বাংলাদেশের বাংলার সাথে ভারতীয় অপরাপর ভাষার সম্পর্ক

চয়ন খায়রুল হাবিব

প্রকাশিত : নভেম্বর ১০, ২০২২

ইউরোপীয় মূল ভাষাগুলো থেকে বাংলাতে অনুবাদ অপ্রতুল হলেও অনেক। সেটা দরকারিও। সে তুলনায় ভারতীয় অপরাপর ভাষাগুলো থেকে বাংলাতে অনুবাদ লজ্জাস্করভাবে কম, প্রায় শূন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথিত আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটেও হিন্দি ছাড়া ভারতীয় অপরাপর ভাষাগুলোর স্বীকৃতি ও শিক্ষা নেই। সাহিত্যের গতি আর সাম্রাজ্যের গতি-প্রকৃতি এক নয়। তাহলে এখনো সবখানে রোমান লাতিন, সংস্কৃত, পালি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশিত হতো। সোভিয়েত পতনের পর রুশ ভাষা সাবেক সোভিয়েত বলয় থেকে প্রত্যাখ্যাত।

ভারতের হিন্দি ও তামিল সিনেমা বাংলাদেশিরা গোগ্রাসে গিলছে, নিজেদের সঞ্চয় ভারতে গিয়ে চিকিৎসায় উজাড় করছে, কিন্তু ভারতের শক্তিশালী অপরাপর সাহিত্য-ভাষাগুলো নিয়ে বাংলাদেশিদের উৎসাহ নেই। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার লক্ষ্যে যে একুশে ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব সম্প্রদায় তাকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের সম্মান দিয়েছে। বাংলাদেশিরা ভারতের অপরাপর ভাষাগুলোকে সে সম্মান দেবে, সেটা আশা করা সমীচীন। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ নেই। ইংরেজি ও আরবির পর বাংলাদেশে এখন কোরিয়ান ভাষার কোচিং সেন্টার দেখা যায়।

সব কিছুতে যদি অর্থের ভাষা, ধনীর ভাষা, মনিবের ভাষা শেখার প্রবণতা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় তাহলে মানবতার সহমর্মিতার ভাষা গৌণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন দিকে ভারত তারকাঁটার বেড়া বসিয়েছে। এই ভারতের বিভিন্ন জাতি ১৯৭১ এ পাকিস্তানিদের হাতে বাংলাদেশিদের গণহত্যায় রুখে দাঁড়িয়েছিল। আমরা কিন্তু ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে, তাদের ভাষায় বলতে পারছি না যে, তোমাদের সংস্কৃতি, আমাদের সংস্কৃতিতে বৃহত্তর যোগাযোগ আছে। আমরা নিজামুদ্দিনের দরগায়, আজমিরে পকেট উজাড় করে আগরবাতি, মোমবাতি জ্বালিয়ে আসছি, কিন্তু গালিবের মাজার কোথায় জানি না।

তাজ মহলে ছবি তুলছি, কিন্তু সাহির লুধিয়ানভির কবিতা জানি না। তেলেঙ্গানার শ্যাম বেনেগালকে ধরে এনেছি বঙ্গবন্ধু বায়োপিক বানাতে, কিন্তু তেলেগু ভাষা থেকে আমাদের ভাষাতে কোনো অনুবাদ নেই। আমরা সবাই জানি, `ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো, বর্গি এলো দেশে`। কিন্তু সেই বর্গিদের ভাষা মারাঠির আধুনিক নাট্যকার বিজয় তেন্ডুলকর, বশীর মামুনেরা আমাদের অচেনা। মধ্যযুগে বাংলা ভাষার সাথে ভারতের অন্য ভাষাগুলোর সম্পর্ক দেখা যাক। মালিক মুহাম্মাদ জায়সী তার `পাদ্মাভাত` মহাকাব্য রচনা করেন ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে। প্রায় একশো বছর পর আরাকানের বৌদ্ধ রাজার অমাত্য মাগন ঠাকুরের নির্দেশে জায়সী অবলম্বনে আলাওল ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে `পদ্মাবতী` রচনা করেন।

জায়সী `পাদ্মাভাত` লেখেন আওয়াধি ভাষায়, অর্থাৎ অযোধ্যা বা উত্তর প্রদেশের হিন্দুস্তানি ভাষায়। জায়সী ফার্সি নাস্তালিক ভাষায়ও লেখালেখি করতেন। `পাদ্মাভাত` অনুবাদ করতে আলাওলকে আওয়াধি হিন্দি ও নাস্তালিক দুটাই জানতে হয়েছে। জায়সীর `পাদ্মাভাতে` যেরকম, আলাওলের `পদ্মাবতীতেও` সেরকম অলঙ্করণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত নীল কাপড়ে ঢাকা যে প্রকাশনাটিকে আলাওলের `পদ্মাবতীর` মূল পাণ্ডুলিপি বলে প্রচারণা চালানো হয়, সেটার ঐতিহাসিক কার্বন টেস্টিং হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। সে মূল পাণ্ডুলিপির অলঙ্করণও আর পুন সংস্করণ করা হয় না, যা থেকে আমাদের মুদ্রণশিল্প, চারুকলা ও অলঙ্করণকলার পরম্পরাগত দুর্বলতা ধরা পড়ে।

বাংলাদেশের বই মেলাগুলোতে সর্বাধিক প্রচ্ছদ করা ধ্রুব এষ আলাওলের `পদ্মাবতীর` অলঙ্করণ কখনো দেখেছে কিনা, এটা আমার খুব জানার ইচ্ছা! সঞ্জয় লীলা বানশালি যখন জায়সীর `পাদ্মাভাত` অবলম্বনে চলচ্চিত্র বানায়, তা দেখে আমার বারবার মনে হচ্ছিল, জায়সীর সময়ে মুদ্রিত অলঙ্করণ সিনেমার পর্দায় উঠে এসেছে। এই যে ভারতীয় অপরাপর ভাষা, সুরের সাথে আমাদের এতো দূরত্ব, তা আমরা ভরাট করছি পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার সাহিত্য দিয়ে, আর ইউটিউবে বলিউডের চোথা করে। ব্রিটিশ তার রাজধানী কোলকাতা থেকে দিল্লি সরিয়ে নেবার পর, যে পশ্চিমবঙ্গ তথা কোলকাতার সাহিত্য ভাষা মূলত হীনমন্যতার ভাষার বেশি কিছু নয়। সেই হীনমন্য ভাষা দিয়ে বাজারের বইয়ের দোকানগুলয় ভর্তি করে আমরা তা দিয়ে চারুকলা, চলচ্চিত্র, সঙ্গীতের চোখ, কান তৈরি করতে চাইছি।

চাপানো উর্দু দিয়ে যেরকম বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তির মুক্তি ঘটেনি, কোলকাতার বাংলা ভাষার করিডোর দিয়েও আমাদের বোধের বিকাশের সম্ভাবনা নেই। এটাকে আবার অপব্যাখ্যা করে ময়মনসিংহা ভাষার অনুকরণে অহমীয়া মিয়া সাহিত্যের চর্চা আমাদের দরকার নেই। প্রকাশনা সংখ্যা বেশি থাকলেই যে কারো বোধের করিডোর প্রশস্ত তাও যেরকম সত্য নয়, সেরকম আঞ্চলিক ভাষাতে সাহিত্য চর্চা করলে জনতার বোধ বিকশিত হবে তাও সত্য নয়।

জয়দেবের `গীতগোবিন্দ` ইংরেজিতে পড়ে এবং বৃন্দাবনের আশ্রমে মূল সংস্কৃতে শুনে আমার খুব ভালো লেগে যায়। `গীতগোবিন্দকে` বাংলাতে অনুবাদ না করে নিজের মত করে `সম্পর্ক সংহিতা` শিরোনামে ভাবান্তর করার আগে বেশ কবছর ধরে আমি সংস্কৃত মন্ত্র শিখতে থাকিদ `গীতগোবিন্দের` অন্তস্থ সুর ধরতে। সে পথে আমি বাংলা থেকে উত্তর ভারতে পাড়ি জমানো সংগীতগুরু আলাউদ্দিন খান ও সচিন দেব বর্মণের সাথে একটা অন্তর্গত সম্পর্ক গড়ে তুলি। ইয়োরোপীয় ছোট, বড় ভাষাগুলো থেকে বাংলা ভাষার অনেক নেয়ার আছে। ভারতের ছোট, বড় ভাষার থেকেও বাংলা ভাষার অনেক নেবার আছে।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক