প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্প ‘বলবান জামাতা’

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৫, ২০২১

কথাসাহিত্যিক এবং রবীন্দ্র গবেষক ও জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের আজ মৃত্যুদিন। ১৯৮৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা ‘বলবান জামাতা’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

নলিনীবাবু আলিপুরে পোস্টমাস্টার। বেলা অবসান প্রায়; আপিসে নলিনীবাবু ছটফট করিতেছিলেন। আশ্বিন মাস—সম্মুখে পূজা—নলিনীবাবু ছুটির দরখাস্ত করিয়াছিলেন, কিন্তু এখনও হেড আপিস হইতে কোনও হুকুম আসিল না। যদি আজ পাঁচটার মধ্যেও হুকুম আসে, তবে আজই মেলে এলাহাবাদ রওনা হইবেন। এলাহাবাদে তাঁহার শ্বশুরালয়। নলিনীবাবু এই প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাইবেন। জিনিসপত্র কিনিয়া, বাক্স তোরঙ্গ সাজাইয়া, প্ৰস্তুত হইয়া
বসিয়া আছেন, কিন্তু এখনও ছুটির হুকুম আসিল না। বেলা চারিটা বাজিল। হঠাৎ টং টং করিয়া টেলিফোনের ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। বড় আশা করিয়া নলিনীবাবু টেলিফোনের নল মুখে দিয়া বলিলেন—Yes.

কিন্তু হায়, ছুটির হুকুম আসিল না। একটা মনিঅর্ডার সম্বন্ধে কী গোলমাল ঘটিয়াছিল, তাহারই সংক্রান্ত একটা প্রশ্ন। নলিনী হতাশ হইয়া আবার চেয়ারে আসিয়া উপবেশন করিলেন। দুই একটা টুকিটাকি কার্যের পর পকেট হইতে একখানি পত্র বাহির করিয়া পড়িতে লাগিলেন। পত্রখানি তাঁহার স্ত্রীর লেখা। ইতিপূর্বেই সেখানি বহুবার পাঠ করা হইয়াছিল; আবার পড়িলেন—
(একটি পাখির ছবি)
নিম্নে সোনার জলে মুদ্রিত
“যাও পাখি যেথা মম আছে প্রাণপতি”
প্রিয়তম,
তোমার সুধামাখা পত্ৰখানি পাইয়া মনপ্রাণ শীতল হইল। নাথ, এতদিনের পর কি দীর্ঘ-বিরহের অবসান হইবে? তোমার চাঁদমুখখানি দেখিবার জন্যে আমার চিত্তচকোর উৎকণ্ঠিত হইয়া আছে। আজ দুই বৎসর আমাদের বিবাহ হইয়াছে, এখনও একদিনের তরে পতিসেবা করিতে পাইলাম না। ছুটি হইলে শীঘ্ৰ চলিয়া আসিও। দুঃখিনী আশাপথ চাহিয়া রহিল। দিনাজপুর হইতে মেজদি আজ আসিয়া পৌঁছিয়াছেন। কতদিনে তোমার ছুটি হইবে? পঞ্চমীর দিন যাত্রা করিতে পারিবে কি? আজ তবে আসি। মনে রেখ, ভুল না।
তোমারই
সরোজিনী

নলিনীবাবু পত্ৰখানি উলটিয়া পালটিয়া পাঠ করিলেন। শেষে পুনর্বার তাহা পকেটে রাখিয়া দিলেন। পাঁচটা বাজিতে আর অধিক বিলম্ব নাই। আজও ছুটির কোনও সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে না। নলিনীবাবু একটি মৃদু রকমের দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া আবার কার্যে মন দিতে চেষ্টা করিলেন। যাহা হউক, আজ চতুর্থী মাত্র। যদি আগামী কল্যও ছুটি আসে, তবুও পঞ্চমীর দিন যাত্ৰা করিতে সমর্থ হইবেন। পাঁচটা বাজিতে আর যখন দুই এক মিনিট বাকি আছে, তখন আবার টেলিফোন কল ঝঙ্কার করিয়া উঠিল। আবার নলিনীবাবু নলে মুখ দিয়া বলিলেন— Yes।

দুই.
ছুটি!—ছুটি!—ছুটি!
