নিঃশঙ্কচিত্ত

অষ্টম দৃশ্য

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২০

(হারিকেনের আলোয় দারা একটা টেবিলের ওপর বসে কিছু লিখছিল। বোঝা যায় সে চিন্তামগ্ন। প্রবেশ করে দিতা। দারা লেখাটা আড়াল করতে চেষ্টা করে।)
দিতা: গজনফরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ও মেয়েটাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। মজুমদারদের পোড়ো দালানটার কাছে মেয়েটাকে রেখে এসে পরে ইন্সপেক্টরকে ফোন করবে। এখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে, গজনফর ঠিক দুটার দিকে রওয়ানা হয়ে যাবে। মেয়েটাকে ঘুমের ঔষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে ওর সাথে পাঠানো হবে।
দারা: শোন, মেয়েটাকে পৌঁছে দেয়া গজনফরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কারণ ওদের কাজকর্র কায়দা আমি জানি। তাই ওকে পৌঁছে দেয়ার  দায়িত্ব আমি নিজেই নিতে চাই।
দিতা: গজনফরই আমার মনে হয়ে কাজটা সেরে আসতে পারত।
দারা: না, দিতা। কথাটা বলার পেছনে আমার কারণ আছে। ধরা পড়ে কৌশিকের মতো যদি কেউ মুখ খোলে তাহলে ভয়াবহ বিপদ।
দিতা: তোমার শরীরের যে অবস্থা তোমার বিশ্রাম নেয়া দরকার ছিল।
দারা: রাত দুটার দিকেই তো যাচ্ছি। সত্যি কথা বলছি, এবার ধরা পড়ার পর সবচেয়ে বড় লাভ হয়েছে কি জানো, প্রচুর বিশ্রাম মিলেছে। দল নিয়ে নতুন করে অনেক কিছু ভাবতে পেরেছি। আগে সারাক্ষণ কাজের চাপে দল নিয়ে কিছুই ভাবতে পারতাম না।
দিতা: দারা, ওরা নিশ্চয় তোমার উপর খুব অত্যাচার করেছে? দারা বিশ্বাস কর, আমি সব বুঝতাম, তোমার জন্য খুব কষ্ট হতো। রাতে আমি ঘুমাতে পারতাম না।
দারা: সরকারের বিরুদ্ধে রাজনীতি করবে আর পুলিশ তোমায় কিছু বলবে না তাতো হতে পারে না। ওরা তো পারলে আমাকে জ্যান্তই পুতে ফেলত।
দিতা: দারা, ইন্সপেক্টরের মেয়েটাকে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব কেন তুমি নিজে নিতে চাইছ? বহুকষ্টে আমরা তোমাকে মুক্ত করে আনতে পেরেছি। এখন আর কোন ঝুঁকির মধ্যে আমরা তোমাকে পাঠাতে পারি না। দলের জন্য তোমাকে প্রয়োজন।
দারা: দলতো কারো একার ওপর ভরসা করে চলতে পারে না দিতা। যাক সে কথা, পুলিশ ফাঁদে ফেলে আমাকে ধরতে পারবে না। রাহুলের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য একবার ধরা পড়েছি বলে তোমরা হয়তো আমার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছ।
দিতা: এটা তোমার ওপর আস্থা হারাবার ব্যাপার নয়। কেন তুমি বুঝতে পারছ না, তোমাকে যে ভাবে আমি হারাতে যাচ্ছিলাম, সেভাবে তোমাকে হারালে কষ্ট হতো। তুমি ধরা পড়ার পর সবকিছু আমার কাছে অর্থহীন হয়ে যাচ্ছিল।
দারা: দিতা, ব্যক্তিগত কারণে এতটা ভেঙে পড়া ঠিক নয়। দল অনেক বড়। আমি থাকি আর না থাকি দলের কাজ তোমাদের সবসময় করে যেতে হবে। দল করতে এসে একজন ব্যক্তিকে এতটা গুরুত্ব দেয়া ঠিক নয়।
দিতা: দলকে, দেশের জনগণকে তুমি কতটা ভালবাস আমি জানি। কিন্তু  আমি যেমন দলকে ভালবাসি, তেমনি তোমাকেও ভালবাসি।
দারা: দিতা, আমার প্রতি তোমার গভীর প্রেমকে আমি সম্মান করি। দলের প্রয়োজন হলে আমাদের এসব ব্যক্তিগত প্রেমকে বিসর্জন দিতে হবে। বিপ্লবের স্বার্থে আমরা এখন ব্যক্তির ঊর্ধ্বে। নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাদ দিয়ে আমাদের শুধু জনগণের জন্য লড়তে হবে।
দিতা: জনগণের জন্য যে লড়াই, সে লড়াইয়ের যে ক্লান্তি তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই তোমাকে আমার বড় দরকার। দারা, ব্যক্তির ভালবাসা যদি একজন বিপ্লবীর ক্লান্তি মুছে দিতে না পারে, তাহলে সে আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করবে কি করে?
