এডওয়ার্ড সাঈদ

এডওয়ার্ড সাঈদ

বাংলাদেশ প্রেক্ষিত ও সাঈদের ইন্টেলেকচুয়াল

সাদ্দাম হোসেন

প্রকাশিত : আগস্ট ০৭, ২০২০

১৯৪৮ সালে বার্ট্রান্ড রাসেলের বক্তব্য দিয়ে রিথ বক্তৃতা শুরু হয়। ঠিক সেখানে বিংশ শতাব্দীর গণবুদ্ধিজীবী mass intellectual এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ আমন্ত্রণ পান ১৯৯৩ সালে। তিনি বুদ্ধিজীবী বা বুদ্ধিজীবীতা নিয়ে দীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক বক্তব্য রাখেন। পরবর্তীতে তা হলো `রিপ্রেজেন্টেনস অব দ্য ইন্টেলেকচুয়াল` নামের বিশ্বখ্যাত কিতাব। ফিলিস্তিনি আন্দোলনের Intifada এই আজীবন সমর্থক সেখানে নানান কিসিমের বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে কথা বলেন। বিগত পৃথিবীর দার্শনিক ব্যক্তিবর্গের (এন্তোনিও গ্রামসী, মিশেল ফুকো, জুলিয়ান বেন্দা বা লুইস নেমিয়ার, নোয়াম চমস্কি বা রাশেল) আলোচনা এনেছেন, নিজের মন্তব্য যোগ করেছেন, অতঃপর ভিন্ন ভিন্ন উপন্যাসের উদাহরণ টেনে বুদ্ধিজীবীর এমনসব সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছেন যার সারমর্ম বলা যায় এককথায়— সে বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবীর খোলস উন্মোচন করেছেন বা দেহের পোশাক টেনে-হিঁচড়ে নগ্ন করে দিয়েছেন। যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী মনে করে তারা আদৌ বুদ্ধিজীবী নয়, বরং যারা— ১.সত্য বলে, ২. মিথ্যার সাথে আপস করে না, ৩. শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদ বা আদিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, ৪. রাজনৈতিক বন্দনা এড়িয়ে চলে, ৫. সে স্থির নয়, চলমান; বোধহয় তিনি বুদ্ধিজীবী।

বুদ্ধিজীবী এবং বিপ্লব বা প্রতিবিপ্লবকে সমার্থক চিন্তা করে যুতসই মন্তব্য করেছেন তিনি। তিনি বলেন, "আধুনিক ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী ছাড়া কোনো বড় ধরণের বিপ্লব সংঘটিত হয়নি। উপরুন্তু বুদ্ধিজীবী ছাড়া কোনো বিপ্লববিরোধী আন্দোলনও সংঘটিত হয়নি। বুদ্ধিজীবীরা হচ্ছেন বিপ্লবের পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে, এমনকি ভাতিজি-ভাতিজা। তারা এককথায় বিপ্লবের প্রাণ।" যেমনটা ইংরেজ ইতিহাসবিদ লুইস নেমিয়ার ১৮৪৮ থেকে ১৮৫১ এর মধ্যে পারস্যদেশীয় উত্থানের সময়কালকে বুদ্ধিজীবীদের বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বাস্তব প্রেক্ষিত হচ্ছে প্রত্যেকজন বুদ্ধিজীবী এক একটি বিপ্লবের সমার্থক, যিনি বিপ্লবী নয় বা বিরাজমান শোষণ-অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ তথা প্রতিবিপ্লব গড়তে পারঙ্গম নয় তিনি বুদ্ধিজীবী নয়, বরং উঁচু মূল্যের প্রশাসনিক বা সাম্রাজ্যবাদের দালাল। এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ বলেন, "বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি জনগণের প্রতি ও জনগণের জন্য সোচ্চার এবং মতামত, মনোভাব, দর্শন উপস্থাপন ও গ্রন্থিবদ্ধ করতে বদ্ধপরিকর। আর সেই ব্যক্তি ছাড়া এই ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়, যে ব্যক্তি লজ্জাজনক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে সক্ষম, যিনি সরকারি কিংবা কর্পোরেশনের সুবিধা পান না, যার raison detre অন্য সব লোকের সামনে তুলে ধরতে হয় এবং ইস্যুগুলো রুটিনমাফিক ভুলে যেতে হয়। বুদ্ধিজীবীরা সর্বজনীন নীতির উপর ভিত্তি করে এই কাজটি করেন। এই সব মানুষই বিশ্বশক্তি ও জাতির কাছ থেকে স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার সম্পর্কে সম্মানজনক ব্যবস্থার আশা করেন। এই মানদণ্ডগুলোর কোনরকম ব্যতিক্রম হলে তা পরীক্ষা করবার প্রয়োজন হয় এবং সাহসের সাথে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়।"

বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের কাছে আসা যাক। এদের নিয়ে ছফা-বয়ান জরুরত, তিনি বলেন, ``যে-কোন দেশের বুদ্ধিজীবীরা যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অসম্মত হন সেই দেশটির দুর্দশার অন্ত থাকে না। বাংলাদেশ সেইরকম একটি দুর্দশাগ্রস্ত দেশ। এই দুর্দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন উদ্যোগ, কোন প্রয়াস কোথায়ও পরিদৃশ্যমান নয়।`` এরপরেই তিনি কঠোর সমালোচনাপূর্বক বলেন, "তাঁরা যখন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কথা বলেন শুনে মনে হবে, আবাহনী মোহামেডান টিমের ভাড়া করা বিদেশি খেলোয়াড়দের মত তাঁদেরও ভাড়া করে আনা হয়েছে। তাঁরা যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলেন শুনে মনে হবে, টেক্সট বই থেকে কথাগুলো মুখস্থ করে হাজেরান মজলিশের শ্রোতাদের সামনে বমি করে দিচ্ছেন। তাঁরা যখন মৌলবাদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার তোলেন, সেটাকে গোদা পায়ের লাথির সঙ্গে তুলনা করা যায়।" হুম, এগুলো বেশ আগের কথা (যদিও এখনো প্রাসঙ্গিক, তখনও প্রাসঙ্গিক এবং সঠিক ছিল), যখন ছফা তৎসময়কার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের বস্ত্র আলগা করেছিলেন। বস্ত্র আলগা করা যায় না এমন কেউ কি এখন আছে যিনি বুদ্ধিজীবী? এখন বাংলাদেশে যারা বুদ্ধিজীবী আছে বা নিজেদের বুদ্ধিজীবী দাবি করে তারা বিচারের সূচক বা নির্ধারকগুলোতে কতটুকু সিদ্ধ? তার পূর্বে আরেকটি প্রশ্ন সংযোজন করে প্রশ্নটি এভাবে করা দরকার, বর্তমান বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হওয়ার শর্ত কী হতে পারে? সমূহ শর্তে টিকে আছে কেউ? এই দুটি প্রশ্নের উত্তর অনেকের কাছে অগ্রহণযোগ্য বা পালটা উত্তর থাকতে পারে। অনেকটা `ইজতিহাদ` Islamic intellectuality এর মতো।

এটা চিরন্তন সত্য যে, এই দেশ একাত্তরের পূর্বে যেমন কোনোদিন স্বাধীন ছিল না বা মুক্তির স্বাদ পায়নি তদ্রুপ একাত্তরের পরেও, বরং একাত্তরের পরে উঁচু মূল্যের ভারতীয় সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসনে পতিত হয়েছে, পার্থক্য হচ্ছে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ। সুতরাং এদেশে বুদ্ধিজীবী হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে ভারতীয় আদিপত্যবাদ এবং তার এদেশীয় দুসরদের বিরোধীতা করা বা তাদের অপকৌশল, অপসংস্কৃতি, অপকর্মের বিরুদ্ধে বুকের কপাট খোলে কলম চালানো, অথবা সমূহ পদ্ধতি হাতে নেয়া হয়তো চিন্তার রাজ্যে নয়তো রাজপথের শানিত দ্রোহে।

দ্বিতীয়ত, শাসকদের হেজিমনিক লিডার হওয়ার যে চিন্তা তার বিরুদ্ধে চিন্তাযুদ্ধ Think-war এবং বিপ্লব Revolution জারি রাখা বুদ্ধিজীবীর দায়িত্বের মধ্যে বর্তায়। এইদেশে পঁচাত্তর পরবর্তী দীর্ঘদিন সামরিক শাসন জগদ্দল পাথরের মতো জেঁকে বসেছিল, এরপর মঈন-ফখরুদ্দিনের দুঃশাসন সম্পর্কে প্রায় সকলের জানা। আবার এও আমরা দেখি যে, দীর্ঘ আন্দোলনের পথপরিক্রমায় অর্জিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থাকে সমূলে উৎখাতের জন্য বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনার ঐকান্তিক সাধনা এবং রিস্কি আয়োজন। যেখানে টিকে গেছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং তার সরকার। এতসব বলাটা স্টেটের চোখে অন্যায়, চিত্রকর শহিদুল ইসলামের মতো শ্যেনদৃষ্টির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে হেজিমনিক শক্তির (যা সময়ের পালাবদলে এদেশের ওপর বারঃবার শওয়ার হয়েছে) অপকর্ম এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে যিনি বিদ্রোহ করেন তিনি বুদ্ধিজীবী, সে হতে পারে জয়ী বা পরাজিত।

তৃতীয়ত, ২০১৩ সালের পর এইদেশের জন্য পূর্বাপর তিনটি ঘটনা মৌলিক হিসেবে এবং পাশাপাশি বর্ণনাযোগ্য। যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও জামায়াতে ইসলামি, গণজাগরণ মঞ্চ ও হেফাজতে ইসলাম। মূলত বাংলাদেশের কোনো প্রাজ্ঞজন কোন নৈতিক অবস্থানে বসবাস করেন তা নির্ভর করে এই তিনটি ঘটনার এপিট-ওপিটের ওপর। `কোন পিঠ পছন্দ?`— তার ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তির বিশ্বাস এবং গণমানুষের জন্য তার সিদ্ধান্ত জানা সহজ হয়ে যায়।

যুদ্ধাপরাধীর বিচার এবং জামায়াতে ইসলামি
ইতিহাস রচনা করে বিজয়ীরা। পরাজিতরা সবসময় ভিকটিম। একাত্তরের ইতিহাসে তেমন হেরফের নেই বলা যায় না। তবে `জামায়াতে ইসলামি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে বা নিষ্প্রভ ভূমিকা রেখেছে` এটা যেমন সত্য তেমনি তারা পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে শক্তি ব্যবহার করেছে বা ইন্টেলেকচুয়াল কথা বলেছে তাও সত্য। সাইয়েদ মওদূদী স্পষ্টত বলেছেন, "পাকিস্তান আমার দেহ ও প্রাণের তুল্য। আমার দুটি হাতের মধ্যে যেমন আমি পার্থক্য করতে পারি না, তদ্রুপ পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না। আমার দুই হাতের মধ্যে যেটি অসুস্থ হোক, তা পুরো শরীরের একটা রোগ। এর কারণ অনুসন্ধান করা ও সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা আমার কর্তব্য। আর তা না করার অর্থ হচ্ছে নিজের সাথে শত্রুতা করা।"

এই যে পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমান বাংলাদেশ) সাইয়েদ মওদূদী তাঁর অঙ্গের মতোই মনে করতেন, তিনি সেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান দাবি বা মাতৃভাষার প্রশ্নে বলেন, "এখানকার সাধারণ লোক উর্দূভাষীদেরকে অত্যন্ত সম্মান করত। অদ্যাবদি আরবী ভাষার পরে উর্দূ ভাষার এক প্রকার ধর্মীয় মর্যাদাও রয়েছে। কিন্তু একেই একমাত্র জাতীয় ও রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করলে এখানকার লোকদের পক্ষে তা বিশেষ অসুবিধার কারণ হয়ে পড়ত। কেননা এখানকার শিক্ষিত লোকেরা উর্দূ ভাষা জানেন না। ফলে তারা প্রতিক্ষেত্রেই উর্দূভাষী শিক্ষিতদের পশ্চাতে পড়ে থাকবার আশঙ্কা করেছিলেন। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাভাষাীগণ উর্দূর সাথে বাংলাকেও সরকারি ভাষা করার দাবি জানিয়েছিলেন। পরিস্থিতির তীব্রতা সম্যক উপলব্ধি করে প্রথম দিনেই এ দাবি মেনে নিলে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়া হতো। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে এর সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ করা হয়েছে। একদিকে একে দমননীতির সাহায্যে নিষ্পেষিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, আর অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বার বার এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা হয়েছে। এ কারণে বাংলার দাবি একটি সমাধানযোগ্য সমস্যা না থেকে একটি মতাদর্শ ও ভাবপ্রবণতার-রূপ গ্রহণ করেছে এবং এ তারই স্বাভাবিক পরিণতি। কেননা একটি দাবির উত্তর যদি `দেয়া হবে না` বলা হয়, তবে তার প্রতি উত্তরে `আদায় করে ছাড়ব` এ আওয়াজ অবশ্যই তোলা হবে। উক্ত ব্যাপারেও ঠিক এ-ই ঘটেছে।"

মূলত সাইয়েদ মওদূদী ও জামায়াতে ইসলামি পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান সমস্যার জন্য সবসময় পশ্চিম পাকিস্তান ও তার সরকারকে দুষারোপ করেছে। বঙ্গবন্ধু বা বাঙালির দাবিকে উপেক্ষা করেনি বা অস্বীকার করেনি। কিন্তু দেশ বিভাগ হোক তা কোনোভাবেই চায়নি। সুতরাং তৎসময়কার হিসেবে তারা দেশপ্রেমিক নাগরিক। দেশ স্বাধীন না-হলে ইতিহাসও হয়ে যেত উলটো। তবে একাত্তরের পর জামায়াতে ইসলামি বা সাইয়েদ মওদূদীর এদেশীয় সাগরেদগণ স্বাধীনতাকে মেনে নিয়েছে। এই বিষয়টা ছফার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে করা `আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়— প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন— সেও ঠেলায় পড়ে` এই বচনের দ্বিতীয় মতের সাথে সদর্থক। `দেশ বিভাগ হোক` তা` চায়নি বা `যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি` জামায়াতে ইসলামি— এর জন্য আমরা মরহুম গোলাম আজম সাহেব আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে হাজির হওয়ার পূর্বে তাঁর একান্ত সচিব নাজমুল হকের মাধ্যমে প্রেরিত তাঁর বক্তব্যের উদ্ধৃতি পেশ করা যায়। তিনি সেখানে তৎকালীন আওয়ামী লীগও দেশ বিভাগ চায়নি মর্মে তথ্য উপস্থাপন করেছেন, "১৯৭১-এর মার্চ মাসের ঐ উত্তাল দিনগুলোতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়ার সাথে শেখ সাহেবের আলোচনার সময় আমার সাথে শেখ সাহেবের একান্ত ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ও বর্তমান স্থানীয় সরকার মন্ত্রী জনাব সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের পিতা জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং জনাব আব্দুস সামাদ আযাদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তাঁরা আমাকে জানিয়েছিলেন যে, অখণ্ড পাকিস্তানের চিন্তা নিয়েই উনারা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। জনাব আব্দুস সামাদ আযাদের সাথে ২৫ মার্চেও আমার টেলিফোনে আলোচনা হয়। তিনি আমাকে পুনরায় আশ্বস্ত করে বলেন যে, তাঁরা অখণ্ড পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোন বিকল্প চিন্তা করছেন না।" যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রশ্নে তিনি বলেন, "১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ভারত সরকার এ দেশের সাথে যে আদিপত্যবাদী আচরণ করেছে তাতে আমাদের নিশ্চিত এ বিশ্বাস ছিল যে, ভারতের সহযোগিতা নিয়ে দেশ স্বাধীন হলে তা ভারতের তাবেদার রাষ্ট্রই হবে। তাই, কিছু বামপন্থি, সকল ডানপন্থি ও সকল ইসলামি দলগুলোসহ প্রায় সকল সুপরিচিত ইসলামি ব্যক্তির এ সুস্পষ্ট ধারণার কারণেই ভারতের সাহায্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সঠিক মনে করেননি। ভারতের সাহায্য না নিয়ে যদি স্বাধীনতা যুদ্ধ করা হতো, তাহলে আমরা অবশ্যই সে যুদ্ধে যোগদান করতাম।"

সবমিলিয়ে বলা যায়, একাত্তরে জামায়াত ইসলাম বাংলাদেশের পক্ষে লড়েনি দলীয়ভাবে (অবশ্যই পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক সমূহ দাবির পক্ষে ছিল, স্বাধীনতা ছাড়া)। কিন্তু তাদের কেউ কেউ অতি-উৎসাহি হয়ে বা খুব বেশি বাঁধা না-থাকার কারণে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বা বিপক্ষে অংশগ্রহণ করেছে এটা অস্বীকার করা যায় না। ফলত এই দলে রাজাকার থাকার সম্ভাবনা যেমন, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাও দেখা যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তারা তখন যুদ্ধাপরাধে war crime লিপ্ত ছিল কিনা? এটার উত্তর সদর্থকও হতে পারে নঞর্থকও হতে পারে। তাদের (দলীয়) দাবি, তারা যুদ্ধাপরাধে war crime লিপ্ত ছিল না। এর বিপক্ষে বাংলাদেশ সরকারের (স্পষ্টত আওয়ামীলীগ সরকার) দাবি তারা যুদ্ধাপরাধে war crime লিপ্ত ছিল। যুদ্ধাপরাধে যারা জড়িত তাদের বিচারের জন্য বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল International crime tribunal গঠন করেছে এবং বিচার চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা জানি এই বিচার ত্রুটিপূর্ণ। এক জনের অপরাধ আরেকজনকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, আসামী পক্ষের সাক্ষীদের অপহরণ করা হয়েছে এবং বিভক্তির রায় দিয়েছে। স্কাইপি কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটেছে, বা ইতিহাসকে আঙ্গুল দেখিয়ে ফাঁসি দেয়ার জন্য সরকার মহোদয় আইন সংশোধন করেছে। যা অযৌক্তিক। এই অযৌক্তিকতার বিরুদ্ধে কথা বলার ফলে বাঘা বাঘা মানুষ হয়রানি হয়েছে বা হতে পারে, যেহেতু স্টেটের ইশ্বরের Government বিরুদ্ধে বলা। তবু যিনি বলেন তিনি বুদ্ধিজীবী।

গণজাগরণ মঞ্চ
৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। এই রায়ের বিরুদ্ধে তথা সর্বোচ্চ শাস্তির (ফাঁসি বা মৃত্যুদণ্ড) দাবিতে `ব্লগারস অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্ক` নামের তথাকথিত একটি সংগঠন আন্দোলন movement শুরু করে। যার মূখপাত্র ছিল ডা. ইমরান এইচ সরকার। যে আন্দোলন movement বহুল আলোচিত গণজাগরণ মঞ্চ বা শাহবাগ আন্দোলন movement নামে খ্যাত হয়ে ওঠে। তারা `১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত সকলের সর্বোচ্চ সাজা প্রদানের দাবি` ছাড়া স্বপ্ন দেখতে ভুলে যান। ধীরে ধীরে তারা সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে থাকে। সংহতি প্রকাশ করে প্রায় বাঘা বাঘা রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিরা। খুদে জামায়াত ইসলামির মিঞা ভাই বিএনপি ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ গণজাগরণ মঞ্চকে স্বাগতম জানায় এবং রাজনীতিকরণের সম্ভাবনা উল্লেখ করে। দেশের পণ্ডিত বা বুদ্ধিজীবী খ্যাত সলিমুল্লাহ খানদের মতো ব্যক্তিরা মঞ্চে আসন গ্রহণ করতে দ্বিধা করেনি।

এই তথাকথিত তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে যারা ছিল বা যে সংগঠনের (ব্লগারস অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্ক) ঘোষণায় দীপ্ত হয়ে ওঠে তার কুশীলবরা তারা এদেশের সংখ্যাগুরু জাতিগোষ্ঠীর মননে আঘাত দিতে পারঙ্গম হয় খুব কৌশলে। তাদের ইতিহাস খতিয়ে দেখা যায় তাদের ব্লগে ব্লগে নবী (সা.)-অবমাননা, ইসলামের মৌলিক বিষয়াদি বা ব্যক্তিদের নিয়ে নানা কটুক্তি। এদের রূখে দেয়ার তেজারতি নিয়ে এরপরই জন্মলাভ করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।

এইখানে মূল বিষয়টা এইজায়গায়, আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একটি বিতর্কিত মামলায়, এবং যা সংঘটিত হয়েছে প্রায় ৪২ বছর পূর্বে তজ্জন্য ফাঁসি চাওয়া কতটুকু যৌক্তিক। সরকার বাহাদুর আবার প্রটোকল সাঁজিয়ে তাদের নিরাপত্তা দিয়েছে বটে, তাদের দাবি পাস করার জন্য আইন সংশোধন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে ফাঁসির রায় বানিয়েছে এবং ন্যূনতম সাংবিধানিক বা বিচারিক রিভ্যিউর সুযোগ না-দিয়ে কাদের মোল্লা সাহেবের রায় কার্যকর করেছে এ কেমন অবিচার? একদল তরুণ বা একটা অংশ (সংখ্যায় যত হোক) চাচ্ছে মানেই কি বিচারহীনতার সংস্কৃতি মেনে নিতে হবে? এই অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলার নাম ইন্টেকচুয়ালিটি, পরম প্রজ্ঞা। যারা চোখে দেখে না তারা বলতেই পারে, যেমন (যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে সরকারের ত্রুটি প্রশ্নে) বলেছেন সলিমুল্লাহ খান সাহেব, "ত্রুটি একশ থাকতে পারে, কিন্তু কোনো মৌলিক ত্রুটি ছিল না"। হুম, হতে পারে ত্রুটি এবং মৌলিক ত্রুটির সংজ্ঞা এই ব্যক্তির জ্ঞাত নয় বা আরো বেশি চর্চার বিষয়।

হেফাজতে ইসলাম
১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ গণজাগরণ মঞ্চের সুখ্যাতি বাখান করতে প্রথম আলো রঙিন হয়েছিল `এমন বাংলাদেশ কখনো দেখেনি কেউ` শিরোনামে। ৫৩ দিন পর। ৬ এপ্রিল, ২০১৩ প্রথম আলোর এমন বাংলাদেশকে খানখান করে নতুন বাংলাদেশে একটি সূর্যোদয়ের শুরু হয়; যেখানে গণজাগরণকে গণবিস্ফোরণে পরিণত হতে দেখে বাঙালি জাতি। এরপরের দিন আমার দেশ পত্রিকার শিরোনাম ছিল `ইসলামি চেতনার গণবিস্ফোরণ`। ঘটনা এখানে নয়, আরো পরে। ৫ মে, ২০১৩। নতুন ভোর, নতুন আলোয়।

মহাসমাবেশ। মহাবিস্ফোরণ। কোটি কোটি মানুষের আবেগ ইসলামের মৌলিক বিষয়ে যারা কটুক্তি করেছে তাদের বিচার হতে হবে, শাহবাগের মুলোৎপাঠন হতে হবে। এই হলেই শেষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর `দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহিদ ব্লগার রাজিবদের` আস্তানা। এই মহাবিস্ফোরণ যেভাবে ঘটেছে, সারা ঢাকা অবরোধ, থরে থরে বিদ্রোহের আস্ফালন; যা দেখে সাম্রাজ্যবাদী বা আদিপত্যবাদী নেতৃত্ব ক্রাশ খেতে বাধ্য। সৈয়দ আশরাফ সাহেব ঘোষণা করলেন, `হেফাজতকে সন্ধ্যার ভেতরে ঢাকা ছাড়তে হবে বা ছাড়ার অনুরোধ`; এর বিপরীতে হেফাজত নেতারা ঘোষণা করলো `কীভাবে পালাবেন প্রস্তুতি নিন`। পরবর্তী ঘটনা সকলের জানা। রাতের আঁধারে লক্ষ লক্ষ বনি আদমকে আলো বন্ধ করে ফ্যাসিবাদী কায়দায় প্রশিক্ষিত ফোর্স দিয়ে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, যাদের হাতে অস্ত্র বলতে ছিল তসবি, কুরআন ও জায়নামাজ। হয়ে গেল তাণ্ডব, রক্তাক্ত শাপলা চত্বর, লালচে` সবুজ জমিন। মিললো না লাশের হিসেবও।

এই ফ্যাসিবাদী কায়দার প্রতিবাদ বুদ্ধিজীবীর রুটিন ওয়ার্ক নিংসন্দেহে। এবং প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় হেফাজতে ইসলাম বনাম গণজাগরণ মঞ্চের যে ডিসকোর্স সেখানে একজন বুদ্ধিজীবী কার পক্ষে অবস্থান করবেন? এডওয়ার্ড সাঈদ বলেন, "বুদ্ধিজীবীর কাজ হবে সমস্যাকে সর্বজনীন করা। একটি বিশেষ বর্ণ কিংবা জাতি, যারা কষ্ট পায় তাদের বৃত্তের মানবিক সুযোগের ক্ষেত্র প্রদান করা এবং অন্যান্যদের কষ্টের সাথে ঐ অভিজ্ঞতাকে সংযুক্ত করা।" এখানে গণজাগরণ মঞ্চ বা শাহবাগ আন্দোলন এদেশের দীর্ঘকালীন ইসলামি রাজনীতির স্পিকার জামায়াত ইসলামী বা তার লোকবলকে অন্যায় হয়রানির সুযোগ খুঁজেছে। অন্যদিকে হেফাজতে ইসলাম এদেশের সংখ্যাগুরু জাতির স্পিকার হিসেবে মৌলিক ভূমিকা রেখেছে, যা বেশিরভাগ পারসনের আধ্যাত্মিক দাবি। সুতরাং, পাঠক সহজে ধরে নিতে পারেন বুদ্ধিজীবী কার পক্ষে বলবে, অথবা কার পক্ষে বললে সে বুদ্ধিজীবীর শর্ত পূরণ করবে বলে ধরে নেয়া যায়।

উপরে বর্ণিত এইসব সমূহ শর্তে টিকে যায় ফরহাদ মজহার, এমনই মনে হয়। আপনার দ্বিমত থাকতে পারে। এখানে ডিসকোর্স পয়েন্ট অব ভিউ`র অংশ। তাই মাথাব্যাথার প্রয়োজন নেই। টেনশনের কাঁঠখোট্টা পোড়ানোরও দরকার নেই। কারণ, ফরহাদজী রাজনীতিবিদ নন। তিনি সবসময় স্বাধীন দেশের ভিকটিম এবং ভাবের দেশের চিন্তক, গণ মানুষের স্পিকার।

এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ বলেন, "বুদ্ধিজীবীরা সব সময় গতিশীল এবং স্থিরভাবে কোথাও দাঁড়িয়ে থাকেন না"। সাঈদের স্থির হতে পারে রাজনৈতিক বা কোনো মতের পক্ষে। এক্ষেত্রে ফরহাদ মজহার অকাট্য দলিল। আমরা জানি জোট সরকারের আমলে তিনি রাষ্ট্রদোহ মামলায় জেলে ছিলেন, আর চৌদ্দ দল তথা শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গুমের স্বীকার হয়েছেন, মামলার মতো সরকারি শ্যেনদৃষ্টির স্বীকার হয়েছেন। পূর্বেই বলেছি, আবারো বলছি তিনি স্বাধীন দেশের ভিকটিম। কেন তিনি দেশের গদিতে গদগদ করা দু` সরকারের আমলেই জেলে যান বা গুম হন? তিনি রাষ্ট্রীয় অন্যায়-জুলুমের দিকে আঙ্গুল তোলেন, সমস্যাকে সর্বজনীন করার কাজ সম্পাদন করেন হাতের লৈখিক স্কেচে। ফরহাদ মজহার বলেন, "আমি শ্রেণী রাজনীতি করি। আবার কেউ জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করে। হঠাৎ করে সে যদি দেখে আমি তার জাতীয়তাবাদকে সমালোচনা করছি, তখন সে থতমত খেয়ে যায়। আপনি নিপীড়িত শ্রেণির পক্ষে কী-না সেটাই হচ্ছে মূলত প্রশ্ন।"

বর্তমান বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রে সমূহ শর্ত বিবেচনায় যদি আসি প্রথম বিবেচনায় মজহার সাহেব একজন বুদ্ধিজীবী। এন্টি ভারতীয় সমর্থক গড়তে এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভারতীয় আদিপত্যবাদের বিরোধীতা জিয়ে দিতে ভাবাগত আন্দোলন করেছেন, সফলও হয়েছেন। কখনো তিনি ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে মিটিং করছেন আরো দশজন প্রাজ্ঞজন নিয়ে, আবার কখনো রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ওঠেপড়ে লেগেছেন। বা কাশ্মীর বা সেভেন সিস্টার রাজ্যসমূহের পক্ষে অনবরত লিখেছেন এবং এদেশের অভ্যন্তরে জনমত গড়ে তুলছেন।

দ্বিতীয় বিবেচনায় আসা যাক। হেজিমনিক শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান কী খতিয়ে দেখি। দেশের বর্তমান অবস্থা এবং আওয়ামী সরকারকে তিনি মনে করছেন ফ্যাসীবাদের সূতিকাগার। তাঁর ভাষায়, "গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছে এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা হিশাবে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক ক্ষমতা ও ব্যবস্থা সুনির্দিষ্ট ও পরিগঠিত রূপ নিয়েছে। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ও সরকার নৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈধতা অর্জনের জন্য শাহবাগের সমাবেশকে সফল ভাবে ব্যবহার করেছে এবং তারই প্রতিক্রিয়া হিশাবে বাংলাদেশে সামাজিক শক্তি হিশাবে হেফাজতে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে। ফ্যাসিবাদের তত্ত্বগত ও সাংস্কৃতিক বয়ান হিশাবে যে বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদকে খাড়া করা হয়েছিল তার বিপরীতে শক্তিশালী ইসলামি রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। গণহত্যা, দমন-পীড়ন ও জেলজুলুম দিয়ে একে মোকাবিলা করা অসম্ভব। ফ্যাসিবাদ তার চেহারা দেখিয়ে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে একে চেনা এখন আর কঠিন নয়।" আওয়ামীলীগ একচ্ছত্র মুক্তিযুদ্ধকে বসতবাড়ি বানিয়ে বা জন্মবিটা বানিয়ে যে ফ্যাসিবাদী চাষ করতেছে তার সমালোচনা করে ফরহাদ মজহার বলেন, "বাংলাদেশের মানুষ একাত্তরে ফ্যাসিবাদের জন্য সংগ্রাম করে নি, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের জনগণ লড়েছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য। যে ফ্যাসিবাদী চার নীতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আকারে হাজির করা হয় তার কোন ঐতিহাসিক সত্যতা ও বৈধতা নাই। সেটা আওয়ামী লীগের দলীয় নীতি হতে পারে, কিন্তু তার জন্য একাত্তরে বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করে নি। যে নীতির জন্য লড়াই হয়েছে তা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেই আছে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণায় ফ্যাসিস্টদের কোন নীতিই অন্তর্ভুক্ত নয়।"

আওয়ামী সরকারকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেছেন এই বুদ্ধিজীবী। তিনি বলেন, "যারা বর্তমান সরকারকে সমর্থন করছেন তাদের পরিবারের কেউ নিরাপদ নয়। আওয়ামী লীগ নামের সরকারটি জন্ম থেকেই ফ্যাসিস্ট। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধংস করেছে। হিটলার ও মুসলিনীর ফ্যাসিজম থেকেও ভয়ঙ্কর আওয়ামী লীগের ফ্যাসিজম। এই ফ্যাসিজমকে তাড়ানো রক্তাক্ত পথের মাধ্যম ছাড়া সম্ভব নয়।" এই এন্টি আওয়ামী লীগ আইডিওলজির কারণেই ফরহাদ মজহারকে পাওয়াফুল ভাবতেও শুরু করেছেন অনেকে বা তরুণ প্রজন্মের বিশাল অংশ।

তৃতীয় বিবেচনা বা শেষ প্রান্তরে আসি। এইখানে তিনটি পৃথক বিষয় বিবেচনা প্রয়োজন অবশ্যই। যুদ্ধাপরাধের বিচারনীতি এবং শাহবাগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আমরাতো বারবারই বলেছি যুদ্ধাপরাধের বিষয়টা আমাদের বাংলাদেশের একটা ক্ষত। এ বিচারটা আমাদের সম্পন্ন করতে হবে। তারা যে ফাঁসি-ফাঁসি কথাটা বললেন, তারা বিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন এবং ইনসাফের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।" এবং "বিচার চলাকালে আইন পরিবর্তন করে কাউকে ফাঁসি দেয়ার নজির পৃথিবীর কোথাও নেই। (বাংলাদেশেই হলো)" শাহবাগের `তরুণ প্রজন্ম` প্রত্যয়ের বিরুধীতা করেন মজহার। তিনি স্পষ্টত বলেন, "শাহবাগে যারা নিজেদের তরুণ প্রজন্ম বলছে তারাতো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র। যারা কারখানায় কাজ করে, যারা গ্রামে কাজ করে, যারা বিদেশে শ্রমিক আকারে কাজ করে- এ বিশাল তরুণদের অস্বীকার করার ধারণাটাই নিহিত রয়েছে প্রজন্ম ধারণাটার মধ্যে। ফলে আমাকে এর সমালোচনা করতেই হয়েছে।"

৫ মে, ২০১৩ মধ্যরাতে হেফাজতের ওপর সরকারি `অফারেশন ফ্লাশ আউট` নিয়েও কড়া শব্দ গুঁজে দিয়েছেন তিনি। বলেন, "একটি দেশের সরকার আলো নিভিয়ে অন্ধকারে তিনটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দশ হাজারেরও বেশি সদস্য নিয়ে নিজেরই নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। এই সত্য আর লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। রীতিমতো অবিশ্বাস্য হলেও এই নির্মম ও অবিশ্বাস্য ঘটনাই বাংলাদেশে ঘটেছে।" হেফাজতের সমাবেশ এবং সরকার বাহাদুরের লংকাকাণ্ড বিশ্লেষণ-পূর্বক মজহার সাহেব ডিসকোর্সে ইসলাম বিজয়ী দেখেন। যার কারণেই তিনি একই প্রবন্ধে বলেন, "এটা ঠিক হেফাজতকে ঢাকা শহর থেকে ‘ফ্লাশ আউট’ করা হয়েছে। এটা ছিল নিষ্ঠুর ও নির্মানবিক কিন্তু সবচেয়ে সহজ কাজ। সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে বাংলাদেশে ইসলাম প্রশ্নের মোকাবিলা করা। বাংলাদেশের রাজনীতি ও ইতিহাসের কেন্দ্রে হেফাজতে ইসলাম শুধু নিজের জন্য একটি জায়গা করে নেয় নি, বরং এটা বুঝিয়ে দিয়ে গেছে ইসলাম বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির কেন্দ্রীয়, গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ধারক প্রশ্ন। এই প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যেতে পারবে না।"

নতুন আরেকটি প্রশ্ন এসে যায়? ফরহাদ মজহার কোন স্তরের বুদ্ধিজীবী? এই প্রশ্নে বুদ্ধিজীবীদের আমি তিনভাগে গণ্য করি। সাধারণ বুদ্ধিজীবী, বিশেষ বুদ্ধিজীবী, গণবুদ্ধিজীবী। উপরোক্ত এডওয়ার্ড সাঈদ যা বলেছেন তৃতীয় বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে এবং আহমদ ছফা যা বলেছেন দ্বিতীয় ও তৃতীয় বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে। সে হিসেবে ফরহাদ মজহার কোথায় পড়ে তা আপনারা ভাবতে পারেন। সিদ্ধান্ত আপনাদের ওপর। প্রথমোক্ত বুদ্ধিজীবী সকল জনসাধারণ, যারা আয় করে।