নিঃশঙ্কচিত্ত

নাটক ৩

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২০

পঞ্চম দৃশ্য
(থানা অফিসের একটি কক্ষে বাবা আর দারা বসে কথা বলছে। দূরে একজন পুলিশের সিপাহী ঘুরাঘুরি করছে।)
বাবা: নাম-ঠিকানাগুলো বলে দিচ্ছিস না কেন, তাহলেই তো সব ঝামেলা চুকে যায়। সরকার তো বলেছে, নাম ঠিকানাগুলো বলে দিলেই ওরা তোকে ছেড়ে দেবে। তোকে শুধু এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে তুই এসব রাজনীতির মধ্যে আর থাকবি না। দরকার হলে তুই দেশের বাইরে চলে যাবি।
দারা: বাবা তুমি কি শুধু মাত্র ঠিকানাগুলো জানবার জন্যই আমার কাছে এসেছ? সরকারের হয়ে যদি দালালি করতে এসে থাকো তাহলে এবার তুমি চলে যেতে পারো।
বাবা: কেন তুই বুঝতে পারছিস না, তোর কারণে আমাকে অনেক ভুগতে হবে। তোর ঘটনায় সরকার একবার আমার উপর ক্ষেপে গেলে আমার ব্যবসা বাণিজ্য সব ব্যাপারে ঝামেলা সৃষ্টি হবে। সবার নাম না বলিস কিছু নাম বলে দে।
দারা: তোমার ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার জন্য তুমি আমাকে আমার বিপ্লবী বন্ধুদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে বলছ। এমন প্রস্তাব দিতে তোমার লজ্জা হলো না?
বাবা: দেখ নামগুলো বলে দে। সারাটা জীবন আমাকে জ্বালিয়েছিস, আর ঝামেলা করিস না। নাম বলে দিলেই তোকে আমি সাথে করে নিয়ে যাব। কেউ তোর কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না। প্রতিবছর আমি সরকারি দলকে কত টাকা চাঁদা দেই, তুই জানিস?
দারা: সরকারি দলকে তুমি যেমন প্রচুর চাঁদা দাও, সরকারও তেমনি তোমায় কম সুযোগ-সুবিধা দেয় না। তোমার ব্যবসা কিসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে? নানা রকম দুর্নীতির পরও তুমি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছ কি করে? এখন তুমি সেই দুর্নীতির সাথে আমাকেও জড়াতে চাইছ। তোমার ব্যবসার স্বার্থে আমার বন্ধুদের নাম ঠিকানা বলতে হবে?
বাবা: শুধু আমার ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য নয়, তোর নিজের জীবনের জন্য নামগুলো তোর বলা দরকার। দারা, তোকে আমি সত্যি কথাটাই বলতে বাধ্য হচ্ছি, নাম ঠিকানাগুলো না বললে ওরা তোকে মেরে ফেলবে। কোনভাবেই আমি তোকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারব না।
দারা: দেখ বাবা, আমার জীবন-মৃত্যু নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
বাবা: কেন তুই এমন একগুঁয়ের মতো ব্যবহার করছিস? এসবের কোন মানে হয় না। এসব শুধু পাগলামি। দেখ, সত্যি কথাই আমি বলছি, নাম ঠিকানাগুলো না বললে ওরা তোকে...
দারা: ওরা আমাকে... ওরা আমাকে... ওরা আমাকে... ওরা আমাকে কি করবে, আমি জানি। সে নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। এখন তুমি যাও।
বাবা: এভাবে একটা ভুল রাজনীতির জন্য তোদের এই জীবন দেয়ার কোন মানে আছে? তোরা বুঝতে পারছিস না... কী যেন নাম তোদের লীডারটার, সে তোদের দিনের পর দিন ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। তোদের প্রত্যেকের উচিত দেশের মঙ্গলের জন্য এসব রাজনীতি ছেড়ে দেয়া।
দারা: বাবা, একটু বুদ্ধি হবার পর থেকে তোমার উপদেশ আমি কোনদিন গ্রহণ করিনি। এবং আজও করব না সে তুমি জান। তবুও মিছামিছি কেন উপদেশ দিচ্ছ?
বাবা: বাবা হিসাবে কি তোকে আমি কোন পরামর্শ দিতে পারি না? বাবা হিসাবে কি তোর কাছে আমার কোনই দাবি নেই?
দারা: না। বাবা হিসাবে তুমি তোমার সমস্ত অধিকার হারিয়ে ফেলেছ, যেদিন থেকে তোমার আমার রাজনীতি আলাদা হয়ে গেছে।
বাবা: সেটা তুই আলাদা করেছিস। মাথা গরমের মতো কথা নেই, বার্তা নেই, আণ্ডারগ্রাউণ্ড পার্টিতে যোগ দিয়ে বসলি। রাজনীতির নামে যত্তসব বাজে ব্যাপার। কোন বাবা এসব পছন্দ করবে?