দারা: তোমার ভাবনাগুলো ভীষণ পরিচ্ছন্ন। সবাই ভালবাসা ব্যাপারটাকে তোমার চোখ দিয়ে দেখে না। সবাই ভালবাসতে চায়, ভালবাসা চায় কিন্তু ভালবাসার প্রয়োজনটা যে কোথায় এত চমৎকার করে তারা বোঝে না।
দিতা: রাজনীতিতে এসেই ভালবাসা ব্যাপারটাকে আমি নতুন করে বুঝতে শিখেছি। নিজের দেশকে, চারদিকের মানুষগুলোকে ভালবাসতে পারলেই শুধু ব্যক্তির প্রতি গভীর ভালবাসা জন্মায়। সমস্ত মানুষকে ভালবাসতে যাওয়ার যে ক্লান্তি ব্যক্তির ভালবাসা সেখানেই তো প্রয়োজন।
দারা: চমৎকার! দিতা, তুমি লিখতে শুরু কর। তোমার লেখা দরকার। তোমার মতো চমৎকার ভাবে কেউ আমার কাছে কখনো ভালবাসাকে ব্যাখ্যা করতে পারেনি। দিতা, আমি বুঝতে পারছি, আমি তোমার সাথে খুব নিষ্ঠুরের মত আচরণ করছি।
দিতা: না, সব সময় তুমি এমনই। যুক্তির পক্ষে তোমার দৃঢ়ভাবে মত ব্যক্ত করাকে অনেকেই নিষ্ঠুরতা বলে ধরে নেয়। তারা ভুল করে। তোমার জেদের ধরণটা তো অন্তত আমি জানি। অনেকেই ভাবছিল তুমি হয়ত ওদের অত্যাচারে সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দেবে। একমাত্র আমি জানতাম কোন কিছুর বিনিময়ে তুমি দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।
দারা: আমার মুক্তির জন্য তুমি বিরাট এক ঝুঁকি নিয়েছিলে। মেয়েটাকে অপহরণ করতে গিয়ে তুমি নিজেও ধরা পড়ে যেতে পারতে। এভাবে ধরা পড়ার শাস্তি কী তুমি তো জানই।
দিতা: যদি ধরে পড়ে যেতাম সে কথা বহুবার ভেবেছি। তোমাকে আর আমাকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে গুলি করা হতো। হয়তবা তোমার সামনে দাঁড় করিয়ে ওরা আমাকে (সে হাত দিয়ে চোখ মুখ ঢেকে ফেলে) নীলিমাদিকে নগ্ন করে ওরা যে-ভাবে পৈশাচিক আনন্দ করেছিল।
দারা: নীলিমাদির স্মৃতি বহুদিন পর তুমি আজ আবার মনে করিয়ে দিলে। নীলিমাদির কথা কোনদিন কেউ জানবে না। কোনদিন এদেশের মানুষ জানবে না তাদের মুক্তির জন্য নীলিমাদি কি অসহায়ভাবে সরকারের লোকদের হাতে প্রাণ দিয়েছিলেন।
দিতা: সাতটা দিন ওরা নীলিমাদিকে না খাইয়ে রেখেছিল। এমনকি নীলিমাদি মারা যাবার আগে জানতেও পারলেন না তিনি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা।
দারা: এসব কথা আমাকে এখন আবার স্মরণ করিও না। তাহলে ভয়ংকর ক্রুদ্ধ হয়ে যাই আমি। আমার এখন শান্ত থাকা দরকার।
দিতা: ক্রুদ্ধ হয়ো না। শান্ত থাক। এই তো আমি তোমার পাশে আছি।
রাহুল: নীলিমাদির চেয়েও খারাপ কিছু ঘটতে পারে তোমার জীবনে। এসব নিয়ে ভেব না। নিজেদের ভালমন্দ নিয়ে ভাববার অধিকার আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের জীবন যৌবন সব সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য। ওদের ভাগ্য গড়ে তোলাই আমাদের কাজ। কারাগারে যাবার পর বিপ্লব করা যে কতোটা জরুরি আমি যেন তা আলো উপলব্ধি করলাম।
