নিঃশঙ্কচিত্ত

দশম দৃশ্য

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২০

(পুলিশ ইন্সপেক্টরের কক্ষ। কক্ষে পুলিশ সুপার বসে আছেন। একজন সিপাহী চা দিয়ে চলে যায়। পুলিশ সুপার চা পান করতে করতে ইন্সপেক্টর প্রবেশ করে।)
সুপার: ইন্সপেক্টর সাহেব, দারা বাহাদুরকে রাজনীতির বিভিন্ন বই, লাল বই পড়তে দেখলাম। কে দিয়েছে এসব, আপনি?
ইন্সপেক্টর: জ্বী স্যার। লোকটা হারে হারামজাদা। নির্যাতন করে তার কাছ থেকে কথা আদায় করা যাবে না। তাই স্যার, বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক তৈরি করেছি। হয়ত স্যার, কাজ হয়ে যেতে পারে।
সুপার: হু!
ইন্সপেক্টর: লোকটার সাথে খুব বন্ধু হবার ভান করছি। মাঝে মধ্যে আমার বাসা থেকে রান্না করে এনে খাওয়াচ্ছি। সব ধরণের সুবিধা দিচ্ছি স্যার। যদি কোনভাবে একবার মুখ খোলে...
সুপার: মনে হয় না মুখ খুলবে। খুব শক্ত। একরোখা। ওর বাবা পর্যন্ত ওকে ঘায়েল করতে পারল না। )ব্যর্থতায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে)
ইন্সপেক্টর: শেষ চেষ্টা করে দেখছি স্যার। নির্যাতন করে তো দেখলাম, কোনই কাজ হল না। স্যার কী বলেন, বুদ্ধিটা খারাপ নিয়েছি?
সুপার: দেখুন চেষ্টা করে। দু-চারটা খবর বের করা গেলেও কাজ হতো। সরকারের ধারণা ছিল দারা বাহাদুরকে ধরতে পারলে ওদের দলের বহু খবর পাওয়া যাবে। কোন লাভ হল না।
ইন্সপেক্টর: দেখি স্যার চেষ্টা করে, যদি কোনভাবে ফাঁদে পা দেয়। ফাঁদে একবার মাত্র পা দিলে...
সুপার: খুব বেশি সময় পাবেন না, দু একদিনের মধ্যেই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার হুকুম আসবে। লোকটা মেধাবী, সাহসী সন্দেহ নেই। ভুল পথে গেল।
ইন্সপেক্টর: হ্যাঁ স্যার, প্রশাসনে ঢুকলে খুব ভাল করত, খুব বুদ্ধিমান লোক স্যার। গেল কিনা দেশ উদ্ধার করতে। ঐ যে স্যার, দারা বাহাদুর এসে গেছেন। একটু আলাপ করে দেখুন কোন কাজ হয় কিনা।
সুপার: না থাক, আজ আর আমি তার সাথে কথা বলতে চাই না। ব্যাপারটা যখন আপনি অন্যদিকে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন, আপনিই কথা বলে দেখুন, সামান্য তথ্য পেলেও... (পুলিশ সুপার উঠে দাঁড়ায়। দারাকে নিয়ে একজন সিপাহী প্রবেশ করে। দারাকে রেখে সিপাহীটি চলে যায়।) এই যে দারা সাহেব, চলে যাচ্ছিলাম, যাক আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল। রাজনীতি নিয়ে পড়াশুনা করছেন জেনে খুশি হলাম। সবকিছু জেনে রাজনীতি করার একটা মুল্য আছে। পালিয়ে রাজনীতি, খুব খারাপ। ইন্সপেক্টর সাহেব, উনি যখন যা পড়তে চান পড়তে দেবেন। পড়াশুনা করলে উনি নিজেই বুঝবেন অতীতে উনি কী ভুল করে এসেছেন। তাহলে আসি দারা বাহাদুর সাহেব। (পুলিশ সুপার দারার সাথে হাত মিলিয়ে চলে যান।)
ইন্সপেক্টর: বসুন, দারা সাহেব। স্যার জানতে চাচ্ছিলেন বইপত্র আপনাকে কে পড়তে দিয়েছে, আমিই কি না। বহু গল্প বানিয়ে বলতে হল তাকে। আশ্চর্য স্যারকেও আমি বোকা বানাতে পারছি।
দারা: শেষে আপনি আবার কোন বিপদে পড়বেন না তো?
