প্রত্নসাহিত্যের পথপ্রদর্শক ছিলেন খন্দকার মাহমুদুল হাসান
অমিত কুমার কুন্ডুপ্রকাশিত : জানুয়ারি ২৯, ২০২১
খন্দকার মাহমুদুল হাসানকে দেখলেই হৃদয়ে একটা প্রশান্তি এসে যেত। খুব হৃদয় ছুঁয়ে কথা বলতে পারতেন মানুষটি। জাগতিক নিন্দা ঠাট্টার ঊর্ধ্বে উঠে চলতে জানতেন। বড় ভালোবাসতেন অনুজদের। বড় আপন করে নিতেন। নিজের করে নিতেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে তিনটি বই দিয়েছিলেন আমাকে। যার একটি ‘দীপ্তিমান’। ষাটে পদার্পন উপলক্ষে বিরাট কলেবরের সংকলন। আর দুটি ‘দার্জিলিংয়ে দক্ষযজ্ঞ; ও ‘ছোটদের হাসির গল্প’।
‘দার্জিলিংয়ে দক্ষযজ্ঞ’ বইটি পড়ে আমি লিখেছিলাম, বহুদিন পর অসম্ভব সুন্দর একটি গোয়েন্দা গল্পের বই পড়লাম। বইটির লেখক প্রখ্যাত গবেষক ও শিশুসাহিত্যিক, দীপ্তিমান খন্দকার মাহমুদুল হাসান। গোয়েন্দা কাহিনি ও অ্যাডভেঞ্চার গল্পের বই ‘দার্জিলিংয়ে দক্ষযজ্ঞ’ বইটি পড়তে পড়তে কখনো হারিয়ে যাচ্ছিলাম সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে, কখনোবা পোড়াবাড়ির রহস্যময় অন্ধকারে। এ বইটি রহস্য রোমাঞ্চে ঘেরা একটি ভ্রমণ কাহিনিও। বইটি পড়তে পড়তে যখন `বিপদের হাতছানি` গল্পটি পড়তে শুরু করলাম তখন গোয়েন্দা গল্প পড়ার নেশায় পেয়ে গেল আমাকে। চুরি যাওয়া মূর্তি উদ্ধারের কী অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা আছে এ গল্পে। বইটি পড়লে বোঝা যায় লেখক ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রত্নকীর্তি ও ভ্রমণ, এই চারটি বিষয়কে নান্দনিকভাবে তার গল্পে তুলে এনেছেন। বইটির নাম যে গল্পের নামে হয়েছে, সেই `দার্জিলিংয়ে দক্ষযজ্ঞ` গল্পটি পড়ে আমার বিশ্বখ্যাত শৈলশহর দার্জিলিং ভ্রমণের প্রবল ইচ্ছা জাগছে মনে। বইটি শুরু করে শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামতে পারলাম না। একের পর এক রোমাঞ্চকর গল্পের স্বাদ নিতে মধ্যরাত পর্যন্ত বইটি পড়ে শেষ করলাম। আহা! এমন বই যদি অন্যদেরও পড়ার সুযোগ হতো। এ বইটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ।
তিনি সর্বশেষ যে বইটি দিয়েছিলেন, সেই ‘ছোটদের হাসির গল্প’ বইটি পড়ে আমি লিখেছিলাম, মাসখানেক আগে বইটি পড়া শুরু করি। বইমেলার জন্য নতুন বইয়ের কাজ করতে গিয়ে বইটি পড়ি পড়ি করেও শেষ হচ্ছিল না। আজ নির্বাচনের ছুটিতে অসমাপ্ত পড়ার কাজটি সমাপ্ত হলো। নিজের কাছেই খুব ভালো লাগল। চব্বিশটি গল্প নিয়ে বেশ বড়ো সাইজের বই এটি। খন্দকার মাহমুদুল হাসান বড় লেখক। ভালো লেখেন। তার `ছোটদের হাসির গল্প` বইটিও সুন্দর। প্রকাশিত হয়েছে আদিগন্ত থেকে। পাওয়া যাবে বইমেলার শিশু কর্ণারের আদিগন্তের স্টলে।
তিনি ২০১৮ সালে আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। অসাধারণ আলোচনা করেছিলেন। মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন কবিতা ক্যাফের অঞ্চল জুড়ে। উপস্থিত নিমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দের হৃদয়ে। প্রিয় এই মানুষটি বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস বিষয়ক লেখালেখিতে দিশারী ছিলেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ বিরাট এলাকায় নিজের একক প্রচেষ্টায় ঘুরে ঘুরে ইতিহাস ও পুরাকীর্তি বিষয়ক গবেষণাকাজ পরিচালনা করতেন। রচনা করতেন সাহিত্য, শিশুসাহিত্য, সাময়িকপত্র ও চলচ্চিত্র নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থ।
এই সার্বক্ষণিক লেখক বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রকাশিত শিশু বিশ্বকোষ রচনায় অংশগ্রহণ করেন স্বমহিমায়। তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য জ্ঞানভিত্তিক বই। হিব্রু থেকে ইহুদি, প্রাচীন বাংলার ধুলোমাখা পথে, যেমন করে মানুষ এলো, বিশ্বসভ্যতার ইতিহাস, ভাষার ইতিকথা, প্রাচীন বাংলার প্রত্নকীর্তি, মানবজাতির ক্রমবিকাশ, হারানো পৃথিবীর গল্প, জীবজগতের কথা তার সৃষ্টিশীলতাকে অমরত্ব দান করেছে।