দিতা: মাঝে মাঝে বড় অভিমান হয়, কাদের জন্য আমরা লড়ছি। যাদের জন্য লড়ছি তারাও কি কখনো স্নেহের হাত বাড়িয়েছে আমাদের দিকে। সকলের চোখেই আমরা শুধু নিষ্ঠুর গলাকাটার দল। কোটি কোটি মানুষকে ভালবেসেই আমরা যে ঘর ছেড়েছি, সাজানো সুখের সংসার বিসর্জন দিয়েছি তারা কেউ তা বুঝতে চায় না।
দারা: কার বিরুদ্ধে অভিমান করছ? সহজ সরল চিন্তার কুংসংস্কার আচ্ছন্ন মানুষগুলোর ওপর? ওরা মাঠে মাঠে হাল না ধরলে সমস্ত সভ্যতা ভেঙে পড়ত। দিতা, সারাদিন যারা পরিশ্রম করে, একঘেঁয়ে কাজে যাদের জীবন বাধা পড়ে আছে তাঁরা সবসময় সুস্থভাবে চিন্তাভাবে চিন্তা করতে পারে না। দারিদ্রে, অত্যাচারে অপমানে তাঁদের অনেক অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়। চিন্তা করে দ্যাখো, যারা সারাদিন পরিশ্রম করছে তাদের সন্তানরা না খেয়ে আছে, গ্রামে-গ্রামে, নগরে-বন্দরে। বিনা চিকিৎসায় তার মারা যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথাটা হলো, লুণ্ঠনকারী এই সমাজ তাদেরকে তার যথাযোগ্য সম্মানটা পর্যন্ত দেয় না।
দিতা: সম্মান! রামপুর গ্রামে কদিন আগে কিছু দরিদ্র মানুষের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গরীব মানুষদের হাতে যেটুকু জমি আছে সেটা দখল করার চেষ্টা চলছে। দুটা মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে তিন পাষণ্ড। (দারা যেন হঠাৎ রেগে উঠে দাঁড়ায়) দল থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তিন পাষণ্ডকে অচিরে হত্যা করার।
দারা: (দারা আবার শান্ত হয়ে বসে) ঠিকই আছে সিদ্ধান্ত। নিয়ন্ত্রণ সভায় এবার নতুন কিছু প্রস্তাব উত্থাপন করতে হবে দিতা।
দিতা: কী প্রস্তাব?
দারা: সকল স্তরের জনগণের মধ্যে দলের গণসংযোগ বহু গুণ বাড়াতে হবে। দলের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যগুলি জনগণের কাছে আরো স্পষ্ট করে তুলতে হবে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে দলের বিচ্ছিন্নতা কমিয়ে ফেলতে হবে। দলে সদস্য গ্রহণের ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। সকলকে সরাসরি দলে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার নেই। দলের বাইরে জনগণের মধ্যে থেকে তারা কাজ করবে। বিশেষ করে কমবয়সী তরুণদের দলে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। রাজনৈতিক পড়াশুনার ব্যাপারে জোর দিতে হবে।
দিতা: ঠিক। রাজনৈতিক পড়াশুনা অনেক বাড়ানো দরকার। সেইসঙ্গে বিশ্ব ইতিহাস আর সাহিত্য পাঠে সদস্যদের আগ্রহ বাড়াবার পক্ষে আমি।
দারা: সামনের নিয়ন্ত্রণ সভায় এসব প্রসঙ্গে কথা বলতে হবে।    
দিতা: দারা, তোমাকে একটা কথা বলব?
দারা: বলো।
দিতা: এবার আমাদের বিয়ে করে ফেলা উচিত। দলে কথাটা উত্থাপন করতে চাই। আমার কথাটাকে তুমি অন্যভাবে নিও না। ভেবে দেখ, আমাদের কারো জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেজন্য আমাদের এবার বিয়েটা করে ফেলা দরকার। পরে যদি আমাদের একটা কিছু ঘটেও যায় তাহলে একটা সান্ত্বনা তো থাকবে। (দারা কিছুই বলে না) দারা, তুমি চুপ করে আছ কেন?
দারা:  এমন এক জীবনের মধ্যে বাস করেও তুমি ব্যক্তিগত স্বপ্ন দেখছ! (দিতার চোখে চোখ রেখে) আমি খুব দুঃখিত যে, নিজেকে আমি ঠিকমত তোমার কাছে প্রকাশ করতে পারছি না। যে কথাগুলো আসলে তোমাকে বলতে চাচ্ছি।
দিতা: কোন দরকার নেই তোমার নিজেকে কষ্ট করে প্রকাশ করার। দেখবে, আমি ঠিক বুঝে নেব তোমায়। যেমন ভাবে আমাকে তুমি সব সময় বুঝে নিয়েছ। নিজেকে প্রকাশ করতে গেলে শুধু অর্ধেকটাই প্রকাশ পায়। উপলব্ধির ভিতর দিয়েই শুধু মানুষকে সম্পূর্ণ বোঝা যায়।
দারা: দিতা, তুমি বড় ভাল মেয়ে। তুমি তো জান আমি নিজেও ভীষণ সৎ। এসবের কোন মূল্য নেই এখন। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে দাঁড়িয়ে প্রেমের স্বপ্ন দেখা যায় না। কেন যে যায় না সেটা এখন ঠিক তোমায় বোঝানো যাবে না।
দিতা: ঠিক আছে, বোঝানোর দরকার নেই। রাত বেড়ে যাচ্ছে। এবার তোমার শুয়ে পড়া দরকার। কাল সকালে আবার দেখা হবে।
দারা: থাকো না আরো কিছুটা সময়। দিতা, তোমাকে একটা কথা বলি, কোনদিন যেন আমাকে ভুল বুঝ না। তোমার চেয়ে আর কাউকে আমি বেশি ভালবাসিনি।
দিতা: আমি জানি সে কথা। মুখ দিয়ে তুমি না বললেও তোমার চোখ দেখে আমি সব বুঝতে পারি।
দারা: মাঝে মধ্যে আমি নিজেকে ঠিক চিনতে পারি না। নিজের চাওয়া-পাওয়াগুলোর ব্যাপারেও আমি বড় দ্বিধাগ্রস্ত। কিন্তু তোমাকে সত্যি আমি গভীর ভাবে নিজের করে পেতে চেয়েছিলাম। তোমার প্রতি আমার যে ভালবাসা এবং দলের প্রতি আমার যে ভালবাসা দুটোই সমান আন্তরিক। তবে দলের দাবিটাই আমার কাছে অনেক বড়।
দিতা: তোমার বিরুদ্ধে আমার তো কোন অভিযোগ নেই। তোমার ভালবাসা প্রকাশের ভঙ্গিটি সবার থেকে আলাদা বলেই প্রথম প্রথম তোমাকে খুব ভুল বুঝতাম। এখন আমি তোমাকে ঠিক বুঝতে পারি। তোমার চোখ, তোমার প্রতিটি ভঙ্গি আমাকে বলে দেয় আমার প্রতি তোমার ভালবাসা কতটা।
দারা: দিতা।
দিতা: তোমার ভালবাসার ভঙ্গিটি বড় ভিন্ন দারা, বুঝতে বেশ সময় লেগে যায়। কিন্তু একবার বুঝে ফেললে আর কোন ভয় থাকে না।
দারা: মানুষ কি চায় জান? সে চায় যে তাকে ভালবাসে সে যেন তাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারে। তুমি আমায় সব সময় বুঝে নিয়েছিলে।
দিতা: তোমার ওপর আমি নির্ভর করতে পারি। তোমার কাছ থেকে আমায় যে ঠকতে হবে না, এই বিশ্বাসটাই আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দদায়ক। দারা, তোমার মধ্যে দায়িত্ববোধ, ভয়ংকরতা, সততা আর স্নেহময়তা এত চমৎকারভাবে পাশাপাশি বাস করে যে মাঝে মাঝে আমি বিস্মিত না হয়ে পারি না।
দারা: সত্যি করে বল তো, আমার সম্পর্কে তোমার কী ধারণা? কোন মিথ্যা বলবে না। আমাকে দেখে সত্যি তোমার কী মনে হয়?
দিতা: তুমি ভীষণ সরল কিন্তু মোটেই বোকা নও। খুব কৌশলী কিন্তু প্রতারক নও। প্রচণ্ড রকমের ভয়ংকর এক লোক কিন্তু নিষ্ঠুর নও। হিসাব করে করে যুক্তি দিয়ে মেপে মেপে পা ফেল, অথচ নিজের জীবনের হিসাব রাখ না।
দারা: বাবা একদিন থানায় এসেছিলেন আমার সাথে দেখা করতে। বাবাকে হঠাৎ এক সময় খুব ভাল লেগে গিয়েছিল। কেন জানি না।
দিতা: তোমার মধ্যে অনেক চাপা কষ্ট জমে আছে। এসো আমরা দুজন এবার দুজনের কষ্ট ভাগ করে নেই। (কিছুটা সময় নীরর থেকে সংকোচে) দারা, তুমি ইচ্ছা করলে আমাকে তোমার আরো কাছে টেনে নিতে পার। দল তো জানেই আমাদের ব্যাপারটা।
দারা: (দিতার মাথায় হাত রেখে) দিতা ভীষণ ভাল মেয়ে তুমি। হয়ত পৃথিবীর সবাই সমান ভাল। ঘটনাই হয়ত এক এক জনকে এক এক ভাবে পাল্টে দিয়েছে।
দিতা: তোমাকে আজ খুব অন্যরকম লাগছে কেন? কেমন যেন মনে হচ্ছে তুমি অনেক দূর থেকে কথা বলছ।
দারা: দিতা, আমাদের জীবনে যাই ঘটুক মেনে নিতে চেষ্টা কর। কোনদিন বিপ্লবের পথ থেকে সরে দাঁড়িও না। বিপ্লব ছাড়া মানুষের মুক্তি নেই। কিন্তু তার জন্য সঠিক পথটা আমাদের খুঁজে পেতে হবে। (স্বর পাল্টে) হঠাৎ যদি কোন দুর্ঘটনায় আমি প্রাণ দেই, আমার মৃত্যুটাকে স্বাভাবিক বলে মনে নিও। কাঁদতে ইচ্ছা করলে কেঁদো। বিপ্লবের পথ থেকে সরে দাঁড়িও না কখনো।
দিতা: দারা, কী হয়েছে তোমার? এমন করে কথা বলছ কেন? দারা ওরা নিশ্চয় তোমার ওপর খুব অত্যাচার করেছে? (কান্নায় দিতা ভেঙে পড়ে)
দারা: দিতা, বিপ্লব আমাদের মরতে শিখিয়েছে। সাধারণ মানুষকে ভালবাসতে শিখিয়েছে। এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কি হতে পারে। (স্বর পাল্টে) যাও এবার তুমিও শুয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে।

দৃশ্য অষ্টম (ক)
(ঘরটা অন্ধকার। হারিকেন নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে দিতা। দারাকে দেখতে পায় না। সাদা কাগজে লেখা একটি চিঠি চাপা দেয়া আছে কিছু দিয়ে। চিঠিটি তার নজর কাড়ে। সে চিঠিটি হাতে তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করে। দারার কণ্ঠে চিঠির কথাগুলো শোনা যাবে।)
যখন এ চিঠি তোমার হাতে পড়বে তখন আমি তোমার থেকে বহু দূরে। ঘণ্টাখানেক আগেই বের হয়ে গেলাম, কারণ কয়েক মাইল হাঁটতে হবে ইন্সটেক্টরের কন্যাকে নিয়ে। ইন্সপেক্টরের জীপটাকে আমি ইচ্ছাকৃতভাবে ছয় সাত মাইল দূরে নদীর অপর পাড়ে রেখে এসেছি। যাতে ওরা এই আস্তানার খোঁজ সহজে না পায়। ইন্সপেক্টরের কাছে তার সন্তানকে ফিরিয়ে দেবো সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে কয়েকঘণ্টার জন্য মুক্তি নিয়ে চলে এসেছিলাম। কথাটা এতক্ষণ গোপন রেখেছিলাম তোমার কাছে। না হলে ইন্সপেক্টরের কোনোই ক্ষমতা ছিল না আমাকে মুক্ত করে দেয়ার।
