নাট্য সমালোচনা এবং সমালোচনা গ্রহণ না করবার প্রবণতা

পর্ব ৫

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২০

বাংলাদেশের নাট্যচর্চার মূল সঙ্কটগুলি কোথায়? সেগুলি কি সকলেরই বিবেচনা করে দেখা উচিত নয়? বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি নিয়ে নাটকে বক্তব্য নেই বললেই চলে। বৃহত্তর জনগণের চাহিদার সঙ্গে এ নাট্যজগতের সম্পর্ক নেই। বাক-স্বাধীনতা হরণ এবং আরো নানা কারণে যখন জনগণের বিভিন্ন অংশ ক্ষুব্ধ, নাট্যচর্চা সেসব প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। পুরো এক যুগের বেশি সময় ধরে নাট্যচর্চা যেন প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সমাজের ভিতর নানা ধরনের স্ববিরোধ থাকে বলেই, শিল্প-সাহিত্যের চর্চা দরকার হয়। সাধারণ ব্যবসায়িক জগতের মতোই শিল্প-সাহিত্যের জগতেও যদি সততার অভাব দেখতে পাওয়া যায়, শিল্প-সাহিত্য যদি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতার দিকে ঝুঁকে পড়ে; তাতে সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে। খুব সহজ একটা প্রশ্ন করা যায়? নাটকের কাজ মানুষকে সচেতন করা। সমাজের সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলা? নাটক কি তার দর্শকদের মধ্যে সত্যিকার অর্থে সামান্যভাবে সেরকম চেতনা গড়ে তুলতে পেরেছে? পুরো সমাজের চরিত্র কি আগের চেয়ে ইতিবাচক না কি প্রতিক্রিয়াশীল বা নেতিবাচক? সমাজের মানুষের নৈতিকতার মান যে আগের চেয়ে নিম্নগামী এটা যে কেউ স্বীকার করবে। গত পঞ্চাশ বছর ধরে শিল্প-সাহিত্য চর্চার তাহলে অবদানটা কী?

শিল্প-সাহিত্য যদি মানুষের নৈতিকতার মান না বাড়াতে পারে, তাহলে নাট্য আন্দোলন এ ঘোষণাটি কেন দিয়েছিল যে তারা সমাজটাকে পাল্টাতে চায়। সমাজ যে আগের চেয়ে আরো হিংস্র হয়ে উঠেছে, লুণ্ঠন আর সন্ত্রাস যে আগের চেয়ে বেড়েছে তা নিয়ে কি সামান্য সন্দেহ আছে? যদি তাই হয়, সার্বিকভাবে নাট্যচর্চার ইতিবাচক ভূমিকাটা কী? দীর্ঘদিনের নাট্যচর্চাকে তাহলে কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে? বলা যাবে কি, নাট্যচর্চা সঠিক পথেই ছিল কিন্তু সমাজ অধ্বঃপতনের দিকেই চলে গেছে। সকলে আমরা অন্যের সমালোচনা করি, কিন্তু নিজেদের আত্মসমালোচনা করতে চাই না। নিজেদের ব্যর্থতাকে খুঁজে দেখতে বা তা স্বীকার করতে চাই না; যদি কেউ ব্যর্থতা ধরিয়ে দেয় সেটা পছন্দ করি না। বর্তমান সমাজের যে ত্রুটি, যা দিনে দিনে বেড়েছে; কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নাট্যচর্চা কখনো সেটাকে দর্শকের সামনে প্রতিফলিত করতে পারেনি। নিজেরাই সে-ব্যাপারে সচেতন ছিলেন না। সমাজে নানা অনিয়ম থাকবে বা চলবে, শিল্প-সাহিত্যের কাজ তার চিত্রগুলিকে উদ্ভাসিত করা এবং ব্যাখ্যা করা। বাংলাদেশের নাট্যচর্চা সেক্ষেত্রে কতোটা সফল? বাংলাদেশের সমাজ-রাষ্ট্র যে নানাভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত, সাংস্কৃতিক জগত আর শিক্ষাব্যবস্থা যে বণিকতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে, কথাগুলি কি নাটকে কখনো উচ্চারিত হয়েছে? নাকি নাট্য জগত বণিকতন্ত্রের সংস্কৃতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিশ্চুপ ছিল? বর্তমান সমাজের নানা ত্রুটি নাট্যজগতের সকলে যে খুশি মনে মেনে নিচ্ছে তাও নয়। বহুজনের মধ্যে অসন্তোষ আছে কিন্তু নাটকে তা নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই। ফলে অপরাধ-অন্যায় আর লুণ্ঠনকে নীরবে বাড়তে দেয়া হয়েছে। সামগ্রিকভাবে পুঁজির দাপটের বিরুদ্ধে লড়াই না করে, মূল শত্রুকে এড়িয়ে গিয়ে কখনো সখনো কথা বলেছে দুর্বল শত্রুর বিরুদ্ধে। প্রধান শত্রুকে তার ভিতর দিয়ে উত্থান লাভ করার সুযোগ করে দিয়েছে। সবটাই যে ইচ্ছাকৃত তাও নয়, সমাজ সম্পর্কে বিচার বিশ্লেষণ করার অক্ষমতা থেকেও সেটা হয়েছে। নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বার্থেও