দারা: সারাজীবন আমাকে যেমন তোমার মাথা গরম ছেলে মনে হয়েছে, তেমনি বড় হবার পর থেকে আমিও তোমাকে ভেবেছি আদর্শহীন। আজও তাই ভাবি, চিরকাল ভাবব। এবার তুমি যাও।
বাবা: দারা, তোরা যে পথে আগাচ্ছিস, যে পথে ক্ষমতা দখল করে দেশের মঙ্গল করতে চাচ্ছিস, সেটা এত সহজে সম্ভব নয়। তোর দেশের কী সম্পদ আছে কতগুলো মানুষ ছাড়া? এ অবস্থায় বর্তমান সরকার যথেষ্ট সুষ্ঠু ভাবেই দেশ চালাচ্ছে। তোরা শুধু শুধু সরকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছিস। এসব সন্ত্রাস ছেড়ে এবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আয়।
দারা: বাবা, তোমার রাজনীতি আর আমার রাজনীতি কোনদিন এক ছিল না। কোনদিন এক হবেও না। তোমার কাছে যা সন্ত্রাস আমার কাছে তাই বিপ্লবের মন্ত্র।
বাবা: তোদের সবার মাথায় শুধু বাজে চিন্তা। এভাবে দু চারজন মহাজন মাতব্বর মেরে তোরা শুধু দুর্নামই কামাই করছিস। এভাবে সন্ত্রাস করে কোন দেশে বিপ্লব এসেছে? চারু মজুমদার বছরের পর বছর চেষ্টা করে পেরেছে সার্থক হতে? চারু মজুমদারের দল এখন লণ্ডভণ্ড। বহুভাগে বিভক্ত। এসব ভ্রান্ত পথ, বিপ্লবের নামে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনা।
দারা: বাবা, বিপ্লবের তুমি কী বোঝা? সারাজীবন তুমি সরকারের পক্ষে দালালি করেছ আর টাকা বানিয়েছ। তোমার মুখে চারু মজুমদারের নাম উচ্চারণ কর না। যারা বিপ্লবের জন্য প্রাণ দেয় তাদের মূল্য তুমি বুঝবে না।
বাবা: রাজনীতির জন্য সোহরাওয়ার্দী, শেরে-বাংলার মত লোকরাও সর্বস্ব ত্যাগ করেছে। জনগণ চিরকাল তাদের স্মরণে রেখেছে? কিন্তু তোরা যেভাবে উল্টাপাল্টা প্রাণ দিচ্ছিস, তাতে তোদের কে মনে রাখবে? তোদের রাজনীতি আজ গলাকাটা রাজনীতি নামে সকলের কাছে পরিচিত। এই রকম রাজনীতির জন্য তোদের এই জীবন দেয়ার কোন মূল্য নেই।
দারা: বাহ! এতদিন পর যেন তুমি আমার ভুল পথ শুধরে দিতে এসেছ। বাবা, তোমার স্মরণ থাকা উচিত, তোমার কাছে পুত্র হিসাবে চেয়েছিলাম বড় একটা আদর্শ। সেটা কোনদিন তুমি দিতে পারনি।
বাবা: কী বলতে চাস তুই? তোদের কোন ভাল কাজে কখনো আমি বাধা দিয়েছি? হঠাৎ করে তুই কতগুলো বাজে লোকের সাথে মিশতে শুরু করেছিলি, শুধু তাদের সাথে মেশার ব্যাপারেই আমি তোকে বারণ করতাম। বাবা হিসাবে সেটা আমার দায়িত্ব ছিল।
দারা: কাদের তুমি বাজে লোক বলছ বাবা! যারা দেশের জন্য জীবন-যৌবন সব বিসর্জন দিল, কোনদিন নিজেদের ব্যক্তিগত ভাগ্য প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করল না। তাদের তুমি বলছ বাজে লোক!
বাবা: দেখ দারা, এসব নিয়ে তর্ক করবার সময় এটা নয়। তোর কাছে হয়ত কখনো আমি আসতাম না। আমাকে আসতে হয়েছে শুধু তোর মা আর মিম্মির জন্য। তোর ধরা পড়ার খবর পেয়ে ওরা দুজনেই খুব কান্নাকাটি করছে। তোর মামাই তোর মাকে বোকার মতো জানিয়ে দিয়েছে খবরটা। ভেবে দেখ, তোর মা সারাজীবন কি না করেছে তোর জন্য? তোর মা-বোনদের ফেলে যেভাবে তুই ছন্নছাড়ার মত জীবন কাটাচ্ছিস সেটা ঠিক নয়। এবার অন্তত নিজের ভালটা বুঝতে শেখ।
দারা: বাবা, নিজের ভাল, এ শব্দটা আর আমার সামনে উচ্চারণ কর না। ছেলেবেলা থেকে এই একটা শিক্ষাই শুধু আমাদের পশু বানিয়ে দেয়। আমাদের সব মনুষ্যত্বকে হরণ করে নেয়।
বাবা: বললাম তো, তোর সাথে আমি এখন তর্ক করতে চাই না। বাড়ি ফিরে চল। তোর মা এবং তোর বোন তোর জন্য অপেক্ষা করছে। তোর মা নিজে এখানে আসতে চেয়েছিল, খুব বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমি তাকে রেখে এসেছি। একজন মা তার জীবিত ছেলেকে বছরের পর বছর ধরে দেখতে পায় না, এটা তার জন্য কতবড় কষ্ট তুই বুঝতে পারিস?

দারা: (দীর্ঘ নীরবতার পর) মার শরীরটা এখন কেমন বাবা? কত বছর মাকে দেখি না! বহুদিন পর তোমাকে দেখেও প্রথম খুব অচেনা লাগছিল। মা কি সেই আগের মতোই হাসি-খুশী দুষ্টু আর চঞ্চল প্রকৃতির আছে বাবা?
বাবা: যে মা সব সময় শুধু শোনে তার ছেলেকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে, সেই মাকে তুই এখনো হাসি-খুশী দেখতে চাস! তোর মা নিঃশেষ হয়ে গেছে। তোরা বিপ্লবীরা এত বড় বড় বই পড়িস, শুধু ঘরের মার মনের খবরটাই রাখিস না।
দারা: জানি, তোমার কথার যুক্তি আছে। কিন্তু বাবা, মার কোলে শুয়ে শুয়ে তো দেশের মঙ্গল করা যায় না। দেশের জন্য প্রত্যেক মানুষের তো একটা কর্তব্য আছে। বাবা, মাকে তুমি বুঝিয়ে বল, মা যেন আমাকে ভুল না বোঝে। মাকে আমি এখনো-
বাবা: দারা, ভেবে দেখ বাবা, এখনো সময় আছে। তোর মৃত্যুর খবর শুনলে তোর মা আর বাঁচবে না। তোকে এখানে রেখে চলে গেলে তোর মার কাছে গিয়ে আমি কি জবাব দেব, বল।
দারা: মাকে বল যে, কোনভাবেই আমার পক্ষে বন্ধুদের নাম ঠিকানাগুলো বলা সম্ভব হল না। বাবা, আমি মারা গেলে তো শুধু একজন মা ভুগবে। যদি আমি নাম ঠিকানাগুলো বলে দেই, ভেবে দেখো, তাহলে কত শত মাকে কাঁদতে হবে। বাবা, ধর যদি আমি ধরা না পড়ে অন্য কেউ ধরা পড়ত, আর সে যদি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার নাম বলে দিত, মা খুশী হতে পারতেন এ ঘটনায়? আমাকে ধরিয়ে দেবার জন্য মা নিশ্চয় সেই ছেলেকে অভিশাপ দিতেন। বাবা, শত শত মায়ের অভিশাপ আমি কুড়োতে চাই না। বাবা, তুমি চলে যাও। [বাবা অনেক্ষণ চুপ করে থাকে। বুঝতে পারে ছেলে কোনভাবেই মত পাল্টাবে না]
বাবা: তোর কাছে একটা খবর গোপন রাখতে চেয়েছিলাম। এখন আর না বলে পারছি না। তোর বোনটার একটা কঠিন অসুখ হয়েছে। [কিছুক্ষণ থেমে] ক্যান্সার। খুব বেশিদিন বাঁচবে না রে। একজন মাকে যদি তার দু-দুটো সন্তানকে হারিয়ে একেবারে নিঃসন্তান হতে হয়।
দারা: বাবা, বাবা এসব কী বলছ তুমি! মিম্মির ক্যান্সার! মিম্মির ক্যান্সার, কী সব বলছ বাবা! কিছুতেই যে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
বাবা: মিম্মি এখনো জানে না মৃত্যু ওর কত কাছে। দারা, মিম্মিকে তো তুই ভীষণ ভালবাসতি। মিম্মিটাও তোর খুবই ভক্ত ছিল। সেই মিম্মির জন্য না হয় নামগুলো বলে দিয়ে আমার সাথে বাড়ি চল। তোর বন্ধুদের যাতে কোন ক্ষতি না হয় সেজন্য সরকারের সাথে আমি কথা বলব।
দারা: বাবা কেন তুমি আমার সাথে দেখা করতে এলে। বাবা, কেন তুমি এমন করে এই দুঃসংবাদগুলো আমাকে দিচ্ছ। বাবা, মিম্মি কেমন করে ক্যান্সারের রোগী হল? এ কথা তুমি তোমার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করছ কী করে?
