‘বাংলার স্থপতি’র পাঠ প্রতিক্রিয়া

ড. ফাদার তপন ডি’ রোজারিও

প্রকাশিত : জুন ০৮, ২০২৩

এ বছর মাতৃভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছে ‘বাঙলার স্থপতি’র সপ্তম খণ্ড। গ্রন্থটি উৎসর্গকৃত হয়েছে স্বাধীনতার রক্তমাখা ইতিহাসের যাত্রাপথে দুর্গম যাত্রীদের উদ্দেশ্যে। বাংলার স্থপতি এ যাবৎ ধারাবাহিকভাবে সাতটি খণ্ডে আত্মপ্রকাশ করেছে। সম্পূর্ণ খণ্ড দশ অধ্যায়ে বিভাজিত। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬০৬। প্রকাশক নলেজ ইন্ডাস্ট্রি লি:। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২৩।

 

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে ঘিরে লেখক, কবি ও গায়ক অ্যালভীন দিলীপ বাগচী তার মেধা, মনন, অধ্যয়ন ও গবেষণার বহু ফসলি পুস্তক বিতানে বর্ণনা করেছেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ত্যাগ তিতিক্ষা আর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের নানা জানা-অজানা তথ্যকথা। তার সুবিশাল রচনার বিষয়বস্তু শুধুমাত্র সংগ্রামী ও স্বাধীনতাকামী বঙ্গবন্ধুর কথা, কাজ ও জীবন চরিতে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং ঔপনিবেশিক সময়কাল থেকে ভারতবর্ষে বাঙালির জাতীয়তাবাদের সমর্থনে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদ ও আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিপ্লব এবং সস্বস্ত্র যুদ্ধের প্রাসঙ্গিকতা যুক্তিযুক্তভাবে তুলে ধরেছেন বিবিধ প্রেক্ষাপটে।

 

লেখক অপরিহার্যভাবেই ঐতিহাসিক সত্যতার অমীমাংসিত কিছু প্রশ্ন, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও তার অনিবার্য পরিণতি নিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বিষয় সংশ্লিষ্ট বইপুস্তক, পত্রপত্রিকা, প্রতিবেদন-পর্যালোচনা, সাময়িকী, আর্টিকেল, সাক্ষাৎকার, ই-সোর্স ইত্যাদি অবলম্বন করেছেন পদ্ধতিগতভাবে। আর সে প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত উৎস লব্ধ তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সঠিক বা সম্ভাব্য উত্তর ক্রমাগতভাবে বলে গেছেন পাঠককে। এ যেন জানা ইতিহাসের এক নবতর ধরণ ও ধারা, যেন হালের প্রজন্মের নির্লিপ্ততায় জাগরিত হয় প্রগাঢ় জাতীয়তাবোধ আর সত্যিকার দেশপ্রেম।

 

এই সোনার বাংলার ইতিহাসের আলোকিত আর মলিন অসংখ্য ঘটনার নৃশংসতম ঘটনা জাতির জনককে হত্যা করে একটি জাতির আত্মজ স্বপ্নকে ধুলিস্যাত করে অন্ধকারে নিক্ষেপ করার অপপ্রয়াস। বিশ্ব ইতিহাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে স্বপরিবারে হত্যার বিষয়টি লেখক অনুধ্যান ও অনুচিন্তনে প্রকাশ করেছেন অতীব তীর্যক তীক্ষ্নতায়। ‘প্রকৃত অর্থে পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড কোনো সামরিক অভ্যুত্থান ছিল না, কিংবা কোনো উচ্ছশৃঙ্খল ও বিপথগামী কয়েকজন সৈন্যদের হঠকারী হত্যাযজ্ঞ ছিল না। বাস্তবিক পক্ষে এই হত্যাযজ্ঞ ছিল ১৭৫৮ সালের ইংরেজ বেনিয়াদের ষড়যন্ত্র ও দেশীয় দালাল, বিশ্বাসঘাতক, মুনাফেক ও অবৈধ দখলবাজদের সাহায্য ও সহযোগিতায় পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ইন্ধনে ও সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে পলাশির প্রান্তরে সংঘটিত বিয়োগান্ত নাটকেরই পুনরাবৃত্তি।

 