সেটা ঘটেছে। স্বভাবতই এ নাট্যচর্চা জনগণকে সচেতন করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশে যে সঙ্কটা চলছে বর্তমানে, বিশ্বের নানা দেশেও তা কালে কালে  বহুবার দেখা গেছে। সেটাই ইতিহাসের স্বাভাবিক ধারা। বাংলাদেশের বর্তমান নাট্যচর্চা দেখে সামগ্রিকভাবে বোঝার উপায় নেই বর্তমানের রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং জীবন সম্পর্কে তারা কী ভাবছে। বরং কথাটা এভাবে বলা ভালো, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে শিল্প-সাহিত্য যেন ক্রমশই বিবর্ণ এবং চরিত্রহীন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নাট্যচর্চা নিয়ে আমরা কোথায় ছিলাম, বর্তমানে কোথায় আছি আর ভবিষ্যতে কোথায় যেতে চাই সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। নাট্যচর্চার অতীত, বর্তমানের সঙ্গে যেন ভবিষ্যত তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সামনে এগুতে চাইলে স্বার্থের পিছুটান, বর্তমানে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলে নানানরকম আপসের প্রশ্ন, পিছু হঠতে চাইলে আবার নতুনের সঙ্গে সংঘর্ষ। স্বাধীনতা লাভের পর অবস্থার চাপে পড়ে কিছু কিছু মোহভঙ্গ ঘটেছে, কিন্তু তখন ঠেকে শিখেছি কিন্তু ভেবে বুঝিনি। নাট্যচর্চার দায় যেন তখন ঘাড়ে এসে পড়েছিল, ঘাড়ে চেপেছে বলে চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। দূরদৃষ্টি দিয়ে তাকে ভেবে দেখার চেষ্টা করা হয়নি। স্বাধীনতার পর নাট্যচর্চার ঘটনাটা হুড়মুড় করে এসে পড়েছিল তারুণ্যের অস্থিরতার ভিতর দিয়ে, কিন্তু আগে থেকে না ছিল প্রস্তুতি, না ছিল সতর্কতা। বহুক্ষেত্রে সে-কারণেই বেসামাল একটা পরিস্থিতি মধ্যে পড়ে গেছে নাট্যচর্চা। কিছু কিছু ব্যক্তির উত্থান ঘটেছে তার মধ্যে দিয়ে, কিছু মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন, প্রাচুর্যের মুখ দেখেছেন। সামগ্রিকভাবে নাট্যচর্চা তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি, কারণ লক্ষ্যটাকেই দূরদৃষ্টি দিয়ে হিসেব করে নির্ধারণ করা হয়নি।

সত্তর দশকের প্রস্ততি পর্ব নিয়ে নাট্যচর্চাকারীদের দৃষ্টিভঙ্গিটি কী ছিল সেটা খানিকটা বিচার করলেই বুঝতে পারা যাবে সঙ্কটটা কোথা থেকে আরম্ভ। বিশ শতকের সত্তরের দশকে স্বাধীন বাংলাদেশে মঞ্চনাটকের নতুন অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরপরই। স্বভাবতই এ নাট্যধারা রাজনৈতিক হয়ে উঠতে চাইলো নানা পারিপার্শ্বিক ঘটনার ভিতর দিয়ে। নাট্যরচনা এবং মঞ্চায়নে রাজনৈতিক চরিত্র অর্জনের চেষ্টা চালালো নতুনভাবে জন্ম নেয়া প্রায় সকল দলগুলি। রাজনীতিকে নাট্যচর্চার প্রধান ভূষণ করে তুলতে উদ্যোগী হলো নাট্যদলগুলি। বাংলাদেশের নাট্যচর্চার এক বিদ্রোহী রূপ লক্ষ্য করা গেল স্বাধীনতা পরবর্তীকালে। নাট্য রচনায় ক্রমেই যুক্ত হতে থাকলো রাজনৈতিক আক্রমণ। রাষ্ট্র ও সরকারের সাথে নানা বিরোধে জড়িয়ে পড়লো নাটক। মঞ্চে নাট্যকর্মীরা শোষকদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াতে চাইলো। সত্তরের দশকের পর আশির দশকেও শোষিত মানুষের মুক্তির কথা ঘোষিত হয়েছিল নাটকে। চলমান সমাজব্যবস্থা পাল্টে সরাসরি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করলো অনেকে। সে সময়কার নাটক সম্পর্কে মশিউর রহমান আদনান লিখছেন, ‘আমরা শ্রেণীহীন সমাজের আবশ্যিকতায় আস্থা রাখি যুক্তিসঙ্গত কারণে। আমাদের প্রেক্ষাপটে সমাজের মূলদ্বন্দ্ব যা আছে তাই হবে আমাদের গ্রুপ থিয়েটারগুলোর রচিত ও পরিবেশিত নাটকের মূল দ্বন্দ্ব।...শোষণ অব্যাহত রাখা বনাম শোষণ উচ্ছেদ করার প্রবণতাগুলো নাটকে উপস্থাপিত হবে এবং সাথে সাথে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আবশ্যিকতার কথা জনগণকে জানিয়ে দিতে হবে।’

নাট্য দলগুলোর বিভিন্ন ঘোষণাপত্রে বা প্রচারপত্রে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে মূল যে প্রশ্নটি গুরুত্ব পায় তাহলো নাটক কেন এবং কাদের জন্য প্রদর্শিত হবে, কোন্ লক্ষ্যকে সামনে রেখে। নাট্যকর্মীরা যেমন নিয়মিত নাটক মঞ্চায়নে উদ্যোগী হলেন তেমনি বহুজন নাটককে গ্রহণ করলেন সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসাবে। সমাজ পরিবর্তনে নাটক যে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে সে ব্যাপারে অনেকই তাঁদের মতবাদ ব্যক্ত করলেন। দেখা যাচ্ছে, সুদূর চিন্তা করা হয়েছিল স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে। নাটককে করতে চাওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক লক্ষ্য সাধনের হাতিয়ার। কেউ কেউ স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, তাঁদের লক্ষ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসে এটা ছিল একেবারেই নতুন চিন্তা। উদ্দেশ্য মহৎ, তাকে সাধুবাদ জানানো যায়। প্রশ্ন হলো, খুব ভেবেচিন্তে চারদিক বিবেচনা করে কি এসব কথা বলা হয়েছিল? যদি ভেবেচিন্তে বলা হয়ে থাকে, বারবার দিকবদল করতে হলো কেন? বাংলাদেশে প্রতিবাদী নাটকের যাত্রা বাহাত্তর সাল থেকে। স্বাধীনতার পূর্বে নিয়মিত নাটক করার কোনো প্রচলন ছিল না। যদিও বিভিন্নভাবে সে সময়ে বহু নাটক মঞ্চায়িত হতো বিভিন্ন বিদ্যালয়ে, সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।

বরং বলা যায় স্থানীয়ভাবে পাড়ায় মহল্লায় বিদ্যালয়ে স্বাধীনতার আগে বহু ধরনের নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বহু নাটক তখন মঞ্চায়িত হয়েছে বহু জায়গায়, ঢাকা এবং মফস্বলগুলিতে। ফলে স্বাধীনতার আগেও নাট্যচর্চার একটি চলমান ধারা ছিল। স্বাধীনতার আগের বাইশ-তেইশ বছরে কম করে হলেও শ পাঁচেক নাটকের বই মুদ্রিত আকারে পাওয়া যায়, যার প্রায়গুলি বহুবার মঞ্চায়িত। বাংলাদেশে তখন নাটক মঞ্চায়নের সংখ্যা স্বাধীনতা পরবর্তীকালের চেয়েও বেশি ছিল। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে প্রবেশপত্র বিক্রি করে নিয়মিত নাটক করার মতো নাট্যদল দল ছিল না। নিশ্চয় কিছু ব্যতিক্রম ছিল, ঠিক যেমন ঢাকা শহরের ড্রামা সার্কল। ড্রামা সার্কল-এর কথা বাদ দিলে স্বাধীনতার পূর্বে নিয়মিতভাবে নাটক মঞ্চায়ন করার ধারা গড়ে তোলা যায়নি বা সেরকম ভাবনা ছিল না। নাটককে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে বা রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করার ব্যাপারটা তখনো কারো বিবেচনায় আসেনি। নাটক মঞ্চায়ন প্রায় সকলের কাছে ছিল সখের ব্যাপার। যদিও তখনো নাটকের মধ্য দিয়ে নানা ধরনের প্রতিবাদ ঘোষিত হয়েছে, সমাজ বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেছেন নাট্যকাররা। মুখে তাঁরা বলেননি কখনো নাটক দিয়ে সমাজ পাল্টাবেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর নিছক শিল্পচর্চা হিসেবে নাটককে গ্রহণ করতে প্রায় কেউই রাজি ছিলেন না। শিল্পের জন্য শিল্প চর্চা কথাটা তখন বাংলাদেশে অচল হয়ে পড়েছে এবং তার বিপরীতে ‘শিল্পের জন্য শিল্প নয়, শিল্প হোক জীবন যুদ্ধের হাতিয়ার’ কিংবা ‘শিল্প হোক সমাজ সচেতনতা বা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার’ ইত্যকার শ্লোগান নাট্যাঙ্গনে বেশ কিছু দলের চিন্তায় ধ্বনিত হচ্ছিল।