নলিনীবাবু দুই সপ্তাহের বিদায় পাইয়াছেন। ডেপুটি পোস্টমাস্টারকে চার্জ বুঝাইয়া দিয়া আজই রাত্রে নলিনীবাবু রওনা হইতে পরিবেন। সরোজিনীর পত্রে প্রকাশ, ‘দিনাজপুরের মেজদি’ আসিয়াছেন। ইঁহার আসিবার কথা পূর্বেই নলিনীবাবু অবগত ছিলেন, এবং সেইজন্যই বিশেষত এবার এলাহাবাদ যাইবার জন্য তাঁহার এত অধিক আগ্রহ। ‘দিনাজপুরের মেজদি’র উপর তাঁহার বিলক্ষণ রাগ আছে—তাই তাঁহার সহিত এখন একবার সাক্ষাতের জন্য তিনি বড় ব্যস্ত। কিন্তু সে ব্যাপারটি কি, বুঝাইতে হইলে, মেজদির একটু পরিচয় এবং নলিনীর বিবাহ-বাসরের একটু ইতিহাস বিবৃত করা আবশ্যক।

মেজদির স্বামী মহা সাহেব-লোক—তিনি দিনাজপুরের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট। মেজদির নামটি উল্লেখ করিলেই সকলেই তাঁহাকে অনায়াসে চিনিতে পরিবেন। শ্ৰীমতী কুঞ্জবালা দেবীর স্বাক্ষরিত ওজস্বিনী স্বদেশী কবিতাগুলি বর্তমান সময়ের মাসিক পত্ৰাদিতে কে না পাঠ করিয়াছেন? সৌভাগ্যবশত ফুলার সাহেব বাঙ্গালা জানেন না, জানিলে এতদিন কুঞ্জবালার স্বামীর চাকুরিটি লইয়া টানাটানি হইত। কুঞ্জবালা বিদুষী, সুতরাং বলাই বাহুল্য তাঁহার রসনাটি ক্ষুরধার। তিনি ইংরাজিতে শিক্ষিতা, সুতরাং তাঁহার ‘আইডিয়াল’ সর্ববিষয়ে সাধারণ বঙ্গললনা হইতে বিভিন্ন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যাইতে পারে, একবার তাঁহার এক দেবর এক শিশি সুগন্ধি কিনিয়া আনিয়াছিল। দেখিয়া কুঞ্জবালা জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও কার জন্য এনেছিস?”
“নিজে মাখব।”
“দূর—ও জিনিস ত কেবল স্ত্রীলোকে আর বাবুতে মাখে, —পুরুষমানুষ কখনও সুগন্ধি ব্যবহার করে?”
বালক দেবরটি, বউদিদির তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ বুঝিতে না পারিয়া ভালমানুষের মত বলিয়াছিল, “কেন? বাবুরা কি পুরুষ নয়?”
নলিনীবাবুর যখন বিবাহ হয়, তখন তাঁহার মূর্তিটি দিব্য গোলগাল নন্দদুলালি ধরনের ছিল। গাল দুইটি টেবো-টেবো, হাত দুখানি নবনীতোপম, প্রকোষ্ঠদেশের কোমল অস্থিগুলি কোমলতার মাংসে সম্পূর্ণভাবে প্রচ্ছন্ন। শীলতার অনুমোদিত না হইলেও, বিবাহ-বাসরে কুঞ্জবালা নলিনীর দেহখানির প্রতি বিদ্রুপের তীক্ষ্ণবাণ নিক্ষেপ করিবার প্রলোভন সম্বরণ করিতে পারেন নাই। রবীন্দ্ৰবাবুর কাব্য কিছু পরিবর্তন করিয়া তিনি বলিয়াছিলেন :
নলিনীর মত চেহারা তাহার
নলিনী যাহার নাম,
কোমল কোমল কোমল অতি
যেমন কোমল নাম।
যেমন কোমল, তেমনি বিকল,
তেমনি আলস্য ধাম,—
নলিনী যাহার নাম।
একটি শ্লেষবাক্য মনুষ্যকে যেমন সচেতন করে, দশটি উপদেশবচনেও সেরূপ হয় না। সেই শ্লেষবাক্য যদি সুন্দরীমুখনিঃসৃত হয় এবং সেই সুন্দরী যদি সম্পর্কে শ্যালিকা হন, তাহা হইলে একটি শ্লেষবাক্যের ফল শতগুণ সাংঘাতিক হইয়া উঠে।
বিবাহের পর নলিনীবাবু কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলেন, তাঁহার শ্বশুর মহাশয়ও সপরিবারে কর্মস্থান এলাহাবাদে চলিয়া গেলেন। কিন্তু বিদুষী শ্যালিকার ব্যঙ্গ নলিনী কিছুতেই বিস্মৃত হইতে পারিলেন না।
একদা সন্ধ্যায় পোস্ট অফিস হইতে বাসায় ফিরিয়া, ইজিচেয়ারে পড়িয়া, নলিনীবাবু ধূমপান করিতেছিলেন, এমন সময় সহসা তাঁহার মনে একটা মতলবের উদয় হইল—কেন, তিনি ত চেষ্টা করিলেই এ কলঙ্ক মোচন করিতে পারেন—শরীর পুরুষোচিত দৃঢ় করিতে পারেন। পরদিন বাজার হইতে তিনি স্যাণ্ডোর ডাম্বেলাদি ক্রয় করিয়া আনিয়া, বাড়িতে রীতিমত ব্যায়াম অভ্যাস করিতে যত্নবান হইলেন। নিজ দৈনিক খাদ্যতালিকা হইতে মিষ্ট, দুগ্ধ, ঘৃত ও তণ্ডুল যথাসম্ভব কাটিয়া দিয়া, তৎস্থানে রুটি, মাংস, ডিম্ব প্রভৃতি যোজনা করিলেন। প্রথম প্রথম পাঁচ সাত মিনিটের অধিক ব্যায়াম করিতে পারিতেন না—ক্লান্ত হইয়া পড়িতেন। অভ্যাসের গুণে ক্ৰমে প্ৰভাতে ও সন্ধ্যায় অর্ধঘণ্টা কাল ধরিয়া নিয়মিতভাবে ব্যায়াম করিতে লাগিলেন।
এক বৎসর এইরূপ করিয়া তাঁহার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদি বিলক্ষণ দৃঢ় হইল। তখন বন্ধ করিয়া দিলেন। দুই একটি শিকারী বন্ধুর সহিত মিলিত হইয়া মধ্যে মধ্যে পল্লীগ্রামে গিয়া হংস, বন্যাশূকরাদি শিকার করিতেও অভ্যাস করিলেন।
এইরূপ করিয়া দুই বৎসর কটিয়াছে। এখন আর সে নলিনী নাই। এখন তাঁহার কপোলদেশ বসাশূন্য, চিবুকাগ্রভাগ সূক্ষ্মতাপ্রাপ্ত, হস্তপদাদি অস্থিবহুল হইয়াছে; ফলত তিনি নামের এখন সম্পূর্ণ অযোগ্য হইয়া উঠিয়াছেন। এমন সময় একবার কুঞ্জবালার সহিত সাক্ষাৎ আকাঙ্ক্ষিত। হায় নামটাও যদি পরিবর্তন করিবার উপায় থাকিত। নলিনীবাবু মনে করিয়াছেন, তাঁহার পুত্ৰ জন্মিলে তাঁহার নাম রাখিবেন—খুব একটা ভীষণ রকমের—কী নাম রাখিবেন এখনও স্থির করিতে পারেন নাই।

তিন.
পরদিন বেলা দুইটার সময়, নলিনীবাবু এলাহাবাদ স্টেশনে অবতরণ করিলেন। তাঁহার পরিধানে পায়জামা ও লম্বা পাঞ্জাবি কোট, মস্তকে পাগড়ি। হস্তে একটি বৃহদাকার যষ্টি দেখা যাইতেছিল। জিনিসপত্রের সঙ্গে একটি বন্দুকের বাক্স। ইচ্ছা ছিল ছুটিতে কিঞ্চিৎ শিকারও করিয়া যাইবেন।
স্টেশনে নামিয়া চতুর্দিকে চাহিয়া দেখিলেন—কই, কেহ ত তাঁহাকে লইতে আসে নাই। গত কল্য যাত্ৰা করিবার পূর্বে তিনি যে শ্বশুর মহাশয়ের নামে চারি আনার টেলিগ্রাম একটি পাঠাইয়াছিলেন, তাহা পৌঁছে নাই কি?
কুলি ডাকিয়া জিনিসপত্র লইয়া, নলিনীবাবু স্টেশনের বাহিরে গেলেন। একজন গাড়োয়ানকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহেন্দ্রবাবু উকিলকা বাসা জানতা?”
গাড়োয়ান উত্তর করিল, “হাঁ বাবু—আইয়ে।”
“চলো”—বলিয়া নলিনী গাড়িতে আরোহণ করিলেন।
এলাহাবাদে নলিনীবাবু পূর্বে কখনও আসেন নাই; এমন কি এই তিনি প্রথম বঙ্গদেশের বাহিরে পদার্পণ করিয়াছেন। পশ্চিমের শহরে নূতন দৃশ্য দেখিতে দেখিতে তিনি চলিলেন।
অর্ধ ঘণ্টা পরে গাড়ি একটি বৃহৎ কম্পাউণ্ডযুক্ত বাড়িতে প্রবেশ করিল। সম্মুখেই বহির্বাটী, বরান্দায় একটি নয় দশ বৎসরের বালিকা খেলা করিতেছিল। বারান্দার নিম্নে, বামে, একটা কূপ; সেখানে বসিয়া একজন পশ্চিমা ভৃত্য সজোরে একটা কটাহ মাজিতেছিল।
গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া, সেই ভৃত্যকে সম্বোধন করিয়া নলিনীবাবু বলিলেন—“এই মহেন্দ্রবাবু উকিলের বাড়ি?”
“হ্যাঁ বাবু।”
“বাবু আছেন?”
“না। তিনি কিদারবাবু উকিলের বাড়ি পাশা খেলতে গিয়েছেন।”
“আচ্ছা—ভিতরে খবর দাও—বল জামাইবাবু এসেছেন।”
এই কথা শুনিবামাত্র, যে মেয়েটি বারান্দায় খেলা করিতেছিল, সে ছুটিয়া বাড়ির মধ্যে গিয়া গগন বিদীর্ণ করিয়া বলিল, “ওগো, তোমাদের জামাইবাবু এসেছেন।”
তৃত্যটির নাম রামশরণ। সে এই কথা শুনিয়া, দন্ত বিকশিত করিয়া বলিল, “আরে! জামাইবাবু?” বলিয়া সে চটপট হাত ধুইয়া ফেলিয়া, নলিনীকে একটি দীর্ঘ সেলাম করিল।
তাহার পর রামশরণ জিনিসপত্র গাড়ি হইতে নামাইয়া ফেলিল। এদিকে বাড়ির ভিতর হইতে নানা আকারের বালকবালিকাগণ আসিয়া উঁকি মারিয়া জামাই দেখিতে লাগিল।
রামশরণ নলিনীবাবুকে বৈঠকখানার ঘরে লইয়া গিয়া বসাইল। বলিল, “বাবু চান করা হোবে কি?”
নলিনী বলিল, “হ্যাঁ—স্নান করব। তুমি গোসলখানায় জল দাও।”
এই সময় একজন বাঙ্গালী ঝি আসিয়া নলিনীকে প্ৰণাম করিয়া বলিল, “ভাল ছিলেন ত?”
“হাঁ ভাল ছিলাম। তোমরা কেমন ছিলে?”