বাবা: দারা, ঘটনা মানুষকে পাথর বানিয়ে দেয়। যখন খবরটা প্রথম শুনেছিলাম, ভেবেছিলাম হয়ত আর বাঁচব না। কিন্তু গত এক বছরে মেনে নিয়েছি, সব কিছু মেনে নিয়েছি। চল বাড়ি ফিরে চল। যতদিন মিম্মি বেঁচে থাকে, তুই, আমি আর তোর মা সবাই মিম্মির পাশে থাকি। আমি না হয় খারাপ, আমি না হয় আদর্শহীন। তোর মা, মিম্মি ওদের বিরুদ্ধে তো তোর কোন অভিযোগ নেই।
দারা: না বাবা, না। আমি পারব না। আমি পারব না। মার জন্য না, মিম্মির জন্য না, কারো জন্যই আমি আর আজ দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।
বাব:  তোর মাকে, মিম্মিকে তোর দেখতে ইচ্ছা হয় না?
দারা: বাবা, যদি এই বন্দীদশা থেকে পালাতে পারি মাকে আর মিম্মিকে সামান্য সময়ের জন্য হলেও দেখতে যাব।
বাবা: যেখানে তুই বন্দী আছিস সেখান থেকে পালানো সহজ নয়রে দারা। বিশেষভাবে পরিকল্পিত এই থানা। চারদিকে দুর্গের মতো পাহারা। পালাবার পথ রাখেনি ওরা।
দারা: জানি। আমাদের মতো মানুষদের গ্রেফতার করে নির্যাতন চালাবার জন্য এটা বিশেষভাবে করা হয়েছে।
বাবা: (নিরুপায়ের মতো অনেকটা) ঠিক আছে, আমি সরকারের সঙ্গে কথা বলব। যাতে তোর মায়ের সঙ্গে তোকে একবার দেখা করতে দেয়।
দারা: না বাবা, মাথার উপর মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বন্দীদশায় মায়ের সামনে দাঁড়াতে পারবো না। মা’র কষ্ট তাতে বাড়বে। যদি বন্দীদশা থেকে পালাতে পারি, স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে মাকে দেখতে যাব একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে।
বাবা: (নীরবতার পর) দারা, তোকে কোনদিন আমি বুঝতে পারলাম না। তুই আমার ছেলে অথচ তোকে কেমন যেন অচেনা লাগছে। কেন তোরা এই সন্ত্রাস করিস আমি বুঝি না। কেন তোরা এই সন্ত্রাসী রাজনীতির জন্য প্রাণ দিস, আমি বুঝতে পারি না।
দারা: সেটা তোমার দোষ নয় বাবা। আমরা যে কি চাই সেটা আমরাও কোনদিন তোমাদের ঠিক মতো বোঝাতে পারিনি। বাবা, শুধু তুমি নও, সবার কাছেই আমরা বড় বেশি অপরিচিত। সেটা আমাদেরই দোষ বাবা।
বাবা: দারা, তোর কি ধারণা, তোর মা আর মিম্মি তোকে যতটা ভালবাসে ততটা ভাল তোকে আমি বাসতে পারিনি। তোর কি ধারণা, তোর এই মৃত্যু আমাকে কোন কষ্ট দেবে না?
দারা: না বাবা, তেমন ভুল চিন্তা হয়ত একদিন করতাম। আজ আর করব না। বাবা হিসাবে সন্তানের প্রতি তোমার নিশ্চয় একটা মমত্ববোধ থাকবে, এত খুবই স্বাভাবিক।
বাবা: একটু বড় হবার পর থেকে তুই শুধু আমাকে ঘৃণাই করেছিস। আমার টাকার পেছনে ছুটে বেড়ানটা কোনদিনই তোর পছন্দ ছিল না। কিন্তু কার জন্য আমার এই টাকা পয়সা, কার জন্য আমার এই ছুটে বেড়ান বলত?
দারা: জানি বাবা জানি, সবকিছুই আমাদের জন্য করছ। তবে কি লাভ হল বাবা? মিম্মি চলে যাবে, আমিও চলে যাব, তারপর কে ভোগ করবে তোমার এই সম্পত্তি? মানুষ কখনো কখনো শুধু খেয়াল আর জেদের বশেই এত সম্পদ উপার্জন করে ফেলে, যা ভোগ করবার ক্ষমতাও তার থাকে না।
বাবা: যদি আমার টাকা না থাকত, তাহলে পিতা হিসাবে তোরা আমাকে অযোগ্য ভাবতি। তোদের সবরকম অভাবের জন্য তখন তোরা আমাকেই দায়ী করতি। যার টাকা নেই, সেই শুধু জানে টাকা কী জিনিস। হীরার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিস বলেই টাকার মূল্য কী বুঝলি না। টাকাহীন জীবন মানেই দারা, অপমানের জীবন। পথে ঘাটে অপমান।
দারা: সেটাও ভিন্ন এক সত্য বাবা। সেজন্য আমাদের দল কী চায় জানো? কোন ব্যক্তির হাতে সম্পত্তি নয়, সম্পত্তি থাকবে রাষ্ট্রের হাতে। মানুষ শুধু তার প্রয়োজন মতো রাষ্ট্রের নিয়ম মাফিক সে সম্পত্তি ভোগ করবে। (একজন সিপাহী ট্রেতে করে দু কাপ চা ও বিস্কুট নিয়ে প্রবেশ করে)
সেপাহী: স্যার, আপনাদের জন্য আমাদের ইন্সপেক্টর সাহেব পাঠালেন। আর কিছু দরকার হলে আমাকে বলতে পারেন।
বাবা: না, আর কিছুই দরকার নেই। নাও এটা তুমি রাখো। (পাঁচশো টাকার একটা নোট দেয় সিপাহীকে) এবার তুমি যাও। (সিপাহী চলে গেলে দারার প্রতি) নে, চা খা (দুজনেই চায়ের কাপ হাতে তুলে নেয়) ওরা তোর ওপর খুব মারধর করে তাই না? (দারা নিরুত্তর) যাবার সময় আমি বলে যাবো ওরা যাতে তোকে আর মারধর না করে। কিছু যদি মনে না করিস তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
দারা: বল।
বাবা: তোর যদি সিগারেট খাওয়ার অভ্যেস থাকে আমাকে বলতে পারিস। আমি কিছু সিগারেট তোর জন্য কিনে রেখে যাব।
দারা: না, বাবা, সিগারেট আমি খাই না। তোমার একটি মাত্র উপদেশ নিজের অজান্তেই আমি পালন করে গেছি। কেন করেছি জানি না। হঠাৎ তোমার আমার জন্য সিগারেট আনার ইচ্ছ হল কেন?
বাবা: মনের সেই কথা তোকে আমি কেমন করে বোঝাব। কাজের ঝামেলায় কোনদিন তোদের বন্ধু হতে পারিনি। তোর মা ঠিকই পেরেছিল। সেজন্যেই দেখতাম তোরা মার সাথে ছিলি আলাদা রকম। আজ হঠাৎ তোর বন্ধু হতে খুব ইচ্ছা করল দারা।
দারা: বাবা।
বাবা: বল। হ্যাঁ, বল।
দারা: একটু আগে যখন তুমি কথা বলতে এলে তখন তোমাকে কেমন যেন ব্যবসায়ী ব্যবসায়ী লাগছিল। এখন আর তা লাগছে না। এখন তোমাকে ভীষণ আপন লাগছে বাবা, তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। বহুদিন পর...
বাবা: তোর মৃত্যু আমায় বড় কষ্ট দেবে খোকা। বড় কষ্ট দেবে। তুই আমার প্রথম সন্তান। তুই ছিলি আমার প্রচণ্ড এক আনন্দ। কি ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্ট ছিলি তুই।
দারা: বাবা, তুমি শুধু এটা ভেবো না যে আমি সারা জীবন শুধু তোমাকে ঘৃণাই করেছি। বাবা হিসাবে সেই ছেলেবেলা থেকে তুমি আমার জন্য যা কিছু করেছ, আমি আজও ভুলিনি। ছেলেবেলায় আমি যখন ঘুমিয়ে পড়তাম তুমি এসে প্রায় আমার মাথায় বালিশ ঠিক করে দিয়ে যেতে। ঘুম ভাঙলেও সেটা কোনদিন তোমাকে জানতে দিতাম না। আমার একবার খুব অসুখ হলে মার বুকের মধ্যে তুমি শিশুর মত মুখ লুকিয়ে কেঁদেছিলে। সে ঘটনাটা আমার আজও মনে আছে। বাবা, তুমি আমাকে ভুল বুঝ না। আমি যা করেছি, সবকিছু দেশের জনগণের জন্য। আমার রাজনীতির জন্য।
বাবা: আমার সেই ছোট্ট ছেলে তুই, জন্মেই শুধু কাঁদতি। সেই ছোট্ট ছেলে যে কখন কীভাবে এমন বড় হয়ে গেলি, আর কী একটা ব্যবধান তৈরি হয়ে গেল আমাদের মধ্যে। রাজনীতি, রাজনীতি আমাদেরকে আলাদা করে দিয়ে গেল। হায়! সন্তানের জন্য যে সম্পত্তি চেয়েছিলাম, শুধু নিজের হিসাবের ভুলে সেই সম্পদ এক সময় সন্তানের চেয়ে বড় হয়ে গেল। দারা, আমার ভুল ক্ষমা করে দিস বাবা।
দারা: বাবা, মাকে বল, মাকে বল যে আমি তার কোন খারাপ ছেলে ছিলাম না। আমি সন্ত্রাসী ছিলাম না। লোকের মুখে মা যদি এসব শুনে থাকে তাহলে ভুল শুনেছে। আমি শুধু আমার দেশকে, আমার দেশের মানুষকে এবং এই জন্মভুমিকে প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিলাম।
বাবা: ছেলেবেলায় তুই কি ভীষণ ভীতু ছিলি, তেলাপোকা দেখলে আঁতকে উঠতি। সেজন্য আমাদের ড্রাইভার বারেক মজা করে তোর নাম দিয়েছিল বাহাদুর। বারেক বলত, আমাদের দারা বাহাদুর খুব সাহসী, তবে তেলাপোকা দেখলেই যা একটু ভয় পায়। সেই থেকে তোর নাম হয়ে গেল দারা বাহাদুর।
দারা: সবকিছু স্মৃতি বাবা, সবকিছু স্মৃতি হয়ে গেছে। আমি নিজেই আর এখন আমার অতীতকে চিনতে পারি না। আমার মত বিলাসী, উচ্চাকাঙ্খী ছেলে কিনা আজ এখানে একজন বিপ্লবীর ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে। [নীরবতার পর] আমি এই জীবনের জন্য সত্যিই গর্বিত বাবা।
বাবা: দারা, একটু বড় হবার পর তুই তো কোনদিন আমার কাছে কিছু চাসনি। আমার ওপর ভীষণ ঘৃণা ছিল তোর। আজ তুই আমার কাছে একটা কিছু চা। তোর যা খুশী একটা কিছু। আমার ভাল লাগবে।
দারা: কী চাইব বাবা? (সামান্য ভেবে নিয়ে) শুধু একটা অনুরোধ বাবা মিম্মির চিকিৎসার জন্য যত টাকা লাগে খরচ কর। বাবা, তোমার সব সম্পত্তি দিয়ে হলেও মিম্মিকে বাঁচাতে চেষ্টা কর। বাবা, মিম্মি কেন মরবে এত কম বয়সে। বাবা, মিম্মি নিশ্চয় ভাবছে আমি খুব নিষ্ঠুর।
বাবা: না, মিম্মি তো সব সময় তোর পক্ষে ওকালতি করছে সবার কাছে। তোর দেয়া ইস্পাত বইটা, আরও যেসব বই পাঠিয়েছিলি সব পড়ে ফেলেছে। মাঝে মাঝে আমাকেও পড়তে দিত। দারা, মিম্মির জন্য যা কিছু করা দরকার আমি করব। এবার তুই শুধু তোর নিজের জন্য আমার কাছে একটা কিছু চা। শুধু তোর নিজের জন্য।
দারা: হ্যাঁ চাইবো বাবা, আমাদের দলের খুব টাকার সঙ্কট যাচ্ছে। ওদের এখন ভীষণ টাকার দরকার। তুমি ওদের বেশ কিছু টাকা দিয়ে দাও, তোমার তো অনেক টাকা।
বাবা: দেবো, নিশ্চয় দেব। বল কত টাকা দেব? আমার সব টাকা তো এখন তোরই টাকা। বল টাকাটা কাকে দিতে হবে?
