্রশ্ন না জাগে, নাট্য রচনায় মাথায় নতুন নতুন প্রশ্ন জাগবে কী করে? নতুন নতুন প্রশ্ন না জাগলে নতুন নাট্য রচনা হবে কী করে? ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে নাটক করার পাশাপাশি দু-চারজন আরো এগিয়ে গিয়ে বলে দিলেন, বাংলার লোকনাট্যকে মঞ্চে আনতে হবে। বিশেষ একটি দল পুরানো রীতি মেনে নারীর চরিত্র পুরুষকে দিয়ে অভিনয় করালো? কীরকম ঐতিহ্য প্রেম, কিন্তু তারা ঘরে বসে খাচ্ছে বিদেশী মদ আর সবকিছুই বিদেশী। নাটকের বেলায় যতোসব লঙ্কাকাণ্ড, দেশ আর দেশউদ্ধার। বিদেশী নাট্য বাতিল। বিদেশী নাট্য বাতিল করাবার আগে, প্রাচীন গ্রীসের আর পাশ্চাত্যের নাটকের দীর্ঘ ঐতিহ্য সৃষ্টি করে দেখাও, পরে বড় মুখ করে বাতিলের কথাটা বলো। গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল! নিজেরা নিজেদের শ্রেষ্ঠতা জাহির করলে হয় না, ইতিহাসে প্রমাণ থাকতে হয়। যারা লোকনাট্য করবেন বলে খুব চেঁচালেন, ফিরে গেলেন পাশ্চাত্যের কাছেই, বাঁধা পড়ে রইলেন পাশ্চাত্যের প্রসেনিয়ামে আর নাট্যচিন্তায়। কারণে চাইলেই তা এড়ানো সম্ভব নয়, কেউই পারেনি। যারা লোকনাট্য নিয়ে বুলি আউড়েছিলেন যদি জিজ্ঞেস করা হতো, বাংলার লোকনাট্য আদতে কোনগুলি, ইতিহাসে এ সম্পর্কে কতটুকু জানা যায়? বহুজনের মুখে জবাব থাকতো না। কিন্তু যুক্তির চেয়ে আবেগ দ্বারা চালিত হলো বেশির ভাগ মানুষ কিন্তু নিজের বিশ্বাসে স্থির থাকতে পারলো না। শম্ভু মিত্র আর উৎপল দত্তের রচনায় নাট্যকর্মীদের এসব আবেগ নিয়ে বহু সমালোচনা, বহু ব্যঙ্গ আছে। শম্ভু মিত্র লিখেছেন, যখন অল্পবয়সে শিল্পকর্মে জড়িত হয়ে পড়ি তখন অনেকটা যেন জৈব তাড়নাতেই শিল্পক্ষেত্রে আসি। নিজের আকাঙক্ষার রূপটা তখনো ঠিক জানি না, তার উদ্দেশ্যও জানি না। সেই সময়ে চারপাশের কতো মত যে আমাদের কতো পথে নিয়ে যায়! কতোরকম ধার-করা মতবাদের ছাঁচ যে আমাদের মনের ওপর চাপাতে চাই।

পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের নাটক রচনা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, যারা ছোটবেলা থেকেই আমরা নাটক পড়তে ভালোবাসি, যারা একটা ভালো নাটক পেলে পাগলের মতো খুশি হই, সেরকম নাটক আমরা ক’টা পাই? নাটকের অভিনয়ে আমরা নানান পদ্ধতি খোঁজার চেষ্টা করি, সেটা ঠিক এই জন্য যে নাটকের অভিনয়ে যেন গভীরতা আসে। নাট্যাভিনয় করে যেন তৃপ্তি পাই। কিন্তু বেশিরভাগ নাটক যা আমাদের হাতে আসে তা আমাদের জীবনবোধের তুলনায় অসার মনে হয়। খুব অনুপ্রাণিত হয়ে নাটকের মধ্যে ডুবে যাবো, সেরকম নাটক কই? বহুজনই মোটা দাগের নাটক লিখছেন কেবল মাত্র নাট্যচর্চাকে টিকিয়ে রাখবারা জন্য। সুতরাং এঁরা লিখলে আর নাটক সাহিত্য হয় কী করে? বাংলাদেশের বহু নাট্যবোদ্ধা হয়তো বলতে পারেন, শম্ভু মিত্রের কথায় কী যায় আসে? তিনি উপনিবেশিক ধারায় নাটক করেছেন, তাঁকে গুরুত্ব দেবার কী আছে! তিনি উপনিবেশের সেবা করে গেছেন, দাসত্ব করেছেন পাশ্চাত্য নাট্যধারার। যাঁরা এমনটা ভাববার ক্ষমতা রাখেন তাঁরা আমার নমস্য ব্যক্তি, তাদের দেশপ্রেম প্রবাদতুল্য; কিন্তু আমি অভাজন শম্ভু মিত্র আর উৎপল দত্তদের দলে। বাংলা মঞ্চে অভিনয় করার মতো নাটক না পেয়ে উৎপল দত্ত নিজে নাটক লিখবার জন্য কলম ধরতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশপ্রেমিক কিছু নাট্যবোদ্ধদের কাছে উৎপল দত্ত পুরোপুরি বাতিল, কারণ তিনি নাকি উপনিবেশিক নাটকের সেবা করে গেছেন। নিজেরা যে কী মহাকাব্য সৃষ্টি করলেন দেখতে পেলাম না।

দু-মুখী ঘটনা হলো, যারা ঘোষণা দিয়ে ময়মনসিংহ গীতিকা আর দেশজ নাটক করার মধ্যে বাংলা নাটকের সাফল্য দেখতে পেয়েছেন, নব্বই শতকে তারাই আবার মলিয়ের হাসির নাটক মঞ্চায়ন করে খুব উল্লসিত বোধ করেছেন। মলিয়ের কোন দেশের নাট্যকার? প্রসিনিয়ামকে গাল দিয়ে প্রসিনিয়ামের ভিতরেই নাটক করেছেন, শেকড় খোঁজার নাম করে মলিয়ের সহ পাশ্চাত্যের নাটক মঞ্চায়ন করেছেন; এমন বহু দ্বিচারিতায় বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ইতিহাস পরিপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নাট্যদলের মধ্যে ‘নাগরিক’ আর ‘আরণ্যক’ এই ধরনের মতবাদের বাইরে ছিল। কখনো শেকড় খোঁজা বা দেশীয় নাট্যাঙ্গিক নিয়ে মাতামাতি করা তাদের চিন্তায় খুব একটা লক্ষ্য করা যায়নি। সঙ্গে আরো কিছু দল ছিল, যাদের মধ্যে নান্দনিক নাট্য সম্প্রদায়। ‘ঢাকা থিয়েটার’ এক্ষেত্রে অন্যভাবে ব্যতিক্রম। বিভাস চক্রবর্তীর মাধব মালঞ্চ মঞ্চস্থ করার বহু আগে থেকেই ঢাকা থিয়েটার দেশজ নাট্যরীতি নির্মাণের ঘোষণা দেয় আশির দশকে। সে ধারা সৃষ্টির লক্ষ্যে দলটি কাজ করে গেছে, নাট্যরচনা বা মঞ্চায়নে ভিন্ন পথ অনুসন্ধান করেছে। ঢাকা থিয়েটারের এ মতের সঙ্গে যে-কেউ দ্বিমত প্রকাশ করতে পারে কিন্তু হঠাৎ হুজুগে এ পথে তারা পা বাড়িয়েছে তা বলা যাবে না। বহুদিনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে তারা দেশীয় নাট্যরীতি নির্মাণের প্রচেষ্টা নিয়ে। কিছু সাফল্য তাদের আছে এ ধরনের নিরীক্ষায়। সেজন্য ধন্যবাদ পাবার যোগ্য তারা। যদিও ঢাকা থিয়েটার নামটাই বিদেশী বা উপনিবেশিক মানে দেশজ নয়।

বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে যে হঠাৎ হঠাৎ নানারকম দিকবদল ছিল, সেগুলি সবই তাৎক্ষণিক। নানা সময়ে নানারকম শ্লোগান এসেছে সেখানে। কখনো নবনাট্য চর্চা, কখনো গ্রুপ থিয়েটার চর্চা, কখনো সমাজ পরিবর্তনের নাটক, কখনো শ্রেণীসংগ্রামের নাটক, কখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাটক, কখনো শেকড়ের সন্ধান, কখনো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নাটক, কখনো পেশাদারী নাট্যচর্চা। নানারকম শ্লোগানে নাট্যচর্চার গতি-প্রকৃতি ঘনঘন বদল হয়েছে, কিন্তু সেসব শ্লোগান আর স্থিরতা পায়নি কখনো। বর্তমান শতকে এরকম শ্লোগান আর খুব একটা শোনা যায় না। হয়তো তার সামান্য কিছু সুফল পাওয়া যাচ্ছে। নতুন ধরনের বেশ কিছু প্রযোজনার দেখা পাওয়া গেছে বর্তমান শতকে। পাশাপাশি বড় বড় দলগুলির নাট্য কার্যক্রম স্তিমিত বা বন্ধ হয়ে রয়েছে বলা যায়। নব্বইয়ের দশকে বা আশির দশকের শেষে যখন নাট্যচর্চার জন্য আধুনিক মঞ্চের দাবির কথা বলা হতো, কখনো কখনো আমি রসিকতা করে বন্ধুদের বলতাম, ‘নাট্যমঞ্চ যখন হবে দেখা যাবে বহুদল তখন আর নাটক করছে না’। কথাটা অনেকটা সত্য প্রমাণিত। ঘনঘন মত বা ঘোষণা পাল্টালে বা দিকভ্রান্ত হলে নাট্যচর্চা মুখ থুবড়ে পড়বেই। বর্তমানে নাট্যমঞ্চের অভাব নেই, বিভিন্ন দলের সদস্যদের হাতে প্রচুর টাকা, সেই সঙ্গে বহু বছরের অভিজ্ঞতা; নাট্যচর্চা সে অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়লো কেন? প্রশ্নটা কি আদর্শের অভাব না কি বিভিন্ন ঘোষণায় যা চীৎকার করে বলা হতো তার সবটাই ছিল ফাঁকি!

নব্বইয়ের দশকের আগেই, বলতে গেলে আশির দশক থেকে টের পাওয়া যাচ্ছিলো বহু কিছু। নিজের অন্তরের চোখে দেখতে পাচ্চিলাম নাট্যচর্চার পরিনাম। বলতে গেলে তাই আশির দশকের শুরুতে বাংলাদেশের নাটক নিয়ে আমি গবেষণা করার কথা ভাবি। কিন্তু ইতিহাস বিভাগে তখন তা করা যাবে না বলে, আশির দশকের মাঝামাঝি মওলানা ভাসানীকে নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলাম। পরে ঘটনাচক্রে সেটা বাদ দিয়ে আশির দশকের শেষে নাট্যচর্চা নিয়ে নতুনভাবে কাজ আরম্ভ করি ইতিহাস বিভাগেই। নাট্যচর্চার সঙ্গে তার অনেক আগে থেকেই যুক্ত ছিলাম। যখন গবেষণা আরম্ভ করি তখন গবেষক হিসেবে গোয়েন্দার মতো বহু কিছুর উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশের নাটককে দেখার চেষ্টা করেছি বিশ্বনাটকের প্রেক্ষাপটে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ আর পশ্চিমবঙ্গের নাট্যচর্চার সঙ্গে মিলিয়ে। বাংলাদেশের নাট্যচর্চা নিয়ে থিয়েটার পত্রিকার বাইরে নব্বইয়ের দশকে আর একটি পত্রিকা বের হচ্ছিলো চট্টগ্রাম থেকে ‘থিয়েটার ফ্রণ্ট’ নামে। বাংলাদেশের নাট্যচর্চা নিয়ে সে পত্রিকায় কড়া সমালোচনা থাকতো। বহু সমালোচনাই ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও খুব বেশি সংখ্যা বের করতে পারেনি তারা, কিন্তু নাট্য সমালোচনার ধার ছিল। যাঁরা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁদের কাছে শুনেছি, পত্রিকার লোকদের বহুসময় আক্রমণাত্বক কথাবার্তা বলা হতো তাদের লেখালেখির জন্য। বহুজনকে নিজেই দেখেছি পত্রিকার সমালোচনা সম্পর্কে বিষোদগার করতে। কিন্তু সেই পত্রিকাটি যে ভুল কিছু বলতো তা কিন্তু নয়। বর্তমান লেখায় সে পত্রিকার সমালোচনা টানবো না, আমার অভিসন্দর্ভে তা রয়েছে।

নব্বইয়ের দশকের নাটক নিয়ে কথা শেষ করবো, বিভিন্ন নাট্য ব্যক্তিত্বদের মতামত দিয়েই। পশ্চিমবঙ্গের মতো জায়গায় যেখানে বাংলা নাটকের দুই স্বীকৃত দিকপাল শম্ভু মিত্র আর উৎপল দত্তর মতো মানুষ মঞ্চায়ন করবার জন্য মানসম্পন্ন নাটক পায়নি, সেখানে বাংলাদেশে বহু মানসম্পন্ন নাটক লেখা হবে ভাবা যায় কি? পশ্চিমবঙ্গের নাট্য জগতের আর এক দিকপাল অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় মানসম্পন্ন নাটক না পেয়ে বিদেশী নাটকের অনুবাদ মঞ্চস্থ করেছেন। তিনজন দিকপালই ছিলেন বিরাট মাপের অভিনেতা। শক্তিমান অভিনেতারা সবসময় অভিনয় করবার জন্য নাটকে বিচিত্র-ধরনের চরিত্র খুঁজে ফেরেন। চান নাটকে এমন সব সংলাপ যার মধ্য দিয়ে নিজকণ্ঠের নানাভঙ্গি প্রকাশ করা যায়। নাহলে অভিনয় করার আনন্দ কোথায়। বাংলাদেশে বহু সময় সংলাপ প্রধান ধ্রুপদি নাটক হাতে নিয়ে অনেককে বলতে দেখা গেছে, ‘এ নাটকে “এ্যাকশন” কোথায়’? তাদের বক্তব্য, নাটকে শুধু কথা আর কথা, সামান্য এ্যাকশন নেই। নাটকে এ্যাকশন বলতে তারা যে কী বোঝেন তারাই জানেন। মনে হয় তাঁদের বক্তব্য হলো, হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে কিছু না দেখাতে পারলে আর সার্থক নাটক কোথায়। কথাটা উড়িয়ে দেবার নয়, মঞ্চ নাটকে নানান ভঙ্গি দেখানো, দৈহিক অভিনয়ের গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু সব নাটকের ক্ষেত্রে এরকম প্রশ্ন করা চলে না। কিছু নাটক এতটাই শিল্পমানসম্মত, কথা দিয়েই মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুগ্ধ করে রাখা যায়, যদি অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বাঁচিক অভিনয় করতে জানেন। সংলাপটা যদি ঠিক মতো বলতে পারেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি, নাটক দেখার চেয়ে শোনার আনন্দ বেশি পেয়েছি ছেলেবেলায়। মঞ্চে যা দেখতাম তা মনে দাগ কাটতো না। কিন্তু আকাশবাণীর মাসের শেষ বুধবার রাতের নাটক শুনে মুগ্ধ হয়ে বসে থাকতাম কবে আবার একমাস পরের বুধবার আসবে। নাটক শুনে শুনে নাটককে ভালোবাসতে শিখেছিলাম, নাটকের সংলাপ বেঁধে রাখতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। না হলে ছেলেবেলায় মঞ্চে যে-সব নাটক দেখেছি তাতে নাট্যকর্মের সঙ্গে যুক্ত হবার সামান্য উৎসাহিত হবার কারণ ছিল না। বরং যাত্রা বেশি আকর্ষণ করতো।

নব্বইয়ের বা আশির দশকের নাটক দিয়ে আজকের মতো লেখাটা শেষ করা যাক। নব্বইয়ের বা আশির দশকের নাটক নিয়ে আমি কী বললাম, তাতে কিছু আসে যায় না। নাটকের আমি আর কীই বা বুঝি। বরং প্রাজ্ঞজনদের কথা কিছুটা শোনা। নাটকের দলগুলি শুরুতে নাট্য মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের কথা বলেছিল। সমাজ পরিবর্তনের সে চেতনা সম্পর্কে যে নাট্য দলগুলির আন্তরিকতার অভাব ছিল তা রূপকথার লোকনাট্য বা সস্তা হাসির নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়। সেজন্য আলী যাকের সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘সংস্কৃতির যে দুরবস্থা এটার জন্য আমরা সবাই দায়ী।...সামগ্রিকভাবে চিন্তাটা লঘু ব্যাপারে চলে এসেছে এবং এই লঘু ব্যাপারের জয় জয়কার চলছে। এবং সেটাতে আমরা কিন্তু মশলা দিচ্ছি। আমরা সেটাকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করছি।’ সেই সাক্ষাৎকারে তিনি একথাও বলেছেন, নাট্যদলগুলো অনেক দূরে সরে এসেছে তাদের ঘোষিত আদর্শ থেকে। নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা যাকের উপরে যে মন্তব্যটি করেছেন, নাটক তার আদর্শ ছেড়ে বহুদূরে সরে এসেছে। মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিণতি হওয়াটাই ছিলো স্বাভাবিক। প্রথম থেকেই দেখা গেছে নাটচর্চার কোনো সুদূর লক্ষ্য বা সুসংহত রূপ ছিল না।

নব্বইয়ের দশকের শেষে এসে মামুনুর রশীদ নিজেই স্বীকার করছেন, নাট্যদলগুলো উচ্চবিত্তের আগ্রাসনের কাছে থিয়েটারকে বিক্রি করে ফেলেছে। মামুনুর রশীদ এসময় এসে মনে করছেন থিয়েটারটা হয়ে গেছে উচ্চবিত্তের বিনোদনের জায়গা এবং থিয়েটার বেনিয়া পুঁজির ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে। নাটকের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে এগিয়ে আসছে বহুজাতিক কোম্পানি। প্রশ্ন দাঁড়ায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কি শ্রমিকশ্রেণীর নাটককে পৃষ্ঠপোষকতা করতে এগিয়ে আসতে পারে যে শ্রমিকশ্রেণী তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে? স্বভাবতই সেটা সম্ভব নয়। ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যে নাটকগুলোকে বা যে দলগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে তারা শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষের নয়। কারণ শত্রুর কোলে বসে তার ইচ্ছার বাইরে আর কোনো ভূমিকা রাখা যায় না। মামুনুর রশীদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, সম্পূর্ণ নাট্য আন্দোলনই হয়ে উঠেছে উচ্চবিত্তদের বিনোদন দেবার মাধ্যম, যা নাট্য আন্দোলন সম্পর্কে বিরাট এক প্রশ্ন তুলে বসে। মামুনুর রশীদ দেখাচ্ছেন, নাট্য আন্দোলন শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে তো নয়ই এমনকি রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের পক্ষেও নয় বরং তা হয়ে উঠেছে শোষকশ্রেণীর তথা সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থসংরক্ষণকারী মাধ্যম।

বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন সম্পর্কে খুব প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য করেছেন উনিশশো আটানব্বই সালে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দীন ইউসুফ। তিনি লিখছেন, মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে নাটক একটি স্বতন্ত্র শিল্প মাধ্যম হিসেবে স্বীয় আসনে প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘ পঁচিশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এ অর্জন। সামান্য পরেই আবার তিনি লিখছেন, ‘পঁচিশ বছরের উপান্তে দাঁড়িয়ে আজ নিজের মনেই প্রশ্ন জেগেছে যে সম্ভাবনার দ্বার উন্মচিত হয়েছিল আমাদের সামনে তার কতটুকু আমরা ব্যবহার করতে পেরেছি। নতুন কিছুই ঘটছে না নতুন কিছু দেখছি না। আমাদের নাটক একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বাঁধা পড়ে আছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা নয় যেন সযত্নে চ্যালেঞ্জকে পাশ কাটিয়ে নিরাপদ প্রযোজনা করা আমাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি আরো লিখছেন, নির্লিপ্ত নির্বিকার নাট্য প্রযোজনা আমাদের থিয়েটারকে এক স্থবির জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নাসির উদ্দীন ইউসুফের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নাটকের মূল চেহারাটা বের হয়ে এসেছে। নাসির উদ্দীন ইউসুফের বক্তব্য যেন প্রথম তিন দশকের বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের উপসংহার বা শেষ পরিণতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে যে নাটককে বলা হয়েছে প্রতিবাদের ভাষা, যে নাটক বারবার অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবার ঘোষণা দিয়েছে, নাসির উদ্দীন ইউসুফ পঁচিশ বছর পর দেখতে পাচ্ছেন সেই নাটক প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ বাদ দিয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে দেখবো নাটক আর সরকার বিরোধী ভূমিকাও পালন করছে না বরং সরকারের সাথে নানাভাবে আঁতাত করে বসে আছে। সরকারের সকল অন্যায়কে নির্বিবাদে মেনে নিচ্ছে। সরকারের কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ মুখরিত হচ্ছে না। সরকারের নানা অন্যায়ের বিরুদ্ধে নাট্যদলগুলোর ইচ্ছাকৃত মুখ বুজে থাকা নিয়ে নিরানব্বই সালে থিয়েটারওয়ালা পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে লেখা হচ্ছে, ‘আমরা, থিয়েটারওয়ালারা, প্রকৃতপক্ষে সমাজ ও রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়েছি। রাষ্ট্রে সমসাময়িককালে ঘটে যাওয়া বড় অনিয়ম, অত্যাচারেও আমরা নীরব ভূমিকা পালন করে চলেছি। অন্যান্য পেশাজীবী কিংবা শ্রমজীবীদের উপর রাষ্ট্রের এই যে অন্যায় এবং এতে আমাদের নীরবতা, সেই নীরবতা এক সময় নিজেদের উপর রাষ্ট্রকৃত অনাচারেও নীরব থাকতে বাধ্য করে।’ কামালউদ্দিন কবির লিখছেন, অনেক আনন্দ আর আশা নিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের নিয়মিত নাট্যচর্চা। সাতাশ বছর অতিক্রমের পর সার্বিক হিসেবের ফলাফলে যতোটা না আনন্দ তারচেয়ে বেশি বিষন্নতা এবং আশার বদলে হতাশার চালচিত্র ফুটে ওঠে।

নব্বইয়ের দশকের শেষে এসে এই যে নাট্য আন্দোলনের স্থবিরতার কথা সবাই বলছেন এর প্রধান কারণগুলো কী? শুরু থেকেই নাট্য আন্দোলনের লক্ষ্যহীন দিক ভ্রষ্ট হয়ে পথ চলার পরিণাম হচ্ছে এই স্থবিরতা। নাট্যকর্মীদের মধ্যবিত্ত মানসিকতার শেষ পরিণামই হচ্ছে এক সময় এসে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা। সংগ্রাম থেকে সরে দাঁড়িয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার পথে পা বাড়ানো। নাট্যদর্শকদের একজন আবু ইউসুফ নিজের পত্রিকায় লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের নাট্যচর্চা হচ্ছে মধ্যবিত্তদের দ্বারা দিয়ে কর্তৃক’। নাট্যচর্চার এই পরিণামের কারণ নিয়ে আরো কথা বলা যাবে, যদি তার শুরুর ইতিহাসে চোখ বুলানো যায়। সেটা করাটা জরুরি। কিন্তু নাট্যচর্চার যে অর্জনগুলি রয়েছে সেদিকেও চোখ ফেলতে হবে। বিশেষ করে বর্তমান শতকে নাট্যচর্চার নতুন চিন্তা ভাবনা, নাট্য নির্দেশনার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আর নাট্য রচনার নতুন দিগন্ত রচিত হয়েছিল, সেগুলিকে সামনে না আনলে বহু সত্যকে আড়াল করা হবে। বাংলাদেশের নাট্যচর্চার বহু ইতিবাচক দিকগুলি তাহলে বাদ পড়বে। সেক্ষেত্রে পুরানোদের চেয়ে নতুনদের বা তরুণদের ভূমিকাটা যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য।

নতুন শতকের দুটো নাটকের কথা প্রথমেই মনে পড়ে, দেশ নাটকের ‘নিত্যপুরাণ’ আর আরণ্যকের ‘সংক্রান্তি’। নিত্যপুরাণ যখন দেখি খুব বিস্মিত হই। নাট্য রচনা হিসেবে মাসুম রেজা যা মঞ্চে উপস্থিত করেছিল, নাটকের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত টানটান উত্তেজনা বিষয়বস্তু আর চরিত্রসৃষ্টি আর সংলাপের গুণেই হয়েছিল। দিলীপ চক্রবর্তী ঢাকার মঞ্চের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জায়গাটা দখল করে ফেললো মঞ্চে নামতে না নামতে। সঙ্গে চুমকি যেন মহাভারত থেকেই নেমে এসেছে তখন। নাটকের বাকি অভিনেতারা সকলেই সে হিসেবে খুব দুর্বল ছিল, কিন্তু নাটকের লেখনি আর নির্দেশনার গুণে সে-সব অভিনয়ের দুর্বলতা ভেসে গেল। বাকিদের দুর্বলতা যেন দিলীপ একা পুষিয়ে দিলো। চুমকি আর দিলীপের অংশটা ভিন্ন একটা পরিবেশ তৈরি করে ফেলতো। নাটকটা কয়েকবারই দেখেছি, কিন্তু বহরমপুরের ঋত্বিকের উৎসবের মঞ্চায়ন যেন সব প্রদর্শনীকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ঋত্বিকের সেটাই ছিল প্রথম উৎসব।

