ব্রিটিশ শাসনের সুফল এবং বাংলার সমাজ-সংস্কার

পর্ব ১

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৯, ২০২১

ব্রিটিশ শাসনের কুফল নিয়ে সর্বদা আলোচিত হয়। সন্দেহ নেই যে, সেটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। ব্রিটিশ শাসনের কুফল আজও ভোগ করছে ভারতবাসী। কিন্তু তারপরেও ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে যে আলোচনা হয় না, তা নয়। যথেষ্ট মানুষ আছে, যারা ব্রিটিশ শাসনের গুণগান গেয়ে থাকেন। প্রথম দিকের নবজাগরণের প্রায় সকলেই ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে কলম ধরেছিলেন। পরে সে ধারাটা পাল্টে যায়। নবজাগরণবাদীরা যে খুব সঠিক পথে ব্রিটিশ শাসনের মূল্যায়ন করেছিলেন, ব্যাপারটা তা নয়। নবজাগরণবাদীরা ব্রিটিশ শাসনকে দেখেছেন মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিদাতা হিসেবে। নবজাগরণবাদীদের সে মূল্যায়ন ছিল সাম্প্রদায়িক দোষে দুষ্ট। সে মূল্যায়ন ভারতে হিন্দু-মুসলমান সম্পকর্কে খুব ভিন্ন পথে টেনে নিয়ে এক পক্ষকে আরেক পক্ষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ব্রিটিশরা নবজাগরণবাদী বর্ণহিন্দুদের এটা করতে প্রথম উস্কে দিয়েছিল। কিন্তু খুব শীঘ্রই ব্রিটিশ শাসন কমবেশি হিন্দুদের বর্ণবাদের বিরুদ্ধে চলে যায়।

সকল শাসনের ভয়াবহ খারাপ দিক যেমন থাকে, কিছু সুফলও থাকে। দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের সকল খারাপ পর্বের পরেও কিছু সুফল তো ছিলই। সেটার একটা মূল্যায়ন করা যেতে পারে। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সবচেয়ে সুফলগুলি এসেছে চিন্তার ক্ষেত্রে। ব্রিটিশ শাসন ভারতের অর্থনীতিতে ভয়াবহ ধস নামিয়ে দিলেও চিন্তার ক্ষেত্রে ইতিবাচক আর নেতিবাচক দু’রকম ফলাফল রেখেছিল। মুসলমানদের চেয়ে বর্ণহিন্দুরা সেসব চিন্তার সুফলগুলি লাভ করেছিল অনেক বেশি। হিন্দুদের দীর্ঘদিনের ভয়াবহ কুসংস্কারগুলির উপর তীব্র আঘাত হেনেছিল ব্রিটিশ শাসন। মুসলামানদের উপর সেই তুলনায় ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব খুবই কম। ব্রিটিশরা প্রথম ক্ষমতা দখল করে বাংলার। ব্রিটিশ শাসন আসার পরপর বাংলায় অনেকগুলি সমাজ সংস্কারের আন্দোলন ঘটে। সবগুলি সমাজ সংস্কার ঘটেছিল হিন্দু ধর্মকে ঘিরে। বিধবা বিবাহ চালু করা, সতীদাহ নিষিদ্ধ করা, নারীদের জন্য শিক্ষার আয়োজন করা, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা; বাংলার এসব আলোচিত সমাজ সংস্কার আন্দোলনগুলির সঙ্গে মুসলমানদের সামান্য সংযোগ ছিল না।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সবগুলি সমাজ সংস্কার আন্দোলনই ছিল হিন্দু ধর্মের নারীদের কেন্দ্র করে। বিশেষ করে বর্ণহিন্দুদের বা ভদ্রসমাজের নারীর মুক্তির প্রশ্নে রামমোহন আর ইশ্বরচন্দ্র শর্মা বিরাট ভূমিকা রাখেন ইংরেজ শাসকদের সহযোগিতায়। ব্রিটিশ শাসকদের ভূমিকা এসব ক্ষেত্রে ইতিবাচক। ব্রিটিশ শাসকদের সমর্থন না পেলে রামমোহনের সতীদাহর বিরোধিতা বা ইশ্বরচন্দ্রের বিধবা বিবাহ চালু করা, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা বা নারীশিক্ষা প্রসারের যে অবদান তা বাধাগ্রস্ত হতো। রামমোহন বা বিদ্যাসাগরের সংগ্রামকে ছোট করা হচ্ছে না, ইংরেজদের যে এসব ক্ষেত্রে বেশ বড় একটা অবদান ছিল সেটাই বলা হচ্ছে। ব্রাহ্মণ্যবাদের যাঁতাকল থেকে বহুক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায়ের মুক্তি ঘটাতে ইংরেজ শাসকদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল।

ব্রিটিশ শাসনে মুসলমানদের সমাজ সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দেয়নি। হিন্দু সমাজে নারীর অধিকার যেভাবে খর্ব ছিল মুসলিম সমাজে তা ছিল না। ধরা যাক, শিক্ষা বা নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলমান আর হিন্দু ধর্মের মধ্যে পার্থক্য কী ছিল? ইসলাম ধর্মে নর ও নারীর জন্য শিক্ষা আবশ্যক ঘোষণা করা হয়েছিল। সাধারণ মুসলমানরা সেখানে লেখাপড়া করার সুযোগ না পেলেও শিক্ষা লাভ করা নিষিদ্ধ ছিল না। কিন্তু মনুর বিধানে নারী ও শূদ্রদের জন্য শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল। ব্রাহ্মণ্য শাসনে সম্ভবত নারীর শিক্ষা গ্রহণের অধিকার কেড়ে নেয়া হয় পরের দিকে। ঋগ্বেদে মন্ত্রদ্রষ্টাদের মধ্যে কুড়িজন বিদুষী মহিলার নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশ্ববারা, ঘোষা, রোমশ, লোপামুদ্রা, অপালা, বাক্যমী, ইন্দ্রাণী, উর্বশী প্রভৃতি ঋগ্বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ছিলেন বলে এদের মন্ত্রদৃক বা ঋত্বিক বলা হয়েছে। যারা মন্ত্রে পারদর্শী হতেন তাদের মন্ত্রবিদ্ বলা হতো। রামায়ণে কৌশল্যা ও তারাকে মন্ত্রবিদ্ বলা হয়েছে। দ্রৌপদীকে মহাভারতে পণ্ডিতা বলা হয়েছে।

মেয়েরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন বলে বেদে উল্লেখ আছে। নারীরা অধ্যাপনা করতেন, তারা পুস্তক রচনাও করেছেন। কিন্তু স্মৃতির যুগে ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নারীদের বাদ দেয়া হতে থাকে। উপনয়নের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবার পর বাল্যবিবাহের প্রবর্তন হলে নারী ধীরে ধীরে অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। মনুসংহিতায় বিধান দেয়া হয়েছে: নারী বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর, বার্ধক্যে পুত্রের অধীনে থাকবে। মাদ্রাসার আগে ভারতের শিক্ষা ছিল বেদকে ঘিরে ধর্মীয় শিক্ষা। মূলত মানবজন্মের উদ্দেশ্য, ব্রহ্মা-সৃষ্টির রহস্য, মৃত্যুর পরের জীবন, পুনর্জন্ম এসব নিয়ে ভাববাদী কথাবার্তা ছিল সে শিক্ষার মূখ্য দিক। শিক্ষার লক্ষ্য ছিল জীবনের উদ্দেশ্যকে অনুধাবন করা এবং পরমের সঙ্গে পুনর্মিলনের পথে মৃত্যু সমস্যার সমাধান। সুতরাং সমগ্র শিক্ষা পরিবেশ ছিল আত্মপ্রয়োগ, ধ্যান এবং যোগের সমন্বয়ে পূর্ণ সংযম এবং তপোবন আশ্রমতত্ত্ব দিয়ে সমগ্র শিক্ষা পরিকল্পনাটি ছকে বেঁধে দেয়া হয়েছিল। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাটি ছিল আধ্যাত্মিক ভাববাদ দ্বারা পরিমণ্ডিত। মৃত্যুর পরের জীবনকে নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা। মানুষের আত্মার চরম মুক্তিই হলো ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার মূল কথা, মানব আত্মাকে বড় করে দেখা এবং দেহকে অতিক্রম করার শিক্ষাই হলো বেদের প্রকৃত শিক্ষা।

ব্রাহ্মণ্য শাসনে যে নারীর শিক্ষার সুযোগ ছিল না, কথাটা খুবই সত্যি। নারীর জন্য উপনয়ন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। মনু সংহিতার ভাষ্যমতে, নারীর উপনয়ন মানে বিবাহ; স্বামী সেবাই তাদের গুরুগৃহে বাসের সামিল। শিক্ষা প্রশ্নে নারীকে এভাবেই মূল্যায়ন করেছেন মনু। কিন্তু এত বাধা সত্ত্বেও এক শ্রেণির মেয়েরা সমাজে শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিল, এরা সমাজে ব্রাত্য ছিল, গণিকা হিসেবে পরিচিত ছিল। রাষ্ট্র এদের নিজ ব্যয়ে শিক্ষিত করতো। প্রতি মাসে রাষ্ট্র গণিকাকে এক হাজার পণ দিতো এবং তার চতুঃষষ্টিকলা শিক্ষার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন শিক্ষকও নিযুক্ত হতো। গণিকাদের এই শিক্ষা দেয়া হতো সমাজের উচ্চবর্ণের মনোরঞ্জনের জন্য। মনে করা হতো, স্ত্রীরা পুরুষের সন্তানের মা হবে আর গণিকারা হবে তাদের বিলাস বা আনন্দের সঙ্গী। সন্দেহ নেই যে, এসকল গণিকারা সত্যিই খুব বিদুষী হত আর শিল্পকলার নানা বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতো। পুরুষদের কাব্যচর্চার সঙ্গী হতো তারা। সেইসব নারীদের নিজেদের বৈবাহিক জীবন না থাকলেও, কেউ কেউ উচ্চসমাজে যথেষ্ট মর্যাদার সঙ্গে জীবন যাপন করতো। সেইসব নারীদের মধ্যে বিভিন্নজন নগরে খুবই খ্যাতিমান হিসেবে পরিচিতি পেতো।

মন্দিরের সেবাদাসীদেরও কমবেশি নানা ধরনের শিক্ষালাভের সুযোগ ছিল। ফলে ব্রাহ্মণ্যসমাজে নারীর শিক্ষালাভের সুযোগ ছিলই না, তা বলা যাবে না। সমাজপতিরা নিজেদের স্বার্থে সমাজের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশের জন্য শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছিল। সেই সব নারীরা বহু রকম শিল্পকলায় পারদর্শীতা অর্জন বা লেখাপড়া শিখবার সুযোগ পেলেও, বেদ শিখবার অধিকার কিন্তু তারা পায়নি। ভারতীয় বহু শিক্ষাবিদ বলছেন, মুসলিম শাসনকালে শিক্ষার লক্ষ্য ছিল জ্ঞানের আলোকের প্রজ্বলন ও ব্যাপ্তি। শিক্ষা ছিল ধর্মভিত্তিক এবং এর একটি লক্ষ্য ছিল মানুষকে ধর্মমনস্ক করে তোলা। পাশাপাশি বস্তুগত উন্নতি লাভ করাও মুসলমানদের শিক্ষার লক্ষ্য ছিল। সাধারণ মানুষের তখন বেশি আগ্রহ ছিল বাস্তব শিক্ষার দিকে। মাধ্যমিক বা পরবর্তী স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল মাদ্রাসা। শিক্ষা গবেষক বেবী দত্ত, মধুমালা সেনগুপ্ত ও দেবিকাগুহ জানাচ্ছেন, প্রায়শই একটি বিশেষ মাদ্রাসা, জ্ঞানের একটি বিশেষ শাখার ওপর বিশেষত্ব লাভ করতো। মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পাঠ্যক্রমের ভিতরে ছিল: ব্যাকরণ, বাগ্মিতা, তর্কবিদ্যা, ব্রহ্মবিদ্যা, অধিবিদ্যা, সাহিত্য, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চরিত্রনির্ণয় বিদ্যা, সরকারি নিয়মাবলী বা প্রশাসনিক শিক্ষা, গণিত, ভূগোল, ইতিহাস, ভৌতবিজ্ঞান, অষুধশাস্ত্র ও ব্যবহারশাস্ত্র। মুঘল যুগের শেষভাগে পাঠ্যক্রমে যুক্তিভিত্তিক বিজ্ঞানগুলি আরো প্রাধান্য পায়। মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কিছুটা সম্পর্ক থাকলেও মূল শিক্ষার কাঠামো ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। মুসলমান ছাড়াও অন্যান্য ধর্মবলম্বীদের তাই মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণে বাধা ছিল না। চলবে