দারা: কারো নাম ঠিকানা তো তোমায় বলা যাবে না বাবা। না, না, আমি তোমাকে অবিশ্বাস করছি না। আমি বুঝতে পারছি, এখন তুমি আন্তরিক ভাবেই টাকাটা আমার দলকে দিতে চাইছ। কিন্তু পরে কখনো যদি তোমার মনের অবস্থা পাল্টে যায়।
বাবা: (দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে) নিজের দলের ব্যাপারে তুই বড় স্বার্থপর দারা, নিজের বাবাকে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে চাস না। ঠিক আছে, তুই তাহলে বল কীভাবে টাকাটা তোর দলকে পৌঁছে দেয়া যেতে পারে?
দারা: ভাবছি। (ভেবে) কারো নাম ঠিকানা তো বলতে পারব না, তবে কেউ যদি কখনো তোমার কাছে যায় টাকার জন্য। তখন দিয়ে দিও।
বাবা: হায়, আমার সাজানো সবকিছু সবকিছু, কেমন যেন ওলট পালট হয়ে গেল। তোদের দু জনের চলে যাওয়া তোর মাকে নিশ্চয় পাগল বানিয়ে দেবে। তখন আমার বেঁচে থাকাটাও অর্থহীন হয়ে যাবে।
দারা: বাবা।
বাবা: বল।
দারা: বাবা, তোমরা আর একটা সন্তান নিও। মিম্মি আর আমার মৃত্যুর পর তোমাদের তো নিশ্চয় একটা সন্তান দরকার হবে।
বাবা: সারাটা জীবন শুধু অন্যের সুখ নিয়ে ভাবলি। দেশ, জনগণ, বাবা, মা শুধুই পরের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিলি। এত মহৎ এত বড় মাপের একটা মানুষ আমারই ঔরসে, আমারই ঘরের অন্ধকারে লুকিয়ে ছিল আগে জানতে পারিনি।
দারা: বাবা, এবার যে সন্তান আসবে তাকে নিজের মতো বাড়তে দিও বাবা। দেখ, একদিন সেও মহৎ হয়ে জন্মাবে। তাকে শুধু বল, তাকে নিয়ে আমি মৃত্যুর আগে অনেক বড় স্বপ্ন দেখে গেছি।
বাবা: তুই আমাদের পরের সন্তানকেও বিপ্লবী হতে বলিস। তারমানে আমি আবার আর একটা সন্তান হারাবার জন্য তৈরি থাকব। কী দরকার তাহলে আমার আর একটি সন্তানের?
দারা: জানি না, বাবা, এর উত্তর আমার জানা নেই। বাবা, আমার মাথার ওপর তোমার হাতটা রাখ ছেলেবেলায় যেমন রাখতে। বাবা, দীর্ঘদিনের কাজের চাপে আমি বড় ক্লান্ত হয়ে পরেছি। বাবা, বাবা, সব দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে আজ আমি আবার শিশু হয়ে যেতে চাই। বাবা একটু বিশ্রাম দরকার আমার।
বাবা: দারা! দারা! লক্ষ্মী ছেলে আমার। (বাবা দারার মাথায় হাত রাখে।)

ষষ্ঠ দৃশ্য
(দারার মাথায় ব্যাণ্ডেজ। বোঝা যায় এটা নির্যাতনের চিহ্ন। সে বসেছিল গরাদের ভিতর। সেখানে কৌশিককে নিয়ে প্রবেশ করে পুলিশ ইন্সপেক্টর ও সেকেন্ড অফিসার। কৌশিকের সারা শরীরের যেটুকু দেখা যায় অত্যাচারের চিহ্ন স্পষ্ট। একজন সিপাহী এসে গরাদের তালা খুলে দেয়।)
ইন্সপেক্টর: দারা বাহাদুর, দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা? পরশুদিন রাহুলকে হত্যা করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। অবশ্য তাকে ধরবার জন্য আমাদের অনেক নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছে।
দারা: কৌশিক!
ইন্সপেক্টর: যাক চিনতে পেরেছেন। তাহলে আপনার দলের আরো একজন ধরা পড়ল। একে একে সবাই ধরা পড়বে। আপনাদের দল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, বুঝলেন।
অফিসার: এইটুকু একটা ছেলে আপনাদের শয়তানির জন্য এখন পুলিশের মার খাচ্ছে। স্কুলে পড়া একটা ছেলেকে পর্যন্ত আপনারা ফুসলিয়ে দলে ঢুকিয়েছেন। এর মৃত্যুর জন্য এখন কে দায়ী হবে?
ইন্সপেক্টর: দারা বাহাদুর, এইটুকু একটা ছেলেকে আপনারা রাজনীতির মধ্যে টেনে আনলেন কি করে? আপনাদের কি বিবেক বলে কিছুই নেই?
দারা: এইসব কিশোর ছেলেরা কেন গুপ্তদলে ঢুকছে সে তো আপনাদেরই ভাল জানবার কথা। দেশের সার্বিক পরিস্থিতিই ওদের আপনাদের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। সখ করে কেউ গুপ্তদলে আসে না।
ইন্সপেক্টর: সখ করেই আসে। পুলিশের সাথে লড়বার, রাতের অন্ধকারে এর ওর বাড়িতে হামলা চালাবার মধ্যে একটা রোমাঞ্চ আছে। নামগুলো বলে দিয়ে এবার আপনি নিজেও বাঁচুন। এই ছেলেটাকেও বাঁচান। নামগুলো আপনি না বললে এখন তারজন্য এই কচি ছেলেটা মারা পড়বে।
দারা: এই ছেলেটাকে তাহলে আপনি এখনো চিনতে পারেননি। ঠিকমত শুনে রাখুন, দেশের মঙ্গলের জন্য এরা হাসিমুখে মরতে পারে। ওর বয়স আপনার চেয়ে কম হতে পারে, ওর সাহস আপনার চেয়ে কম নয়।
অফিসার: সাহস নয়, বলুন দুঃসাহস। ছেলেগুলোকে নষ্ট করে আবার ওদের সাহস নিয়ে বড়াই করছেন। দেশের জন্য মরতে ভয় পায় না! দেখা যাবে।
ইন্সপেক্টর: আপনার ব্যাপারে আমরা এখনো ধৈর্য্যের পরিচয় দিচ্ছি তার একটা কারণ আছে। আপনার কাছে দলের মূল খবরগুলো রয়েছে, সেজন্যই আপনাকে আমরা এত দ্রুত মেরে ফেলতে চাই না। এই ছেলেটাকে আমরা আপনার সামনেই মেরে ফেলব।
অফিসার: গরু কীভাবে জবাই করে দেখেছেন তো, ঠিক সেইভাবেই তাকে জবাই করা হবে। তার কচি কণ্ঠনালী থেকে লালরক্ত গড়িয়ে পড়বে আপনার পায়ের কাছে।
ইন্সপেক্টর: ভেবে দেখুন ওকে আপনি বাঁচাতে চান কি না। ওকে আমরা আগেই মেরে ফেলতে পারতাম। আপনার কাছ থেকে কথা আদায় করবার জন্যই ওকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।
দারা: ইন্সপেক্টর, এসব খেলায় কিছুতেই আপনারা জিততে পারবেন না। বললাম তো, দেশের জন্য হাসিমুখে প্রাণ দিতে এরা শিখেছে। মৃত্যুকে সে ভয় পায় না। তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখুন, সেখানে কি ভয়ের চিহ্ন আছে?
ইন্সপেক্টর: মৃত্যুর আগে ওর ওপর নানাভাবে অত্যাচার করা হবে। কেন আপনি সেটা হতে দেবেন? দলের অস্তিত্বের চেয়ে মানুষের প্রাণের মূল্য অনেক বেশি। দল একবার ভেঙে গেলে আবার গড়া যায়। মানুষ একবার মরে গেলে আর সে ফেরে না।
দারা: ছেলেটার জন্য যখন আপনাদের এতই দরদ, তখন ওকে ছেড়ে দিন। ঝামেলা চুকে যাক।
অফিসার: দেখলেন তো স্যার, বাঁকা বাঁকা কথা বলার অভ্যাসটা গেল না। এই লোকটাই এদের সবাইকে খারাপ করেছে। দেশের সব তুখোড় তুখোড় ছেলে মেয়েগুলোকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে।
ইন্সপেক্টর: এখনো সময় আছে, বিপ্লবের নামে এসব পাগলামি ছাড়ুন। আপনার বাবা তার টাকার গরম দেখিয়ে আর কিছুই করতে পারবে না। আপনাকে নিয়ে পুলিশ এখন যা খুশী তাই করতে পারে।
অফিসার: এই দেখুন তবে ওর হাত আর হাতের আঙুলগুলো আমি একটা একটা কি করে ভাঙছি। (সেকেন্ড অফিসার হঠাৎ কৌশিকের হাত পেছনে নিয়ে জোরে আঙুলসহ চাপ দেয়। ব্যথায় কৌশিক কঁকিয়ে ওঠে)
কৌশিক: আহ! আহ!
ইন্সপেক্টর: এই জ্বলন্ত সিগারেটটা ওর কপালে চেপে ধরুন তো। দেখি তো কেমন সহ্যগুণ লোকটার। (সেকেন্ড অফিসার ইন্সপেক্টরের হাত থেকে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে চেপে ধরে কৌশিকের হাতের ওপর। কৌশিক আর্তনাদ করে। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে দারা)
দারা: যদি কোনদিন এখান থেকে ছাড়া পাই, আপনার ঐ সমস্ত শরীর আমি সিগারেটের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেব। জ্যান্ত শরীর থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নেব।
ইন্সপেক্টর: আপনজনের কষ্টে তাহলে আপনার মনেও ব্যথা লাগে? সিগারেটটা আবার চেপে ধরুন। শুনুন, নিজের একজন কর্মীর আর্তনাদ শুনুন।
কৌশিক: দারা ভাই! আহ্ আঃ আঃ আঃ
দারা: ইন্সপেক্টর এসব কী শুরু করেছেন। ওকে অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়ে যান।
ইন্সপেক্টর: বাহ! বাহ! শুনুন, এক ঘন্টা সময় দেয়া হল আপনাকে ভাবনা-চিন্তা করবার জন্য। এক ঘন্টা পর ঠিক রাত বারোটার সময় আমরা আবার আসব। আপনার সামনেই ওর উপর অত্যাচার চলবে। শান্ত মাথায় ভাবুন, মাত্র এক ঘন্টা সময় দেয়া হল আপনাকে।
অফিসার: লকআপ করে রাখো দুটোকেই। (ইন্সপেক্টর ও সেকেন্ড অফিসার চলে যায়। সিপাহী গরাদের দরজায় তালা দিয়ে প্রস্থান করে।)
দারা: কৌশিক!
কৌশিক: দারা ভাই, আপনার সাথে শেষ পর্যন্ত দেখা হল। আমি ভাবতেই পারিনি যে আবার আপনাকে দেখতে পাব। আপনি ধরা পড়ার পর আমরা ধরা নিয়েছিলাম ওরা হয়ত আপনাকে মেরে ফেলেছে।
দারা: তুমি কীভাবে ধরা পড়লে?
কৌশিক: বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য রাহুল ভাইকে হত্যা করার দায়িত্ব দিয়ে আমাকে পাঠান হয়েছিল। ওদের ফাঁদ বুঝতে না পেরে বোকার মত ধরা পড়ে গেলাম।
দারা: কবে ধরা পড়েছ?
কৌশিক: পরশু রাতে। ধরা পড়ার পর প্রথমে ওরা সকলের নাম ঠিকানা জানতে চেষ্টা করে।
দারা: কারো নাম বলেছ?
কৌশিক: না। নাম না বলার জন্য ওরা আমাকে মারধর করে। তারপর আপনার কাছে নিয়ে আসে। ট্রেনে করে আনবার সময় ওদের বুটের লাথি খেতে হয়েছে সারা পথে। এখনো হয়ত ওদের আসল অত্যাচার শুরু হয়নি।
দারা: হ্যাঁ। এতক্ষণ যা কিছু সহ্য করেছ সব প্রাথমিক, এরপর শুরু হবে আসল অত্যাচার। সব তোমাকে দাঁত কামড়ে সহ্য করে যেতে হবে।
কৌশিক: পারব তো?