ইন্সপেক্টর: না। বরং ভালই হল। যেভাবে গল্প সাজিয়েছি আর কোন ভয় নেই। আপনি নিশ্চিত থাকুন। আপনার খাওয়া দাওয়ার কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?
দারা: সে পথ কি আর আপনি খোলা রেখেছেন?
ইন্সপেক্টর: আমার স্ত্রী বলছিলেন আপনি নাকি প্রায় সবটাই খাবার ফেরত পাঠান। কিছুই নাকি খান না?
দারা: দলে দিনের পর দিন না খেয়ে খেয়ে না খাওয়াটাই আমাদের এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি তো তবুও খাচ্ছি, ওরা হয়ত...
ইন্সপেক্টর: দারা বাহাদুর সাহেব, আপনি একজন ধনীর দুলাল, যাঁর কোন কিছুর অভাব ছিল না, জবাব দিন তো সেই আপনি কেন বিপ্লবের পথে গেলেন? কিসের প্রয়োজনে?
দারা: পৃথিবীতে যেখানে প্রচুর মানুষ না খেতে পেয়ে, রোগে ভুগে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে, যেভাবে মানুষের ওপর প্রশাসনের অত্যাচার চলছে, শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার নামে যে ভাবে আইন ধনীর স্বার্থ রক্ষা করছে, সেখানে একজন সুস্থ মানুষ বিপ্লবের কথা ছাড়া আর কী ভাবতে পারে? এ অবস্থার তো একটা পরিবর্তন দরকার।
ইন্সপেক্টর: পরিবর্তনটা আসবে কীভাবে বলুন। আপনাদের দেশপ্রেম, সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আমার মনে কোন দ্বিধা নেই। আপনারা গ্রামে গ্রামে ছুটে বেড়াচ্ছেন, গরীব মানুষদের একত্র করছেন। প্রশ্ন হলো তাদের দিয়ে কি সত্যি কোন বিপ্লব ঘটান সম্ভব?
দারা: কেন সম্ভব নয়?
ইন্সপেক্টর: সরকারের পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে কখনো কি তারা জিততে পারবে? আপনারা তো ক্ষুদ্র শক্তি।
দারা: পৃথিবীর বহু দেশে বিপ্লব ঘটেছে। সেসব দেশের পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর শক্তিও কম ছিল না। জনগণের বিপ্লবকে কি তারা ঠেকাতে পেরেছে? মনে রাখবেন, পুলিশ আর সৈন্যরা লড়ছে তার চাকুরির জন্য। আর বিপ্লবীরা লড়ছে একটা মতাদর্শের জন্য। সেই মতাদর্শ যখন প্রতিষ্ঠার কাছাকাছি চলে যাবে, তখন দেখবেন গ্রাম থেকে আসা সামরিক জনতাও তাতে যোগ দেবে।
ইন্সপেক্টর: সেটাই যদি সত্যি হয়, তাহলে এই দীর্ঘ বছরের পর বছর সংগ্রাম করেও কেন আপনারা জিততে পারছেন না? কেন বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন?
দারা: যে মতাদর্শের জন্য আমরা লড়ছি সেটা সকলের দোর গোড়ায় পৌঁছে দেয়া ছিল আমাদের প্রথম কাজ। বিপ্লব তো জনগণের এক উৎসব। আমরা জনগণকে বাদ দিয়ে লড়তে নেমেছিলাম। দু চারজনের প্রাণ নেয়াটা কঠিন কাজ নয়, কঠিন কাজ হচ্ছে লড়াইয়ের মতাদর্শটাকে সকলের দোর গোড়ায় পৌঁছে দেয়া। আমরা তা পারিনি।
ইন্সপেক্টর: জনগণের একটা নীরব সমর্থন সবসময় আপনাদের প্রতি ছিল। পুলিশের লোক হিসাবেই বলছি, জনগণ আপনাদের বন্ধু হিসাবেই দেখত। পুলিশ যখন আপনাদের খুঁজে বেড়াত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামের জনগণ আপনাদের পরিচয় গোপন রাখত।
দারা: জোতদার-মহাজন-গ্রামের ডাকাতরা কিছু গুণ্ডাপাণ্ডারা আমাদের হাতে মারা পড়েছে। সে কারণেই সাধারণ মানুষরা আমাদেরকে তাদের বন্ধু বলে ভাবত। তবে এ সংগ্রাম যে তাদেরকেও আমাদের সাথে দরকার, তা আমরা তাদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের কাজগুলো তাদের কাছে একটা রহস্য সৃষ্টি করেছে, আর কিছু নয়।
ইন্সপেক্টর: তার মানে আপনি আপনাদের কাজের ভুল স্বীকার করছেন? আপনি বলতে চাচ্ছেন যে আপনাদের পথ সঠিক ছিল না? যে পথে আপনারা এগিয়েছেন সেটা ভ্রান্ত পথ?
