প্রাচ্য, পাশ্চাত্য এবং ইসলাম

পর্ব ২

আলিজা আলী ইজেতবেগোভিচ

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৩, ২০২৩

‘প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও ইসলাম’ সংস্কৃতি ও সভ্যতার ওপর একটি যুগোপযোগী গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। আলিজা আলী ইজেতবেগোভিচ এই বইটিতে বিশ্বের আধুনিক দর্শন ও মতাদর্শগুলি মানুষকে প্রয়োজন মোতাবেক গাইডলাইন দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং ইসলাম কীভাবে মানুষের জীবনকে দেহ ও মনের যৌথ মিথস্ক্রিয়ায় স্বাভাবিক ও স্বতস্ফুর্তায় ফেরাতে চাইছে, তা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। এটি ধর্মতত্ত্বের ওপর কোনো বই নয়। এটি বিশ্ব ভাবাদর্শের পরিসরে ইসলামের অবস্থান নির্ধারণের লক্ষ্যে ইসলামের আদর্শ, ঐতিহ্য, প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলছে। এখানে আলিজা ইসলামকে ভিতর থেকে নয় বরং বাইরে থেকে বিচার করার জন্য সচেষ্ট হয়েছেন। এই অর্থে, বইটির বিষয় প্রাথমিকভাবে ইসলাম একটি আদর্শ হিসেবে নয়, বরং ইসলাম একটি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি, এই হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

 

প্রথম প্রকাশ ১৯৯৪ সালে। এরপর একে একে সাতটি সংস্করণ। একশো বছরে প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে অন্যতম সেরা। কেন? কারণ এই বইতে পৃথিবীর প্রচলতি ডমিনেটিং মতাদর্শ বিশেষ করে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব, বস্তুবাদ, বিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্বের সাথে ইসলামের তুলনামূলক সম্পর্ক ও সম্পর্কহীনতার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। আগেই বলেছি, আলিজা এই বইতে ইসলামকে থিওলজিকাল পয়েন্ট থেকে বিচার করেন নাই, করেছেন বর্তমান বিশ্বের প্রচলিত দর্শন, বিজ্ঞান, ঐতিহাসিক, রাজনীতিক প্রেক্ষাপট এবং সমাজতাত্ত্বিক বিষয় ও বিবেচনায়। তাই তিনি একে একে সৃষ্টি ও বিবর্তন, সংস্কৃতি, শিল্প জগত, নৈতিকতা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস, ড্রামা ও ইউটোপিয়া, ইসলাম, মুসা (আ.), যীশুখস্ট, মোহাম্মদ, ইসলাম ও ধর্ম, ধারণা ও বাস্তবতা প্রভৃতি বুদ্ধিবত্তিক ও আত্মসন্ধানী বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।

 

এই বইটি মুসলিম ও নন-মুসলিম, যারা বুদ্ধিবত্তিক, জ্ঞান বিজ্ঞান ডিস্কোর্স বিষয়ক বই পড়তে আগ্রহী তাদের জন্য অবশ্য পাঠ্য । আশ্চর্য, আমাদের বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী মহলে মার্ক্স, গ্রামসি, ফ্রয়েড, লাঁকা বিদ্যাসাগর ইত্যাদির কাজ সম্পর্কে আলোচনা হয়। কিন্তু এই চিন্তা উদ্রেককারী, সভ্যতার নতুন পথের চিহ্নায়ক এই কালজয়ী গ্রন্থটি বিষয়ে সবাই উদ্দেশ্যমূলকভাবে নীরব। কবি ইশারফ হোসেন নব্বইয়ের দশকে তার পত্রিকা ‘সকাল’এ এই বইটির গুরুত্বের ওপর প্রথম সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন। এতে আমি উৎসাহিত হয়েছি এবং বইটির নির্বাচিত কিছু অংশ ক্রমান্বয়ে অনুবাদের ইচ্ছা পোষণ করছি। পাঠক, বন্ধুদের পাঠ-প্রতিক্রিয়া সাদরে আমন্ত্রিত। –আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

 