দারা: পারতে হবে। কৌশিক মনে রেখো তোমার গুরুত্ব এখন অনেক বেশি। দলে থাকার সময় তোমার যে গুরুত্ব ছিল, বন্দী হওয়ার পর তোমার গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। তোমার ওপর এখন দলের অনেক ছেলে মেয়ের বাঁচা-মরা নির্ভর করছে।
কৌশিক: ওরা নিশ্চয় আপনার ওপরেও অনেক অত্যাচার করে। হ্যাঁ আপনার মাথার ব্যান্ডেজ দেখেই আমি বুঝতে পারছি। ওরা কি আপনাকে খেতে টেতে দেয়?
দারা: হ্যাঁ সেটা দেয়। কারণ আমি মরে গেলেও ওদের বিপদ। নাম ঠিকানাগুলো জানার একটা পথ ওদের হাত ছাড়া হয়ে যাবে।
কৌশিক: গত পরশু রাতে ধরা পড়ার পর থেকে ওরা আমায় কিছু খেতে দেয়নি। এক গ্লাস পানি চেয়েছিলাম। ওরা বলল, আমি যদি নাম ঠিকানাগুলো বলে দেই ওরা আমায় পেট ভরে খাওয়াবে।
দারা: বল কি! ওরা তোমাকে পুরো দু দিন না খাইয়ে রেখেছে!
কৌশিক: হ্যাঁ। ওরা তো আমাকে মেরে ফেলবে তাই। তাই না খাইয়ে রাখছে। নীলিমাদিকেও তোর ওরা না খাইয়ে রেখে মেরেছিল। আপনাকে এখানে পেয়ে আমার সাহস লাগছে। মরতে আর বেশি ভয় লাগছে না।
দারা: দাঁড়াও তোমার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছি। আমার রাতের খাবারটা এখনো রয়ে গেছে। (খাবার ও এক গ্লাস পানি ওর কাছে এনে) বাবা এসেছিলেন আমার সাথে দেখা করতে। দু চারজন পুলিশকে প্রচুর টাকা বকশিস দিয়ে গেছেন। বলে গেছেন আমার খাওয়ার যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেটা দেখতে। ওরা লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝে মধ্যে ভাল কিছু খাবার দিয়ে যায় ওদের খাবারের সাথে। নাও খাও।
কৌশিক: খেয়ে আর কী হবে। আমরা তো আর বাঁচব না। ওরা তো আমাদের মেরেই ফেলবে। কতদিন মাকে দেখি না। গত দু দিন ধরে শুধু মার কথা মনে পড়ছে। মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
দারা: এসব কথা এখন ভেব না, তাহলে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। নাও খেয়ে নাও। (কৌশিক খেতে শুরু করে। কিন্তু খাওয়ার প্রতি তার আগ্রহ নেই)
কৌশিক: আমার খুব ভয় করছে দারা ভাই।
দারা: কেন?
কৌশিক: ওরা যদি আমার ওপর অত্যাচার করে সহ্য করতে পারব তো? যদি সহ্য করতে না পারি, যদি যন্ত্রণায় নাম ঠিকানাগুলো বলে দেই, তখন কি হবে?
দারা: না, না। কৌশিক সেটা তুমি করতে পার না। কোনভাবেই না। তোমার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য পুরোদল ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কৌশিক, নিজের জীবনের চেয়ে দল অনেক বড়।
কৌশিক: নিজের জীবন বাঁচাবার জন্য, কিম্বা ওরা যে সব লোভ দেখাবে, সে সব লোভেও আমি নাম ঠিকানাগুলো বলব না। দারা ভাই, যদি অত্যাচার সহ্য করতে না পারি! ওরা কীভাবে অত্যাচার করবে আমি তো জানি না।
দারা: যতই অত্যাচার হোক, শুধু মনে রাখবে কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য, আমাদের দেশ, বিপ্লব-সব তোমার ওপর নির্ভর করছে। পৃথিবীর সকল বড় বড় বিপ্লবীরা পুলিশের সমস্তরকম নির্যাতন সহ্য করেও দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। তুমি কি তা পারবে না? ক্ষুদিরাম হাসতে হাসতে প্রাণ দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে মাস্টারদা সূর্যসেন, আরো হাজার হাজার বিপ্লবী।
কৌশিক: মৃত্যুকে আমার কোন ভয় নেই, তার জন্য দুঃখও নেই। শুধু ওদের অত্যাচারকে বড় ভয় লাগে। যদি সহ্য করতে না পেরে নাম-ঠিকানাগুলো বলে দেই। ওহ! ওরা কেন আমায় গুলি করে মেরে ফেলছে না!
দারা: কৌশিক, সময় কমে আসছে। ওরা ঠিক সময় চলে আসবে। নিজেকে শক্ত কর। তোমার ওপর এখন অনেক কিছু নির্ভর করছে।
কৌশিক: আমার ভয় করছে। সত্যি আমার ভয় করছে। আমি চেষ্টা করব সবকিছু সহ্য করতে। জানি না, শেষ পর্যন্ত কী হবে। ওরা নিশ্চয় দিনের পর দিন আমাকে না খাইয়ে রাখবে। হয়ত আমার চোখ তুলে নেবে। মুখ বেধে গরম পানি ঢালবে। তখন আমার শ্বাস হয়ত বন্ধ হয়ে আসতে চাইবে। তখন আমি কী করব আমি জানি না। দারা ভাই, আমি বোধ হয় সত্যিকার বিপ্লবী নই, তাই ভয় পাচ্ছি। আমি তো দেশকে ভালবাসি। দেশের জনগণকে ভালবাসি। দারা ভাই, আমার এত ভয় লাগছে কেন? অপারেশনে যেতে তো আমার এত ভয় লাগত না। দারা ভাই, আপনি আমাকে সাহস দিন, আর একটু সাহস দিন।
(সেকেন্ড অফিসার এসে কৌশিককে খেতে দেখে। তার পাশে প্রহরীটিও এসে দাঁড়িয়েছে।)
অফিসার: এই যে, খুব আদর হচ্ছে না! আমরা ওকে না খাইয়ে রেখেছি আর আপনি ওকে খেতে দিয়েছেন। বাহ খুব তো দরদ। দেখা যাবে এবার কতটা দরদ আপনার ওর জন্য। এই তালাটা খোল তো।
(সিপাহী তালা খুললে সেকেন্ড অফিসার ভিতরে প্রবেশ করে)

দারা: এইটুকু একটা বাচ্চা ছেলেকে দু দিন না খাইয়ে রেখেছেন, ওকে একটু খেতে দিয়েছি তো দোষের কি হয়েছে?