হাসিয়া ঝি বলিল, “যেমন রেখেছেন। আজ ছ’মাস আমি এ বাড়িতে চাকরি করছি, দিদিমণিকে রোজ জিজ্ঞাসা করি,—‘জামাইবাবু কবে আসবেন গো?—দিদিমণি বলেন, এই ছুটি হলেই আসবেন। তা এতদিনে মনে পড়ল সেও ভাল। আপনি চান করে ফেলুন। মা ঠাকরুণ জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কি জলটল খাবেন, না ভাত চড়িয়ে দেওয়া হবে?”
নলিনী, মোগলসরাই স্টেশনে, কেলনারের কল্যাণে, প্রাতরাশ সমাধা করিয়া আসিয়াছিলেন; বলিলেন, “এখন ভাত চড়াতে হবে না;—জলটল খাব এখন।”
ঝি বলিল, “আচ্ছা তবে স্নান করে ফেলুন। পরে আপনাকে একটি নতুন জিনিস দেখাব। আমার বখশিসের জন্যে কি গহনা টহনা এনেছেন বের করে রাখুন।” বলিয়া ঝি নলিনীর প্রতি রমণীজন-সুলভ কটাক্ষপাত করিয়া, মৃদু হাস্য করিল।
রামশরণ বলিল, “তুই বখশিস লিবি, হামি বুঝি বখশিস লেব না?”
নলিনী ইহার অর্থ কিছুই বুঝিতে পারিল না, কেবল গভীরভাবে ঘাড়টি নাড়িতে লাগিল।
স্নানান্তে ফিরিয়া আসিয়া নলিনী দেখিল, কতকগুলি বালকবালিকা তাহার বন্দুকের বাক্স খুলিয়া বন্দুকটি বাহির করিয়াছে। সকলে মিলিয়া তাহার ভিন্ন ভিন্ন অংশগুলি জোড়া দিবার চেষ্টা করিতেছে।
তাহাদের হাত হইতে বন্দুকটি লইয়া নলিনী সাবধানে স্থানান্তরে রাখিয়া দিল। এমন সময় পূর্ব কথিত ঝি আসিয়া প্রবেশ করিল। তাহার কোলে একটি অল্পবয়স্ক শিশু। তাহার মুখখানি সদ্য পরিষ্কৃত, চক্ষুযুগল এই মাত্র কজ্জ্বলিত, মাথার চুলগুলি সাবধানে আঁচড়াইয়া দেওয়া।
ঝি শিশুটিকে হাতে করিয়া তুলিয়া নাচাইয়া বলিল, “দেখ জামাইবাবু দেখ, কেমন সোনার চাঁদ হয়েছে। যেন রাজপুত্তুরটি। নাও—একবার কোলে কর।”
নলিনী কখনই ছোট শিশু পছন্দ করিত না। তথাপি ভদ্রতার খাতিরে বলিল, “বাঃ-বেশ ছেলেটি ত!” বলিয়া কোলে লইল।
ঝি বলিল, “বেশ ছেলেটি বললেই হয় না, এখন কি দিয়ে মুখ দেখবে দেখ।”
নলিনী পকেট হইতে দুইটি টাকা বাহির করিয়া শিশুর বদ্ধমুষ্টির মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দিল।
কলিকাতার ঝি তদর্শনে গালে হাত দিয়া বলিল, “ওমা ওমা ওকি? নোকে বলবে কি গো! রূপো দিয়ে সোনার চাঁদের মুখ দেখা!”
সমবেত বালকবালিকাগণ খিলখিল করিয়া হাস্য করিয়া উঠিল। অত্যন্ত অপ্ৰতিভ হইয়া, আর কোনও কথা খুঁজিয়া না পাইয়া, নলিনী বলিল, “সোনা ত আনিনি৷” মনে মনে স্বীয় পত্নীর উপরও রাগ হইল। তাহার কি উচিত ছিল না। পত্রে নলিনীকে লেখা যে, অমুকের সন্তান হইয়াছে, তাহার মুখ দেখিবার জন্য একটা গিনি আনিও?
ঝি বলিল, “সে কথা শোনে কে? তা হলে আজই সেকরা ডেকে সোনার গহনার ফরমাস দাও। ছেলের বাপ হলেই হয় না!”
নলিনীর বুদ্ধিসুদ্ধি ইতিপূর্বেই যথেষ্ট গোলমাল হইয়া গিয়াছিল; শেষের এই কথা শুনিয়া সে একেবারে দিশেহারা হইয়া পড়িল৷ ‘ছেলের বাপ হলেই হয় না’ ইহার অর্থ কী? তবে নলিনীই কি ছেলের বাপ নাকি?
শিশুকে ঝির কোলে ফিরাইয়া দিয়া সভয়ে নলিনী জিজ্ঞাসা করিল, “ছেলেটি কবে হল?”
ঝি পুনর্বার গালে হাত দিয়া বলিল, “অবাক কল্লে যে! তোমার ছেলে কবে হল তুমি জান না, পাড়ার লোককে জিজ্ঞাসা করছ?”
যে দুইটি বালকবালিকা উহারই মধ্যে একটু বয়ঃপ্রাপ্ত ছিল, তাহারা ঝির এই ব্যঙ্গোক্তি শুনিয়া হাসিয়া উঠিল। ক্ষুদ্রতর বালকবালিকাগণ তাহাদের দেখাদেখি, উচ্চতর হাস্য করিয়া মেঝেতে লুটোপুটি কৱিতে লাগিল।
সদ্যস্নাত নলিনীর ললাট তখন ঘৰ্মসিক্ত হইয়া উঠিয়াছে। সে, মনের বিস্ময় মনে চাপিয়া রাখিবার প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছে। এ গুঢ় রহস্য ভেদ করিবার ক্ষমতা তাহার নাই।
এই সময়ে একটি বালিকা আসিয়া, নলিনীর হাতে একটি গেলাস দিয়া বলিল, “জামাইবাবু! একটু সরবত খাও।”
নলিনী গেলাসে মুখ দিয়া দেখিল, জলটা লবণাক্ত। গেলাস নামাইয়া রাখিল। তখন হঠাৎ তাহার মনে হইল, তাহার প্রতি এই পিতৃত্ব আরোপটাও, জামাই ঠাট্টারই একটা অংশ হইবে। এই মীমাংসায় উপনীত হইয়া, নলিনীর মন একটু শান্ত হইল। তাহার কুঞ্চিত ভ্ৰযুগাল আবার সমতা প্রাপ্ত হইল।
সেই বৈঠকখানার একটা কোণে, একটা কবাট খুলিবার শব্দ হইল। কবাটের সম্মুখস্থিত পদ অপসৃত করিয়া রামশরণ ভৃত্য বলিল, “বাবু আসুন—জলখাওয়া দেওয়া হয়েছে।”
নলিনী চাহিয়া দেখিল, অন্দর মহলের একটি কক্ষ দৃশ্যমান। উঠিয়া সেই কক্ষে প্রবশে করিল। কক্ষের মধ্যস্থলে সুন্দর কার্পেটের আসন পাতা রহিয়াছে। তাহার সম্মুখে রূপার রেকাবি বাটি গেলাসে ভরা নানাবিধ খাদ্য ও পানীয়। নলিনী ধীরে ধীরে আসনখানির উপর উপবেশন করিয়া জলযোগে মন দিল।
এমন সময় কক্ষান্তর হইতে মলের ঝুমঝুম শব্দ উত্থিত হইল। একটি ক্ষুদ্র বালিকা দ্বারপথে মুখ দিয়া বলিল, “মেজদি আসছেন।”
নলিনী বুঝিল, কুঞ্জবালা আসিতেছেন। নিজ দক্ষিণ হস্তের আস্তিন সে ভাল করিয়া গুটাইয়া লইল। কুঞ্জবালা আসিয়া দেখুন, তাহার হাতের কব্জি এখন আর সুগোল নহে, মাংসল নহে, পরন্তু তাহা সুপুষ্ট অস্থি ও শিরায় সমাকীর্ণ।
মলের শব্দ নিকটে হইতে নিকটতর হইতে লাগিল। “কি ভাই এত দিনে মনে পড়ল?”—বলিতে বলিতে যুবতী আসিয়া কক্ষমধ্যস্থলে দণ্ডায়মান হইলেন। কিন্তু তাহা একমুহুর্তের জন্য মাত্র। চারি চক্ষে মিলিত হইতেই, সেই মহিলা একহাত ঘোমটা টানিয়া দ্রুতপদে কক্ষ হইতে নিস্ক্রান্ত হইয়া গেলেন।
নলিনী দেখিল, তিনি কুঞ্জবালা নহেন!
পার্শ্বের কক্ষ হইতে দুই-তিনটি রমণীর উত্তেজিত কণ্ঠস্বর নলিনীর কর্ণে আসিল :
“কি লো, পালিয়ে এলি যে?”
“ওমা, ও যে অন্য লোক৷”
“অন্য লোক কি লো? আমাদের শরৎ নয়?”
“না, শরৎ হবে কেন?”
“কে তবে?”
“আমি জানি?”
“এ কি কাণ্ড? জুয়াচোর নাকি?”
“যে রকম চোয়াড়ে চেহারা, আশ্চর্য নয়।”
“ওমা এ কি কাণ্ড! জামাই সেজে কে এল?”
একজন বালকের কণ্ঠস্বরে শুনা গেল, “একটা বন্দুক নিয়ে এসেছে।”
“অ্যাঁ—ওমা কি সর্বনাশ হল গো! ওরে রামশরণা—রামিশরণা—কোথা গেলি! যা, শীগগির বাবুকে খবর দে।”—রমণীগণের দ্রুত পদধ্বনি শ্রুত হইল। তাহার পর নলিনী আর কিছু শুনিতে পাইল না।
এই সময়ের মধ্যে, অদূরস্থিত একটি পুস্তকের আলমারির প্রতি নলিনীর দৃষ্টি পড়িয়ছিল। সারি সারি বাঁধান ল-রিপোর্ট; প্রত্যেকখানির নিম্নে সোনার জলে নাম লেখা—এম. এন ঘোষ।
তখন সমস্ত ব্যাপার নলিনী দিনের আলোকের মত স্পষ্ট বুঝিতে পারিল। তাহার শ্বশুরের নাম মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনি মহেন্দ্ৰনাথ ঘোষ। তবে ভ্ৰমক্রমে সে অন্য লোকের শ্বশুরবাড়িতে চড়াও করিয়াছে।
নলিনী তখন মনে মনে হাস্য করিতে করিতে নিশ্চিন্তমনে একে একে জলখাবারের পাত্রগুলি খালি করিয়া ফেলিল।

চার.