কলকাতায় গিয়েছিলাম তখন গবেষণার কাজে, নৃপেনদা বললেন তাঁর সঙ্গে বহরমপুর যেতে হবে। ঋত্বিক নাট্যদলের লোকজনরা আমাকে চেনে না কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ নাটা আকাদেমী পত্রিকার সম্পাদক নৃপেন্দ্র সাহার কারণে আমি বিশেষ অতিথি বনে গেলাম তাদের উৎসবে। সেই সুবাদে বহরমপুরে বসে নাটকটা দেখা হলো চতুর্থবার। দর্শক যে এভাবে টানটান উত্তেজনা নিয়ে, পিনপতনের নিস্তব্দতা নিয়ে গোগ্রাসে নাটক দেখতে পারে, জীবনে সেই অভিজ্ঞতা টের পেলাম ঋত্বিকের উৎসবে নিত্যপুরাণ মঞ্চায়নে। মফস্বল শহর বহরমপুরে পরদিন শুধু নিত্যপুরাণের আলোচনা। পরদিন ছিল দেশ নাটকের ‘বীরসাকাব্য’। সব টিকেট বিক্রি হয়ে আরো চাহিদা টিকেটের। টিকেট সব ফুরিয়ে গেছে, দর্শকদের অনুরোধ শেষ হচ্ছে না। কারণ গতদিনের নিত্যপুরাণের কথা শুনে সকলের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। নিত্যপুরাণ যে আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল সকল নাট্যপ্রিয় বহরমপুরবাসীর মধ্যে, বীরসা কাব্য হতাশ করলো সেখানে। নিত্যপুরাণ নিত্যপুরাণই, আরা একটি নিত্যপুরাণের জন্য বহু বছর অপেক্ষা করতে হবে। দিলীপ চক্রবর্তী আর নিত্যপুরাণ যেন দুজন দুজনার। দিলীপ যেন এখনো একলব্য হিসাব মাথার মধ্যে ঢুকে আছে, মহাভারতের একলব্যকে চিন্তা করতে গেলে দিলীপকেই যেন দেখতে পাই।

মামুনুর রশীদের শ্রেণীসংগ্রামের বিভিন্ন নাটক ক্লান্ত করে ফেলেছিল আমাকে বহু আগেই। ক্লান্ত হলেও সবগুলিই নাটকই দেখতাম আরণ্যকের। কারণ আমার নাটক নিয়ে গবেষণার অন্যতম প্রধান বিষয় তখন শ্রেণীসংগ্রামের নাটক। নাটকে শ্রেণীসংগ্রাম কথাটা আরণ্যকই চালু করে তাদের আশির দশকের ঘোষণায়। ভিন্নদিকে রাজনৈতিক নাটক হলো আমার গবেষণার প্রধান দিক। ফলে মামুন ভাইর নাট্যরচনার বিষয়বস্তুর মধ্যে কতোটা শ্রেণীসংগ্রাম সত্যিই উপস্থিত ছিল সেটা বিশ্লেষণ করা আমার দায়িত্ব। ফলে আমার অভিসন্দর্ভে মামুন ভাইকে যে নিষ্ঠুরের মতো সমালোচনা করেছি তেমনটা আর কাউকে নয়। বিভিন্ন নাটকের সঙ্গে সঙ্গে অভিসন্দর্ভে মামুনুর রশীদের নাটকের সমালোচনা যা করার করে জমা দিয়ে দিয়েছি তখন। জমা দেয়ার পর গেলাম মামুন ভাইর নতুন নাটক সংক্রান্তি দেখতে ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমন্দিরে। মনে মনে ভয়, আবার কোন শ্রেণী সংগ্রাম দেখতে হবে। শ্রেণীসংগ্রাম নিয়ে আমার সামান্য আপত্তি নেই, সব আপত্তি সূত্রবদ্ধ নাটক নিয়ে। শেষ দৃশ্যে শাসকদের পরাজয় আর শোষিতদের মুক্তি মানেই রাজনৈতিক নাটক নয়। ফ্রেডারিক এঙ্গেলস মিন্না কাউটস্কির লেখা পড়ে তাকে চিঠিতে  লিখেছিলেন, ‘সুতরাং আমার অভিমত হচ্ছে যে, সমস্যার সমাধান সরাসরি হাজির না করেও, কিংবা কখনো কখনো প্রকাশ্য পক্ষাবলম্বনে বিরত থেকেও, সমাজতান্ত্রিক সমস্যামূলক উপন্যাস তার পবিত্র দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করে প্রকৃত অবস্থা বিশ্বস্তভাবে অঙ্কনের মাধ্যমে।’ মামুন ভাই সর্বদা তাঁর নাটকে শোষিতদের জয় দেখাতে ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু সংক্রান্তি নাটকটা দেখলাম আমি মুগ্ধ হয়ে। মামুন ভাইর অভিনয় আমার আগেও ভালো লাগতো কিন্তু এবার আর শুধু অভিনয় নয়, পুরো নাটক আমার মন জয় করে ফেললো।  কারণ বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ আলাদা।

মনে হলো, যদি আমার অভিসন্দর্ভটা ফিরিয়ে এনে আবার জমা দিতে পারতাম, তাহলে “সংক্রান্তি”-র মঞ্চায়ন নিয়ে বিরাট একটা ইতিবাচক আলোচনা লিখে ফেলতাম। যদিও সে সুযোগ একেবারেই ছিল না। কারণ আমার অভিসন্দর্ভের সময়কাল ছিল নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত। সংক্রান্তি মঞ্চায়িত হয় তার পর। সংক্রান্তি ঢাকার মঞ্চে নতুন একটা ধারা নিয়ে এসেছিল। তিনি প্রচলিত পুরানো দিনের সংকে নতুনভাবে কাজে লাগালেন। মামুন ভাইর এ নতুন উদ্ভাবনটা আমাকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিল। সংকে কাজে লাগানো শুধু নয়, নাটকটার গঠন আর অভিনয় পদ্ধতি সব মিলিয়ে আমাকে মুগ্ধ করে রাখলো। বিষয়বস্তু খুব সাধারণ, কিন্ত তা যেন বহু মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে ফেলতে পারে। নাটকের অভিনেতারা মনে হলো সকলেই প্রায় নতুন, কিন্তু সকলেই এক ভিন্ন ধারায় ভিন্ন রকম অভিনয় করে গেলেন। ঢাকার মঞ্চে স্বাভাবিক রীতিরই এক অস্বাভাবিক ভিন্ন স্বাদের অভিনয় প্রতিভাদের দেখা মিললো। নাটকটার পরের প্রদর্শনী দেখলাম, সামান্যরকম উসখুশ না করে দ্বিতীয় প্রদর্শনীটা মুগ্ধতার সঙ্গে শেষ করলাম। মামুন ভাইর নাটক দেখতে গিয়ে আগে কখনো এমন হয়নি। নাটকটার তখন আমি প্রচারক হয়ে দাঁড়ালাম। নৃপেনদাকে নিয়ে গেলাম নাটকটা দেখতে, তিনি তত খুশি নন মামুন ভাইর আগের নাটকের বিচার।
বাকি কয়েকজনকে মনে হলো মামুন ভাইকে নিয়ে হতাশ, তাঁদের বিচারে ‘ওরা কদম আলী’ আর ‘ওরা আছে বলেই’র মতো শ্রেণী সংগ্রামের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে মামুন ভাই এখন হাস্যরস দেখাতে নেমেছেন। মনে নেই কে যেন বলেছিলেন, জয়জয়ন্তী তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক। বহুজনের সঙ্গে এ ব্যাপারে আমার দ্বিমত হয়েছিল। তার মানে এ নয় যে আমি সঠিক। কিন্তু হাস্যরস দিয়ে সংক্রান্তি নাটকটা শুরু হতো আর মামুন ভাই ধীরে ধীরে দর্শকদের অন্য এক জগতে নিয়ে যেতেন গল্পের ভিতর দিয়ে, শেষদৃশ্যটা যখন গান দিয়ে শেষ হতো আমার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে থাকতো। নাটকটা কতোটা ভালো আর মন্দ, সে বিচারে না গিয়ে বলবো, ঢাকার মঞ্চে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের একটা সফল নাটক। মামুন ভাই তার নিজেরই বিগত সকল গল্পের রীতি ভেঙে নতুন এক গল্প উপহার দেন দর্শককে আর তার সঙ্গে মিলিয়ে এক নতুন ধরনের অভিনয় উপস্থাপন করেন। বর্তমান শতকের আরো কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে পারের সংখ্যায়। সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় বহুবচনের ‘মহাজনের নাও’, সাইফ সুমনের নির্দেশনায় থিয়েটার আর্ট ইউনিটের ‘না মানুষি জমিন’, রতন দেব নির্দেশিত উদীচীর ‘রাজনৈতিক হত্যা’, লেট মি আউট মুগ্ধ হয়ে দেখেছি। চারটি নাটকই যেকোনো বিচারে যথেষ্ট মান সম্পন্ন। সুবচনের ‘মহাজনের নাও’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, দর্শকদেরকে ধরে রাখে টানটান উত্তেজনায়। রাজনৈতিক হত্যা এবং লেট মি আউট নাটক সম্পর্কে ঠিক একই কথা বলা যায়, দর্শকদেরকে আটকে রাখে গল্পের গাথুনির মধ্যে; নির্দেশনাও চমৎকার। নির্দেশনার ক্ষেত্রে বলতে হবে, না মানুষি জমিন নাটকটিকে কিছুটা চলচ্চিত্র দেখার স্বাদ পাওয়া যায়। বর্তমান শতকে আরো অনেকগুলি নাটক আমার ভালো লেগেছে যা নিয়ে পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা হবে। চলবে