মঞ্চায়িত নাটকগুলির মধ্য দিয়ে যে নানারকম প্রতিবাদ বা খুব উগ্র ধরনের প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নাটক রচনার মধ্য দিয়ে গণমানুষের প্রতি শক্তিধর মানুষের যে ধরনের নির্যাতন আগ্রাসন চলে তাকে চিত্রিত করা হয় এবং সেই সাথে বঞ্চিত মানুষের ক্ষোভকেও মূর্ত করা হয়। নানারকম বিভ্রান্তি সত্ত্বেও স্বাধীনতা পরবর্তী মঞ্চ নাটক তাই নতুন সব প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। স্বাধীনতা-উত্তর কালে নাটকের দলগুলো দর্শকদের সচেতন করার ব্যাপারটি তাদের মাথায় রাখে। প্রচলিত নাট্যধারা ও সমাজ ব্যবস্থার নানা রকম ত্রুটির প্রতি নাট্যকার ও নাট্যকর্মীদের ক্রোধ প্রকাশিত হয়। দর্শককেও তারা সেই ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন করতে, সে-সকল ত্রুটি বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী করে তুলতে চায়। এভাবেই নাটক সমাজের দুরাবস্থার পরিবর্তন ও সে পরিবর্তনের লক্ষ্যে মানুষের চিন্তার জগতকে ঘা দেয়ার একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যে নাট্য আন্দোলন শুরু হয় তা নিয়ে সকল মহলই খুব উচ্ছ্বসিত ছিল। বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন লেখনিতেই তা ধরা পড়ে। সেই সময়কার নাটক সম্পর্কে মাহবুব জামিল লিখছেন, এঁদের রচনাতে দুর্বার চেষ্টা আছে বর্তমান সমাজ, সমকালীন সমাজের রূপ প্রতিফলিত করা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলার রূপও সেজন্য যেমন দেখা যাচ্ছে, তেমনি নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোকে ভিত্তি করে রচিত হচ্ছে এসব নাটক। বর্তমান রাজনীতির চেহারাও বাদ যাচ্ছে না। মাহবুব জামিল ঠিকই বলেছিলেন। নাটকের বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকে আসে অভূতপূর্ব পরিবর্তন, যাকে দর্শকরাও প্রথম দিকে গ্রহণ করেছে কিছুটা আবেগ ও আন্তরিকতার সাথে। স্বাধীনতার চেতনা বাংলাদেশের নাট্যকারদের পুনর্জাত করেছিল নতুন মূল্যবোধে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের যে নতুন নাট্যধারা তারও সূতিকাগার ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের পাশাপাশি নতুন ধারার এই নাট্যচর্চার জন্য জন্ম নেয় আরণ্যক, নাট্যচক্র, বহুবচন, থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার, চট্টগ্রাম থিয়েটার, অরিন্দম, তীর্যক ইত্যাদি নাট্যসংস্থা। নতুনভাবে কাজ আরম্ভ করে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতির দাবিতে রচিত হলো নতুন নাটক, আবির্ভূত হলেন নতুন নতুন নাট্যকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন তরুণ পূর্ববর্তী কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই কিছু নাটক রচনা ও মঞ্চায়িত করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সেলিম আল দীন, আল মনসুর, হাবিবুল হাসান, নিরঞ্জন অধিকারী, শাহনুর খান, নুরুল করিম নাসিম প্রমুখ। নাটক লিখলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বাইরেও অনেকে। তাঁদের মধ্যে স্মরণীয় হলেন আবদুল্লাহ আল-মামুন, মামুনুর রশীদ, মমতাজউদদীন আহমদ, হাবিব আহসান, রবিউল আলম, কাজী জাকির হাসান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শেখ আকরাম আলী, রশীদ হায়দার, এবং আরো কয়েকজন। এই সকল নাট্যকারদের রচনায় তৎকালীন রাষ্ট্র ও সমাজের নানা ত্রুটির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লিখিত নাট্যকারদের নাটকগুলো পুরনো ধারার নাট্যরচনা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। বাংলাদেশের নতুন নাট্যধারায় নতুন এক মতবাদের আবির্ভাব আসন্ন হয়ে ওঠে। এই মতবাদের প্রবক্তরা ছিলেন রাজনৈতিক দল বহির্ভূত, সমাজ বিশৃঙ্খলায় বিক্ষুব্ধ, নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবার তাড়নায় উদগ্রীব একদল তরুণ। যাঁরা মঞ্চের পূর্বেকার সমস্ত রীতিনীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, নতুন নাট্যধারা নির্মাণের কথা বলেন, নতুন বিষয়বস্তুকে ঘিরে নাটককে জনতার বিষয় করে তুলতে চান। যাঁদের লক্ষ্য ছিলো নতুনভাবে কিছু করা। পুরাতন নাটক নয়, পুরনো ঐতিহ্য খোঁজার চেষ্টা নয়। নিজেরাই তাঁরা নাটক লিখেছেন, নিজেরাই তা মঞ্চস্থ করেছেন কিন্তু নিজেদের মতবাদ বা চিন্তা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছাড়াই। সেই পথ ধরেই জন্ম নিয়েছিল গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন।