এদিকে রামশরণ ভৃত্য ঊর্ধ্বশ্বাসে বাবুকে খবর দিতে ছুটিল। কেদারবাবু উকিলের বাসায়, ছুটির সময়, প্রায়ই পাশা খেলার আড্ডা জমিয়া থাকে। অদ্য এখানে বড় মহেন্দ্রবাবু, ছোট মহেন্দ্রবাবু (নলিনীর আসল শ্বশুর) এবং অন্যান্য অনেকগুলি উকিল সমবেত হইয়াছেন।
পাশা খেলা চলিতেছিল, এমন সময় ঝড়ের মত আসিয়া রামশরণ সেখানে প্রবেশ করিল। নিজ প্রভুকে দেখিয়া বলিল, “বাবু—বাবু—জলদি বাড়ি আসুন—”
তাহার মুখ চক্ষু দেখিয়া ভীত হইয়া মহেন্দ্র ঘোষ বলিলেন, “কেন রে—কারু অসুখ বিসুখ?”
“বাড়িমে একঠো ডাকু এসেছে।”
সকলেই উৎসুক হইয়া উঠিলেন।
মহেন্দ্র ঘোষ বলিলেন, “ডাকু? দিনের বেলায় ডাকু?”
রামশরণ বলিল, “ডাকু হোবে কি জুয়াচোর হবে কি পাগল আদমি হোবে কিছু ঠিকানা নাই। সে বলে কি হামি বাবুর দামাদ আছি।”
ইহা শুনিয়া অন্য সকলে হাস্য করিলেন। কিন্তু মহেন্দ্র ঘোষ উত্তেজিতস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কখন এল? কি করছে?”
“এই তিন বাজে এসেছে। একঠো লাঠি এনেছে, একঠো বন্দুক এনেছে—অন্দরমে গিয়ে জল উল খেয়েছে। মাইজি লোগকে বড়া ডর হয়েছে।
“বন্দুক এনেছে? লাঠি এনেছে?—হতভাগা পাজি শূয়ার—তুই বাড়ি ছেড়ে এলি কার জিন্মায়?” বলিয়া ক্ষিপ্তের মত মহেন্দ্রবাবু বাহির হইলেন। গাড়ি প্ৰস্তৃত ছিল। লম্ফ দিয়া গাড়িতে উঠিয়া হাঁকিলেন, “জোরসে হাঁকাও৷”
কয়েকজন উকিল সঙ্গে সঙ্গে বাহিরে আসিয়াছিলেন। কেহ বলিলেন—“বোধ হয় পাগল হবে।” কেহ বলিলেন—“না, পাগল হলে বন্দুক আনবে কেন? কোনও বদমায়েস গুণ্ডা হবে।” ছোট মহেন্দ্ৰবাবু (নলিনীর শ্বশুর) বলিয়া দিলেন, “পগলাই হোক, গুণ্ডাই হোক, ধরে পুলিসে হ্যাণ্ডোভার করে দিও।”
গাড়ি নক্ষত্ৰবেগে ছুটিল—বাড়িতে পৌঁছিলে, গাড়ি হইতে লাফাইয়া পড়িয়া মহেন্দ্রবাবু বলিলেন, “কই? কোথায়?”
এমন সময় নলিনী কক্ষ হইতে বাহির হইয়া বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল। গৃহস্বামীকে অভিবাদন করিয়া বলিল, “আপনিই মহেন্দ্রবাবু? আপনার কাছে আমার একটা ক্ষমাপ্রার্থনা করবার আছে।”
নলিনীর ভাবভঙ্গি ও কথাবার্তায় মহেন্দ্রবাবু একটু থতমত খাইয়া গেলেন। বাড়ি পৌঁছিয়াই যেরূপ প্ৰহারের বন্দোবস্ত করিবেন ভাবিয়ছিলেন, তাহাতে বাধা পড়িয়া গেল।
মহেন্দ্রবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে আপনি?”
“আমার নাম নলিনীকান্ত মুখোপাধ্যায়। আমি মহেন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের জামাতা। মহেন্দ্রবাবু উকিলের বাড়ি গাড়োয়ানকে বলেছিলাম, সে আমাকে এখানে এনে ফেলেছে। আমি আমার ভুল এই অল্পক্ষণ মাত্র জানতে পেরেছি। এতক্ষণ চলে যেতাম। আপনাকে আনতে লোক গিয়েছে—আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে তবে যাব, এইজন্যে অপেক্ষা করছি।”
এই কথা শুনিয়া মহেন্দ্র ঘোষের রাগ জল হইয়া গেল। তিনি নলিনীর হাত দুখানি নিজ হস্তে ধারণ করিয়া হো-হো শব্দে অনেকক্ষণ হাস্য করিলেন।
শেষে বলিলেন, “মহিনের জামাই তুমি? বেশ বেশ। দেখ, এখানে দু’জন মহেন্দ্ৰবাবু উকিল থাকাতে, মক্কেল নিয়ে মাঝে মাঝে গোলমাল হয় বটে। হয়ত মফস্বল থেকে কোনও উকিল, আমার কাছে এক মোকৰ্দমা পাঠিয়ে দিলে, মক্কেল কাগজপত্র নিয়ে গিয়ে উপস্থিত হল তোমার শ্বশুরবাড়িতে। কিন্তু জামাই নিয়ে গোলমাল এই প্রথম!”—বলিয়া মহেন্দ্ৰ ঘোষ অপরিমিত হাস্য করিতে লাগিলেন।
তাহার পর নলিনীকে লইয়া বৈঠকখানায় বসাইলেন। কিঞ্চিৎ গল্প গুজবের পর, নলিনীর জন্যে একটি ভাড়াটিয়া গাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। নলিনী তখন বিদায় গ্রহণ করিয়া নিজ শ্বশুরালয় অভিমুখে যাত্ৰা করিল।

পাঁচ.