অফিসার: দোষের কি হয়েছে সেটা এক্ষণি দেখাচ্ছি। (লাথি দিয়ে সে খাবার সরিয়ে ফেলে। তারপর সিপাহীকে বলে) এই দাও তো সাঁড়াশিটা! ওর দাঁত আমি একটা একটা করে তুলে ফেলব। তারপর দেখব ও কেমন করে খায়। (দারা ঘটনায় একটু বিব্রত হয়। সেকেন্ড অফিসার সিপাহীর কাছ থেকে সাঁড়াশি নিয়ে কৌশিকের দাঁতে প্রচণ্ড জোড়ে আঘাত করে। কৌশিক ভীষণ ভয় পেয়ে যায়, মুখ থেকে রক্ত গড়ায়। থরথর করে কাঁপতে থাকে সে। সেকেন্ড অফিসার দাঁত তোলার জন্য এগিয়ে যায়। দারা দিকে ছুটে গিয়ে তার পেছনে আশ্রয় নেয় কৌশিক)
কৌশিক: দারা ভাই, দারা ভাই, আহ! আহ! দারা ভাই। (ভয়ে কৌশিককের চোখ মুখ বিকৃত হয়ে যায়)
দারা: সেকেন্ড অফিসার, আপনি এসব কী শুরু করেছেন? আমাকে এক ঘন্টা সময় দেয়া হয়েছে। সে এক ঘন্টা এখনো পার হয়নি।
অফিসার: ও আচ্ছা, তাই তো। এক ঘন্ট সময়। তবে তারও বারো মিনিট পার হয়ে গেছে। ঠিক আছে এক ঘন্টা পর এসে ওর দাঁত আমি একটা একটা করে তুলব। দারা বাহাদুর, দেখব কত দরদ আপনার। [সিপাহীকে] গেটের তালা বন্ধ করে দাও।
(সেকেন্ড অফিসার দ্রুত বের হয়ে যায়। সিপাহী গেটে তালা লাগিয়ে অর্ন্তধান করে। দারা ও কৌশিক দু জন অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে।)
দারা: কৌশিক, তুমি কি বুঝতে পারছ যে ওরা শেষ পর্যন্ত তোমাকে আমাকে মেরে ফেলবে? সেটা দু দিন আগে কিম্বা পরে।
কৌশিক: জ্বী।
দারা: মৃত্যুর আগে তোমার সবচেয়ে বেশি কোন ইচ্ছাটা হবে?
কৌশিক: জানি না, তবে মাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করবে। মা’র সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছা করবে। মা যদি সত্যি এখন এখানে চলে আসত!
দারা: তোমার মায়ের সঙ্গে নিশ্চয় ওরা তোমায় দেখা করতে দেবে না। মৃত্যুর আগে তোমার কি তোমার মাকে কোন কিছু বলে যেতে ইচ্ছা করবে?
কৌশিক: হ্যাঁ। মা মাঝে মধ্যে আমাকে খুব মারতেন। মা হয়ত ভেবেছে তাই আমি রাগ করে বাসা থেকে চলে এসেছি।  আমি তো বাসা ছেড়েছি বিপ্লবের জন্য। কেউ যদি মাকে গিয়ে বলে দিতো মা’র ওপর আমার কোন রাগ নেই। মা’কে আমি সব সময় ভালবাসতাম। দারা ভাই আমার মা খুব ভাল।
(দারা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। গভীর চিন্তার মধ্যে পড়ে যায়। সে তার মাথার ব্যাণ্ডেজ খুলতে থাকে।)
দারা: তোমার মা’র কথা মনে পড়ে, আর কার কথা মনে পড়ে?
কৌশিক: বড় দিদির কথা। যখন আমি ছোট ছিলাম বড় দিদি আমাকে খাইয়ে দিতেন। গোছল করিয়ে দিতেন। দারা ভাই, ছোট্ট থাকতেই আমার বাবা মারা যান। আমার মা একটা স্কুলে চাকরি করে আমাদের সংসার চালান। আমরা খুব গরীব। কতদিন আমরা না খেয়ে থেকেছি। যেদিন বাসায় কম রান্না হতো সেদিন মা তার খাবার থেকে আমায় তুলে দিতেন। দারা ভাই, মা নিশ্চয় আমার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকে প্রতিদিন।
দারা: খুব স্বাভাবিক। তোমাদের বাসাটা যেন কোথায়?
কৌশিক: শহরের সরকারী গালর্স স্কুলে গিয়ে আমার মায়ের নাম ‘মনোরমা দে’ জিজ্ঞাসা করলেই সবাই চিনবে। স্কুলের কাছেই আমাদের বাসা। আপনি এভাবে মাথার ব্যাণ্ডেজ খুলে ফেলছেন কেন?
দারা: মাথাটা খুব ব্যাথা করছে তাই। (দারা ব্যাণ্ডেজ খুলে হাতে নেয়। দড়ির মতো পাকাতে থাকে)
কৌশিক: দারা ভাই, আপনি আর আমি এখানেই মরে যাব তাই না? আর কোনদিন আমরা পৃথিবীতে আসব না। মা’র সাথে বড় আপার সাথে আর কোনদিন আমার দেখা হবে না।
দারা: বিপ্লবের জন্য আমার প্রাণ দিতে খুব ভাল লাগছে। তোমারও নিশ্চয়ই ভাল লাগছে। (কৌশিক চুপ) মানুষ তোমাকে নিয়ে কতো গর্ব করবে। কৌশিক, গরাদের বাইরে লক্ষ্য করে দেখ তো কিছু দেখতে পাচ্ছ কি? কোন লোকজন?
কৌশিক: কোথায়?
দারা: গরাদের বাইরের ঐ দেয়ালটার দিকে। খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য কর তো। (কৌশিক খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছিল! দারা হঠাৎ তার হাতের পাকানো ব্যাণ্ডেজ দিয়ে কৌশিকের গলায় ফাঁস পড়িয়ে দেয়, কৌশিক কিছু বোঝার আগেই। সে ফাঁস থেকে মুক্ত হতে চায়।)
দারা: কৌশিক তোমাকে আমি হত্যা করছি। বিপ্লবের স্বার্থে। নাহলে নির্যাতনে তুমি নাম ঠিকানাগুলো ওদের বলে দেবে। ক্ষমা কর কৌশিক, আমাকে ক্ষমা কর। বিপ্লব সকল কিছুর ঊর্ধ্বে।
(সিপাহীটি কিছু একটা লক্ষ্য করে ছুটে আসে। গরাদ খুলে সে বাধা দেবার আগেই শ্বাসরুন্ধ হয়ে কৌশিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে) চলবে