
বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ: দেশি-প্রবাসী বিতর্ক
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : মার্চ ২৪, ২০২০
দেশের বাইরে থাকা বহু প্রবাসী মনে করছে, প্রবাসীদের প্রতি দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ। তাদের লেখা পাঠ করে মনে হলো তারা ধারণা করছে, বাংলাদেশে প্রবাসীদের হেনস্থা করা হচ্ছে। ব্যাপারটা তা নয়। মানুষের রাগটা আসলে সরকারি অব্যবস্থাপনার প্রতি, প্রবাসীদের প্রতি সেভাবে নয়। বাংলাদেশে এবার ছুটি কাটাতে আসা প্রবাসীদের প্রথম যে ক্ষোভ দেখা দেয়, সেটাও কিন্তু সরকারি অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলার সময় সকলকে তাই সতর্ক থাকতে হবে। না হলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো, দেশি আর প্রবাসী বিভাজন তৈরি হবে। কথাটা খুব স্মরণে রাখা দরকার, এ নিয়ে যেকোনো মন্তব্য করার আগে।
বাংলাদেশের সকল স্তরের মানুষ প্রবাসীদের নিয়ে সবসময় গর্ব করে এবং মনে করে, বাংলাদেশের উন্নতির পেছনে তাদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে যারা প্রবাসী হিসেবে বড় বড় চাকরি করে, তাদের চেয়ে সাধারণ প্রবাসীদের প্রতি সম্মানটা অনেক বেশি। প্রবাসীদের অবদান, তাদের কষ্টসহিষ্ণুতা এবং সংগ্রাম বাংলাদেশে শ্রদ্ধার সঙ্গে আলোচিত হয়। কিন্তু তাদের কি কোনো সমালোচনা হয় না? নিশ্চয়ই হয় তাদের অনেক আচরণ নিয়ে, আর তা অনেকটা যুক্তিসঙ্গতভাবে। তার সঙ্গে এবারের ঘটনার সম্পর্ক নেই।
ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের মানুষ সব সময় নিজদেশের মানুষের নিন্দা করে থাকে, সেটা কি দেশি কী প্রবাসী। নিজদেশের মানুষের এই যে সমালোচনা করার ঐতিহ্য এটা প্রধানত ব্রিটিশ সামাজ্যবাদী শাসকদের কাছ থেকে পাওয়া। ব্রিটিশরা ক্ষমতা গ্রহণ করে এমন একটা গোষ্ঠী তৈরি করার চেষ্টা করে, যারা ব্রিটিশদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে আর নিজদেশের সবকিছুর নিন্দা করবে। ডিরোজিওর ছাত্ররা যেমন ভারতের সবকিছুর নিন্দা দিয়ে আরম্ভ করেছিল। যারা প্রথম ভারতের সবকিছুর নিন্দা করেন খুব উগ্রভাবে, তারা সকল দেশীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছিল। কিছুদিন পর তারা আবার হিন্দুধর্মের গোড়া সমর্থক হয়েছিল।
ব্রিটিশরা জানতো নিজ দেশের মনুষদের মধ্যে বিভেদ বাধিয়ে রাখতে পারেলে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে আর ইংরেজ সরকারে বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেবে না। নিজেরা নিজেরা লড়াই করে দুর্বল হবে, যার বড় উদাহরণ হিন্দু-মুসলমান বিরোধ। সত্যিকার অর্থে এটা মাত্র একটা দিক। সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটা হলো, ভারতীয়রা সব ব্যাপারে নিজেদের সবকিছুকে খাটো চোখে দেখবে, আর