ফরহাদ মজহারের কুরবানি বিষয়ক প্রস্তাবনা ও কিছু কথা

পর্ব ১

তুহিন খান

প্রকাশিত : জুলাই ২৬, ২০২১

সম্প্রতি শ্রদ্ধেয় ফরহাদ মজহার কুরবানি নিয়া একটি সিরিজ লেখা শুরু করছেন। কুরবানি নিয়া ফরহাদ মজহার যে লেখাগুলা লিখছেন, এগুলা ধারাবাহিক লেখা। এখন পর্যন্ত দুইটা কিস্তি উনি লিখছেন; সেই দুই কিস্তিতে যা যা আসে নাই, তা সামনের কিস্তিগুলায় আনবেন— বলছেন সেকেন্ড কিস্তির শেষে। তাই কুরবানি নিয়া ফরহাদ মজহার যা যা বলতে চান, তা এখনো সম্পন্ন ও সম্পূর্ণ না। ফলে, মন্তব্য করা মুশকিল।

তবু, ওনার লেখা নিয়া নানা ধরনের বিতর্ক তৈয়ার হইছে। এই ধরনের বিতর্করে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখি। যদিও, বিতর্কের পাশাপাশি নানা ধরনের কুতর্ক ও ব্যক্তি আক্রমণও তার বিরুদ্ধে হইছে; সেগুলার ব্যাপারে নিন্দা জানানো ছাড়া আপাতত আর কিছু বলা সমীচীন মনে করি না।  আমার লেখার শিরোনামেই পষ্ট হয়ে আছে যে, আমি কী লিখতে চাই। অবশ্যই, এই লেখার কেন্দ্রে থাকবে ফরহাদ মজহারের লেখাগুলা। পাশাপাশি, মুফাসসিরিনের টেক্সট বিশ্লেষণ করে, এই তর্কের বিভিন্ন অনুসিদ্ধান্তের দিকে আমি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইব।

তর্কে ঢোকার আগে প্রথমেই আমাদের বুইঝা নেওয়া জরুরি যে, ফরহাদ মজহার কী বলছেন, আর কী বলেন নাই। প্রথমে বলা যাক, উনি কী বলছেন। আমি ওনার লেখার দুটো কিস্তিই পড়ছি। প্রথম কিস্তির প্রস্তাবনাগুলা নিম্নরূপ:
এক. পশু কোরবানি, এটি দুনিয়ার বিভিন্ন ধর্মেরই অন্তর্গত প্রাক্টিস।
দুই. `মনের পশু` ফেনোমেনাটি ক্রিশ্চিয়ান থিওলজিজাত; এটিরে আধুনিককালে সেক্যুলারিজমের মোড়কে উপস্থাপন করা হয়।
তিন. ইসলামে কোরবানির ধারণাটি বোঝার জন্য আমাদের বোঝা জরুরি যে, ইসলামে কোরবানির সূচনা-গল্পটির লগে, বাইবেলের গল্পটির অমিলগুলি কী কী।

এরপরে তিনি কোরবানি ও ভোগবাদিতা সংক্রান্ত আলাপ করছেন, তবে মোটাদাগে এই তিনটাই তার প্রধান টেক, ওই লেখায়। মজার ব্যাপার, এই লেখায় ফরহাদ মজহার লিখেছেন, এবার আসা যাক আখেরি নবি কেন হজরত ঈসার (আ.) নজির থাকা সত্ত্বেও খ্রিস্টিয় চিন্তার বিপরীতে আবার কোরবানির প্রচলন করলেন। এর প্রধান কারণ হজরত ইব্রাহিম। একত্ববাদের প্রধান পুরুষ হিসাবে হজরত ইব্রাহিমের মহিমা আবার কায়েম করাই ছিল আল্লার রসুলের প্রধান লক্ষ্য। আল্লার সন্তুষ্টি বিধান যদি রুহানিয়াতের পথ হয়ে থাকে তাহলে হজরত ইব্রাহিম স্বপ্নে সেই ইঙ্গিত পেয়ে তাঁর সন্তানকে কোরবানি করতে চেয়েছিলেন। কোরবানির এই নজির যেন আমরা ভুলে না যাই।//

একটু এগোয়ে, আল্লার আদেশ পালন করতে গিয়ে হজরত ইব্রাহিম নিজের পুত্র সন্তানকে কোরবানি করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ঘটনার স্মরণে কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব। এই দিন হজরত ইব্রাহিম আলাইহে ওসাল্লামকে স্মরণ করবার দিন। একই ভাবে এই দিন মিল্লাতে ইব্রাহিমের প্রতি অঙ্গীকারেররও দিন।

দেখা যাইতেছে যে, ইব্রাহিম খলিলুল্লাহর স্বপ্নটি যে কোনো সাধারণ স্বপ্ন ছিল না, সেটি একটি `ইঙ্গিত` বা `আল্লার আদেশ` ছিল, এ ব্যাপারটি ফরহাদ মজহার তার পয়লা কিস্তিতে উল্লেখ করছেন। লেখার দ্বিতীয় কিস্তিতে ফরহাদ মজহার তুলনামূলক জটিল একটা আলাপে ঢুকতে চাইছেন। পশ্চিমা দর্শনে কোরবানির এই ঘটনাটি একটা ফিলোসফিক্যাল ডিবেটের প্রধান কাঁচামাল হিশাবে হাজির আছে। কিয়ের্কেগার্ড, জাঁক দেরিদা, লেভিনাস, জিজেকসহ আরো অনেকেই এই ঘটনাটিরে কিছু ফিলোসফিক্যাল ডিবেটের কাঁচামাল হিশেবে নিছেন। স্বাভাবিকভাবেই, উনাদের সামনে ছিল বাইবেলের গল্প। এবং সেই গল্পের ভিত্তিতেই, উনারা নিজেদের দার্শনিক মতামত দিতেছেন, যা আবার বিশ্বদর্শনের অংশ হয়ে উঠতেছে। ফলে, ইসলাম গল্পটা কীভাবে বলে, এবং সেই বলার ভিতর দিয়া আমরা নতুন কিছু পাই কিনা, পাইতে পারি কিনা— সেই প্রশ্নও কালে কালে উঠছে।

বিখ্যাত তাত্ত্বিক আসমা বারলাস ও সৈয়দ হোসাইন নসরও এই তর্কে যুক্ত হইছেন, এবং মুসলিম ঐতিহ্যে গল্পটার যে ইউনিক ফারাক, সেগুলা চিহ্নিত করে দর্শনের নতুন ক্ষেত্র উন্মোচনের ট্রাই করছেন। আসমা বারলাসের বরাতে, পারভেজ আলম তার `মদিনা` বইতে এই ডিবেটগুলা আনছেন। মজহারের প্রস্তাবনা ছিল, সেকেন্ড কিস্তিতে, এই দার্শনিক ডিবেটে আমরা কীভাবে যুক্ত হইতে পারি। এবং, এর তরিকা হিশাবে উনার পয়লা প্রস্তাবনা ছিল এই যে, কোরআনে বর্ণিত কোরবানির ঘটনার সাথে বাইবেলের ঘটনার কিছু ফারাক আছে। এই ফারাকগুলা বোঝা জরুরি।

এ পর্যন্ত মজহার সাহেবের সিদ্ধান্তগুলার সাথে কারুরই তেমন দ্বিমত থাকার কথা না। দ্বিমত হইছে মূলত, যখন মজহার বাইবেল থেকে কোরআনের কাহিনী আলাদা করতে গিয়ে বলছেন, আল্লাহ হযরত ইব্রাহিমকে কোরবানির আদেশ দেন নাই; এইরকম `বিয়ন্ড ইথিকাল` আদেশ আল্লাহ দিতে পারেন না। এটা ইব্রাহিমের স্বপ্ন, কোরআন তাই বলে। আচ্ছা। তাইলে, ফরহাদ মজহার কী বলছেন জানলাম। উনি কী কী বলেন নাই?

১. কোরবানি আল্লাহর বিধান না। এটা নৃশংসতা। বরং, প্রথম কিস্তিতে এর উল্টাটাই বলছেন উনি।
২. কোরবানি করা ক্রিশ্চিয়ান কালচার। এরও উল্টাটাই উনি বলছেন প্রথম লেখায়।
৩. কোরবানি হযরত ইব্রাহিমের সুন্নত না। এটাও উনি বলেন নাই; বরং এর উল্টাটাই বলছেন প্রথম লেখায়।

এটা ক্লিয়ার কইরা নিলাম, কারণ অনেকেই না বুঝে, আবার অনেকে প্রোপাগান্ডামূলকভাবে এই ধরনের দাবি করতেছেন, দেখলাম। তো, উনার কোন কথাটা নিয়া তাইলে তর্ক? উনি কোরবানির বিধান, এটা ইব্রাহিমি সুন্নত হওয়া, কোনটাই অস্বীকার করেন নাই। উনি বলছেন, কোরআনে বর্ণিত ইব্রাহিমের স্বপ্ন আর বাইবেলে বর্ণিত আল্লাহর আদেশ— দুইটা এক জিনিশ না। আমার ধারণা, উনি এটাই বলতে চাইছেন।

এ বাবদে আমার বক্তব্য এই যে, কোরআনে বর্ণিত গল্পটির সাথে বাইবেলের গল্পের খুব সিগনিফিকেন্ট কিছু ফারাক আছে; এসব ফারাক নিয়া ডিবেট ও মন্তব্য, এমনকি ইসলামি অ্যাকাডেমিয়ার সর্বজনস্বীকৃত মুফাসসিরিনও করছেন। সেই ফারাকগুলা অবশ্যই আমাদের জানা ও বোঝা দরকার। তাফসিরের কিতাবগুলাতে অনেক ইসরাইলি রেওয়ায়েত আছে এবং মুফাসসিরিন এ ব্যাপারে মূলনীতিও নির্ধারণ করছেন— এটা তো মিথ্যা না। ড. মুহাম্মদ আবু শাহবাহ তার `আল ইসরাইলিয়্যাত ওয়াল মাওদুয়াত ফি কুতুবিত তাফসির` বইয়ে এ নিয়া বিস্তারিত আলাপ করছেন। তাইলে, বাইবেলের গল্পের সাথে কোরআনের গল্পের যদি কোন সিগনিফিক্যান্ট ফারাক থাকে, সেইটা অ্যাকাউন্টে নেওয়াই উচিত, উসুল অনুযায়ী।

আলাপ হইল, ফরহাদ মজহার যে বলছেন, আল্লাহ ইব্রাহিমরে আদেশ দেন নাই কোরবানির, উনি স্বপ্নে দেখছেন— এর অর্থ কী? এর দুই অর্থ হইতে পারে। এক. হযরত ইব্রাহিমের স্বপ্নটির সাথে আল্লাহর ইচ্ছা বা আদেশের কোন যোগ নাই; এটা নিছকই একটা স্বপ্ন। দুই. অবশ্যই ইব্রাহিমের স্বপ্নটির সাথে আল্লাহর ইচ্ছার যোগ আছে, কিন্তু বাইবেলের ঘটনায় আল্লাহর আদেশ দেওয়ার ধরন ও পদ্ধতির সাথে কোরআনে বর্ণিত ঘটনায় আল্লাহর আদেশ দেওয়ার ধরন ও পদ্ধতির ফারাক আছে।

ফরহাদ মজহার যদি প্রথম অর্থে কথাটা বলেন, তাইলে এর সাথে আমাদের দ্বিমত আছে। যদি উনি দ্বিতীয় অর্থে কথাটা বলেন, তাইলে আমরা মুফাসসিরিরনের ব্যাখ্যার আলোকে দেখতে পারি, ব্যাপারটার স্বরুপ কী (যেহেতু প্রথম লেখায় উনি স্বপ্নটিকে `আল্লার ইঙ্গিত` বা `আল্লার আদেশ` বলছেন, ধইরা নেওয়া যায়, উনি দ্বিতীয় অর্থেই কথাটা ব্যবহার করছেন)। অর্থাৎ, ইব্রাহিমের স্বপ্নের সাথে আল্লাহর আদেশ বা অভিপ্রায়ের যোগ আছে, কোরআনের বাকরীতিও তাই বলে— এটাই আমাদের মন্তব্য। কিন্তু, সেই আদেশ বা অভিপ্রায়ের পদ্ধতিটা বাইবেলের চাইতে আলাদা কিনা, সেই আলাদা হওয়ার ভিতর দিয়া সিগনিফিক্যান্ট কোন ফিলোসফিক্যাল জাজমেন্ট আমরা দিতে পারি কিনা, সেটা অবশ্যই খুবই জরুরি ও গুরুতর প্রশ্ন, এবং এই প্রশ্ন নিয়া আলাপ হওয়াই উচিত।