নিঃশঙ্কচিত্ত

সপ্তম দৃশ্য

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২০

(দুদিন পরের ঘটনা। সময় বিকাল বেলা। ইন্সপেক্টরের কক্ষে বসে ইন্সপেক্টর ও দারা আলোচনারত। দারার মুখে বড় দাড়ি গজিয়ে গেছে।)
ইন্সপেক্টর: দেখুন, আপনার ব্যাপারে মোটামুটি একটা সরকারী সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। শুনে হয়ত আপনার খারাপ লাগবে। সরকার আপনার ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড শাস্তিই বহাল করেছে। তবে নাম ঠিকানাগুলো বলে দিলে আপনার জন্য এখনো মুক্তির একটা পথ আছে।
দারা: আপনার কি মনে হয় যে এ খবর শুনে আমার খারাপ লাগছে এবং মৃত্যুদণ্ডের ভয়ে আমি নামগুলো বলে দেব?
ইন্সপেক্টর: সেরকম ভদ্রলোক যে আপনি নন সে তো আমি বুঝতেই পারছি। দেখুন, সরকারী সিদ্ধান্তের পরও আমার কিছু করার আছে। নামগুলো জানার জন্য আমি একটা শেষ চেষ্টা করব। আপনার ওপর আমি নির্মমভাবে অত্যাচার চালাব।
দারা: বাচ্চা ছেলেকে ভয় দেখাচ্ছেন?
ইন্সপেক্টর: নামগুলো বলে দিলে আপনার ক্ষতি কি? আপনারও জীবন রক্ষা পাবে, আমারও পদোন্নতি হবে। বুঝতেই পারছেন এই ঘটনার সাথে আমার পদোন্নতির একটা সম্পর্ক জড়িত। এই পদোন্নতিটা লাভের জন্য এমন কোন কাজ নেই যা আমি করতে পারি না।
দারা: নিশ্চয়। পদোন্নতি লাভের জন্য আপনার কিছু একটা করা দরকার। এটাও বুঝতে পারছি যে আপনার পদোন্নতির পর পদোন্নতি দরকার। জীবন শুধু আপনাকে শিখিয়েছে ক্রমাগত আর সাবইকে ছাড়িয়ে উপরে উঠে যেতে হবে।
ইন্সপেক্টর: দেখুন, এসব নীতিকথা আমাকে শুনিয়ে কোন লাভ নেই। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। অতএব নামগুলো আদায় করার জন্য যে-কোন রকম পথ আমি বেছে নেব। দরকার হলে আপনার আঙুল আমি একটা একটা করে ভাঙব। দরকার হলে গরম লোহার শিক দিয়ে আমি আপনার শরীর পুড়িয়ে দেব।
দারা: কাজগুলো কি আপনি নতুন করছেন? প্রভুদের হুকুম মতো হরহামেশাই তো এসব করে থাকেন। বন্ধু, যখন যে সরকার আসবে তার হয়ে অন্যের মাথায় লাঠি চালান, সামান্য ঘুষের জন্য নির্দোষ লোককে এনে হেনস্থা করা, এসব তো আপনার পেশা এবং কাজের অঙ্গ।
ইন্সপেক্টর: কী বোঝাতে চান আপনি? আপনি কি ভাবেন পুলিশের লোকরা সবাই খুব হারামি? তাদের কোন সৎ গুণ নেই? ছাত্র জীবনে আপনার মতো এরকম রাজনীতি আমিও করেছি। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানে পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়েছি। কিন্তু যখন অন্য কোন চাকুরি জুটল না, পুলিশের চাকুরি নিতে বাধ্য হয়েছি। আপনার কী? হীরার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছেন। বাবা, মা, ভাই, বোন কারো জন্য অর্থ উপার্জনের দরকার হয় না। রাজনীতি আপনি করবেন না তো কে করবে? ওসব রাজনীতির সখফখ বড় লোকদের দিয়েই হয় বুঝলেন, গরীবের জন্য নয়।