দারা: কাজে নামলে পরে ভুল ঠিকটা বোঝা যায়। ঘরে চুপচাপ বসে থেকে তো লাভ নেই। আমরা যদি ভুল করে থাকি সে ভুলটা মহৎ উদ্দেশ্যই করেছিলাম। তবে পরের বার আগের ভুলটা অবশ্যই শুধরে নিতে হবে।
ইন্সপেক্টর: আপনাকে বোঝা যায় না, কোন অঙ্ক দিয়েই মেলানো যায় না। এই একজনকে গলা টিপে মেরে ফেলেছেন, আবার কতগুলো মানুষের কথা ভেবে নিজেই প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন। জানেন, গত রাতে শুধু বারবার আপনার কথাই ভেবেছি। এই যে এত অত্যাচার, তবুও আপনি দলের সদস্যদের নাম ঠিকানাগুলো বললেন না। এই যে পালাবার সুযোগ পেয়েও মৃত্যুকে মাথা পেতে নেয়ার জন্য ফিরে এলেন, দেশের জন্য জনগণের জন্য এই যে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতে যাচ্ছেন; সেটাতো ভীষণ একটা মহৎ কাজ। আমি তো পারি না এ রকম মহত্ব দেখাতে। যা আপনি পারেন, আমি কেন তা পারি না। বলুন কেন পারি না?
দারা: এটা আর কিছুই নয়। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা, ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজন, ভিন্ন ভিন্ন আকাঙ্ক্ষা, মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে গড়ে তোলে।
ইন্সপেক্টর: হঠাৎ একবার মনে হয়েছিল, হ্যাঁ আমিও একজন বিপ্লবী হব। যা আপনি পারেন তা আমারও পারা উচিত। কিন্তু একটু পরেই বুঝলাম আমার পক্ষে সম্ভব নয় বিপ্লবী হওয়া।
দারা: কেন সম্ভব নয়?
ইন্সপেক্টর: কারণ আমার স্ত্রী আছে, কন্যা আছে, বৃদ্ধা মা আছেন, ছোট ভাই আছে। তাদের ফেলে রেখে কোথাও আমি যেতে পারি না। হ্যাঁ, আমি ঘুষ খাই, ঘুষের জন্য নিরীহ লোককে ঠকাই, বিপদে ফেলি। কেন? কারণ কতগুলো মানুষকে বাঁচানোর জন্য সংসার আমাকে বেঁধে ফেলেছে, এর থেকে ছাড়া পাওয়া দূরূহ। যদিও আমি মুক্ত, তবুও আমি খাঁচার মধ্যে বন্দী এক পাখি। আর যদিও আপনি আমার বন্দী, কিন্তু আপনার চিন্তা মুক্ত।
দারা: এটা যদি বুঝে থাকেন, তাহলে এটাও বুঝবেন কেন আমরা রাজনীতি করি। কখনো কি ভেবেছেন, কেন আপনার মা, আপনার স্ত্রী, আপনার ভাইকে আপনার ওপর নির্ভর করতে হয়।
ইন্সপেক্টর: কারণ তারা আয় করে না। আমার মা বৃদ্ধা, তার পক্ষে আয় করা সম্ভব নয়। আমার ভাই, আমার কন্যা এখনো ছোট। তাদের এখনো আয় করার বয়স হয়নি।
দারা: না, না, ইন্সপেক্টর সাহেব, তা নয়। তাদেরকে যে আপনার দেখাশুনা করতে হচ্ছে সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণ। কারণ রাষ্ট্র তাদের দেখাশুনা করার দায়িত্ব নেয়নি। যদি রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে থাকত, তাহলে দেখতেন আপনার স্ত্রী সন্তানকে বাঁচানোর জন্য আপনাকে কোন দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হতো না।
ইন্সপেক্টর: সেরকম একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলা কি সম্ভব, যেখানে রাষ্ট্রই সকলের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেবে?
দারা: নিশ্চয় সম্ভব এবং প্রমাণিত। আমরাও সে রকম একটি রাষ্ট্রের স্বপ্নই দেখছি। যেখানে সকল সম্পত্তি হবে রাষ্ট্রের। প্রতিটি নাগরিকের সকল ব্যয়ভার রাষ্ট্রই বহন করবে। পিতা মারা গেলে সন্তানের খাওয়ার অভাব হবে না। বৃদ্ধা মা সন্তানের কাছে অসহায় ভাবে হাত পাতবে না। আপনি মারা গেলে পরে আপনার সন্তানের কী হবে, এ নিয়ে আপনাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। কাল কোন দুর্ঘটনায় আপনার হাত কাটা গেলে, রাষ্ট্রই আপনার দেখাশুনার ভার নেবে। (খানিকটা থেমে) যখনই আপনাকে ভাবতে হয়, আপনি মারা গেলে আপনার স্ত্রী সন্তান খাবে কী, তখন ভবিষ্যতের এই অনিশ্চয়তা আপনাকে সঞ্চয়ী হতে শেখায়। আর আপনি দুর্নীতির পথ বেছে নেন। রাষ্ট্রই যদি সকলের সব দায়-দায়িত্ব বহন করে তাহলে আর ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ের প্রয়োজন কী?

(হঠাৎ টেলিফোন বেজে ওঠে। ইন্সপেক্টর টেলিফোন তুলে নেয়।)
ইন্সপেক্টর: হ্যালো। জ্বী স্যার। জ্বী স্যার। জ্বী স্যার, অবশ্যই। জ্বী স্যার, কড়া পাহারা থাকবে। জ্বী স্যার, হাত পা চোখা বাঁধা অবস্থায় পাঠানো হবে। জ্বী স্যার সম্পূর্ণ গোপনে। তার দলের লোকরা কিছুই জানতে পারবে না। জ্বী স্যার আজ রাতের মধ্যেই। জ্বী স্যার।
(ইন্সপেক্টর ফোনের রিসিভার রেখে দেয়। বিভ্রান্ত মনে হয় তাকে, কোন কথা না বলে সে দারার দিকে দৃষ্টিপাত করে। সে চোখের ভাষাটি খুবই ভিন্ন।)
দারা: কোথা থেকে টেলিফোন এসেছিল ইন্সপেক্টর সাহেব? আপনাকে এত দুশ্চিন্তাগ্রস্থ বা অস্থির দেখাচ্ছে কেন?
ইন্সপেক্টর: জ্বী! আপনাকে আজ রাতে এ থানা থেকে সরিয়ে ভিন্ন এক থানায় নিয়ে যাওয়া হবে। রাত নটার দিকে। পাশের এক থানায়। এখন থেকে আপনি সেখানেই থাকবেন। হয়ত আপনার সাথে আমার আর দেখা হবে না।
দারা: ইন্সপেক্টর, আপনার কি ধারণা আপনার চোখের ভাষা আমি পড়তে পারছি না? আমি জানি আজ রাতে আপনারা আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। আপনারা আমার চোখ-হাত-পা বেঁধে কোথায় নিয়ে যাবেন, সেটা কি না বোঝার কিছু?
ইন্সপেক্টর: দারা বাহাদুর সাহেব, আমার কিছুই করার নেই। আমি এক সামান্য ইন্সপেক্টর। আমার ওপর কোন ক্ষোভ রাখবেন না। উপর থেকে আপনার মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছে। (থেমে) আজ রাতে আপনাকে গুলি করে হত্যা করা হবে। (ইন্সপেক্টর হঠাৎ হাত জোড় করে দারার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে) আমি অক্ষম! এ আদেশ আমি অমান্য করতে পারব না। সে ক্ষমতা বা সাহস আমার নেই।
দারা: নিজেকে কেন অপরাধী করছেন ইন্সপেক্টর। উঠে দাঁড়ান। আমরা হচ্ছি ঘটনার ক্রীড়নক। ঘটনা যেভাবে ঘটবার সেভাবেই ঘটে যাচ্ছে।
ইন্সপেক্টর: পৃথিবীকে আপনি ভালবাসেন। অথচ পৃথিবী আপনাকে বাঁচার অধিকারটুকুও দিল না। বিশাল এক শৃঙ্খল পরে আমি এখানে বসে আছি। আপনার চেয়েও অনেক বড় কারাগারে আমি বন্দী। দারা বাহাদুর, আমার অক্ষমতার জন্য ক্ষমা করবেন।
দারা: ক্ষমা ব্যাপারটা বড় আপেক্ষিক। কে কাকে ক্ষমা করব। পৃথিবীর সকল মানুষের মুক্তি আমার স্বপ্ন ছিল। সকল মানুষ যেন খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারে। যদি কখনো পারেন, আমার সে স্বপ্নটাকে সফল হতে সাহায্য করবেন।
ইন্সপেক্টর: (উঠে দাঁড়িয়ে) দারা বাহাদুর সাহেব, নিজের জন্য কি কিছুই চাইবার নেই আপনার? কখনো দলের জন্য, কখনো দেশের জন্য নিজেকে কতো সহজে মৃত্যুর হাতে সঁপে দিচ্ছেন। মানুষ একবার মরে গেলে আর সে ফিরে আসে না! সেই মৃত্যুর কাছে নিজেকে এত সহজে সমর্পণ করছেন কেমন করে?
দারা: আপনার কি ধারণা, আমি সখ করে মৃত্যুবরণ করছি? আমাকে ছেড়ে দিন। দেখবেন, আমি আবার বাঁচতে চাইব। কে সখ করে মরতে চায় বলুন। আমার জন্য কি হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা আছে?
ইন্সপেক্টর: ছিল। সে পথ এখনো খোলা আছে। সে পথ তো আপনি গ্রহণ করবেন না। আমিও চাই না সে পথ আপনি গ্রহণ করুন।
দারা: সে পথ মানে? কোন্ পথের কথা বলছেন ইন্সপেক্টর সাহেব?
ইন্সপেক্টর: আপনার দলের সদস্যদের নাম ঠিকানাগুলো বলে দেয়া। নাম ঠিকানা বলে দিলে এখনো আপনার জন্য মুক্তি পাবার পথ খোলা আছে। কিন্তু আজ আর আমি চাই না যে, আপনি নাম ঠিকানাগুলো বলে দিয়ে নিজের মুক্তির পথ বেছে নেন।
দারা: (দারা বিস্মিত!) কেন চাইছেন না?
ইন্সপেক্টর: দারা বাহাদুর, বহুদিন পর আমি একজন মানুষকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। মানুষের শঠতা, নীচতা, আত্মপ্রবঞ্চনা-এসব দেখে দেখে মানুষ সম্পর্কে আমার সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে গিয়েছিল। আপনাকে দেখে, আমার পুরান সকল বিশ্বাসগুলো আবার জোড়া লেগেছে। আবার আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, পৃথিবীতে এখনো ভাল মানুষ আছে। যারা কোন কিছুর বিনিময়ে অন্যকে প্রতারণা করে না, নিজের জীবন দেবে তবুও বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। আপনার সম্পর্কে আমার সে বিশ্বাস নিজের মুক্তির জন্য নাম-ঠিকানাগুলো বলে দিয়ে ভেঙে দেবেন না।
দারা: কৌশিককে হত্যা করার পর নাম ঠিকানাগুলো বলবার সমস্ত অধিকার আমি হারিয়ে ফেলেছি। ধরুন, যদি আমি নাম ঠিকানাগুলো বলে দেই, তাহলে তো আপনার জন্য এখনো পদোন্নতি লাভের একটা সুযোগ আছে। পদোন্নতি মানেই আপনার বেতন বাড়বে, পদমর্যাদা বাড়বে।
ইন্সপেক্টর: আমি চাই না। আমার পদোন্নতি আজ না হোক, কাল হবে। আমার পদোন্নতির জন্য আপনি নাম ঠিকানাগুলো বলে দিয়ে আপনার দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করুন, তা আমি চাই না। কেউ যদি আপনাকে বিশ্বাসঘাতক ভাবে আমার কষ্ট হবে।
দারা: ঘটনাচক্রে আজ আপনি আমার সম্মান রক্ষার জন্যে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করতে চাইছেন। মানুষ ঘটনাচক্রে কোন কোন ক্ষেত্রে খুব মহৎ হয়ে দাঁড়ায়। পরের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে। বিপ্লবীরাও তাই। আপনি যেমন আজ আমার জন্য আপনার স্বার্থ ত্যাগ করতে চাইছেন, বিপ্লবীরাও তেমনি দেশের জন্য স্বার্থ ত্যাগ করতে তৈরি হয়েছে। একটি ঘটনা যেমনি আপনাকে আমার ব্যাপারে পাল্টে দিয়েছে, তেমনি নানারকম ঘটনার মধ্যে দিয়েই একজন মানুষ বিপ্লবী হয়ে দাঁড়ায়।
ইন্সপেক্টর: আপনার হাতে আর মাত্র সাত ঘন্টা সময় আছে। আপনার যদি শেষ কোন ইচ্ছা থাকে যা আমার পক্ষে মেটানো সম্ভব, আমাকে বলতে পারেন। যথাসাধ্য চেষ্টা করব আমি।
দারা: হাতে মাত্র আর সাত ঘন্টা সময়। হ্যাঁ এই সাত ঘন্টা, জীবনের শেষ সাত ঘন্টা সময় মানুষ কীভাবে ব্যয় করতে পারে? হ্যাঁ সাত ঘন্টা আমি লিখতে চাই। আমাকে কি কিছু কাগজ আর কলম দেয়া যাবে?
ইন্সপেক্টর: নিশ্চয়ই! আর কিছু দরকার? বলুন, আর কিছু দরকার?
দারা: না, কাগজ আর কলমই যথেষ্ট। আর একটু নিরবচ্ছিন্ন সময়। (একটু পর) ইন্সপেক্টর।
ইন্সপেক্টর: বলুন।
দারা: আমার হাতে সময় খুব কম। আমার অনেক কিছু বলার ছিল যা হয়ত আমি বলে যেতে পারব না। তবুও যা আমি লিখব আপনি কি আমার নির্দেশ মতো তা পৌঁছে দেবেন?
ইন্সপেক্টর: নিশ্চয় পৌঁছে দেব। কাকে পৌঁছে দিতে হবে বলুন।
দারা: কাকে পৌঁছে দিতে হবে আমি এখনো নির্দিষ্ট জানি না। দেশের জন্য যারা কিছু করতে চায় তাদেরকে আমার অনেক কিছু বলার আছে। আমার লেখাগুলো দেশের তরুণদের কিশোর-কিশোরীদের হাতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করবেন। ওরাই দেশের জন্য সবার আগে প্রাণ দিতে চায়। তাই ওদেরকে সব জানতে হবে, বুঝতে হবে।
ইন্সপেক্টর: ঠিক আছে আপনি লিখুন। আপনার আদেশ অনুযায়ী আমি লেখাগুলো পৌঁছে দিতে চেষ্টা করব। আমার মতো একজন পুলিশ অফিসার যদি বিপ্লবের কোন কাজে আসে আমি খুশি হব। আপনি এখানে বসেই লিখুন, কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না। আমি কাগজপত্র পাঠিয়ে দিচ্ছি। (ইন্সপেক্টর যেতে উদ্যত, হঠাৎ দারা তার হাত টেনে ধরে)
দারা: বন্ধু আমার, আপনি তো দেখছি অন্তরে বিপ্লবী আর বহিরাঙ্গনে এক ত্রাস সৃষ্টিকারী পুলিশ অফিসার। আসলে কোনটি আপনি?
ইন্সপেক্টর: রাষ্ট্রের একজন দাস আমি। নানা শৃঙ্খলে বাঁধা একজন দাস। ক্ষুধার শৃঙ্খলে বাঁধা। মৃত্যুভীতির শৃঙ্খলে বাধা। আসলে একই শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে আছি সবাই, কোথায় সে শৃঙ্খলের শেষ কে জানে। একই শৃঙ্খল কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন রঙের। চলবে