বাংলাদেশের প্রারম্ভকালীন নাটক সম্পর্কে বিশ্লেষণ করার সময় এখানকার মঞ্চনাটকের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ যেসব চিন্তা-ভাবনা করেছেন বা বিভিন্ন সময় যেসব মন্তব্য রেখেছেন সে সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করা যেতে পারে। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন সম্পর্কে নাটকের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের যেসব লেখনী বা মতামত পাওয়া যায় তা অধিক ক্ষেত্রেই পরস্পর বিরোধী। নিজেদের কৃতিত্বকে বড় করে দেখাতে গিয়ে যেমন তাঁরা নাট্য আন্দোলনের মাহাত্ম্য প্রচার করেছেন, তেমনি তাঁদের লেখনীতে মাঝে মধ্যে এমন সব সত্য বের হয়ে এসেছে যাতে নাট্য আন্দোলনের নেতিবাচক দিকগুলিই প্রতিভাত হয়েছে। নাট্য আন্দোলনের প্রথম সারির ব্যক্তিরা নিজেদের দলের কাজ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হলেও, সেগুলোকে খুব বড় করে দেখলেও অন্যান্য দলের কার্যক্রমের যখন সমালোচনা করেছেন তখন মঞ্চনাটকের দুর্বলতাগুলোই সেখানে ধরা পড়েছে। বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের ওপর সেভাবে বিশ্লেষণাত্বক লেখালেখি হয়েছে খুব কম। হয়নি যে তা নয় কিন্তু সামগ্রিকভাবে সংখ্যায় কম। বিশেষ করে নান্দনিক বা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নাটকগুলোকে সেভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি। রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত ত্রৈমাসিক ‘থিয়েটার’ পত্রিকার তখন বিশেষ একটি ভূমিকা ছিল যা আগেই বলা হয়েছে। কখনও কখনও নাটকের ওপর বিশ্লেষণাত্বক কিছু কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। নাটকের সঙ্গে যুক্ত বা যুক্ত নন দু ধরনের কয়েকজন মানুষ নাট্যচর্চার এই পথচলা নিয়ে বিশ্লেষণের কাজটি করতেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে নাট্য আন্দোলনকে মূল্যায়ন করার মতো সমাজসচেতন লেখার দেখা তখনো মেলেনি। নতুন নাট্যচর্চাকে সঠিক পথ দেখাবার মতো বিশেষজ্ঞ, নাট্যকর্মে দক্ষ বা নাট্যচিন্তা সম্পর্কে প্রজ্ঞাবান কাউকে তখনো পাওয়া যায়নি। নাট্য বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোকপাত করার মতো ক্ষুরধার লেখনি সে কারণেই তখন পর্যন্ত অপ্রতুল ছিল।

সত্তর দশকে দেখতে পাওয়া যায়, নাটক রাজধানীতে নতুন প্রাণের স্ফুরণ ঘটায়, পুরানো নাট্যচিন্তার জায়গায় নতুন এক নাট্যচিন্তাকে দর্শকদের সামনে হাজির করে। সাধারণভাবে বলা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী নতুন ভঙ্গির প্রযোজনাগুলো নাট্য প্রয়োগের মধ্যে একটা গতি এনে দিয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী নাটকে বারবার যবনিকা ফেলবার রেওয়াজ উঠে গিয়েছিল। নাটকের দৃশ্য পরিবর্তনের জন্য দর্শকদের আগের মতো ক্লান্তিকরভাবে বসে থাকতে হতো না। নাট্য প্রযোজনার এই গতিময়তা স্বাধীনতা পরবর্তী সফলতার একটি প্রধান দিক। বাংলাদেশ মহিলা সমিতির মিলনায়তনকে কেন্দ্র করেই প্রধানত এই নিয়মিত নাট্যচর্চা দানা বেঁধে উঠেছিল। নাটক নিয়ে যেমন ব্যাপক হৈ চৈ, তেমনি নানা বিরূপ বা সমালোচনামূলক মন্তব্যও লক্ষ্য করা গেছে। রামেন্দু মজুমদার এ সময়ের নাটক সম্পর্কে লিখছেন ‘নাটক নিয়ে সম্প্রতি এতো হৈ-চৈ কেন হলো? তার আসল কারণ আমাদের দেশে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক তৎপরতা দৃষ্টিগোচর হয় না। এমন একটা পরিবেশে নিয়মিত নাটক, সুপরিবেশিত ও সমাজ সচেতন নাটক সহজেই দর্শক চিত্তকে নাড়া দিতে পেরেছিল।’ স্বাধীনতার পরপর ঢাকা ও চট্টগ্রামে দেখতে পাওয়া যায়, হঠাৎ প্রচুর নতুন নাটক লেখা হয়। যেমন নাটকে আগ্রহী নতুনরা নাটক লিখতে আরম্ভ করেন, তেমনি পুরানো অনেক লেখক-সাহিত্যিকরাও হঠাৎ নাটক লেখার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। হঠাৎ করে এতবেশি নাটক লেখা হতে আরম্ভ করে এবং এতবেশি নাট্যকারের দেখা মিলতে শুরু করে যে, এই প্রাচুর্য দেখে নাট্যকার নুরুল করিম নাসিম লিখেছিলেন, ‘আমাদের এখানে এক সময় সাহিত্য জগতে কবিতার চেয়ে কবির সংখ্যা দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল। তখন অকবিদের ভিড়ে আসল কবিকে চিনে নিতে কষ্ট হতো। এখন যেন সেই রকম একটা সময় এসে গেছে। অনাট্যকারদের ভীড়ে আসল নাট্যকার চিনে নিতে ভুল হয়।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই খুব বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করা গেল নাটকের নতুন প্রাণচাঞ্চল্য। স্বাধীনতার পরপর আমরা দেখতে পাই, হঠাৎ প্রচুর নাটক লেখা হয়। বহু মানুষ নাট্যকর্মে জড়িয়ে পড়ে। ইতিপূর্বে কিছু নাটক সম্পর্কে মমতাজউদদীন আহমদের মন্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। মমতাজউদদীন আহমদের সে লেখায় দেখা যায়, বাহাত্তর-তেহাত্তর সাল সময়কালে ন্যূনতম একশো বিশটি নাটক লেখা হয়েছে রাতারাতি, কিন্তু প্রশ্ন সেইসব নাটকগুলি এখন কোথায়? কখনো কি সেগুলির নাম আর সেভাবে উচ্চারিত হয় বা কজন সেগুলির নাম জানে!

যাঁরা এই নাট্যচর্চার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন জাতির খুবই ক্ষুদ্র অংশ। নাট্য আন্দোলন বা নব নাট্যচর্চার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিল রাজধানী ঢাকা ও বিভিন্ন শহরের একটি অংশের কতিপয় বা গুটিকয়েক মানুষ। সারাদেশ বা সারাদেশের জনগণ এর সাথে ছিল না। যুব সমাজের এক অংশকে তা মাতিয়ে তুললো। নাটক একই সঙ্গে হলো তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই, প্রতিবাদের ভাষা ও নিজেদের প্রচারের মাধ্যম এবং বিনোদন লাভ ও বিনোদন বিতরণেরও উপায়। শহুরে সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ নাটক সম্পর্কে উৎসাহী হলো। নতুন নাট্যধারা তাদের সচকিত করলো। নতুন ধারার নাট্যচর্চা দর্শকদের আশীর্বাদ লাভ করেছিল, কারণ নাটকের সাথে একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন জড়িত ছিল। বাংলাদেশের নাটক যে একটি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করেছিল সে নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। প্রশ্ন দাঁড়ায় নাট্যচর্চার সেই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে আমরা কীভাবে বিচার করব? নাট্য আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন সবাই সেটাকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও প্রথম থেকেই নানারকম প্রশ্নও দেখা দিয়েছিল। থিয়েটার পত্রিকাতে যেমন আনু মুহাম্মদ ছিয়াত্তর সালে লিখছেন, নাটকের অগ্রযাত্রাকে আন্দোলন বলে অভিহিত করবার আগেই ভাববার প্রয়োজন আছে যদি এ নাটক-স্রোত আন্দোলন হয় তবে নাট্যকর্মীরা এই আন্দোলন কী জন্যে, কাদের জন্যে করতে চাইছেন? কী তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য? তিনি লিখছেন, বর্তমানে দর্শক এবং পরিধি দুদিক থেকেই নাটক সীমিত পরিসরে আবদ্ধ। বর্তমানে যেসব নাটক পরিবেশিত হচ্ছে সীমিত পরিসরে সেগুলোর চরিত্র প্রশ্নাতীত নয় তবে সামাজিক দ্বন্দ্বের প্রকাশ আমরা সেগুলিতে দেখতে পাই। সামাজিক শ্রেণীগত দিক থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং সীমাবদ্ধতার কারণে সেসব নাটক কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমাপ্ত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত। তিনি সেই একই প্রবন্ধে আরো লিখছেন, ‘বর্তমান নাটকের ধারায় কিছু কিছু দিক আমার কাছে দুর্বলতা বলে মনে হয়েছে, যেমন: নাট্যঅঙ্গনে বেশ কিছু গোষ্ঠী নাটককে শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে ধরেছেন, তাঁরা এটাকে আন্দোলন বলছেন না; বললেও তা অন্য অর্থে বলছেন।’ তিনি আরো লিখছেন, ‘সবচেয়ে গুরুতর দুর্বলতা যেটি আমি মনে করছি সেটা হচ্ছে কোনো কোনো গোষ্ঠী ও বহুসংখ্যক  কর্মীর মধ্যে আদর্শ এবং লক্ষ্যের অভাব কিংবা আদর্শ ও লক্ষ্যের বিচ্যুতি।’

বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন যখন শুরু হয়, সেই সময়ের নাট্যচর্চা সম্পর্কে বশীর আল্হেলাল লিখছেন, স্বীকার করতেই হবে পরিস্থিতির বহুল পরিবর্তন হয়েছে। সেই সঙ্গে এ-কথাও স্বীকার করতে হবে নাটকের নব-সম্ভাবনার কোনো লক্ষণও লক্ষ্যগোচর নয়। তিনি সে সময় নাট্যচর্চা সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে আরো লিখছেন, ‘বাহাদুরী করা হয়। বলা হয়, “বাংলাদেশের নাটকের অঙ্গনে বিদ্রোহ এসেছে। তারুণ্যের দীপ্ত স্পর্শ লেগেছে। আধুনিক আঙ্গিকের নাটক মঞ্চায়ন করার একটা উল্লেখযোগ্য প্রয়াস আমাদের এখানে ক্রমবর্ধমান। সুবাতাস বইছে। নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্ম হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যচক্র ঢাকার নাট্য জগতে রীতিমতো বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল।” ইত্যাদি। ঢাকার নাট্যজগতে নাটক কোথায় যে তার বিদ্রোহ ও বিস্ফোরণ ঘটল? নাটকের কোনো ঘুণ-ধরা প্রাচীন পতিত ইমারত কি এখানে আছে যে বিদ্রোহ ও বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তার পতন ঘটাতে হবে? আগে একটা মোটামুটি ইমারত গড়ে উঠুক, তারপর বিদ্রোহ ও বিস্ফোরণের চিন্তা।’ বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের প্রথম পর্বের নাটকের বিষয়বস্তু ও সামগ্রিক দিকটি নিয়ে অনেকেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। থিয়েটার পত্রিকায় তিয়াত্তর সালেই অসীম সাহা লিখছেন, ‘স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাট্যচর্চার একটি তীব্রতম প্রবাহ লক্ষ্য করা গেলেও, তা আপাত চমকে যতখানি আলোড়নে সমর্থ, নাট্যিক গুণাগুণের যথাযথ প্রতিফলনে ততখানি নয়। বিশেষত টেকনিক্যাল প্রয়োগনিপুণতার দিকে বর্তমান নাট্যকারদের আগ্রহ অত্যন্ত বেশি বলেই মনে হয়।’ নুরুল করিম নাসিম লিখছেন, ‘অনেকের ধারণা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার, তেমনি নাট্য আন্দোলনেরও সূচনা হবে সেখান থেকে। রাজনৈতিক আন্দোলন এবং সাহিত্য বা শিল্প আন্দোলন দুটি বিপরীত ধর্মী বিষয়। একটি আবেগকে পুঁজি করে, বিশেষ একটি সময়কে ভিত্তি করে, কিছু ছলাকলা আশ্রয় করে, রাজনীতির আন্দোলন গড়ে তোলা যায়, কিন্তু সাহিত্য বা নাট্য আন্দোলন নয়। সাহিত্য বা নাট্য আন্দোলন নিছক আবেগ নয়, আন্তরিকতা, অভিজ্ঞতা এবং আরও কিছু অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ প্রয়োজন।’

শাহরিয়ার কবির সে সময়েই নাট্যকারদের শ্রেণীদৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। নাট্যকর্মীদের সম্পর্কে তাই শাহরিয়ার কবির লিখছেন, ‘বুর্জোয়া শিল্পকর্মী শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে অহরহ যে ধুম্রজাল সৃষ্টি করে চলেছেন আমাদের অধিকাংশ শিল্পীই সেই ধারণা থেকে মুক্ত নন। এঁরা কখনও বলেন, শিল্পের জন্য শিল্প, কখনও মানুষকে ভালোবাসার জন্য শিল্প রচনা করেন, কখনও রাজনীতি নিরপেক্ষ শিল্প সৃষ্টি করেন, কখনও বাস্তবতার হুবহু প্রতিফলনকে শিল্প বলেন, কখনও বা বলেন, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যই হচ্ছে শিল্প বিচারের মাপকাঠি। আসলে এঁরা প্রত্যেকেই প্রতিক্রিয়াশীল শিল্পের কর্মী যারা প্রগতির বিপরীতে কাজ করে যাচ্ছেন।’ ঢাকার বাইরেও বাংলাদেশের সর্বত্র একই ব্যাপার ঘটেছিল। নাট্য আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত একজন নাট্যকার নুরুল করিম নাসিম তিয়াত্তর সালেই লিখছেন, ‘এটা আনন্দের এবং আশার বিষয় প্রচুর নাটক হচ্ছে কিন্তু সত্যিকার অর্থে আন্দোলন শুরু হয়নি, শুরু হয়েছে আলোড়ন। এই আলোড়ন এবং আবেগ আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে আমরা জানি না।’ বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন প্রশংসার পাশাপাশি এভাবেই সমালোচিত হয়ে আসছিল নানা দিক থেকে। যেমন আটাত্তর সালে রামেন্দু মজুমদার লিখছেন, ‘স্বাধীনতা-উত্তরকালে নাট্য প্রযোজনার ক্ষেত্রে আশাতীত কর্মতৎপরতা পরিলক্ষিত হয়েছে, কিন্তু নাট্যরচনার ক্ষেত্রে আমাদের দারিদ্র্য তেমন একটা ঘোচেনি। সোজা ভাষায় যে হারে বা মানে আমাদের দেশে নাটক অভিনীত হচ্ছে তার সাথে তাল মিলিয়ে ভালো নাটক রচিত হচ্ছে না।’ রামেন্দু মজুমদারের বক্তব্য মেনে নিলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, মানসম্পন্ন নাটক রচনা ছাড়া কি সত্যিকারভাবে একটি নাট্য আন্দোলন দাঁড়াতে পারে? নাট্য আন্দোলন দূরের কথা, নাট্যচর্চার অগ্রগতি ঘটানো কি সম্ভব? বিশ্ব মানের বা উৎকৃষ্ট মানের নাটক রচনার ভিতর দিয়েই নাট্যাচর্চা গতিময় হতে পারে বা নাট্য আন্দোলনের যাত্রা সেভাবেই হওয়ার কথা। প্রকৃত ঘটনা হলো এই যে, মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তীকালের নানা ঘটনাবলীকে ঘিরে ইতিহাসের একটা অনিবার্য পরিণতিতে ভিন্ন পথে চলতে শুরু করেছিল পুরানো নাট্যধারা। কিন্তু তখনো তার মূল চরিত্রটি নির্ণিত হয়নি।

বিভিন্ন জনের সমালোচনাগুলো অনেক সময় খুব কঠোর প্রকৃতির হলেও তার মধ্যে বহু সত্য ধরা পড়েছে। নাট্যচর্চার শুরুতে যেমন কোনো ধরনের কোনো দিক নির্দেশনা ছিল না, ঠিক তেমনি তা মহিলা সমিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। নাট্যকর্মীরা তখন সত্যিকার অর্থেই জানতেন না তাঁরা আসলে কী চান। নাটক করার পেছনের মূল লক্ষ্যটা তখনো তাঁরা নির্ধারণ করতে পারেননি। কাদের জন্য নাটক করবেন সে ব্যাপারেও তাঁদের কোনো স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। যে-কোনো আন্দোলন শুরু করার পূর্বে একটা সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা থাকা দরকার, একটা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির করা দরকার। সে আন্দোলনকে এগিয়ে নেবার জন্য কাজের পদ্ধতি কী হবে সে ব্যাপারেও ভাবনা চিন্তা করা দরকার। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে সেটা কখনও দেখা যায়নি। বিশেষ করে নাট্য রচনার সংখ্যা অনেক হলেও, গুণগত বিচারে তা সেভাবে আলোচনার দাবি রাখে না। ইতিহাস স্বাক্ষী দেয়, বাহাত্তর সালের নাট্য আন্দোলনকারীরা নাট্য রচনার যে ধারা জন্ম নেয়, তার পেছনে বিজ্ঞানমনস্কতা না থাকায় তা খুব দ্রুত হারিয়ে গেল। সামান্য হৈ চৈ ফেলে ইতিহাস থেকে বিদায় নিলো। নাটকগুলো পরবর্তীকালে আর মঞ্চায়ন হতে দেখা যায়নি। সত্তর দশক ছিল বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের প্রথম পর্ব। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত এই সময়কালে যাঁরা নাটকের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিলেন, পরবর্তীকালে এঁদেরই একটি অংশ নাট্য আন্দোলনের নেতৃত্বে চলে আসেন। নাট্যদল হিসাবে সে সময়ের দলগুলিরই কয়েকটি পরবর্তীতে প্রধান সারির দলে পরিণত হয়। শুধু তাই নয়, সেই দলগুলিই দীর্ঘ সময় পর্যন্ত নাট্য আন্দোলনে ব্যাপক প্রভাবও বিস্তার করে। যদিও প্রথম দিকের বহু ব্যক্তি পরবর্তী সময় নাটকের সাথে আর জড়িত থাকেননি, কিংবা প্রথম দিকের বেশ কয়েকটি দলও আর শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল না; তারপরও এটা সত্য যে, পরবর্তী নাট্য আন্দোলনে যেসব দলগুলো সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে, যাদের প্রযোজনা সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পেয়েছে, সেইসব নাট্যদলগুলো হচ্ছে তিয়াত্তর সালের আগে যেগুলোর জন্ম। পরবর্তীতে বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্বরাও ঐসব দল থেকেই আগত, যাঁরা প্রথম থেকেই নাট্যকর্মের সাথে জড়িত ছিলেন। চলবে