দারা: হ্যাঁ, কথাটা হয়ত খুবই সত্যি বলেছেন। যাদের দিন এনে দিন খেতে হয় তাদের জন্য রাজনীতি করার সময় কোথায়। কিন্তু রাজনীতি তো তাদের জন্যই প্রয়োজন, তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য।
ইন্সপেক্টর: হয়েছে হয়েছে রাখুন, ন্যায্য অধিকার। গত একশো বছর ধরেই তো এদেশে রাজনীতি হচ্ছে, গরীবের ভাগ্য পাল্টাবার জন্য। সেই সিপাহী বিদ্রোহের দিন থেকে। কোন ঘোড়ার ডিমের লাভ হয়েছে তাতে জনগণের। ঐ সব ফালতু কথা শুনতে আর ইচ্ছা লাগে না, বুঝেছেন।
দারা: এখানেই তো আপনার সাথে একজন বিপ্লবীর পার্থক্য। আপনারা যত দ্রুত নিরাশ হয়ে পড়েন, একজন বিপ্লবী তো তা পারে না। চারদিকে মানুষ না খেয়ে মরছে, ক্ষুধায় কাঁদছে, শীতে কাঁপছে, এ অবস্থায় একজন সচেতন মানুষ চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। তাকে একটা কিছু করার জন্য ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসতে হয়।
ইন্সপেক্টর: ঘর ছেড়ে আপনারা যত খুশি বের হয়ে আসুন, তা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। হ্যাঁ বরং আপনারা ঘর থেকে বের হয়ে আসবেন, সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল সন্ত্রাস করে বেড়াবেন, তাতেই আমার লাভ। বিরোধী দল না থাকলে দেশে পুলিশের আর কী দরকার? দয়া করে এবার নামগুলো বলে দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলুন। আপনি মুক্তি নিয়ে মায়ের কোলে চলে যান, আমিও একটা পদোন্নতি নিয়ে বড় একটা পদে বসি। তারপর সময় সুযোগ পেলে না হয় আবার রাজনীতি করবেন। আপনার মতো বড়লোক বাবা থাকলে এসব ফালতু রাজনীতি বাদ দিয়ে মন্ত্রী হবার চেষ্টা করতাম।
দারা: বড়লোকদের প্রতি আপনারও দেখছি ঘৃণা ও ক্ষোভ রয়েছে। এই যে যারা গাড়ি চড়ে বেড়ায়, লোকজনকে চাকরের মতো খাটায়, এমনকি আপনাদেরকেও হুকুমের দাস বানিয়ে রাখে তাদের প্রতি?
ইন্সপেক্টর: বাজে কথা বলবেন না তো। বড়লোকদের প্রতি আমার ক্ষোভ থাকবে কেন! বড়লোক হওয়া একটা যোগ্যতা। পারলে তো আমিও বড় লোক হব। দেখুন, আপনার ঐ যে গ্রামের কৃষক, আপনি কি ভাবছেন সে সারাজীবন গরীব হয়ে থাকতে চায়? মোটেই না। সেও বড়লোক হতে চায়। শুধু সুযোগ, সুযোগের অভাব। বুঝেছেন। আর আপনার ঐ কৃষক যদি কোনভাবে একবার বড়লোক হতে পারে, আপনি কি মনে করেন সে নিজের বাড়িতে চাকর-বাকর রাখবে না? দাসদাসী খাটাবে না? সব মানুষই নিজের উন্নতি চায়।
দারা: সব মানুষ উন্নতি চায় এবং আপনিও চান। পুরো জাতিকে পেছনে ফেলে একজনের উন্নতি হয় না। কারণ যতদিন বাকিদের অবস্থা আপনার সমান না হচ্ছে, তারা তো আন্দোলন চালিয়ে যাবেই।
ইন্সপেক্টর: চা খাবেন? চা খেলে বলুন, চা দিতে বলি। চা-টা খান, গল্প করুন, তারপর বন্ধুদের নামগুলো বলে দিন। দু-চারটা নাম ঠিকানা শুধু, দেখবেন ওতেই কাজ হবে। নামগুলো কোনভাবে সরকারের কাছে পৌঁছাতে পারলে আমার পদোন্নতি কে আটকায়। দরকার হলে সে জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। চা দিতে বলি?
দারা: আমাকে চা খাইয়ে আপনার খুব লাভ হবে না। সারাদিন ঘরের মধ্যে একা একা বন্দী হয়ে থাকি, তার চেয়ে আপনার সাথে কথা বলতে ভালই লাগছে। এখন মনে হচ্ছে আপনার সাথে গল্প করাটাও আমার চরিত্র স্খলনের কারণ হতে পারে।
ইন্সপেক্টর: (হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে) দেখুন, আপনাকে আমি গুলি করে মারব। নিজের হাতে। ঠিক মাথায় গুলি করব, যেন আপনার মগজগুলো গলে গলে পড়ে। আমার বন্দী হয়ে কিনা আপনি আমার সাথে বাহাদুরী দেখাচ্ছেন।
দারা; (হাসে) কী করব বলেন, নামের সঙ্গে যে বাহাদুর শব্দটা রয়েছে।
ইন্সপেক্টর: দাড়ান বাহাদুরী দেখাচ্ছি। (হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠলে সে রিসিভার তুলে নেয়) হ্যালো, হ্যাঁ বলছি। কি, কী বললে? খুকিকে পাওয়া যাচ্ছে না, খুকীকে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? একজন মহিলা তাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে! কখন?[দারা খুব মনোযোগ দিয়ে টেলিফোনের কথাগুলি শোনে] তোমরা সবাই কী করছিলে? স্কুল থেকে? কী বলছ! দাড়াও, দেখছি।
(সে রিসিভার রেখে দেয়)

দারা: কী হয়েছে ইন্সপেক্টর? আপনার মেয়েকে কেউ ধরে নিয়ে গেছে বললেন যেন, আপনার মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে, তাই তো?
ইন্সপেক্টর: থামুন তো আপনি। যথেষ্ট আপনার বকবক শুনেছি। সেন্ট্রি, সেন্ট্রি?
দারা: শুনুন ইন্সপেক্টর, সেন্ট্রিকে ডেকে কোন লাভ নেই। আপনার মেয়ের খবর এখন শুধু আমিই দিতে পারি। শান্ত হয়ে বসুন।
ইন্সপেক্টর: তারমানে? কী বোঝাতে চান আপনি?
দারা: ভয়ের কিছু নেই। আমার দলের লোকরাই আপনার মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে। একটু পরেই ওরা আপনাকে টেলিফোন করবে। হ্যাঁ, টেলিফোন করে ওরা আপনার কাছে আমার মুক্তি দাবী করবে। ঘাবড়াচ্ছেন কেন? যদি আমাকে ছেড়ে দেয়া হয় আপনার মেয়েও মুক্তি পাবে।
ইন্সপেক্টর: আমি আপনাকে এবং আপনার দলের সবকটাকে গুলি করে মারব। সবকটাকে জ্যান্ত পুতে ফেলব। শুয়োরের বাচ্চারা পেয়েছে কী?
দারা: ইন্সপেক্টর, মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। খেলা এবার নতুন ভাবে আরম্ভ হয়েছে। চিৎকার চেঁচামেচি করে কোন লাভ নেই। মনে রাখবেন, আপনার মেয়ে কয়েকজন সন্ত্রাসীর হাতে বন্দী। যে-কোন সময় সে মারা পড়তে পারে। একমাত্র আমাকে মুক্তি দিলেই আপনার মেয়ে বাঁচবে।
ইন্সপেক্টর: কী পেয়েছেন আপনারা? ভেবেছেন যা খুশি করে বেড়াবেন? এটা মগের মুল্লুক নাকি? কয়েদখানার মধ্যে নিজের দলের একটা ছেলেকে খুন করেছেন, আমরা কিছু বলিনি। কারণ ওটা আপনাদের লোক। আমার মেয়ের কিছু হলে-
দারা: ইন্সপেক্টর, কেন বুঝতে পারছেন না, খেলার পুরো চাল পাল্টে গেছে। নিজের বন্দীর কাছেই এবার আপনি জিম্মি হয়ে পড়েছেন। হয় আমার মুক্তি নতুবা আপনার মেয়ের মৃত্যু, কোনটা বেছে নেবেন? শান্ত মাথায় ঠিক করুন।
ইন্সটেক্টর: ভাব নিচ্ছেন? কী ভাবছেন আপনি!
দারা: বলেছিলাম না, যদি একবার এখান থেকে ছাড়া পাই। কিছু একটা ভরসা করেই তো বলেছিলাম।
ইন্সপেক্টর: আমার মেয়েকে আপনার দলের লোকরা কেন ধরে নিয়ে যাবে? সে তো কোন কিছুর সাথে জড়িত নয়। সে তো আপনাদের কোন ক্ষতি করেনি।
দারা: ইন্সপেক্টর, মানুষ জয়ী হতে চায় এবং জয়ী হবার জন্য সে যে-কোন রকম পথ বেছে নেয়। আপনার সরকারও কি তাই করছে না? দেশে বড় বড় আদালত থাকতে সে কি গোপনে এখানে আমার বিচার করছে না। ক্ষমতার দম্ভে আপনারা কি আমার ওপর বিশ্রী সব অত্যাচার করেননি? একটা অন্যায় আর একটা অন্যায়ের জন্ম দেয় ইন্সপেক্টর।
ইন্সপেক্টর: দরকার হলে আপনার দল একটা প্লেন হাইজ্যাক করত। অথবা একজন মন্ত্রীকে ধরে নিয়ে গিয়ে সরকারকে ভয় দেখাত। আমার এই নিষ্পাপ শিশুকে কেন?