দিতা, আমার মুক্তির জন্য তোমরা ইন্সপেক্টরের মেয়েকে অপহরণ করেছিলে। তোমাদের প্রতি আমি তারজন্য কৃতজ্ঞ। কিন্তু ভেবে দেখ, সরকার যদি আমাকে মুক্তি না দিত আর যদি ইন্সপেক্টরের মেয়েকে হত্যা করা হতো, জনগণের মধ্যে আমাদের দল সম্পর্কে কী ধরনের চিন্তাভাবনা শুরু হতো? একটি শিশুকে যে রাজনৈতিক দল হত্যা করতে পারে তার সম্পর্কে জনগণ কী ধারণা পোষণ করত? সরকার ইচ্ছা করেই আমাকে আটকে রাখত, চাইত শিশুটিকে হত্যা করা হোক। একটি শিশু হত্যার দায় আমাদের দলের ওপর চাপাতে পারলে সরকার খুশিই হতো। যদিও আমি জানি শিশুটিকে তোমরা কিছুতেই হত্যা করতে না। কিন্তু ঘটনা শেষ পন্যন্ত কোনদিকে প্রবাহিত হতো সেটা বলা কঠিন ছিল। নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শ বাঁচাতে হলে সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতি আমাদের বুঝতে হবে। যতদূর জানতে পেরেছি একটা ষড়যন্ত্র চলছে, আমাদের গুপ্তদলের যারা ধরা পড়বে সরকার চাইবে না তারা অস্ত্র ছেড়ে আগের জীবনে ফিরে যাক। বরং সরকার তদেরকে নিজেদের নোংরা কাজে ব্যবহার করতে চাইবে। বিপ্লবী একটি দলকে এভাবেই তারা সন্ত্রাসের পথে পাঠাবে। বিপ্লবী আর সন্ত্রসীদের মধ্যে জনগণ তখন আর কোন পার্থক্য খুঁজে পাবে না। আমাদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড যাতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসাবে পরিচিত না হয়, তারজন্য ইন্সপেক্টরের মেয়েকে মুক্ত করে আমি আবার ধরা দিলাম। বিপ্লবের স্বার্থেই আমি তা করছি। আমার জীবনের চেয়ে বিপ্লব সম্পর্কে মানুষের উচ্চধারণা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। বিপ্লবীদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে শিশুরা কোনক্রমেই আমাদের রাজনীতির শিকার হবে না। দিতা, অকারণ রক্তপাত আমাদের হাতকে রক্তাক্ত করে তুলবে। তখন আমরা সামান্য কারণে নিজেরাই নিজেদের রক্তাক্ত করব। দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। বিপ্লব শুধু একটি আকাঙ্ক্ষা মাত্র নয়, বিপ্লব একটি কর্ম। স্বপ্নের জগতে বসে কর্ম সফল হয় না, তারজন্য দরকার বাস্তবের ভূমি। ভুল পথ আমাদের পরিহার করতে হবে। সকল শিশুকে ভবিষ্যতের একজন বিপ্লবী হিসাবে আমাদের চিন্তা করতে হবে।
বর্তমান আস্তানাটা মনে করি তোমাদের জন্য আর নিরাপদ নয়। নিশ্চয় সেটা তুমিও বুঝতে পারছো এবং আশা করছি দ্রুত এখান থেকে সরে পড়বে। বাবার সঙ্গে শেষ সাক্ষাতে আমার দাবির প্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন, দল চাইলে দলকে তিনি অনেক টাকা দেবেন। ব্যাপারটা খুব সহজ, মৃতপথযাত্রী পুত্রের প্রতি পিতার গভীর অনুভূতি; মতাদর্শগত কারণ নেই। যদি মনে হয় দলের জন্য এ সুবিধাটা নেয়া দরকার, বর্তমান চিঠিটাই যথেষ্ট হবে। দলকে প্রয়োজন মতো নানারকম কৌশল করে টিকে থাকতে হবে। ইন্সপেক্টরের মেয়েকে অপহরণ করা এবং ফিরিয়ে দেয়ার পুরো ব্যাপারটাই সকলের স্বার্থে গোপন রাখাটা জরুরি বলে মনে করি। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, বঞ্চিত মানুষদের জয় হোক। চলবে