ফারাক্কার বাঁধের মতো গোঙানি তার লেখনি

আবদুস সালাম আজাদী

প্রকাশিত : আগস্ট ১৫, ২০২১

এবনে গোলাম সামাদ একটা পূর্ণাঙ্গ নাম নয়, নামের আংশ। মানে গোলাম সামাদের ছেলে। তার যত আর্টিকেল ও বই পড়েছি, তার জীবন সম্পর্কে পড়েছি, তা থেকে তার পূর্ণ নাম উদ্ধার করতে পারিনি। রকমারি ডট কম লিখেছে, তার আব্বা মোহাম্মাদ ইয়াসিন ও মাতা নছিরন নেছা। তিনি ১৯২৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে শিক্ষা সংঘ বিষ্ণপুর থেকে সেকেন্ডারি সমমান পাস করেন। ১৯৪৯ সালে পাস করেন রাজশাহী কলেজ থেকে এইচএসসি। এরপর তেজগাঁও কৃষি ইন্সটিটিউট থেকে স্নাতক করে ইউকে যান। সেখান থেকে ফ্রান্সে ডিগ্রি শেষ করে বাংলাদেশে ফিরে আসেন, এবং ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

লেখালেখি, গবেষণা, বুদ্ধিবৃত্তির সংযোজনে বক্তৃতা ও আলোচনায় তিনি বাংলাদেশের কৃতী সন্তান। আজ রোববার সকাল দশটায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন, এই দুয়া করি। তার লেখা আমি ইনকিলাবে নিয়মিত পড়তাম। পরে সংগ্রামে ও আমার দেশেও পড়েছি। তিনি ছিলেন শেকড় সন্ধানি লেখক। সমাজ-সংসার, পরিবেশ-প্রতিবেশ, স্বদেশ-স্বার্থ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, আত্মজৈবনিক লেখনি-ধারা, আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা সঞ্জাত দর্শন-চিন্তা-কর্ম ছিল তার লেখার উপজীব্য। তিনি বাংলাদেশের পট পরিক্রমার বিদগ্ধ অংশীদার। স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের কাছে ছিল তার পরিচিতি, শিক্ষা-সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে তার ছিল অবাধ যাতায়াত।

এসব সুযোগগুলো তিনি কলমের কালিতে যথেষ্ট মিশাতে পেরেছিলেন বলেই তার অনেক তথ্য আমরা ইতিহাসের কাঁচামাল হিসেবে গণ্য করি। এবং গণ্য করি বলেই তার এমন কিছু কথা যা সাধারণ ন্যারিটিভের উলটো দিকের, অথচ মানতে মনে সন্দেহ হয় না। পাকিস্তান আন্দোলন ধর্মীয় আন্দোলন ছিল না, দেওবন্দ পন্থীদের পাকিস্তান অনীহা, ১৯৬৫ এর ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের ভারতের বিপর্যয়, ১৯৭১ সালে জামাআতে ইসলামির স্বাধীনতা বিরোধিতার বৈধতা— এইসব তথ্য তার মুখে মানিয়েছে, এবং তার সেই তথ্য প্রবাহে হই হাঙ্গামা তত না হওয়ার পেছনে এইটাই মুখ্য কারণ বলে আমার মনে হয়েছে। তিনি সাহসী লেখক ছিলেন। মেরুদণ্ড তার যেমন সোজা ছিল, তার উপর ভর করে মুখটাও সচল রাখতেন তিনি। আর চোখদুটোকে বাজের মতো তীক্ষ্ণ রাখতেন। তিনি কথা যখন বলতেন রাজশাহীর প্রমত্ত পদ্মার ঢেউ সেখানে আছড়ে পড়তো, স্রোতের গতি সেথা শক্তিময়তার সাথে প্রবাহ পেত, এবং ফারাক্কার বাঁধের মতো গোঙানি তার লেখনির প্রতিটি শব্দ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কথা, জেনারেল এরশাদের ব্যাপারে তার মনোভঙ্গিতে আমি এসব গুণগুলো পেয়েছি। তিনি পাকিস্তান আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও সমসাময়িক ধারা বর্ণনার ক্ষেত্রে ফটোগ্রাফার ছিলেন না, ছিলেন ফটো জার্নালিস্ট। তার শিল্পিত রূপগুলোতে তিনি নিজস্ব রঙের প্রলেপ এমনভাবে দিয়েছেন যা সমস্ত লেখক, গল্পকার, গায়ক ও কবিদের থেকে তার লেখাগুলোকে একদম আলাদা করে দাঁড় করিয়েছে। তিনি একাধারে হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, ফরাসি, আরবি ও ফার্সি ভাষা জানতেন। এতে তার ভাষা কিছুটা শৃংখলিত হলেও নানান ভাষার আবছা রঙে ও ভিন্ন সুগন্ধির মিশ্রণে তার লেখা সুখপাঠ্য হয়ে উঠতো। নানান সংস্কৃতি ও তথ্য তার লেখায় যেমন রুচি বাড়াতো, তেমন বিশ্ব ইতিহাসের তারকাময় ইশারা তার লেখার গগনে জ্বলজ্বল করতো। ফলে তা পদ্যরীতির মানুষের কাছে যেমন শ্রদ্ধার ছিল, গদ্যরীতির সাধারণ্যে তা ব্যাপক পঠিত হতো।

তিনি বুদ্ধিজীবী সমাচারে আস্তিক ন্যারিটিভের স্রোতে থাকা মানুষ। যে মারাত্মক ঢেউ বাংলাদেশকে হিন্দুত্বের মন্দিরে বলি দিতে কালফণির মতো মাথা উঁচু করে থাকতো, তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি তার লেখা ও গবেষণায় সেই বাংলাদেশকে সবুজ মসজিদে সেজদারত বানাতে তৎপর থাকতেন। তার পূর্বসূরী কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে সতীর্থ মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের সাথেই ছিল তার আত্মার সম্পর্ক। অনুজ ইসলামিস্টদের জন্য তার বুক যেমন প্রশস্ত ছিল, দিল ছিল তার চেয়ে অনেক উদার। ফলে তার পা যেমন ইসলাম পন্থীদের অলিন্দে সাঁটানো ছিল, হাত দুটোও ছিল ইসলামপন্থীদের লেখার কাগজে সদা ব্যস্ত। তার জ্ঞানের সীমাটা তিনি এত বিস্তৃত করতে সক্ষম হন যে, তার উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ঝর্ণাধারায় মিশে কল্ললিত হয়েছে ইতিহাস পাঠ, চিকমিক করেছে দর্শনের ফেনায়িত রং, তরঙ্গ তুলেছে সমাজবিজ্ঞান ও নৃতত্ত্বের ঘাত-প্রতিঘাত, স্রোতধারা তৈরি করেছে ধর্মের বয়ান প্রতিবয়ান। রাজনীতিতে তিনি যেমন খবর রাখতেন, অর্থনীতির বাজারেও তিনি নানা অলিগলি ঘুরতেন, সাহিত্যের সরোবরে ফোটা উৎপলের রূপ মাধূর্যেও তিনি স্নাত হতেন।

সুবিধা ছিল তিনি গবেষক ছিলেন, ফলে এমন কোনো বিষয় ছিল না যেখানে তার নখ বসতো না। বলছি না তিনি খামছে আনতেন নতুন নতুন তথ্য, বরং তার যোগ্যতা ছিল জ্ঞানের অষ্টাদশী শশীবালাদেরকে তার গানের সুরে ঘুঙ্গুরি পায়ে নাচ দেখাতে বাধ্য করতে পারতেন তিনি। সেজন্য এত প্রবীণ হয়েও তার লেখায় নবিনতার ছাপ ভোরের আলোময় পূবাকাশের মতো ফোটাতে পারতেন। তার কপালে সেজদার দাগ ছিল, পরনে তাক্বওয়ার পোষাক ছিল, মনে তাওহিদের অবিমিশ্রিত নিষ্ঠা ছিল, হাত ছিল পরোপকারে প্রলম্বিত। তিনি আঘাত খেতেন কিন্তু দিতেন না, সমালোচনা করতেন তবে ইসলামি আদব ও পশ্চিমের অব্জেটিভিটির সমন্বয় করতেন। তিনি অশ্লীল ছিলেন না, ভাষাকে রাস্তার বালকদের মুখের লালা থেকে পবিত্র রাখতেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, তার কাছে গেলে হয় তিনি বন্ধু হতেন, নতুবা শিক্ষক অথবা ছাত্র। ফলে যারা একবার তার কাছে গেছে তাকে মনে গেঁথে ফেলেছে। আমি জানি তার ইন্তকালে আমার মতো সবারই চোখে প্রচুর ঢল নামবে। মনে তৈরি হবে প্রিয়জন হারানো ক্রন্দন।