বিশ্বজয়ী হও

পর্ব ৬

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুন ২৮, ২০২০

মানুষ যাই করতে যাক না কেন, তার জন্য প্রথম যে বস্তুটির প্রয়োজন তা হলো সাহস। সাহস অবলম্বন না করলে একটি পদক্ষেপও ফেলা যায় না। জীবনটা ঝুঁকি নেয়ার জন্য। প্রতি পদক্ষেপে বিপদ আসতে পারে। প্রতি মুহূর্তে মনে হতে পারে, এই বুঝি মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হয়েছে। মৃত্যু আজই আসুক, আর অনন্তকাল পরেই আসুক, মৃত্যু আসবেই। তা চিরন্তর সত্য। সুতরাং সর্বপ্রকার মৃত্যুভয় ত্যাগ করো, সাহস অবলম্বন করো। তবে এর অর্থ এই নয় যে, আগুনে গিয়ে ঝাঁপ দিব, চলন্ত ট্রেনের সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াব, কিংবা বিপদজনক ইলেকট্রিক তারে ঝুলে নিজের বাহাদুরি দেখাব। সাহস অবলম্বনের অর্থ, চেষ্টা করলে অসাধ্য বলে কিছু নেই, এ কথার বিশ্বাস স্থাপন করা।

অধুনা মূসা ইব্রাহীম থেকে শুরু করে প্রথম হিমালয়ের শিখর স্পর্শ করা এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগেসহ সকলেই এই বিশ্বাস মনের মাঝে স্থাপন করেছিলেন যে, তারা হিমালয় জয় করতে পারবে এবং এ বিশ্বাস বলে মৃত্যুভয় পর্যন্ত তুচ্ছ করে, শত বাধা-বিপত্তি, আপদ-বিপদকে দু`পায়ে মাড়িয়ে তারা এগিয়ে গিয়েছে বলেই তারা সফল হয়েছে। সাহস কি না করতে পারে। সাহস সর্বশক্তিমান। স্বামীজি বলতেন, ভয় পেও না, কারণ মনুষ্যজাতির ইতিহাসে দেখা যায়, সাধারণ লোকের ভিতরেই যত কিছু মহাশক্তির প্রকাশ হয়েছে, জগতে যত বড় বড় প্রতিভাশালী পুরুষ জন্মেছেন, সবই সাধারণ লোকের মধ্য থেকে; আর ইতিহাসে একবার যা ঘটেছে, পুনরায় তা ঘটবে। কিছুতেই ভয় পেও না। তোমরা বিস্ময়কর কাজ করবে। যে মুহূর্তে তোমাদের হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার হবে, সেই মুহূর্তেই তোমরা শক্তিহীন। ভয়ই জগতের সমুদয় দুঃখের মূল কারণ, ভয়ই সর্বাপেক্ষা বড় কুসংস্কার; নির্ভীক হলে মুহূর্ত মধ্যেই স্বর্গ আমাদের করতলগত হয়। তোমরা যদি আমার সন্তান হও, তবে তোমরা কিছুই ভয় করবে না, কিছুতেই তোমাদের গতিরোধ করতে পারবে না। তোমরা সিংহতুল্য হবে। সমগ্র জগৎকে জাগাতে হবে। এ না করলে চলবে না, কাপুরুষতা চলবে না, বুঝলে?

বাংলার প্রথম মুসলিম শাসক ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি বিশ্বাস করেছিলেন তিনি বাংলা জয় করতে পারবেন, এবং সেই আত্মবিশ্বাস বলে মাত্র কয়েকজন অশ্বারোহীকে নিয়ে বাংলা জয় করবার সাহস করেছিলেন এবং তিনি জয়ী হয়েছিলেন। লক্ষণ সেন ভীরু ছিলেন। কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা না গড়েই অজানা আশঙ্কা আর ভয়, হ্যাঁ, শুধুমাত্র ভয়ই তাকে সিংহাসনচ্যুত করেছিল। ইতিহাস থেকে বিজ্ঞান, ধর্ম থেকে রাজনীতি সর্বত্রই সাহসিকতার জয়। একদা এক ভদ্রজনকে স্বামীজি বলেছিলেন,‘বীরের মতো এগিয়ে চলুন। একদিনে বা এক বছরে সফলতার আশা করবেন না। সর্বদা শ্রেষ্ঠ আদর্শকে ধরে থাকুন। দৃঢ় হোন, ঈর্ষা ও স্বার্থপরতা বিসর্জন দিন। নেতার আদেশ মেনে চলুন; আর সত্য, স্বদেশ ও সমগ্র মানবজাতির কাছে চিরবিশ্বস্ত হোন; তাহলেই আপনি জগৎ কাঁপিয়ে তুলবেন। মনে রাখবেন ব্যক্তিগত ‘চরিত্র’ এবং ‘জীবন’ই শক্তির উৎস, অন্য কিছু নয়।

