বিনয় মজুমদার: কবিতার বোধিবৃক্ষ

পর্ব ১

মলয় রায়চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৯

আমার মনে হয়েছে, গাণিতিক সৌন্দর্য তত্ত্বের ওপর বিনয় মজুমদার গড়ে তুলেছেন তাঁর চারটি সাব-জনারের (sub-genre) কবিতার বনেদ, ‘ফিরে এসো, চাকা’, ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’, ‘বাল্মীকির কবিতা’ এবং হাসপাতালে ও শিমুলপুরে দিনযাপনের খতিয়ান ‘শিমুলপুরে লেখা কবিতা’, ‘কবিতা বুঝিনি আমি’, ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ , ‘ছোটো ছোটো গদ্য ও পদ্য’ আর ‘পৃথিবীর মানচিত্র’। ‘ফিরে এসো, চাকা’ ছিল বাংলা সাহিত্যে ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণের সঙ্গে তুলনীয়, এবং পরবর্তী সাব-জনারগুলো প্রতিবার নতুন স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে।

গণিতের সৌন্দর্যে সমর্পিত তিনি নান্দনিক তৃপ্তি পান, গণিতের নির্দিষ্ট রূপকে সুন্দর মনে করে আনন্দ উপভোগ করেন, দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার মাঝেও তিনি হর্ষের মনন-জগতে বসবাস করেন। যাঁরা বিনয় মজুমদারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তারা জানেন যে, উত্তর দেবার সময়ে তিনি হঠাৎই রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে উঠতেন, এবং শিমুলপুরে থাকাকালীন কয়েকটি গানও রচনা করেছিলেন। ওমর খৈয়াম ও এমিলি  ডিকিনসনও গণিতের সৌন্দর্যের বনেদে গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের কাব্য। গণিতের সাথে কবিতা ও সঙ্গীতের, এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মের আরাধ্য পুস্তকগুলোর গাণিতিক লেখনবিন্যাসে (যেমন বাইবেল, কোরআন, জেন্দাভেস্তা, গীতা, ত্রপিটক, গুরুগ্রন্হ, তোরা, তালমুদ, কিতাব-ই-আকদাস, অগমসমূহ, কোইজিকি ইত্যাদি) পার্থক্য খুঁজে পান না গণিত ও কবিতার বিস্ময়ে আক্রান্ত বেশ কয়েকজন গণিতবিদ।

কবিতা ও সঙ্গীতের মতো তাঁদের মননে গণিত অনির্বচনীয়, তা ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি ক্রিয়ায় বিদ্যমান। গাণিতিক সৌন্দর্যের বিখ্যাত উদাহরণটি হলো পিথাগোরাসের উপপাদ্যটি। বিনয় মজুমদারের সঙ্গে জীবনানন্দের প্রধান তফাত এখানেই। বিনয় দারিদ্র্য, দুঃখ, কষ্ট, অবহেলা, অসুস্থতা, নিঃসঙ্গতা সত্ত্বেও থাকতেন আনন্দের প্রভায় জ্যোতির্ময়। কবিতাকে জীবনের সঙ্গে একাত্ম করেছেন তিনি। তাঁর কাছে অনেকেই জানতে চাইতেন ‘কবিতা কী?’ বিনয় ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হে বলেছেন, “কবিতা কী তা বলা অসম্ভব। কেন? বলুন তো আপনি কী? আপনি কি একশো কোটি বছর আগে থেকে পৃথিবীতে আছেন? আপনি মরলে কি যে-কোনো অবস্থায় হোক প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন? আপনি যখন আলুডাল খান, এই আলুডাল পাকস্থলিতে গিয়ে হজম হয়ে শেষে প্রাণবন্ত মাংস হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, পাকস্থলিতে জড়বস্তু আলুডাল প্রাণবন্ত হচ্ছে অর্থাৎ পাকস্থলিতে প্রাণ সৃষ্টি হচ্ছে।

এই তত্ত্বে কি আপনি বিশ্বাস করতে পারেন? যদি না পারেন তবে আপনার প্রাণ কী? এইভাবে দেখা যাবে যে, আপনি নিজের সম্বন্ধে কিছু কথা জানেন না। নিজেকেই পুরোপুরি জানেন না আপনি। তাহলে কবিতা কী তাও আপনার জানা অসম্ভব।

২০০০ সালে প্রকাশিত ডেভলিন কিথ তাঁর ‘ডু ম্যাথেমেটিশিয়ানস হ্যাভ ডিফারেন্ট ব্রেইনস’ গ্রন্হে হাঙ্গরিয় গণিতবিদ পল এরডস-এর এই উদ্ধৃতির মাধ্যমে গণিতের সঙ্গে সঙ্গীতের সম্পর্ক স্পষ্ট করেছেন, Why are numbers beautiful ? It is like asking why is Beethoven’s Ninth Symphony beautiful. If you do not see why, someone can not tell you. If they are not beautiful, nothing is.

১৯১৯ সালে বারট্রাণ্ড রাসেল তাঁর ‘দি স্টাডি অফ ম্যাথেম্যাটিক্স’ গ্রন্হে লিখেছিলেন, Mathematics, rightly viewed, possesses not only truth, but supreme beauty— a beauty cold and austere, like that of sculpture; without appeal to any part of our weaker nature, without the gorgeous trappings of painting or music, yet sublimely pure, and capable of a stern perfection such as only the greatest art can show. The true spirit of delight, the exaltation, the sense of being more than Man, which is the touchstone of the highest excellence, is to be found in mathematics as surely as poetry.

আইনস্টাইন বলেছিলেন, Pure mathematics is, in its way, the poetry of logical ideas. চলবে