শতাধিক গ্ৰন্থের রচয়িতা এই অমর লেখক ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, চলচ্চিত্র, সাহিত্য ও সাময়িকপত্র বিষয়ক মহামূল্যবান গবেষণাগ্রন্থসমূহের জন্য ব্যাপকভাবে প্ৰশংসিত। ছোটদের জন্যে দু`হাতে লিখেছেন গোয়েন্দাকাহিনি, অ্যাডভেঞ্চার গল্প, রহস্যোপন্যাস, শিকার কাহিনি, ভয়-ভূতের গল্প, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, জীবনী, ইতিহাস ও বিজ্ঞানবিষয়ক বই। তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বইয়ের মধ্যে আরো আছে, বাঙালির ইতিকথা, সেরা কিশোর গল্প, প্রাচীন বাংলার আনাচে কানাচে, ইতিহাসের সেরা গল্প, অচেনা পৃথিবীর অজানা কাহিনী, পাহাড়-মরু-সাগর-নদী, বিশ্বসেরা দুঃসাহসী অভিযান, বাংলাদেশের প্রথম ও প্রাচীন, সেকালের ঢাকা, সুন্দরবনের গল্প, প্রাচীন পৃথিবীর আশ্চর্য কাহিনী, রহস্যজালে দুই গোয়েন্দা, পুরাকীর্তির খোঁজে বাংলার পথে, ভূত সমগ্র, ঢাকা অভিধান, এক গোয়েন্দা চার রহস্য, অবাক করা সত্য গল্প, পুরাকীর্তির বাংলাদেশ, ইতিহাসের সত্য গল্প, ইতিহাসের আলোয় বাংলাদেশ, রহস্যভেদী চার গোয়েন্দা, পৃথিবীতে প্রথম, বাংলাদেশের পুরাকীর্তি কোষ (মধ্য যুগ), মানুষখেকোর খপ্পরে, কাঠমান্ডুর মূর্তিরহস্য, দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা দুঃসাহসী অভিযান, সীতাকুণ্ডে কুপোকাত, ভয়াল বনের আতংক, প্রথম বাংলাদেশ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড),প্রথম বাংলাদেশের কোষ, বাংলার চার কীর্তিমান ইত্যাদি। এসব বই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে, এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেক দূরে।
খন্দকার মাহমুদুল হাসান একজন আপাদমস্তক ভদ্র মানুষ ছিলেন। এমন মানুষটির পাশে দাঁড়ালে নিজেকে আশ্চর্য ধনী মনে হতো। তিনি যেমন চিন্তা রাজ্যের উঁচুতে অবস্থান করতেন, তেমনি অন্যকে উঁচুতে নিয়ে যাবার প্রচেষ্টাও ছিল মনে ও মননে। সবাইকে আপন করে নেবার সহজাত শক্তিতে ভরপুর ছিল তার হৃদয়। এমন নিরহংকারী মানুষ জগতে বিরল। এই নিপাট ভদ্রলোক আমাদের শিশুসাহিত্যের গর্ব ছিলেন। তিনি ছিলেন শিশু সাহিত্যর একনিষ্ঠ সেবক। বিচিত্র অনুসঙ্গে তিনি প্রতিনিয়ত শিশুসাহিত্য সমৃদ্ধ করেছেন। বড় সজ্জন এই মানুষটি ছিলেন প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা এবং লেখালেখিতে অনন্য। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষণা তাকে স্বতন্ত্র মহিমায় প্রতিষ্ঠা করেছে সন্দেহ নেই। গদ্য শক্তিতে অসাধারণত্ব লাভ করা এই মানুষটির হাজার পৃষ্ঠার উপরে সমৃদ্ধ অসংখ্য গ্রন্থ রয়েছে।
খন্দকার মাহমুদুল হাসান দুই দুইবার বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রদত্ত অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি এম নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কারও দু`বার পেয়েছেন। প্রথমবার পেয়েছিলেন ২০১৪ সালে। ভারত থেকে পেয়েছেন যতীন্দ্রমোহন রায় স্মৃতি পুরস্কার সহ দেশে-বিদেশের অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। ১৯৫৯ সালের ২৫ আগস্ট তার জন্ম। পৈত্রিক নিবাস পাবনা জেলায় হলেও তিনি জন্মগ্রহণ করেন রংপুরে, ২৫ আগস্ট ১৯৫৯ সালে। পিতা খন্দকার আজমল হক। মাতা রওশন আরা বেগম।
তিনি কুষ্টিয়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। চাকরি করেছেন সরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পদে। থাকতেন মোহম্মদপুরের নিজস্ব ফ্লাটে। কিছুদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। চিকিৎসা চলছিল রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালে। কয়েকদিন ধরে তিনি হাসপাতালটিতে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে (২৯ জানুয়ারি ২০২১) এই গুণী লেখক ষাট বছরের আয়ুষ্কাল নিয়ে চলে গেলেন পরপারে। তিনি চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন আমাদের জন্য তার অমর কীর্তি। এই কীর্তিমান তার কীর্তির মাঝে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। আমরা তাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবেসে যাব, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক
























