আমিনুল ইসলাম বাদশা

আমিনুল ইসলাম বাদশা

বাদশা ভাইয়ের সঙ্গে হেঁটেছি আমি

তারেক মাহমুদ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২০

আমিনুল ইসলাম বাদশা। প্রখ্যাত বাম রাজনীতিক। তখনো ঢাকা আসিনি। পাবনা থেকেই তার নাম শুনে শুনে বড় হয়েছি। সম্পর্কে তিনি আমার নানা হন। কিন্তু কখনো দেখা হয়নি। তার অনুজপ্রতিম রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলেন আরেক ত্যাগী রাজনীতিক শফি আহমেদ। ডাকসুর জিএস ছিলেন ষাটের দশকে। ১৯৯১ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি পরলোকগমন করেন। সম্পর্কে তিনি আমার মায়ের মামা ছিলেন। অর্থাৎ আমার নানা।

আমিনুল ইসলাম বাদশার সাথে আমার সরাসরি পরিচয় হয় ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকের কোনও একদিনে। আমি শফি আহমেদ স্মরণে একটা লেখা দিতে গিয়েছিলাম দৈনিক সংবাদ অফিসে। প্রসঙ্গত: উল্লেখ থাকে যে, আমি ১৯৯৩ সালে ঢাকা চলে আসি কবি হওয়ার জন্য। পাশাপাশি পড়াশোনার জন্য ভর্তি হই ঢাকা সরকারি তীতুমীর কলেজে বিএসসিতে। ঢাকাতে আমার প্রতিদিনের প্রধান কাজ ছিল বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে ঘোরাঘুরি করা, লেখা দেয়া আর আড্ডা দেয়া। তখন কয়েকটি দৈনিকে আমি নিয়মিত লিখতাম ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। ওটাই ছিলো আমার আয়ের উৎস। বিশেষ করে দৈনিক সংবাদ, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক ভোরের কাগজ, দৈনিক আজকের কাগজ ইত্যাদি। অন্যান্য সাহিত্য পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনে তো অবশ্যই লিখতাম। নিজেও একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করি পথিক নামে। সেটা ১৯৯৭ সালের কথা।

সন্তোষ’দার (প্রখ্যাত সাংবাদিক, লেখক, প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যাক্তিত্ব সন্তোষ গুপ্ত) সাথে আমার আগে থেকেই আলাপ ছিলো। মূলত: ওই লেখাটি সন্তোষ’দাকেই দিতে গিয়েছিলাম। তার হাত দিয়েই আমার বেশির ভাগ লেখা সংবাদে প্রকাশিত হতো।

সন্তোষ’দা যেখানে বসতেন তার দরোজা পেরোলেই একটা ছোট খোলা প্যাসেজ ছিল। সেখানে প্রাচীন আমলের একটা কালো রঙের সোফা ছিল। দেখলাম, সন্তোষ’দা সেখানে বসেই আয়েশে ধূমপান করছেন। তার পাশে তারই সমবয়সী এক দৃঢ়চেতা ভদ্রলোককে দেখলাম। সন্তোষ’দা আমাকে বসতে বললেন। ভদ্রলোককে দেখলাম। শ্যামা বর্নের, ক্লিনশেভড, ব্যাকব্রাশ করা চুল, মাঝারি উচ্চতা। কিন্তু কণ্ঠে খুব দৃঢ়তা। সন্তোষ’দার সঙ্গে কথা বলছেন হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে। অনেক আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গিতে। বয়স প্রায় ৭০-এর কোঠায় হলেও তারুণ্যে ভরপুর। সেটা প্রথম পরিচয়ের সুবাদে হ্যান্ডশেক করেই বুঝলাম। সন্তোষ’দাই আমাকে আলাপ করিয়ে দেন। আমি বিস্ময় চোখে দেখলাম আমার ছোটবেলায় গল্পে শোনা মানুষটিকে। তিনিও আমার পরিচয় শুনে আপন করে নিলেন।

এরপরে তার সাথে একসাথে হেঁটেছি অনেক। তার সাথে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে গিয়েছি। কখনো হেঁটে, কখনো রিকশায়। কখনো কমিউনিস্ট পার্টির পুরনো টিনের অফিস, কখনো প্রেসক্লাব, টিসএসসি, শাহবাগ, পল্টন। বিভিন্ন জায়গায়। সেসব ছোটবড় সভা সেমিনারে তিনি বলেছেন আমরা শুনেছি, আমি শুনেছি।

পরিচয়ের কিছুদিন পরেই তাকে বাদশা ভাই নামেই সম্মোধন করতাম। নানা বলার চাইতে এই নামটিকেই তিনি অনুমোদন করেছিলেন। তার সাথে রাজধানীর বিভিন্ন পথে হেঁটেছি আমি। অনেক কথা বলেছি। তিনি আমার তৎকালীন বয়সের তুলনায় প্রায় ৫০ বছরের বড়। কিন্তু মনে হয়েছে, আমরা একই বয়সী। একই বয়সী মানুষের মতো কথা বলতাম, হাঁটতাম, সম্পর্কের কারণে জড়তা কাজ করেনি কখনো।

একবার পল্টন থেকে হাঁটতে হাঁটতে তার সাথে তার পাবনা কলোনির বাসায় গিয়েছিলাম। পল্টন, বিজয়নগর, কাকরাইল, শান্তিনগর, মালিবাগ, শান্তিবাগ ছাড়িয়ে পাবনা কলোনি। এতটা পথ হাঁটতে হাঁটতে কত কথাই না বলা হয়েছিল। সেই বিকেল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাত। আমি আর বাদশা ভাই। দুজনে বলছি দুজনেই শুনছি। কত ঐতিহাসিক কথা শোনাতেন তিনি। আমি অবুঝ বালকের মতো প্রশ্ন করে যেতাম তারপর কি হলো... তারপর... তারপর... তখন আপনি কি করলেন... আর কে কে ছিল... তারপর... ইত্যাদি।

পাবনা কলোনির বাসায় তিনি নিজ হাতে আমাকে চা বানিয়ে খাইয়েছিলেন। বাদশা ভাই রান্নাঘরে চা বানাচ্ছেন আর আমি তার বসার ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইয়ের গন্ধ নিচ্ছি। সেই গন্ধের মধ্যে জড়িয়ে আছে খাপড়া ওয়ার্ড. ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট, মুক্তিযুদ্ধ আরো কত সময়, আরো কত আন্দোলনের ইতিহাস।

আমরা ভুলে যাই সবকিছু। নতুন কিছু দেখলে আমরা হাত বাড়িয়ে দেই, পুরনোকে ভুলে যাই। কিন্তু একবারও ভাবি না এই নতুনের আগমনের পেছনে পুরনোর অবদান কতখানি।

আমিই তো শেষ কথা নয়। এই যে আমাকে দেখতে পাচ্ছো এটা তো সবটুকু নয়। আমাকে পুরোপুরি দেখতে হলে জানতে হলে চিনতে হবে আমার পিতাকে, পিতামহকে, প্রপিতামহকে। আরো আরো পেছনে। যত অতীতে যাবে তত বেশি স্বচ্ছ হয়ে উঠবে আমার পরিচয়।

আর তাই আজকের বাংলাদেশকে জানতে হলে জানতে হবে আমিনুল ইসলাম বাদশাকে, তার সহযোদ্ধাদেরকে। তাদের ত্যাগের উপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের বাংলাদেশ, এ কথা এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলে গেলে চলবে না।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা