নিঃশঙ্কচিত্ত

নবম দৃশ্য

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৭, ২০২০

(সময় ভোর। পুলিশ ইন্সপেক্টরের কক্ষে একটি চেয়ারে পা ছড়িয়ে দিয়ে বসে আছে দারা। ইন্সপেক্টর দাঁড়িয়ে, তাকে খুব নম্র ও অপ্রকৃতিস্থ লাগছিল।)
ইন্সপেক্টর: দারা বাহাদুর সাহেব, আপনি যে এভাবে ফিরে আসবেন আমরা কেউ শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হয়েছিল মৃতুদণ্ডের আসামী ছাড়া পেলে আর কি কখনো ফেরে? মনে হয়েছিল আমি বোধ হয় বোকামিই করে ফেলেছি। (স্বর পাল্টায়) দারা বাহাদুর সাহেব, আপনি ফিরে না এলে আমার ওপর দিয়ে যে কী ঝড় বয়ে যেত, প্রশাসনকে কিছুতেই আমি সত্যি কথাটা বোঝাতে পারতাম না। তারা ভাবত পুরো ব্যাপারটায় আমার হাত আছে। আমিও হয়ত আপনাদের দলের কেউ। (ইন্সপেক্টর সামান্য থামে) সত্যি! আপনার এই ফিরে আসা এ অবিশ্বাস্য ঘটনা। আপনি চলে যাবার পর শুধু বারবার মনে হয়েছে, আমার মেয়ে ফিরে আসবে, কিন্তু আপনি আর ফিরবেন না। সারাটা রাত যে কী দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে কেটেছে! (দারা নিরুত্তর) দারা বাহাদুর, আমায় ক্ষমা করবেন। আপনার সাথে যে আচরণ আমি করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য। পৃথিবীর সবচেয়ে একজন ভাল মানুষের সাথে আমি পশুর মত আচরণ করেছি।
দারা: আপনার মেয়ে কেমন আছে? ধরে নিয়ে যাওয়ার পর খুব নাকি কান্নাকাটি করেছিল।
ইন্সপেক্টর: এখন ঘুমুচ্ছে। আমি আর আমার স্ত্রী চিরকৃতজ্ঞ আপনার কাছে। আমাদের মেয়ের জন্য আপনি যা করলেন।
দারা: শুধুমাত্র আপনার মেয়ের জন্য নয় ইন্সপেক্টর, আমার প্রধান লক্ষ্য ছিল আমার দলের সুনাম। আমার দলকে যাতে শিশু হত্যার দায়ে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে না হয়, সেটাই ছিল আমার কাছে মূল প্রশ্ন।
ইন্সপেক্টর: কেন নিজেকে খাটো করছেন? কেন নিজের মহত্ত্বটাকে লুকিয়ে রাখতে চাইছেন! দলের সম্মান রক্ষার জন্য আপনার তো প্রাণ দেয়ার কোন দরকার ছিল না। আমি তো আপনাকে মুক্ত করেই দিয়েছিলাম। আপনি ছাড়া পাবার পর আমার মেয়ে তো এমনিতেই মুক্তি পেত, আর তাতে করে আপনার দলকেও শিশু হত্যার দায়ে দায়ী হতে হতো না। তবুও তো আপনি ফিরে এলেন শুধুমাত্র আপনার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবার জন্য। নিশ্চিত মৃত্যুর কথা জেনেও প্রতিশ্রুতি ভাঙতে পারলেন না।
দারা: যদি প্রতিশ্রুতি ভাঙতাম তাহলে কী দাঁড়াত বলুন তো। সমস্ত বিপ্লবীদের সম্পর্কে আপনার মনে এক বিশ্রি ধারণার জন্ম হতো। সাধারণ একজন খুনীর সাথে বিপ্লবীদের আর কোন পার্থক্য থাকত না। আমি চাইনি বিপ্লবীদের সম্পর্কে কেউ কোন নীচু ধারণা পোষণ করুক।
ইন্সপেক্টর:  তাহলে আপনার ফিরে আসার কারণ কি শুধু এই যে, বিপ্লবীদের আপনি সমাজে বড় করে দেখাতে চান?
দারা: সবচেয়ে বড় কথা হল, একটি নিষ্পাপ শিশুকে, যে রাজনীতির কিছুই বোঝে না, তাকে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে ফেলাটা আমার ভাল লাগেনি। আমার দল সেই ভুলটা করতে যাচ্ছিল।
ইন্সপেক্টর: আপনার বক্তব্য মতো, আপনার মুক্তির জন্য একটি শিশু হত্যার দায় আপনি আপনার দলের ঘাড়ে চাপাতে চাননি?
দারা: যে কোন শিশুই সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তাকে নিয়ে রাজনীতি চলে না, এটাই আমার বারবার মনে হয়েছিল। কে বলতে পারে যে আপনার আজকের শিশু আগামীকাল আমার চেয়েও বড় বিপ্লবী হিসাবে গড়ে উঠবে না।
ইন্সপেক্টর: আপনি বড় সুদূর প্রসারী চিন্তার লোক। যাই বলুন না কেন, জেনে শুনে মৃত্যুর ফাঁদে পা দেয়া, বাঁচার পথ থাকা সত্ত্বেও আবার মৃত্যুর কাছে ফিরে আসা এটা কোন ছেলেখেলা নয়।
দারা: কখনোই কোন ছেলেখেলা আমি খেলিনি। এমন কি আমার ছেলেবেলাতেও নয়। যারা ছেলেখেলা খেলতে চায় বিপ্লবের পথ তাদের জন্য নয়।
ইন্সপেক্টর: আমি বুঝতে পারছি আপনার মতন সুস্থ ও সাহসী লোকদের রাজনীতিতে থাকা দরকার। তাহলেই হয়ত আমাদের রাজনীতির গঠনমূলক কিছু হতে পারে। দুর্ভাগ্য, আমাদের হাতে আপনারাই শুধু মারা পড়েন। চোর বদমাসদের আমরা শুধু প্রশ্রয় দিয়ে যাই। আমি বিস্মিত হচ্ছি, আপনার মতো একজন নরম স্বভাবের লোক কেমন করে মানুষ হত্যা করে!
দারা: খেয়াল করে দেখুন তো বিপ্লবীরা কাদের হত্যা করেছে। যারা সমাজে খারাপ তাদেরকে শুধু। জোতদারদের বাড়িতে তারা গেছে, টাকা পয়সা লুট করেছে, কিন্তু কোন নারীর সম্ভ্রম তারা নষ্ট করেনি। জোতদারদের খুন করেছে, অন্য কারো গায়ে হাত তোলেনি। এসব কি সত্যি নয়?
ইন্সপেক্টর: হ্যাঁ সত্যি।
দারা: বহুবার পুলিশের বহু অফিসার, সেপাই আমাদের হাতে ধরা পড়েছে, আমরা তাদের হত্যা না করে ছেড়ে দিয়েছি। বিপ্লবীরা অকারণে রক্তপাতে বিশ্বাস করে না। বিপ্লবীদের সম্পর্কে বাজার কিছু সস্তা গল্প চালু আছে। তারা নিষ্ঠুর, কাউকে দয়া করে না। আমি চাই বিপ্লবীদের সম্পর্কে মানুষের মনের সে ধারণাগুলোর অবসান হোক।

ইন্সপেক্টর: চা দিতে বলি আপনাকে। ভাববেন না কোনরকম তোষামোদ করছি। বিশ্বাস করুন, পৃথিবীর আর সবার থেকে আপনি সম্পূর্ণ আলাদা, ভিন্ন এক মানুষ আমার আছে। আপনার সাথে আমার সব শত্রুতা শেষ হয়ে গেছে। যদিও আপনি একজন বিপ্লবী এবং আমি পুলিশ অফিসার, তবুও আমরা বন্ধু। শুধু আপনাকে নয়, ভিতরে ভিতরে হয়ত আমি বিপ্লবকেও ভালবেসে ফেলেছি। দারা বাহাদুর সাহেব, আমার বিরুদ্ধে মনে কোন ক্ষোভ রাখবেন না। যদি আমার বিরুদ্ধে কোন ক্ষোভ থাকে ক্ষমা করে দেবেন।
দারা: না, ব্যক্তিগতভাবে আপনার ওপর আমার ক্ষোভ থাকার তো কারণ নেই। যে চাকুরি আপনি করছেন, সেখানে আপনি চাইলেও হয়ত এর চেয়ে ভাল কিছু আমার জন্য করতে পারতেন না। মনে রাখবেন, এই সমাজ ব্যবস্থায় আপনি শৃঙ্খলিত, যে শৃঙ্খল হয়ত আপনি কখনো অনুভব করতে পারছেন না। সত্যি এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে আপনি বাঁধা পড়ে আছেন।
ইন্সপেক্টর: বেঁচে থাকার প্রয়োজনে একটি চাকুরি এবং সেই চাকুরির প্রয়োজনে নিজের বিবেককে ধ্বংস করা, এত প্রতিদিন সবার ভাগ্যেই ঘটছে।
দারা: বিপ্লবের জন্য যারা লড়ছে তারা লড়ছে আপনাদের সেই শৃঙ্খল ভাঙার জন্য। আমি নিজে অবশ্য এখনো বুঝতে পারছি না, সেটা কীভাবে সম্ভব! (খানিকটা স্বাগত) আমার আরো বেশি পড়াশুনা করা দরকার ছিল।
ইন্সপেক্টর: আপনি কী বই পড়তে চান আমাকে বলুন, আমি যোগাড় করে এনে দেব। দারা বাহাদুর, জীবনের শেষ কয়টা দিন আমি আপনার কোন কাজে লাগতে চাই। আমার আত্মীয় স্বজনদের মধ্যেও দু একজন আছে, যারা বিপ্লবী তত্ত্বেও বিশ্বাস করে। যদিও এতদিন তাদের আমি পাগল ভেবে এসেছি, এখন থেকে আর তা ভাবতে পারব না। আপনার কোন বই দরকার হলে ওদের কাছ থেকে কিম্বা কোন গ্রন্থাগার থেকে এনে দিতে পারব।
দারা: (দারার চরিত্রে ভিন্ন একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। শান্ত-সমাহিত ভাব) ইন্সপেক্টর, হঠাৎ আপনার আচরণ আমার প্রতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। কী আশ্চর্য পরিবর্তন। না এর জন্য আপনার গায়ে আমার হাত তুলতে হয়নি, অস্ত্রের ভয় দেখাইনি। শুধু ছোট্ট একটা ঘটনা-
ইন্সপেক্টর: দারা বাহাদুর সাহেব, ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন ঘুষঘোর, বদমাস, দায়িত্বহীন; তবে আপনার প্রতি আমার যে শ্রদ্ধা তার মধ্যে কোন ফাঁকি নেই। হয়ত উপরওয়ালাদের হুকুমে আমি আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার জন্য বধ্যভূমিতে পাঠাব, কিন্তু বুকের মধ্যে থাকবে আপনার জন্য শ্রদ্ধা ভালবাসা এবং কৃতজ্ঞতা। (থেমে) মিথ্যা বলছি না, বিশ্বাস করুন।
দারা: ইন্সপেক্টর, পৃথিবীতে মানুষ হিসাবে কেউ খারাপ নয়। ঘটনার স্রোত যে মানুষকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে কেউ জানে না। যার বিপ্লবী হবার কথা ঘটনার স্রোতে সেই হয়ত পুলিশ অফিসার হয়ে বসে আছে। যার হবার কথা সবচেয়ে হৃদয়বান, সেই হয়ত খুনী হয়ে গেছে। ঘটনা প্রতিদিন আমাদেরকে পাল্টে দিচ্ছে। ঘটনা কাউকে বিপ্লবী বানায়, কাউকে প্রতিবিপ্লবী। কাউকে রাজার মুকুট পরিয়ে দেয়, কাউকে করে পথের ভিখিরি। যদি আপনার কন্যা বিপ্লবীরা ধরে নিয়ে না যেতো এবং যদি তাকে আমি মুক্ত করে না আনতাম, তাহলে কি আজ এই সম্মান আপনি আমায় দেখাতেন। ব্যক্তিগত কোন গুণাবলী নয়, শুধু একটি ঘটনা আপনাকে পাল্টে দিয়ে গেছে। জীবনের এমনি হাজার ঘটনা হাজার ভাবে আমাদের পাল্টে দিয়ে যায়। তখন আমরা ভিন্ন ভিন্ন মানুষ হিসাবে গড়ে উঠি। প্রতিনিয়ত আমরা শুধু ঘটনার স্রোতে ভেসে বেড়াই।
ইন্সপেক্টর: ঘটনাও তো মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ঘটনাকে তো আপনিই নিয়ন্ত্রণ করলেন যখন আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন আমার মেয়েকে উদ্ধার করবেন এবং পুনরায় ধরা দেবেন। এ সিদ্ধান্ত যদি আপনি না নিতেন তাহলে তো ভিন্ন একটি ঘটনা ঘটত।
দারা: হ্যাঁ ঘটত। এবং ভিন্ন ঘটনার কারণে আপনার মধ্যে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া জন্ম নিত। এটাই হচ্ছে দ্বান্দ্বিকতা। ঘটনা যেমন মানুষকে পাল্টায়, তেমনি মানুষও আবার ঘটনাকে পাল্টে দেয়। প্রতিটি মানুষই ঘটনাকে পাল্টে দেয় আর প্রতিটি ঘটনাও মানুষকে পাল্টে দেয়। ঘটনা যখন মানুষকে পাল্টায়, তখন মানুষের মনে নতুন এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, ভিন্ন শিক্ষায় সে শিক্ষিত হয়ে ওঠে। আর মানুষ যখন ঘটনাকে পাল্টায় তখন সে ঘটনা নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টির পথে অনেকগুলো কারণের একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চলবে