এটাই হচ্ছে ভাগ্যের বা নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস। বঙ্গবন্ধুর শৌর্য, বীর্য ও তেজদীপ্ত যৌবনের উত্তাপে অর্জিত ও গড়া যে সোনার বাংলা সেই সোনার বাংলার মাটিতে, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর নিজ বাড়িতে মৌন, শান্ত, নিষ্প্রভ, জড়, অচল, স্থবির, নিশ্চল সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর প্রাণহীন রক্তাক্ত লাশ অযত্নে, অবহেলায়, চরমতম ঘৃণায় ফেলে রেখে লুটেরা হত্যাকারীর দল এগিয়ে গিয়েছিল ক্ষমতার মসনদের দিকে। বিশ্ব মানবতার সেদিন যেন ঘটেছিল অপমৃত্যু! মানবতার ক্রন্দনধ্বনি এখানেই থেমে যায়নি, বরং হত্যাকারীদের নিষ্ঠুর আচরণ হতবাক করে দিয়েছিল গোটা দুনিয়াকে! বিশ্ববাসী সকরুণ দৃষ্টি মেলে দেখলো, যার সারা জীবনের সাধনা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি, তাদের স্বাধীনতা, স্বাধীন আবাসভূমি স্বাধীন বাংলা বাংলাদেশ, তার পরম সাধনার ধন ও আরাধ্য সোনার বাংলা, সোনার মানুষ গড়ার আকাঙখা সেই স্বাধীন বাংলাদেশে তার অন্তিমযাত্রায় কফিন আচ্ছাদিত হয়নি তার নিজের গড়া বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের পতাকায়।

 

বিউগল ধ্বনি বেজে ওঠেনি শেষ যাত্রায়। যার সারা জীবনের ত্যাগ ও শ্রমের ফসল স্বতন্ত্র, একান্ত আপন ও নির্ভয় আবাসভূমি, বাঙালির চিরস্থায়ী ঠিকানা তার সমাধির জন্য তার রচিত সোনার বাংলার রাজধানী ঢাকায় জুটেনি একফোঁটা জায়গা। শেষ ঠিকানায় চিরনিদ্রায় শায়িত হবার জন্য রাজধানীতে জোটেনি মাত্র সাড়ে তিন হাত জায়গা। বঙ্গবন্ধুর লাশ রক্তাক্ত অবস্থায় খুনিদের মত্ততা ও উল্লাস নৃত্যের মধ্য দিয়ে বলতে গেলে অন্তিম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া একেবারে অযত্নে অবহেলায় কোনো রকম একটুখানি ধর্মীয় হাল্কা, স্বল্প, অপরিমত অগ্রহণযোগ্য ও বিবেক তাড়িত, উপেক্ষিত হেলাভরে ছিটেফোঁটা আচার মেনে কবর দেওয়া হয় তার নিজ জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায়। বলতে গেলে সেই সামাধি প্রক্রিয়া ছিল যেন অখ্যাত ও পরিচয়হীন কোনো ব্যক্তিকে মাটিচাপা দেওয়ার মতো।’ পৃষ্ঠা ৩৫

 

বাংলার স্থপতি গ্রন্থের দশটি অধ্যায়ের উপশিরোনামগুলো সঠিক ও যৌক্তিক বলেই মনে হয়। পঁচাত্তরের দুঃখ-স্মৃতি, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড কেন ঘটেছিল? কারা বঙ্গবন্ধু হত্যায় পরোক্ষভাবে জড়িত? তাদের মুখ ও মুখোশের পরিচয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমিকা সৃষ্টিতে কয়েকটি সংবাদপত্রের দুরভিসন্ধিমূলক ভূমিকা, বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে সিআইএ জড়িত, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল, হত্যার আগে চরিত্র-হত্যা, বঙ্গবন্ধু তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর আশংকায় শংকিত ছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা আদালতের রায়, শেষ কথা বিশ্ববাসীর স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু, আবশ্যিকভাবেই স্বদেশ ভাবনা ও ভালবাসার অনন্য ইতিহাস অভিজ্ঞানস্বরূপ। পর্যালোচিত গ্রন্থটিতে লেখক জাতির জনককে নিয়ে স্বীয় মূল্যায়ন এমনিভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন:

 

‘বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের অধিকাংশ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে কারাগারে নির্বাসিত জীবনে। আত্মীয়-স্বজনহীন, বন্ধনহীন, একাকী। সেই একাকী জীবনের, একটানা সংগ্রামপূর্ণ পথ চলাতে বাঙালি জাতির মুক্তি ব্যতীত তার অন্য কোনো সান্ত্বনা ছিল না। বঙ্গবন্ধু ভাল করেই বুঝতে পেরেছিলেন, পাখিদের মধ্যে কাক, সরীসৃপদের মধ্যে সাপ, পশুদের মধ্যে খেঁকশিয়াল, আর মানুষের মধ্যে শাসক ও শোষক দখলবাজ পাকিস্থানিরা সবচাইতে ধূর্ত ও নিষ্ঠুর। তাই পরাধীন বাঙালির মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে, মাতৃভূমির মুক্তিব্রত। ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলনের পর বাঙলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য স্থির করে বঙ্গবন্ধু এগিয়ে চলেছিলেন ৭১-এর পটভূমির দিকে। অতপর দীর্ঘ ন’মাস রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাক-হানাদারদের পরাজিত করে বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীন বাংলাদেশের সষ্ট্রা বঙ্গবন্ধু। তাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