বইটির বিষয়বস্তু
আমরা আজ পর্যন্ত ভিন্ন উপায়ে ইসলামের সংজ্ঞার দ্বারস্থ হয়েছি। মূল কথা মাথায় রেখে আমরা বলতে পারি, ইসলাম প্রথমে বিশ্বের দ্বৈতবাদ স্বীকার করে এবং তারপর তা কাটিয়ে উঠতেও জানে। এই বইয়ে ইসলামি বিশেষণটি ব্যবহার করা হয়েছে শুধুমাত্র আইন কানুনকে সত্যায়নের জন্যই নয়, যা সাধারণত ইসলাম নামে পরিচিত। কিন্তু তাদের অন্তর্নিহিত মৌলিকনীতিগুলিকে পরখ করে দেখতে। এখানে ইসলাম একটি রেডিমেড সমাধানের পরিবর্তে একটি পদ্ধতির নাম- বিপরীত নীতির সংশ্লেষণের একটা মাধ্যম। যে পদ্ধতিতে জীবন সৃষ্টি হয়েছিল- ইসলামের মূলনীতি আমাদের তা স্মরণ করিয়ে দেয় । যে অনুপ্রেরণা মনের স্বাধীনতা এবং প্রকৃতির সংকল্পকে সংযুক্ত করেছে, তা মনে হয় একই যখন ওযু এবং নামাজ সংযুক্ত হয় ইসলামি সালাতের ঐকতানে। একটি শক্তিশালী অন্তর্দৃষ্টি, এই সালাত থেকে সম্পূর্ণরূপে ইসলাম পুনর্গঠন করতে সক্ষম হবে, পারবে ইসলামের বাইরে বিশ্বের সর্বজনীন দ্বৈতবাদ নির্মাণ করতে।

 

ইউরোপ একটি মধ্যম পথ খুঁজে পেতে সক্ষম হয়নি, যদিও ইংল্যান্ড এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হওয়ার চেষ্টা করেছে। এই কারণে ইউরোপীয় পরিভাষা ব্যবহার করে ইসলামকে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাই ইসলামী পরিভাষা সালাত, যাকাত, খলিফা, জামাআহ, ওযু ইত্যাদি- যথাক্রমে প্রার্থনা, কর, শাসক, সম্প্রদায় এবং ধৌত করা বোঝায় না। সংজ্ঞাটি যে ইসলাম ধর্ম এবং বস্তুবাদের মধ্যে একটি সংশ্লেষণ, এটি যে খ্রিস্টধর্ম এবং সমাজতন্ত্রের মাঝখানে বিদ্যমান- এই বিষয়টি শর্তসাপেক্ষে গ্রহণ করা যেতে পারে। শুধুমাত্র কিছু দিক বিবেচনা করে এটি কমবেশি সঠিক বলা যায়। এই দুটি শিক্ষার মধ্যে ইসলাম কোন সরল পাটিগণিতিক মাধ্যম নয়। সালাত, যাকাত, ওযু অবিভাজ্য কারণ তারা একই সময়ে একটি অন্তরঙ্গ এবং সরল অনুভূতি প্রকাশ করে। এটি এমন একটি কাজ যা একটি শব্দ এবং একটি ছবি দিয়ে প্রকাশ করা হয়, কিন্তু যা একটি যৌক্তিক দ্বৈত অর্থের প্রতিনিধিত্ব করে। মানুষের সাথে সমান্তরালভাবে কোনটা যায় তা এখানে স্পষ্ট। মানুষ তার মাপকাঠি এবং তার ব্যাখ্যা।

 

এটা জানা যে, কুরআন একজন বিশ্লেষণাত্মক পাঠককে এই বলে ধারণা দিতে পারে যে এটি কিছুটা অব্যবস্থাপনার সাথে সাজানো হয়েছে, এবং এটি মনে হতে পারে যে এটি বিভিন্ন রকম উপাদানের ফলাফল। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে কোরান হলো জীবন, সাহিত্য নয়। ইসলাম চিন্তা করার উপায় নয় বরং জীবনযাপনের একটি পদ্ধতি। কুরআন বিষয়ে খাঁটি মন্তব্য হতে পারে যে এটি হলো জীবন, এবং আমরা হাদিসের বরাত দিয়ে জানি কোরান ছিল নবী মুহাম্মদের (সা.) জীবন। ইসলাম তার লিখিত আকারে (কুরআন) অগোছালো মনে হতে পারে, কিন্তু মুহাম্মদের (সা.) জীবনে এটি নিজেকে প্রেম এবং শক্তি, মহৎ এবং বাস্তব, ঐশ্বরিক এবং মানবীয়- এসবের স্বাভাবিক মিলনের আধার হিসাবে প্রমাণ করে। ধর্ম এবং এবং রাজনীতির এই চমৎকার মিশ্রণ একজন মুসলমানের জীবনে বিপুল শক্তির জন্ম দেয়। তাই ইসলাম জীবনের সারমর্মের সাথে খুব মিলে যায়।

 

ইসলামের এই মধ্যম অবস্থানের কারণে ইসলাম ধর্মকে সবসময় দুই বিপরীত দিক থেকে আক্রমণ করা হয়েছে। ধর্মের দিক দিয়ে এভাবে যে এটি খুব স্বাভাবিক, বাস্তব এবং বিশ্ব-স্বভাবের সাথে স্বাভাবিক। আবার বিজ্ঞানের দিক দিয়ে বলা হয় যে এটিতে ধর্মীয় এবং রহস্যময় অনুষঙ্গ রয়েছে। ইসলাম একটিই, কিন্তু মানুষের মতই এর দেহ এবং আত্মা দুটিই আছে। এর বিপরীত দিকগুলি ভিন্ন দৃষ্টিকোণের উপর নির্ভর করে। যেমন বস্তুবাদীরা ইসলামকে শুধুমাত্র একটি ধর্ম এবং রহস্যবাদ হিসেবে মনে করে । আবার খ্রিস্টানরা এটিকে শুধুমাত্র একটি সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলন হিসাবে দেখে।

 

ভিতর থেকে দেখার সময়ও ওপরের এই দ্বৈতবাদী ছাপ নিজেকে পুনরায় প্রকাশ করে। ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলোর একটিও বিশুদ্ধ ধর্মের অন্তর্গত নয় বা বিজ্ঞানের অন্তর্গত নয়- যা রাজনীতি এবং অর্থনীতির সাথে যায়। মিস্টিক (অতীন্দ্রিয়বাদীরা) সর্বদাই ধর্মীয় উপাদানের উপর জোর দিয়েছে, অন্যদিকে যুক্তিবাদীরা ইসলামের অন্যটি দিকটির ওপর। তাদের উভয়েরই ইসলামের সাথে সবসময় সমস্যা ছিল, কারণ ইসলাম তাদের মনের মত কোনো শ্রেণীবিভাগে পড়ে না। ওজুকে একটি উদাহরণ হিসাবে নিন। একজন মিস্টিক (অতীন্দ্রিয়বাদী) এটিকে প্রতীকী অর্থ সহ একটি ধর্মীয় ওজু হিসাবে সংজ্ঞায়িত করবে। একজন যুক্তিবাদী এটিকে একটি শুধুমাত্র স্বাস্থ্যবিধি বিষয় হিসাবে দেখবেন। তারা উভয়ই সঠিক, তবে আংশিকভাবে। অতীন্দ্রিয় ব্যাখ্যার মধ্যে রয়েছে ত্রুটি- তারা ওজুর স্বাস্থ্যকর দিকটিকে নিছক একটা ফর্ম হিসাবে দেখে। একই যুক্তি অনুসরণ করে বলা যায় এই পদ্ধতি ইসলামকে শারীরিক, বৌদ্ধিক, এবং সামাজিক উপাদান বাদ দিয়ে একটা খাঁটি ধর্মে পরিণত করবে। যুক্তিবাদীরা এর সম্পূর্ণ বিপরীত পথ অবলম্বন করেন। ধর্মীয় দিক অবহেলা করে তারা ইসলামকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত করে, যার থেকে একটি নতুন ধরনের জাতীয়তাবাদ তৈরি হয়- একটি তথাকথিত ইসলামী জাতীয়তাবাদ যেখানে নৈতিক-ধর্মীয় উপাদান নাই। ফলে এটি পরিণত হয় অন্য সব জাতীয়তাবাদের মত। এই ক্ষেত্রে মুসলিম হতে হলে কোনো নৈতিক বা ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নাই, বা সর্বজনীন সত্যের প্রতি কোন মনোভাব পোষণ করার দরকার নাই। এর অর্থ শুধুমাত্র একটি দলের সাথে জড়িত থাকা যেটি অন্য দল থেকে আলাদা। বরং ইসলাম হচ্ছে- একটি জাতিকে ভালো কাজে নির্দেশ করা এবং অন্যায় কাজে নিষেধ করার জন্য আহবান করা। অর্থাৎ একটি নৈতিক মিশন হাতে নেয়া। যদি আমরা ইসলামের রাজনৈতিক উপাদানকে উপেক্ষা করি এবং মিস্টিসিজম (রহস্যবাদ) গ্রহণ করি, তাহলে আমরা আসলে নীরবে পরাধীনতা এবং দাসত্বই গ্রহণ করবো। বিপরীতে আমরা যদি শুধু ধর্মীয় উপাদানকে উপেক্ষা করি তাহলে আমাদের নৈতিকতা চর্চা আঘাতপ্রাপ্ত হবে।