সব ব্যাপারে ব্রিটিশদের অনুকরণ করতে গর্ব অনুভব করবে, এটাই শাসকরা চেয়েছিল। ব্রিটিশরা এ ব্যাপারে মনে হয় পঁচানব্বই শতাংশ সফল। ব্রিটিশদের ভাষা, পোষাক, খাদ্য, শিক্ষা, শাসন, ব্রিটিশদের চামড়া সব কিছুর প্রশংসায় ভারতীয়রা উচ্ছ্বসিত আর তা অনুকরণে সচেষ্ট। মানে কি দাঁড়ালো? নিজের সবকিছুই হীন আর ব্রিটিশদের সবকিছুই শ্রেষ্ঠ। ফলে নিজেদের আমরা নিন্দা করতে শিখেছি ব্রিটিশ শাসনে।
ব্যাপারটার উল্টোদিক হলো এই, ব্রিটিশরা খুব খারাপভাবে দেশ চালিয়েছিল; স্বাধীনতার পর ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশের সরকারগুলি দেশ চালালো ব্রিটিশদের দিয়ে যাওয়া বিধিবিধান দিয়ে কিন্তু আরও খারাপভাবে। জনগণকে শাসন-শোষণে তারা ব্রিটিশদের চেয়েও সর্বক্ষেত্রে এককাঠি সরেস। ব্রিটিশ শাসনে বা তাদের শয়তানীনিতে ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়েছিল ঠিকই, স্বাধীন ভারতে তা বেড়ে গেল আরও বহু বহু গুণ। ব্রিটিশ ভারতে যেটুকু আইনের শাসন কষ্টসৃষ্টে পাওয়া যেতে, স্বাধীন দেশগুলিতে তাও পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে অনেকই আবারো সঠিকভাবেই বলতে শুরু করলো ব্রিটিশ শাসনে আমরা ভালো ছিলাম।
কী ঘটলো তবে? ব্রিটিশ শাসনে ব্রিটিশরা চাইত, ভারতীয়রা নিজেরা নিজেদের নিন্দা করুক, আর আমাদের গুণকীর্তন করুক; স্বাধীন দেশে ব্রিটিশরা না চাইতেও তাই ঘটলো। ব্রিটিশ শাসন দেশীয়দের কাছে দেশীয়দের শাসনের চেয়ে ভালো মনে হতে শুরু করলো। ফলে এখন কিছু সময় যুক্তিসঙ্গত কারণে আর বহুসময়ে যুক্তিহীনভাবে আমরা নিজেরা নিজেদের নিন্দা না করে পারি না। ব্রিটিশরা যে অভ্যাসটা গড়ে দিয়ে গিয়েছিল, সেটা ছাড়তে পারি না সত্যিকার অর্থে আমাদের সরকারগুলির অযোগ্যতার কারণে। হ্যাঁ, যোগ্যতা তাদের একটাই, নিজের জনগণকে অসম্মান করা, অত্যাচার করা, তাদের বাকস্বাধীনতা হরণ করা আর নিজেদের সম্পর্কে নির্লজ্জের মতো বড় বড় বুলি দেয়া। বিভিন্ন সরকারগুলির দুর্নীতির কথা আর নাইবা তুললাম।
ফিরে আসি প্রবাসীদের প্রসঙ্গে। সব ঠিকঠিক ছিল, প্রবাসীদের নিয়ে কোনো ক্ষোভ দেশীয় কারো মনে ছিল না। কিন্তু হজ্জ্বক্যাম্পে তাদের রাখার ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্টরা চরম অব্যাস্থাপনা আর দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিলেন। স্বভাবতই, প্রবাসীরা ক্ষেপে গেল। ক্ষেপে যাবার কথা, আর ক্ষেপে যাবার পক্ষে প্রবাসীরা চমৎকার যুক্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু কথায় বলে, ‘ক্রোধ মানুষের পরম শত্রু’, ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন’। সবার বক্তব্য ঠিকই ছিল কিন্তু একজন মাথাগরম করে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হতে সাহায্য করলো। তার বক্তব্য ঠিক, যুক্তি ঠিক, কিন্তু আচরণ বা কথা বলার ভঙ্গি ঠিক ছিল না।
কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশের মানুষ প্রবাসীদের পক্ষ নিয়েছিল। প্রবাসীদের পক্ষে নানাভাবে মন্ত্রীকে সমালোচনা করেছে, ব্যঙ্গ করেছে। বাংলাদেশে বসে সেসব ব্যঙ্গ করার ঝুঁকি ছিল। কিন্তু প্রবাসী ভাইদের জন্য তারা তা করেছে। সরকারও তাতে একটা কোণঠাসা অবস্থায় পড়ে গেল। বাইরে বসে তারপর এক প্রবাসী ভয়াবহ মাথাগরম করে উগ্রভাবে যা বলল, তাতে যুক্তি ছিল কিন্তু ভব্যতা ছিল না। খুব দৃষ্টিকটু আর শ্রুতিকটু ছিল তার ভঙ্গি। ব্যক্তিগতভাবে আমার তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও মনে হয়েছে। সরকার তারপর আর প্রবাসীদের ব্যাপারে কঠোর মনোভাব নিতে চায়নি। আবার সঠিক যেসব পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল তা নিতে পারেনি। সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারার অপারগতা আর পাশাপাশি প্রবাসীদের কিছু কাজকর্ম দেশীয়দেরকে আতঙ্কগ্রস্থ করে তুলেছিল। সেই প্রেক্ষিতে দেশীয়রা সরকারের যেমন সমালোচনা করেছে, তেমনি প্রবাসীদের উপর বিরক্ত হয়েছে।
কথাটা সত্যি যে, প্রবাসীদের দ্বারা বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভবনা ছিল। বাইরে থেকে কেউ বহন করে না আনলে তা এখানে ছড়াবার কারণ নূন্যতম ঘটতে পারতো। ফলে প্রবাসীদের দেশে ফেরার পর যাতে কারো শরীরের সুপ্ত ভাইরাস না ছড়াতে পারে, সেক্ষেত্রে প্রবাসীদেরই কিছু দায়দায়িত্ব থেকে যায়। প্রবাসীরা বিরাট অংশ তা মোটেই পালন করেনি। কিন্তু প্রবাসীদের কাছ থেকে সকলে সেটা আশা করেছিল। প্রবাসীদের ভ্রান্তির কারণে এবং তারচেয়ে অনেক গুণ বেশি সরকার পক্ষের দায়দায়িত্বহীনতার কারণে বর্তমানে করোনা ভাইরাস অনেকটা ছড়িয়েছে তার কিছু কিছু প্রমাণ মিলছে। ফলে মহাবিপদে আতঙ্কিত কিছু মানুষ কিছু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে প্রবাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয় তাদের প্রতি প্রবাসী হিসেবে ঘৃণা থেকে এটা করা হয়নি, নিজেদের বা সকলের বিপদ কাটিয়ে তুলবার জন্য করা হয়েছে। কাজটা সুন্দর বা যথাযথ হয়নি স্বীকার করছি। কিন্তু সেসব নিয়ে যুক্তিপূর্ণ আলোচনা না করে, বিদেশি-বিদেশি এসব প্রশ্ন উচ্চারণ করলে মানুষের মধ্যে নানান বিভেদ আরম্ভ হবে। ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বা অন্যান্য দাঙ্গার কারণ মনের ভিতরে সৃষ্টি হওয়া এসব বিভেদ।
সকলের কাছে অনুরোধ থাকবে, যেন সব ব্যাপারে গঠনমূলক কথা বলি। প্রবাসীরা কোনো না কোনো দেশীয় মানুষের ভাই বা আত্মীয়। ফলে দেশি আর প্রবাসী প্রসঙ্গ টেনে আনলে বিরোধটা হবে ভাইয়ে ভাইয়ে। সুবিধা পাবে অন্যরা। প্রবাসী হিসেবে ভাইরা ভুল করলে সমালোচনা করা যাবে না, এটা যেমন ঠিক না। আর ভাই ভাইয়ের কাছে দোষ করলে ক্ষমা চেয়ে নেবে।