 

মুজিববিরোধিরা আজ যত কথাই বলুক না কেন, যতই মিথ্যাচার রটাক না কেন, বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখণ্ডের সম্মুন্নত গৌরবমণ্ডিত মাস্তুলের শীর্ষে বসে আছেন বঙ্গবন্ধু, তাকে অস্বীকার করতে পারে কে? বাংলার আকাশে বাতাসে, শিল্পে, সাহিত্যে, কাব্যে গল্পে, মানচিত্রে ও ইতিহাসে মিশে আছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি আছেন নদীর কল্লোলে, সাগর সঙ্গমে, পাহাড়, পর্বতে ও বৃষ্টি-বারিধারাতে মিশে। খাল-বিল-নদী নালায় ও বাংলার জমিনে সর্বত্র সবখানে। তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্বের কথা চিন্তা করা বৃথা চেষ্টা। তাঁকে ছাড়া বাংলার মানচিত্রের প্রকাশ অসম্পূর্ণ। বাঙালি জাতির সম্পূর্ণতা পেতে হলে বঙ্গবন্ধুকে স্বীকার করে নিতে হবে প্রয়োজনের তাগিদে। নিজের ও দলীয় স্বার্থ আমাদের দৃষ্টিকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে যে দলের চাইতে দেশ বড় এবং দেশকে স্বীকার করতে হলে বঙ্গবন্ধুকে স্বীকার করে নিতে হবে এই বাস্তব সত্যটাকে আজ অনেকেই স্বীকার করতে ভুলে গেছে।’ পৃষ্ঠা ৫৯৫

 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর লেখক যে ১-৭ খণ্ড রচনা করেছেন তা যেমন বিশাল তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ। একটি খণ্ড পাঠ করলে বাকি খণ্ডও পাঠের আগ্রহ জেগে ওঠে। এ যেন একটি ধারাবাহিক ঐতিহাসিক নভেল। চৌম্বকীয় ইতিহাস পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পড়লেও আকর্ষণ থেকে যায় পরবর্তী ঘটনার অন্তরালে আরও কী ঘটনা আছে তা জানার অভিপ্রায়। সুগভীর বাঙালি জাতীয়তাবাদ মরময়িতা মিশে আছে সমুদয় স্থান-কাল-পাত্রের ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহে।

 

লেখক অ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাসের রচিত ‘বাংলাদেশ এ্যা লিগাচি অভ ব্লাড’ গ্রন্থটির নানা তথ্যের সত্যতা যেভাবে সমপ্রশ্নিত করেছেন তা বিরলই বটে! তবে কী লেখক অ্যালভীন দিলীপ বাগচী নিজেও একজন পক্ষপাতদুষ্ট কিংবা রাজনৈতিকভাবে ভাড়াটিয়া লেখক? সময়ই তার সদুত্তর দিবে। যদি একই ইতিহাসকে ঘিরে নতুন প্রজন্ম নতুন ইতিহাস রচনা বা গবেষণা করতে চায় তবে বাংলায় স্থপতি গ্রন্থের ১ম থেকে ৭ম খণ্ডের এ বিশাল যৌক্তিক ইতিহাস ভাণ্ডারকে কোন গবেষক উপেক্ষা করতে পারবেন না। প্রশ্নের ভিতরে প্রশ্ন, উত্তরের ভিতর উত্তর খুঁজে পেতে বাংলার স্থপতি একটি নবতর ধারা সংযোজন করেছে বলেই মনে হয়। যত পাঠ তত অভিমত, আরও বেশি তেজোময় হতেই হবে তার সমালোচনাধর্মী পর্যালোচনা। বাংলার স্থপতি সপ্তম খণ্ড নিয়ে এ নাতিদীর্ঘ গ্রন্থ পর্যালোচনাটিও তেমনি সমালোচনা সমাদৃত জ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য ও কৃষ্টির অংশী মাত্র।

 

লেখক পরিচিতি: সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

একুশে বইমেলা ২০১৮