কোন রাজা কাপুরুষ ছিল, বলো তো? যে ভয় পেয়েছে সে তৎক্ষণাৎ সিংহাসনচ্যুত হয়েছে। কোন ধর্ম প্রচারক ভীরু ছিল? যে ভীরু ছিল সে ধর্ম প্রচারক হয়নি। পৃথিবীর সব ধর্ম প্রচারকই ছিলেন অসীম সাহসী। তাঁরা একটি মতকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছেন এবং তা সকলের মাঝে প্রকাশ করবার সাহস করেছেন। সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে মৃত্যুভয় অবধি তুচ্ছ করে তারা এগিয়ে গিয়েছেন এবং মহৎ হয়েছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ভয় পেয়ে যে সৈনিক পিছু হটে, আমরা তাকে দেশদ্রোহী বলি, ঘৃণার বিষবাষ্প নিক্ষেপ করি তার উপর। আর যে সাহস অবলম্বন করে যুদ্ধ করে। নিজের প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দেয়, আমরা তাকে বীরশ্রেষ্ঠ বলি। শ্রদ্ধায় আমাদের মস্তক নত করি তাদের নাম পর্যন্ত শুনলে।

আর আমাদের জীবনতো একটি যুদ্ধক্ষেত্রই। প্রতি মুহূর্তে আমরা প্রকৃতি, সমাজ, রোগ-শোক, জরা-ব্যাধি সব কিছুর সাথে যুদ্ধ করছি। যতক্ষণ এসব প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে পারছি ততক্ষণই জীবন। যখনই ব্যর্থ হচ্ছি তখনই মরণ। প্রতি মুহূর্তে আমাদের মাথার প্রতি বর্গইঞ্জি জায়গার উপর সাত কেজি বাতাস চাপ প্রয়োগ করছে। বলছে, তোমায় আমি শির উঁচু করে দাঁড়াতে দেব না। আমার শরীর বলছে, আত্মা বলছে, না। তুমি যতই বল প্রয়োগ কর না কেন, আমি উঠে দাঁড়াব। আমার দেবত্ব প্রকাশ করব। বাতাসের বাঁধা তুচ্ছ মনে করছে এ দেহ। অভিকর্ষজ বল তোমাকে উঁচুতে উঠতে বাধা দিচ্ছে। তুমি তার সাথেও বিদ্রোহ করছ। উঁচুতে উঠতে উঠতে আজ মঙ্গলগ্রহ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তোমার প্রযুক্তি। চারপাশের ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক সহ লাখো জীবানু দেহের ভিতর-বাহির সদা-সর্বদা আক্রমণ করছে। দেহ তাদের সহস্র আক্রমণ সহ্য করেও বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে।

স্বামীজি বলতেন, কখনও ভেবো না প্রকৃত মানুষের পক্ষে কিছু অসম্ভব। এরূপ বলা ভয়ানক নাস্তিকতা। যদি পাপ বলে কিছু থাকে, তবে ‘আমি দুর্বল’ বা ‘ওরা দুর্বল’ এরূপ বলাই একমাত্র পাপ। মানুষের জন্ম প্রকৃতিকে জয় করবার জন্যই, তাকে অনুসরণ করবার জন্য নয়।

তুমিতো দেখেছ, আমাদের দেহ কিন্তু মোটেও ভীরু নয়। মোটেও দুর্বল নয়। দুর্বল আমাদের মন। অসীম ক্ষমতার আত্মা আর ভীষণ সাহসী দেহকে সঙ্গে নিয়েও দুর্বল আমাদের মন। কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার তাই না! কিন্তু এটা সত্য যে আমরা ভয় পায় এবং এটাও সত্য যে আমাদের ভয় আসে অজ্ঞানতা থেকে।

তুমি যদি যুদ্ধ সম্পর্কে যথোপযুক্ত ট্রেনিংপ্রাপ্ত একজন যোদ্ধা হও তবে যুদ্ধভীতি তোমার থাকবে না। কারণ রণকৌশল সম্পর্ক জ্ঞান আছে যে তোমার। তুমি যদি একজন শৈল্যশাস্ত্রবিদ হও, তবে মানুষের বুক চিরে তার পাজর স্পর্শ করতে তোমার ভয় থাকবে না। কারণ তুমি জান এভাবে একজন রোগীকে সুস্থ করে তুলতে হয়।

অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে ভয় আসে অজ্ঞানতা থেকে। আচ্ছা বলতো, আমরা রাত্রে ভয় পায় কেন? কারণ রাত আমাদের জন্য অজ্ঞানতায় পরিপূর্ণ। রাত্রে সর্বত্র অন্ধকারের কারণে আমরা কিছু দেখতে পাই না। তাই কাটা কলাগাছের সাদা খোলসকে ভূত, পেঁচার ডাককে প্রেতের কান্না, ব্যাঙের লাফ দেওয়াকে সাপের আনাগনা ও বিপদমুক্ত রাস্তাকে সহস্র বিপদের আশঙ্কায় আমাদের মনকে ভারী করে তুলি।

কিন্তু যদি এমন হতো, রাত্র দুইটায় যখন সবাই ঘুমিয়ে আছে এবং একা বন পথে তুমি যাচ্ছ তখন হঠাৎই সময়টা দুপুর দুটো হয়ে গেল, তাহলে দেখবে তুমি ভয় পেতে না। আমরা দশজনের সাথে থাকলে, কিংবা রাত্রে বিরাট আলো জ্বাললে ভয় পাই না, কারণ তখন আমাদের মন সাহসী হয়ে যায়। সে ভাবে আমি সহজে বিপদে পড়ব না।

অর্থাৎ আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে, মন থেকে সাহসের উৎপত্তি হয় এবং মনে সেই সাহসের সঞ্চার করে জ্ঞান। সুতরাং সাহস অবলম্বন করতে হলে আমাদের প্রথম জ্ঞানী হতে হবে এবং সে জ্ঞান আসবে বই পড়ে, দেশ ভ্রমণ করে, জ্ঞানী মানুষের সাথে মিশে, নানান কলাকৌশল, শিল্প, সাহিত্য সঙ্গীত আমাদের করায়ত্ব করে।

এছাড়াও যখন আমরা বই পড়ি তখন বই এর মূল্যবান কথা বা তথ্যগুলো অন্য নোটবুকে লিখে রাখা উচিত। একই ভাবে কোন স্থান ভ্রমণের আগে সেখানকার ইতিহাস ভালভাবে পড়ে নেওয়া ভাল। ভ্রমণকালে ঐ স্থানের সঙ্গে যুক্ত বিশেষ বিশেষ তথ্য নোট বইতে লিখে রাখা উচিত। আর এতসব করতে পারবে যদি তোমার দেহ ও মন পুষ্ট হয়। আমরা ভাল খাবার খাই দেহটাকে সবল করবার জন্য, কিন্তু ভাল সংস্কৃতির চর্চা করি না মনকে সবল করবার জন্য।

রবীন্দ্রনাথ বলতেন,‘সংস্কৃতি হচ্ছে একটা কলসের মত, আমরা যে লেখাপড়া করি তা এই কলসে এসে জমা হয়। যাদের সংস্কৃতি নেই তাদের জ্ঞান জমা রাখবার কোন পাত্র নেই। তারা যতই লেখাপড়া করুক না কেন, তাদের সে পড়া গড়িয়ে বের হয়ে যায়। আমাদের চারপাশে আমরা কি তাদের দেখি নে?’

মনে রেখ, বই পড়া আর ভ্রমণ এগুলো যেমন মানুষকে জ্ঞানী করে তোলে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি তেমনি মানুষকে মহৎ করে তোলে। তুমি যদি মহৎ না হও, তবে তোমার ঐ সাহস কোন মানব কল্যাণে লাগবে না। চোর-ডাকাত, গুণ্ডা-বদমাশ, এদেরও সাহস আছে, তবে তা সৎ সাহস নয়, অসৎ সাহস, দুঃসাহস। হিটলারও সাহসী ছিলেন, তবে আমরা তাকে ঘৃণ্য মানুষ মনে করি। অপর দিকে নেতাজি সুভাস চন্দ্র বোসও সাহসী ছিলেন। আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি। বঙ্গবন্ধু যদি পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীকে ভয় পেতেন তবে আমরা স্বাধীনতা পেতাম না। সক্রেটিস যদি ভয় পেতেন তবে আমরা বিজ্ঞানের সঠিক তথ্য জানতে পারতাম না। ভয়ই মৃত্যু। ভয়ই সমস্ত পশ্চাৎপদতার কারণ।

স্বামীজির ভাষায়, বীরভোগ্যা বসুন্ধরা বীরই বসুন্ধরা ভোগ করে, এ-কথা ধ্রুব সত্য। বীর হ, সর্বদা বল্ ‘অভীঃ, অভীঃ। (আমার ভয় নেই, আমার ভয় নেই)। ভয়ই মৃত্যু, ভয়ই পাপ, ভয়ই নরক, ভয়ই অধর্ম, ভয়ই ব্যাভিচার। সর্বদা দুর্বলতার বিষয়ে ভাবা দুর্বলতার প্রতিকার নয়, শক্তির কথা স্মরণ করাই প্রতিকারের উপায়।

জীবনের পরম সত্য এই শক্তিই জীবন, দুর্বলতাই মৃত্যু। শক্তিই সুখ ও আনন্দ; শক্তিই অনন্ত ও অবিনেশ্বর জীবন; দুর্বলতাই অবিরাম দুঃখ ও উদ্বেগের কারণ; দুর্বলতাই মৃত্যু। তোমরা সকলে ভাব, ‘আমরা অনন্ত বলশালী আত্মা (সত্তা)’; দেখ দিকি কি বল বেরোয়। ‘দীনহীনা!’ কিসের ‘দীনহীনা’? কিসের রোগ, কিসের ভয়, কিসের অভাব? ‘দীনহীনা ভাবকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় কর দিকি। সব মঙ্গল হবে। নেতিবাচক ভাবের কিছু থাকবে না, সবই ইতিবাচক ভাব হওয়া চাই, যথাঃ আমি আছি, ঈশ্বর আছেন, আর সমুদয় আমার মধ্যে আছে। আমার যা কিছু প্রয়োজন, স্বাস্থ্য, পবিত্রতা, জ্ঞান সবই আমি আমার ভিতর অভিব্যক্ত করব।

সাহস অবলম্বন কর ও কাজ করে যাও। ধৈর্য ও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাও, এই একমাত্র উপায়। সাহস অবলম্বন কর- বিশ্বাস কর, আমরাই মহৎ কাজ করব, এই গরিব আমরা যাদের লোকে ঘৃণা করে, কিন্তু যারা লোকের দুঃখ যথার্থ প্রাণে প্রাণে বুঝেছে। রাজা-রাজড়াদের দিয়ে মহৎ কাজ হবার আশা খুব কম।

যে জাতির মনে সাহস নেই, সে জাতি কখনও উন্নত হতে পারে না। কশ্মিনকালে হবেও না। ছোটবেলা থেকে আমরা শিশুদের ভয় পাইয়ে ঘুম পারাই। ভয় দেখিয়ে খাবার খাওয়াই ও মারের ভয়ঙ্কর দৃশ্য চোখের সামনে উপস্থাপন করে আমাদের কথা শুনতে বাধ্য করি। আরে ঐ শিশু বড় হয়ে কাপুরুষ হবে না তো কে হবে? ছোটবেলা থেকে শিশু-কিশোরদের মনে এমন সব চিস্তা প্রবেশ করুক যা তাদেরকে সাহসী করে তুলবে। ভয় ও মন দুর্বল করা কোন কথা যেন তাদর স্বপ্নেও না আসে।

বন্ধুরা সাহস না থাকলে পরীক্ষায় পাশ করা যায় না, স্টেজে উঠে গান, কবিতা, বক্তৃতা তো নয়ই। একজন ব্যক্তি যদি মনে করে আমি ভাল পারফর্ম করছি, তাহলে সে ভাল করবে। আর যদি ভাবে আমি খারাপ করছি এবং মনে করতে থাকে এ অনুষ্ঠনের শেষে সবাই কতই না আমাকে খারাপ বলবে, তবে সে খারাপই করবে। আরে ভাই তুমি তো স্টেজে উঠেছ। যারা তোমার নিন্দা করবে বলে ভাবছ তারা তো স্টেজেই উঠতে পারেনি, তবে তাদের সমালোচনায় তুমি কান দিবে কেন?

মনে রেখ, সহাস বলপ্রদ। সাহস শক্তিদায়ী? সাহসই সমস্ত কার্যের শুভ সূচনা করে ও সফল ভাবে শেষ করতে সাহায্য করে। বন্ধুগণ সৎকাজে সাহস অবলম্বন কর। কখনই অসৎ কাজে নয়, নিশ্চয়ই তুমি মহান হবে। চলবে