নামাজে মন ফেরানো

পর্ব ৯

শারিন সফি অদ্রিতা

প্রকাশিত : জুলাই ১৮, ২০২০

আমরা নামাজে তাশাহুদের পরে একটা দুয়া পাঠ করি, যেটা আমাদের দেশে দুয়া মাসুরা নামে পরিচিত। এই দুয়া নিয়ে একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা আছে।  শেখ হাসিব নূরের ক্লাস করছিলাম এবং সেদিন ক্লাসে তিনি আমাদেরকে এই দুয়াটাই পড়াচ্ছিলেন। শেষের দুই লাইন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি স্টুডেন্টদের দিকে অদ্ভুত একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন। তিনি বললেন, আমার স্টুডেন্টরা যারা উপস্থিত আছ, আল্লাহ মাফ করুক, ধরো তোমাদের স্বামীরা যদি পরকীয়া করে তোমাদের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে, এরপর খুব করে মাফ চায়, কথা দেয় যে আর ওই পথে যাবে না— কে কে আছ যারা তাকে ক্ষমা করে দিতে পারবে?

প্রায় একশো স্টুডেন্টের ক্লাসে ৩০ টার মতো হাত উঠলো। শেখ বললেন, বাহ, তোমাদের মন তো অনেক বড়! আচ্ছা ঠিক আছে, ধরলাম সংসারের সুখের খাতিরে তাকে মাফ করে দিয়েছ। সংসার চলছে ভালোই। কয়মাস পরে আবার টের পেলে যে, সে তার পরকীয়ার প্রেমিকাকে ভুলতে পারেনি। এখনো তোমার অজান্তে চুটিয়ে প্রেম চলছে। আবারও সে ধরা খেয়ে তোমার কাছে অনেক মাফ চাইলো। আর ওই কাজ করবে না বলে ওয়াদা দিল। তোমাদের মধ্যে কারা কারা এই পর্যায়ে এসে তার স্বামীকে ক্ষমা করে দেবে, হাত তোলো। মোটে দশটার মতো কাঁপা কাঁপা হাত উঠতে দেখা গেল। শাইখ বললেন, তোমাদের ক্ষমা করার ক্ষমতা দেখে আমি আসলেই অবাক!

এরপর তিনি বললেন, স্টুডেন্ট সকল, যদি দ্বিতীয় বারের মতো হাজব্যান্ডকে মাফ করে দিবার পরও আবারও ধরা খেয়ে মুখ লাল করে ফিরে এসে সে তোমার কাছে ক্ষমা চায়, তখন তাকে কে কে মাফ করতে পারবে? দেখলাম, এক নিকাবি বোন খুব চাপা করে তার হাতটা ধীরে ধীরে তুললেন। চারপাশে তাকিয়ে আর কোনো হাত দেখতে পেলাম না। পুরো ক্লাসে পিন-পতন নীরবতা।

শাইখ এবার কথা শুরু করলেন, জেনে রেখো, আমাদের রব আল্লাহ হচ্ছেন গফুরুর রহীম। আমরা যেখানে প্রথমবার মাফ করতেই দশবার চিন্তা করি আর তৃতীয় বার মাফ করার কথা ভাবতেই পারি না, সেখানে আল্লাহ তা`আলা আমাদেরকে মাফ করে যান। তিনবার, তিনশো বার, তিন মিলিয়ন বার— যতবার ইচ্ছা আল্লাহর হক তুমি নষ্ট করে যাও না কেন— তিনি বারবার তোমাকে মাফ করবেন। পরকীয়ার থেকেও জঘন্য গুনাহ বারবার রিপিট করলেও তিনি মাফ করবেন যতক্ষণ ধরে তুমি খাঁটি তাওবাহ করে তার দিকে ফিরে আসতে থাকবে। নিঃশ্বাস ফুরোলেই কেবল এই দরজা বন্ধ হবে। এমন একজন রবের কথা অমান্য করতে এবং সেই অবাধ্যতার উপর অটল থাকতে বুকে পাটা থাকা লাগে।

সুবহানআল্লহ! এই দুয়াটার শেষের অংশে গফুরুর রহিমের এই ব্যাখ্যা আমি কখনো ভুলতে পারিনি। আসুন এখন বিস্তারিত দুয়াটা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। আবু বকর (রা.) একবার রাসূলকে (সা.) অনুরোধ করলেন, ইয়া আল্লাহর রসূল (সা:), আমাকে এমন একটা দুয়া শিখিয়ে দেন, যেটা পড়ে আমি নামাজে আল্লাহকে ডাকতে পারবো। তখন রসূল (সা.) তাকে শিখিয়ে দিলেন, আল্লাহুম্মা ইন্নি জলামতু নাফসি যুলমান কাছিরাও, ওয়ালা ইয়াগ ফিরূজ যুনুবা ইল্লা আন্তা ফাগফিরলি মাগফিরাতম মিন ইনদিকা ওয়ার হামনি ইন্নাকা আনতাল গফুরুর রহিম। (সহীহ বুখারী)

অর্থ, হে আল্লাহ, আমি আমার নিজের আত্মার উপর অত্যাধিক অত্যাচার করেছি এবং আপনি ছাড়া পাপ ক্ষমা করার কেউ নেই । সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমার প্রতি রহম করুন। নিশ্চয়ই আপনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু।

জুলুম বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, কোনো অত্যাচারী ক্ষমতাসীন ব্যক্তি তার থেকে দুর্বল কারো সাথে অবিচার করছে। এরকম অত্যাচার করাকে আমরা মোটেও ভালো চোখে দেখি না। অথচ আমরা নিজেরাই নিজেদের উপর সবচেয়ে বড় অত্যাচারটা করি যখন আমরা আমাদের আত্মাকে আমরা আল্লাহ থেকে বঞ্চিত করি। যতবার আমরা পাপ করি, এর মাধ্যমে নিজেদের উপর অত্যাচার করি। আল্লাহর আদেশ অমান্য করা আত্মার উপর সবচেয়ে বড় জুলুম। নামাজের এই পর্যায়ে এসে আমরা নিজেদেরকে নিজ আত্মার অত্যাচারী হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছি এবং জালিমে পরিণত হওয়া থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি।

আমরা যখন জালিম হয়ে যাই, তখন আল্লাহ ছাড়া আমাদেরকে রক্ষা করার আর কেউ নেই। তাই আল্লাহর কাছেই মাগফিরাহ ও রহমাহ চাই। আল্লাহর কাছেই ক্ষমা ও রহমত চাই. ফাগফিরলী মাগফিরাহ এবং ওয়ারহামনি এই দুইটার মানেই আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়া। কিন্তু তাদের মধ্যে খুব সুন্দর একটা পার্থক্য আছে। এখানে মাগফিরাহর তাৎপর্য হলো, যত বড় গুনাহই বান্দা করুক না কেন, আল্লাহ মাফ করতে সক্ষম। আর ওয়ারহামনির তাৎপর্য হলো, যতবারই বান্দা গুনাহ করুক না কেন, আল্লাহ মাফ করতে সক্ষম। সুবহানাল্লাহ! এই গফুরুর রহিমের তাৎপর্য টা শেখ নূর ভালোভাবেই আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিলেন।

ইয়া গফুরুর রহিম, ইয়া আল-আফুও, আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন। আমাদের উপর থেকে সকল আযাবকে উঠিয়ে নিন, আমরা যে আপনারই ক্ষমা এবং রহমতের ভিখারি। আমিন। চলবে