দারা: ভয় পাচ্ছেন কেন? আমাকে ছেড়ে দিলেই তো আপনার মেয়ে মুক্তি পাবে। একটু আগে যেমন আপনি আমায় উপদেশ দিয়েছিলেন, নাম ঠিকানাগুলি বলে দিলেই আমি মুক্তি পেয়ে মায়ের কোলে ফিরে যেতে পারব, তেমনি এবার আপনাকেই আমার উপদেশ দেবার পালা। আমাকে ছেড়ে দিন, আপনার মেয়েও আপনার কোলে ফিরে আসবে।
ইন্সপেক্টর: আপনাকে ছেড়ে দেয়ার ক্ষমতা আমার এখতিয়ারে নেই। সে হুকুম দিতে পারে শুধু উপরওয়ালারা। দরকার হলে আপনারা উপরওয়ালার কারো মেয়েকে অপহরণ করুন। তাহলে আপনার মুক্তি অনেক সহজ হবে।
দারা: হ্যাঁ, এখন মনে হচ্ছে একটা ভুল হয়ে গেছে। কোন উপরওয়ালার মেয়েকে অপহরণ করা দরকার ছিল। দুঃখিত, ভুল যখন একবার হয়ে গেছে এখন আর কিছুই করার নেই।
ইন্সপেক্টর: তারমানে আপনারা এখন আমার নিষ্পাপ শিশুকে নিয়ে রাজনীতির খেলা খেলবেন, যে রাজনীতির কিছুই বোঝে না। রাজনৈতিক ঘটনার সাথে যার কোন সম্পর্ক নেই। যে একটা বাচ্চা শিশু, মাত্র ইস্কুলে যেতে আরম্ভ করেছে।
দারা: ব্যাপারটা নিয়ে আপনি এত দুশ্চিন্তা করছেন কেন? হিসাবটা তো সহজ, আপনি আমায় ছেড়ে দেবেন, আপনার মেয়েও মুক্তি পাবে।
ইন্সপেক্টর: ওহ্ আপনি বুঝতে পারছেন না কেন, আমি একজন সাধারণ ইন্সপেক্টর। আপনাকে ছেড়ে দেয়া, না দেয়া সেটা উপরওয়ালাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপার।
দারা: আপনার উপরওয়ালাদেরকে বলুন, দেখুন তারা কি সিদ্ধান্ত দেয়। তারা নিশ্চয় আপনার মেয়ের মৃত্যু চাইবে না, আমাকে ছেড়ে দেয়াই ঠিক করবে।
ইন্সপেক্টর: ব্যাপারটা আপনি যত সহজ করে দেখছেন অত সহজ নয়। আপনি কি মনে করেন আমার কোন সেপাইার মেয়েকে আপনার লোকরা ধরে নিয়ে গেলে, সেই মেয়েকে বাঁচানোর জন্য আমি আপনাকে ছেড়ে দিতাম? না। উপরওয়ালাদের কাছে আমরাও সেপাইর চেয়ে বেশি কিছু নই। আমার মেয়ের জীবন মরণ তাদের কাছে কোন সমস্যা নয়। তারা হয়ত এমন কোন সিদ্ধান্ত দেবে যা আমার মেয়ের জন্য ক্ষতিই বয়ে আনবে।
দারা: আশ্চর্য! একটি বাচ্চা মেয়ের নিরাপত্তা দেয়াটা কি সরকারের দায়িত্ব নয়? সরকারের কি উচিত নয় নিষ্পাপ ঐ মেয়েটাকে বাঁচানর জন্য আমাকে ছেড়ে দেয়া? একটা শিশুর নিরাপত্তার কথা ভাবা কার দায়িত্ব বলুন তো?