 

মানুষের ভবিষ্যৎ এবং তার বাস্তব কর্মকাণ্ডের জন্য ইসলামের অর্থ হচ্ছে আত্মা এবং শরীরের ঐক্য নিয়ে মানুষ তৈরি করা এবং লক্ষ্য রাখা যাতে সমাজের আইন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি এই ঐক্যকে বিনষ্ট না করে। ইসলাম হচ্ছে ইতিহাসের ভেতর দিয়ে এই অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক ভারসাম্যের অনুসন্ধান। আজ এইটাই ইসলামের লক্ষ্য এবং ঐতিহাসিক ভবিষ্যৎ কর্তব্য। এই বইয়ে আলোচিত সমস্যাগুলো বর্তমান ঐতিহাসিক পরিস্থিতির সাথে মিলে যায়। বিশেষত আজ যেভাবে মতাদর্শের ভিত্তিতে বিশ্ব দুটি বিরোধী শিবিরে বিভক্ত। আজ আমরা রাজনৈতিকভাবে, আদর্শগতভাবে এবং আবেগগতভাবে দুটি বিভক্ত বিশ্বের মুখোমুখি। মানুষের জগতের দ্বৈততা সম্পর্কে একটি বিশাল ঐতিহাসিক পরীক্ষা আমাদের চোখের সামনে হাজির। বিশ্বের একটি অংশ এই মেরুকরণ দ্বারা এখনও প্রভাবিত হয় নাই, যার সিংহভাগ মুসলিম দেশ নিয়ে গঠিত। এই ঘটনা আকস্মিক নয়। ইসলাম আদর্শগতভাবে স্বাধীন- জোট নিরপেক্ষ।

 

ইসলাম তার সংজ্ঞা অনুসারে এমনই। মুসলিম দেশগুলোর এই আদর্শিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রক্রিয়া ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। এই সম্পর্কহীনতা শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি বিদেশী মডেল এবং প্রভাব- পশ্চিম এবং পূর্ব উভয় থেকে নিজেদের পরিত্রাণের জন্য সময়ের চূড়ান্ত দাবি। বর্তমান বিশ্বে ইসলামের এটাই স্বাভাবিক অবস্থান। ইসলাম যা পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যে একটি কেন্দ্রীয় অবস্থাবে আছে, তাকে নিজের মিশন সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এখন যখন এটি আরো স্পষ্ট যে বিরোধী ইডিয়োলজি তাদের চরম রূপ মানবজাতির উপর আরোপ করতে পারবে না এবং তাদেরকে এই সংশ্লেষণ এবং একটি নতুন মধ্যম অবস্থানের দিকে যেতে হবে, তখন আমরা প্রমাণ করতে চাই যে ইসলাম মানুষের স্বাভাবিক চিন্তাধারার সাথে মিলে যায় এবং এটিই সবচেয়ে জীবনের সাথে বেশি সঙ্গতিপূর্ণ। যেহেতু অতীতে ইসলাম ছিল প্রাচীন সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্যের মধ্যস্থতাকারি, আজ এইটা আবার চালু করতে হবে। এই নাটকীয় উভয়সংকট এবং বিকল্পের কালে, ইসলাম এই বিভক্ত বিশ্বের মাঝখানে একটা মধ্যস্থতাকারি জাতি হিসাবে কাজ করবে। এইটাই তৃতীয় পথের সংজ্ঞা, এইটাই ইসলামি পথ। চলবে