এদিকে কেদারবাবু উকিলের বাড়িতে, সে অপরাহ্নে পাশা খেলা আর ভাল জমিল না। মহেন্দ্ৰ ঘোষ প্রস্থান করিলে, সে সভায় অনেকে অনেক আশ্চর্য জুয়াচুরির গল্প করিলেন। অনেক পাগলের গল্পও হইল। ক্রমে সভাভঙ্গ হইল। উকিলগণ একে একে নিজ আলয়ে ফিরিয়া গেলেন।
মহেন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি শাগঞ্জ মহল্লায়। তিনি বাড়ি ফিরিয়া, চা ও তাওয়াদার তামাক হুকুম করিলেন। আপিস কক্ষে ইজিচেয়ারে বসিয়া, চা-পান করিতে লাগিলেন। ভূত্য একটি বৃহদাকার ছিলিম আলবোলায় চড়াইয়া, গুলের আগুনে মৃদু মৃদু পাখার বাতাস করিতে লাগিল।
চা-পান শেষ হইলে, মহেন্দ্রবাবু আলবোলার নলটি মুখে করিয়া আরামে চক্ষু মুদ্রিত করিলেন।
কিয়ৎক্ষণ এইরূপে কাটিলে পর, একটি ভাড়াটিয়া গাড়ি কম্পাউণ্ডের মধ্যে প্রবেশ করিল। উকিলের বাড়ি, কত লোক আসে যায়, মহেন্দ্রবাবু কিছুই ব্যস্ত হইলেন না, কিন্তু চক্ষু উন্মীলন করিয়া রহিলেন।
বাহির হইতে শব্দ শুনিলেন, একটি অপরিচিত কণ্ঠস্বর বলিতেছে, “এই মহেন্দ্ৰবাবুর বাড়ি?”
“হাঁ বাবু!”
“খবর দাও, বল বাবুর জামাই এসেছেন।”
এই ‘জামাই’ শুনিয়াই মহেন্দ্রবাবু কেদারা ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িলেন। জানালার পর্দা তুলিয়া দেখিলেন—বৃহৎ যষ্টিহস্তে ষণ্ডামার্কা আকারের একজন লোক দাঁড়াইয়া আছে, গাড়োয়ান গাড়ির ভিতর হইতে একটা বন্দুকের বাক্স বাহির করিতেছে।
দেখিয়াই মহেন্দ্রবাবু হাঁকিলেন, “কোই হ্যায় রে?”—বলিতে বলিতে বাহিরে আসিয়া বারান্দায় দাঁড়াইলেন।
তাঁহার মূর্তি দেখিয়া বেচারা নলিনী একটু থতমত খাইয়া গেল। মহেন্দ্রবাবু দাঁতমুখ খিচাইয়া সপ্তমে বলিলেন, “পাজি বেটা জুয়াচোর—ভাগো হিঁয়াসে। আভি ভাগো! ঘুরে ফিরে শেষে আমার বাড়িতে এসেছ? শ্বশুর পাতাবার আর লোক পেলে না? বেটা বদ্‌মায়েস গুণ্ডা!”
ইতিমধ্যে অনেকগুলি ভৃত্য দারোয়ান আসিয়া পড়িয়াছিল। মহেন্দ্রবাবু হুকুম দিলেন, “মারকে নিকাল দেও। গর্দান পাকড়কে নিকাল দেও।”
ভৃত্যগণ নলিনীকে আক্রমণ করিবার উপক্ৰম করিল। তাহা দেখিয়া নলিনী তাহার বৃহৎ ষষ্টি মস্তকোপরি ঘূর্ণিত করিয়া বলিল, “খবরদার! হাম চলা যাতা হ্যায়। লেকেন যো হামকে ছুঁয়েগা, উসকা হাড্ডি হাম চুরচুর কর ডালেঙ্গে।”
নলিনীর মূর্তি ও লাঠি দেখিয়া ভৃত্যগণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
নলিনী মহেন্দ্রবাবুকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, “আপনি ভুল করছেন। আমি আপনার জামাই নলিনী।”
এ কথা শুনিয়া মহেন্দ্রবাবু অগ্নিশর্ম্মা হইয়া বলিলেন, “বেটা জুয়াচোর! তুমি শ্বশুর চেন আর আমি জামাই চিনিনে? আমার জামাইয়ের এ রকম গুণ্ডার মত চেহারা?—ভাগো হিঁয়াসে—নিকালো হিঁয়াসে—নয়ত আভি পুলিশমে ভেজেঙ্গে—“
নলিনী আর দ্বিরক্তি করিল না। গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়া গাড়োয়ানকে বলিল, “চলো স্টেশন।”

ছয়.
গোলমাল থামিলে, তাওয়াদার তামাকটা শেষ করিয়া মহেন্দ্রবাবু বাড়ির মধ্যে গেলেন।
তাঁহার গৃহিণী তাঁহাকে দেখিবামাত্র বলিলেন, “মদ খেয়েছ নাকি? জামাইকে তাড়ালে?”
মহেন্দ্রবাবু গভীরস্বরে বলিলেন, “জামাই কাকে বল? সে একটা জুয়াচোর!”
“জুয়াচোর কিসে জানলে?”
তখন মহেন্দ্রবাবু, পাশা খেলিবার কালে কেদারবাবুর বাসায় যাহা যাহা শুনিয়াছিলেন, সবই বলিলেন। শুনিয়া গৃহিণী বলিলেন, “বেশ ত, কিন্তু তাতেই কি প্রমাণ হয়ে গেল যে সে জুয়াচোর? দু’জনেরই এক নাম—বাড়ি ভুল করে সেখানে গিয়ে ওঠাই কি আশ্চর্য নয়?”
স্ত্রীর মুখে এ যুক্তি শুনিয়া মহেন্দ্রবাবু একটু দমিয়া গেলেন। লাঠি ও বন্দুক দেখিয়াই হঠাৎ তিনি বুদ্ধিহারা হইয়া পড়িয়াছিলেন—এ সকল কথার ভালরূপ বিচার করিয়া দেখিবার অবসর পান নাই।
একটু ভাবিয়া মহেন্দ্রবাবু বলিলেন, “সে যদি হত—তাহলে খবর দিয়ে আসত—আমরা স্টেশনে তাকে আনতে যেতাম। কথা নেই, বার্তা নেই, হঠাৎ কখনও জামাই প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি এসে উপস্থিত হয়? সে জুয়াচোর—জুয়াচোর।”
“কেন আসবার কথা থাকবে না? আসবার কথা ত রয়েছে। পুজোর আগেই আসবে আমরা ত জানি—তবে ঠিক কবে আসবে তা খবর ছিল না বটে।”
পিতার এই বিপদ দেখিয়া, কুঞ্জবালা বলিলেন, “ওগো সে নলিনী নয়—আমি তাকে দেখেছি।”
মহেন্দ্রবাবু বলিলেন, “তুই দেখিছিস নাকি? বল ত!—বল ত! কোথা থেকে দেখলি?”
“যখন ওই গোলমালটা হল, আমি দোতলায় উঠে জানালা দিয়ে দেখলাম। নলিনী আমাদের ননীর পুতুল। এ ত দেখলাম একটা কাটখোট্টা জোয়ান।”
মহেন্দ্রবাবু অত্যন্ত আশ্বস্ত হইয়া বলিলেন, “ঠিক বলেছিস। আমি ত সে কথা তার মুখের উপরেই বলে দিয়েছি। আমি আমার জামাই চিনিনে? তার কি আমন মিরজাপুরী গুণ্ডার মত চেহারা? তার দিব্যি নধর বাবু-বাবু চেহারাটি। বিয়ের সময় একদিন মাত্র দেখেছি বটে—তা বলে এমনিই কি ভুল হয়?”
এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় একজন ভৃত্য আসিয়া বলিল, “বাবু, টেলিগেরাপ এসেছে।”
টেলিগ্রাম পড়িয়া মহেন্দ্ৰবাবুর মুখ শুকাইয়া গেল। ইহা সেই নলিনীর প্রেরিত গতকল্যকার চারি আনা মূল্যের টেলিগ্রাম।
গৃহিণী বলিলেন, “খবর কী?”
নিতান্ত অপরাধীর মত, মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে মহেন্দ্ৰবাবু বলিলেন, “এই ত টেলিগ্রাম এসেছে। সে তবে দেখছি জামাই-ই বটে।”
গৃহিণী বলিলেন, “তবে এখন ফেরাবার কী উপায় হয়?”
“যাই, নিজে গিয়ে দেখি। যাবার সময় গাড়োয়ানকে বলেছিল, ‘স্টেশনে চল’৷ এখন ত কলকাতা যাবার কোনও গাড়ি নেই। বোধ হয় স্টেশনে গিয়ে বসে আছে। যাই, গিয়ে বাপু বাছা বলে ফিরিয়ে আনি৷”
বাড়ির লোকে মনে করিয়াছিল, নলিনী এই ব্যাপার লইয়া শালীশালাজকে ঠাট্টা করিয়া গায়ের ঝাল মিটাইবে। কিন্তু নলিনী ফিরিয়া আসিয়া একদিনের জন্যও সে কথা উত্থাপন করে নাই। যে ভুল হইয়া গিয়াছে তাহার জন্য তাহার শ্বশুরবাড়ির সকলেই লজ্জিত, অনুতপ্ত—তাহাই নলিনীরপক্ষে যথেষ্ট হইয়াছিল। একদিন কেবল অন্য প্রসঙ্গে মহেন্দ্ৰ ঘোষ উকিলের কথা উঠিলে সে বলিয়াছিল—“যা হোক, পরের শ্বশুরবাড়িতে উঠে যে আদর যত্ন পেয়েছিলাম—অনেকে সে রকম নিজের শ্বশুরবাড়িতে পায় না।