ইন্সপেক্টর: বললাম তো যত সহজ করে আপনি ব্যাপারটাকে দেখছেন ব্যাপারটা তত সহজ নয়। আজ যদি আমার মেয়ের কারণে আপনাকে ছেড়ে দেয়া হয়, কাল থেকে তাহলে এটাই একটা খেলা হয়ে দাঁড়াবে। এরপর থেকে প্রতিবারই লোকজন এভাবে মুক্তির জন্য কারো না কারো মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে যাবে। অতএব সরকারকে দৃঢ়ভাবে বোঝাতে হবে যে এভাবে করে সরকারকে দুর্বল করা যায় না।
দারা: তাহলে আপনার মেয়ের মুক্তির জন্য আপনি কী করবেন ভাবছেন? আমার দলের লোকদের দাবি একটাই, তাহলো আমাকে ছেড়ে দেয়া। আমাকে ছেড়ে না দেয়া হলে নিঃসন্দেহে আপনার মেয়ে মারা পড়বে।
ইন্সপেক্টর: আপনি নিশ্চিত হলেন কী করে যে এটা আপনার দলেরই কাজ? আপনার মুক্তির জন্যই তারা আমার মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে?
দারা: একটু অপেক্ষা করুন, দেখবেন আমার ধারণাই সত্যি। একজন পুলিশ কর্মকর্তার মেয়েকে নিশ্চয় চোর ডাকাতরা ধরে নিয়ে যেতে সাহস করবে না। নিয়ে যাবার কোন কারণও নেই।
ইন্সপেক্টর: আমি কি তাহলে উপরওয়ালাদেরকে টেলিফোন করে জানাব ব্যাপারটা? উপরওয়ালারা যদি আমাকে সিদ্ধান্ত দেয় আপনাকে ছেড়ে দেয়ার তাহলে আমি আপনাকে ছেড়ে দেব।
দারা: আপনি তো বললেন আপনার উপরওয়ালারা আপনাকে একজন সিপাহী ছাড়া আর কিছু ভাবে না। অতএব আপনার জীবন মরণ তাদের কাছে কতটা ভাববার বিষয় হবে তা নিয়ে এখন আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আপনি যদি মনে করেন উপরওয়ালারা সব খবর জানার পর আপনার মেয়েকে বাঁচানর জন্য আমাকে ছেড়ে দেবে, তাহলে অবশ্যই টেলিফোন করতে পারেন।
ইন্সপেক্টর: তারা আপনাকে ছেড়ে দিতে না বলুক, নিশ্চয় ফোর্স দিয়ে আমাকে সাহায্য করবে। আমার মেয়েকে উদ্ধারের জন্য গোয়েন্দা বাহিনীকে কাজে লাগাবে। গোয়েন্দারা চাইলে হয়ত ফোর্স নিয়ে আমার মেয়েকে উদ্ধার করেও আনতে পারে।
দারা: সেক্ষেত্রে গোয়েন্দা পুলিশরা যদি কৃতকার্য হয় তাহলে অবশ্যই আপনি আপনার মেয়েকে ফেরত পাবেন। তবে জীবিত অবস্থায় নয়, মৃত। আপনার কি মৃত মেয়েকে কোন দরকার আছে? তাহলে গোয়েন্দাদের সাহায্য নিন।
ইন্সপেক্টর: ভীষণ নিষ্ঠুরের মতো কথা বলছেন আপনি। কেন আপনারা তাকে মারবেন? সে আপনাদের কী ক্ষতি করেছে? বলুন কী ক্ষতি করেছে সে?
দারা: কোন ক্ষতি সে আমাদের করেনি। সে কারণে তো আমিও চাই না মেয়েটা মারা পড়ুক। সে বেঁচে থাক, বেঁচে থেকে বাবা মার কোলে ফিরে আসুক। তার বেঁচে থাকার এখনো পথ খোলা আছে।
ইন্সপেক্টর: তার মানে আপনি বলতে চান যে এক্ষণি আমার মেয়ের মুক্তির জন্য আমি আপনাকে ছেড়ে দেই। হ্যাঁ আমাকে খাঁচার মধ্যে আটকে দিয়ে এখন আপনি নিজের সুবিধা অনুযায়ী খেলছেন।
দারা: পুরো ব্যাপারটা যেহেতু আমার কারণে ঘটেছে, সেজন্যই আমাকে খুব মন দিয়ে খেলতে হচ্ছে। মেয়ের মুক্তির জন্য আপনাকেও সে খেলায় অংশ নিতে হবে।
ইন্সপেক্টর: মেয়ের মুক্তির জন্য যদি আমি আপনাকে ছেড়ে দেই তাহলে এক্ষণি আমার চাকুরি চলে যাবে। মেয়ের জীবনের জন্য চাকুরি ছেড়ে দেয়া আমার কাছে কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু চাকুরি ছেড়ে দিলেই কি সরকার আমায় ছেড়ে দেবে? না, সবার সামনে দাঁড় করিয়ে দায়িত্ব অবহেলার জন্য আমাকে গুলি করে মারা হবে।
দারা: তাহলে সমস্যা হচ্ছে এখন আপনার আর আপনার মেয়ের জীবনের মধ্যে কার জীবনকে আপনি বেশি মূল্য দেবেন। নিজের মৃত্যু, না মেয়ের মৃত্যু?
ইন্সপেক্টর: আমার একটি মাত্র মেয়ে। আপনি কি মনে করেন তাকে আমি মেরে ফেলতে চাই?
দারা: মেয়েকে বুঝি আপনি খুব ভালবাসেন? বাবা হিসাবে অবশ্য আপনার জন্য সেটা খুব স্বাভাবিক।
ইন্সপেক্টর: আমাদের ঐ একটি মাত্র মেয়ে, আমাদের একমাত্র সন্তান। জন্মের পর থেকে যে ওকে আমরা কত কষ্টে বাঁচিয়ে রেখেছি। শুধু একটার পর একটা অসুখ, কঠিন কঠিন সব অসুখ। শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেল। এখন ওকে ছাড়া আমরা আমাদের জীবনের কথা ভাবতে পারি না। ও ভীষণ লক্ষ্মী মেয়ে আমার। আমার এই মেয়েকে নিয়ে কেন আপনারা রাজনীতি করতে গেলেন? (হঠাৎ টেবিলে মাথা রেখে ইন্সপেক্টর শিশুর মত কেঁদে ওঠে। তার কান্না দারার মধ্যে ভীষণ রকম এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। দারা  কিছুক্ষণ ইন্সপেক্টরকে অসহায়ের মতো কাঁদতে দেখে। তারপর ইন্সপেক্টরের মাথায় হাত রাখে।)
দারা: কাঁদবেন না, প্লীজ কাঁদবেন না। মাথা তুলুন। (কিছুক্ষণ চুপচাপ দুজনেই, ইন্সপেক্টরের ফোঁপানো কান্না শোনা যায়। দারার হাত তখনো ইন্সপেক্টরের মাথার উপরে) আপনার মেয়ের সমস্যার একটা সমাধান নিশ্চয় খুঁজে পাওয়া যাবে। আপনি শান্ত হোন। একটা ছোট্ট শিশুকে নিয়ে রাজনীতি, তাকে রাজনৈতিক ঘটনার সাথে জড়িয়ে ফেলা আমারও পছন্দ নয়। (দারা বাহাদুরের ব্যবহারের ইন্সপেক্টর বিস্মিত। সে টেবিলের ওপর থেকে মাথা তোলে। দারার দিকে তাকায় অসহায় ভঙ্গিতে) একটা শিশু, সে শিশুই। সে কার শিশু সেটা বড় কথা নয়। সে আমাদের সকলের ভবিষ্যৎ।
ইন্সপেক্টর: সমাধান, সমাধান কী বলুন। আমার দিক থেকে সমাধানের কোন সুষ্ঠু পথ আমি দেখছি না। আর আপনাকে ছেড়ে দেয়া, সে ক্ষমতাও আমার নেই। সেটা অসম্ভব ঘটনার মতোই।
দারা: (কতকটা নিজের মনে) ভীষণ আনন্দ লাগছে আমার একথা ভাবতে যে, পুরো ঘটনাকে এখন আমি একা নিয়ন্ত্রণ করছি। আপনাদের কারো কিছু করবার নেই। যা কিছু সব আমার একার হাতে। কী ভীষণ এক শক্তি আমি এখন, বুঝতে পারছেন। (সে হাঁটতে হাঁটতে একদিকে চলে যায়।)
ইন্সপেক্টর: কী হয়েছে আপনার, আপনি এমন করছেন কেন, খুলে বলুন, সব কিছু খুলে বলুন।
দারা: (স্বাগত) না, না, রাজনৈতিক ঘটনার জন্য কোনভাবেই একটা নিষ্পাপ মেয়ের জীবন ধ্বংস হতে পারে না। অনেক ভুল হয়ে গেছে আমাদের, আর নয়। নতুন কোন ভুলকে আর প্রশ্রয় দেয়া যায় না। না নিজের জীবনের বিনিময়েও না।
ইন্সপেক্টর: আমার মেয়ে বেঁচে আছে তো? সত্যি করে বলুন। আমার কেমন ভয় লাগছে। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। আপনারা কী করেছেন আমার মেয়েকে?
দারা: নিশ্চিত থাকুন, আপনার মেয়ে জীবিত ফিরে আসবে। (নিজেকে) ভয়ংকর এক আগুন নিয়ে খেলছি। জীবনে এমন বিশ্রী মুর্হূত আর কখনো আসেনি কিম্বা এমন সুন্দর কোন মুহূর্ত। (ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে) ইন্সপেক্টর, আপনার মেয়ের মুক্তির জন্য আমার সাথে ভয়ংকর একটা খেলায় আপনাকে অংশ নিতে হবে। (টেলিফোন বেজে ওঠে। ইন্সপেক্টর রিসিভার তুলে নেয়)
ইন্সপেক্টর: হ্যাঁ বলছি। হ্যাঁ, বলুন। বলুন আমার মেয়ে ভাল আছে তো? দেখুন, আমার কথা শুনুন, (রিসিভার রেখে দিয়ে দারা বাহাদুরকে) আপনার দলের লোকেরা টেলিফোন করেছিল। যদি আগামী বারো ঘন্টার মধ্যে আপনাকে মুক্তি না দেয়া হয়, ওরা আমার মেয়েকে...
দারা: আপনার মেয়ের মুক্তির সব পরিকল্পনা আমি করে ফেলেছি। আপনাকেও চাকুরি হারাতে হবে না, আপনার মেয়েও মুক্তি পাবে।
ইন্সপেক্টর: কী পরিকল্পনা? কী করবেন আপনি বলুন।
দারা: ইন্সপেক্টর খুব কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকে।
ইন্সপেক্টর: বলুন।
দারা: গোপনে আপনি আমায় মুক্ত করে দেবেন। আমি আমার আস্তানায় চলে যাব। আমি ফিরে গেলেই আপনার মেয়ে মুক্তি পাবে। (হাত তুলে ইন্সপেক্টরকে থামিয়ে দিয়ে) আমার কথা এখনো শেষ হয়নি ইন্সপেক্টর। আমাকে ছেড়ে দিলেই আপনার মেয়ে মুক্তি পাবে। আর আপনার মেয়ে মুক্তি পেলেই আমি আবার নিজে এসে আপনার কাছে ধরা দেব।
ইন্সপেক্টর: কী বলছেন আপনি, একবার ছাড়া পেয়ে আবার নিজে এসে ধরা দেবেন। যাকে দু বছর আমরা চেষ্টা করেও ধরতে পারিনি সেই আপনি বলছেন, একবার ছাড়া পেলে আপনি এসে আবার ধরা দেবেন। বাহ্! চমৎকার গল্প।
দারা: যদিও আমাকে বিশ্বাস করা আপনার জন্য কঠিন তবুও এই একটা পথই খোলা আছে আপনার মেয়ের মুক্তির জন্য। আমাকে বিশ্বাস করার একটা ঝুঁকি এখন আপনাকে নিতেই হবে।
ইন্সপেক্টর: আমার মাথা শূন্য হয়ে যাচ্ছে, একজন মৃত্যুর আসামী ছাড়া পেলে ফিরে আসে সে তো শুধু একবার গল্পে পড়েছিলাম। বাস্তবেও যে এমন ঘটে কোনদিন শুনিনি।
দারা: ইন্সপেক্টর, আপনার মেয়ে নির্দোষ। তার জীবনকে পুঁজি করে আমার মুক্তি চাই না। দরকার হলে মুক্তির জন্য কারাগারের গরাদ কেটে বের হয়ে যাব কিন্তু এভাবে আমার মুক্তি চাই না।
ইন্সপেক্টর: আপনি যে সত্যি বলছেন আমি কেমন করে বুঝব। আমার ওপর রাগ করবেন না, পৃথিবীতে এত মিথ্যা, এত ছলনা, বঞ্চনা; এর মধ্যে কাকে যে বিশ্বাস করব, আর কাকে বিশ্বাস করব না-
দারা: ধরুন যদি আমি পালিয়ে যাই, তবুও আমাকে আপনার বিশ্বাস করতেই হবে। কারণ আপনার মেয়ের মুক্তি, তার জীবনের নিরাপত্তার জন্য একটা মাত্র পথই খোলা আছে।
ইন্সপেক্টর: হ্যাঁ, আপনাকে আমি বিশ্বাস করলাম। কেন যেন আপনাকে আমার বিশ্বাস করতেই ইচ্ছা করছে। শত অত্যাচারেও যখন আপনি দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি, তখন আমার সাথেও হয়ত আপনি বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না। জানি এটা একটা ভয়ংকর রকম ঝুঁকি।
দারা: পুরো ব্যাপারটা গোপন রাখতে হবে। কাউকে জানতে দেয়া যাবে না। কোনভাবে ঘটনাটা উপরওয়ালাদের কানে পৌঁছুলে আপনার বিপদ হতে পারে।
ইন্সপেক্টর: আমার লোকজনদের কাছে আমি ব্যাপারটা গোপন রাখব কী করে?
দারা: গোপন রাখতে হবে। শুনুন, আপনার মেয়ে যে অপহরণ হয়েছে সেটা কোনভাবেই প্রকাশ করা যাবে না। আপনার স্ত্রী এবং আপনি ছাড়া আর কাউকেও এ কথা ঘূণাক্ষরে জানতে দেবেন না।
ইন্সপেক্টর: এতক্ষণে নিশ্চয় দু চারজন পাড়া প্রতিবেশী খবরটা জেনে গেছে। আমাদের লোকরাও হয়ত কেউ কেউ জানে। বুঝতেই পারেন এসব খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
দারা: যারা জানে তাদেরকে বোঝাতে হবে আসলে ব্যাপারটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আপনার কোন বন্ধু বা আত্মীয় আপনার মেয়েকে তার বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। বা এর চেয়ে ভাল কোন বুদ্ধি বের করুন।
ইন্সপেক্টর: বুঝলাম। আপনাকে যে ছেড়ে দেব সেটাতো জানাজানি হবেই। আমার অফিসের লোকরা তো জানবেই।
দারা: না জানবে না। বিশ্বস্ত দু-একজনকে বলতে পারেন শুধু। বাকিদেরকে বলবেন, জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য রাতে আমাকে আপনি আপনার বাসায় নিয়ে যাবেন। আপনার বাসা তো থানার ভিতরেই। আপনার বাসায় পৌঁছানোর পর আপনি আপনার জীপটা আমাকে দিয়ে দেবেন। আমি রাত শেষ হবার আগেই জীপ এবং আপনার মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসব।
ইন্সপেক্টর: খুব চমৎকার ভাবেই পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত আমি বিপদে পড়ব কিনা বুঝতে পারছি না। যদি আপনি আমার গাড়ি নিয়ে ভেগেও যান আমার কিছুই করার থাকবে না।
দারা: আমার যা বলার আমি বললাম, এবার আপনার সিদ্ধান্ত নেবার পালা। আপনার জবাবটা সন্ধ্যার আগেই আমাকে জানিয়ে দেবেন। রাতের মধ্যেই সব ঘটতে হবে। আপনার হাতে ছয় ঘন্টা সময় আছে।
ইন্সপেক্টর: আমি যখন একবার রাজী হয়েছি আর পেছনে ফিরতে চাই না। জীবনে যদি ঠকতে হয়, হ্যাঁ, সব কিছু সহ একবারই চরমভাবে ঠকতে চাই। হ্যাঁ, সবকিছুই আপনার কথা মতো ঘটবে। রাতে আপনি গাড়ি নিয়ে চলে যাবেন।
দারা: সাবধান কোন চালাকি করতে যাবেন না। আমাকে কোন ভাবে অনুসরণ করার চেষ্টা করলে আপনার মেয়ে মারা পড়বে। আমি আশা করব তেমন কিছু ঘটুক আপনি চাইবেন না।
ইন্সপেক্টর: আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে কেউ অনুসরণ করবে না।
দারা: খুব ভালোভাবে স্মরণ রাখবেন, চালাকি করলে আপনার মেয়েটা মারা পড়বে।
ইন্সপেক্টর: সামান্য প্রকার কেউ আপনার অনুসরণ করবে না। কোনভাবে আপনার পথে বাধার সৃষ্টি করা হবে না। আপনি আমাকে কথা দিন আমার মেয়ে ফিরে আসবে, আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন।
দারা: আমি যা বলবার আপনাকে বলছি। আপনি যদি প্রতিটি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন, আমার দিক থেকেও প্রতিটি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হবে। চলবে