বড়লোকের প্রমোদভ্রমণের সঙ্গি হওয়া যখন বদান্যতা

সাদ রহমান

প্রকাশিত : আগস্ট ০৮, ২০২১

আইটেম গার্ল, কমেডিয়ান, কমেডি রাইটার, ব্লু ফিল্মমেকার বা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির মডেল— এরা প্রত্যেকেই যার যার পজিশন থেকে শিল্পকে লিড দেন। এখন কমেডিয়ান ক্যানো কমেডিয়ান থাকলেন, আইটেম গার্ল ক্যানো নায়িকা হইলেন না, বা ব্লু ফিল্মমেকার ক্যানো ভদ্র সিনেমা বানাইলেন না, এইসব দাবি আপনি তুললে তা আপনার `মোরাল` বাহাদুরি এবং অন্যের জন্য অসুবিধাজনক। এইসব দাবি করা যাবে না।

আমি কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা শিল্পকর্ম দেখছিলাম— আরেকজনের পার্সপেক্টিভকে বুঝে উঠুন— এই মর্মে। শিল্পকর্মটা ভালো লাগছিল। আপনার নিজের `হয়ে ওঠা`রও প্রথম শর্ত এটাই, অন্যের `হয়ে ওঠা`কে বুঝতে পারা। অন্যের হয়ে ওঠাকেই আপনার স্বীকার করতে হবে আগে, তাহলে ফাংশনালি আপনার নিজের হয়ে ওঠাটা ভ্যালিড হবে।

আজকের দিনে জয়া আহসানরা যেভাবে অন্যান্য মডেল-নায়িকাদেরকে খারিজ করতে চাইতেছেন, সেটাতে তারা অন্যের `হয়ে ওঠা`কে অস্বীকার করতেছেন। তাদের এই ভাবনা ক্লিয়ারলি রেসিজম। তারা ভাবতেছেন তারাই প্রধান শিল্পী থাকবেন, এবং অন্যের `হয়ে ওঠা`কেও তারাই লাইসেন্স দিবেন।

শিল্পে সবাই সমান কাজ করবে না। কেউ কম শিল্প করবে, কেউ বেশি করবে। কেউ ভালো করবে, আবার কেউ খারাপও করবে। কিন্তু এই কমবেশি কিংবা ভালোখারাপ দিয়া শিল্পীর পরিচয় নির্মাণ হবে না। যদি কেউ শিল্প করতে আসেন, তাতেই তার পরিচয় সম্পন্ন হবে। এবং তিনি কী ধরনের শিল্পী হবেন, সেইটাও তারই সিদ্ধান্ত।

এই জিনিসটা বুঝতে পারলে তবেই পরের আলাপ করা যাবে, নাহলে আলাপ সম্ভব না।

দুই.
তথায়, ধরুন শিল্পী এখানে একজন আইটেম গার্ল। প্রশ্ন হলো, আইটেম গার্ল হিসেবে দর্শকের যেই বিশিষ্ট `দেখার চোখ` বা ভঙ্গি তাকে গ্রহণ করতে হচ্ছে, সেটা কি তিনি-ই তৈরি করছেন কিনা। দর্শকের এই `দেখার চোখ` সহই কি তিনি আইটেম গার্ল হয়ে উঠছেন না?

উঠছেন, এবং শিল্পী হিসেবে আইটেম গার্লের ওইটাই কাজ। দর্শকের মধ্য থেকে যৌন `দেখার চোখ` বাইর কইরা আনা।

মজার বিষয় হইলো, তাকে দর্শক এইভাবে দেখবার ফলে তার জন্য একখানা প্যারালাল পথ তৈরি হইতেছে। যথা, নাচের যেই মুদ্রা উনি টিভিতে বা পর্দায় দেখাইতেছেন, এক্ষেত্রে সেই মুদ্রা কেউ কেউ গোপনে দেখার ইচ্ছা পোষন করতেছেন। শিল্পীকে সেই ইচ্ছার কথা জানানো হইলে তা শিল্পীর ইচ্ছার উপরেই নির্ভর করতেছে।

দেখা যাইতেছে, কেউ অনেক টাকা বা সোনা-গয়না-গাড়ি নিয়া হাজির হইছেন শিল্পীর কাছে। এবং তার বদলে শিল্পীও রাজি হইছেন টাকাঅলাকে নাচের মুদ্রা দেখাবেন। ঘরের মধ্যে, হোটেলে বা বিদেশভ্রমণ করে। বা তার চাইতেও বেশি কিছু করবেন। আমার অভিমত হইলো, এইটায় শিল্পের বা আইনের, বা কারোরই কোনও অনিষ্ট হয় নাই। মানে আপত্তির জায়গা নাই।

বরং আপত্তিকর বিষয় হইলো, এই বিদেশ ভ্রমণগুলোকে অনেকে প্রস্টিটিউশন হিসেবে পাঠ করতে চান আজকের দিনে। তার মধ্য দিয়া নিজেদেরই ধার্মিক ধারণা, অর্থাৎ `প্রস্টিটিউটশন হইলো অনৈতিক` দিয়া শিল্পীকে `মন্দ` হিসেবে হাজির করেন।

আমাদেরকে বুঝতে হবে, শিল্পীর এই প্যারালাল পথ তৈরি হওয়া, যা তার শিল্পের ভোক্তাদের একান্ত আগ্রহ থেকে আসে, এটার সঙ্গে প্রস্টিটিউশনের যোগাযোগ নাই। প্রস্টিটিউশন হইলো, একজন প্রস্টিটিউট যখন একজন প্রস্টিটিউট, আপনার সঙ্গে যৌনসম্পর্কের ভিত্তিতে পয়সা কামানো-ই তার উদ্দেশ্য। নায়িকা, মডেল বা অভিনেত্রীর মতো গ্ল্যামার বা শিল্পসমাজে তার আধিপত্যের দরকার নাই।

তিন.
আজকে বাংলাদেশের বাজে বাজে মিডিয়াগুলো নায়িকা পরীমনির কিছু বিদেশভ্রমণকে হাইলাইট কইরা খবর প্রচার করতেছে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, এইসব `বিদেশভ্রমণ`কে প্রস্টিটিউশনের আন্ডারে ফালাইয়া জাতীয়ভাবে তাকে অপদস্ত করা। আর যিনি প্রস্টিটিউট না, তাকে প্রস্টিটিউট বানানো হইলে তাকে অবশ্যই অপদস্ত করা হয়।

মিডিয়াগুলো মূলত দেশের কম-বুদ্ধিমান মুসলিম নাগরিকদের কাছে পরীমনিকে অপবিত্র কইরা তুলতেছে, এবং তাদেরকে পরীমনির বিরুদ্ধে ইউজ করতে চাইতেছে। আর এটাও বলা খুব কঠিন না যে, মিডিয়া মূলত কিছু পাওয়ারফুল চক্রান্তকারীর দেখানো রাস্তাতেই এই কাম করতেছে। পরীমনির বিরুদ্ধে পাওয়ারের যেই চক্রান্ত, সেই রাস্তাই মিডিয়া এখন পরিষ্কারের দায়িত্ব নিছে। অতি হীন আচরণ এটা, মিডিয়া ও মিডিয়ার মাথাদের তরফে।

প্রস্টিটিউশন যত ভালো কাজই হোক, পরীমনিকে এই ধারণার সঙ্গে সংযুক্ত করা যাবে না। উনার যেসব প্রমোদ-ভ্রমণকে মিডিয়া আজকে `খবর` বানাইতেছে, সেটা উনার একান্তই যোগ্যতার ফসল। উনার সৌন্দর্য, প্রসিদ্ধি, ও ট্যালেন্টের ফলেই কিছু দর্শকের মনে তিনি ক্রিয়া করছেন, এবং তাদের আরাধ্য হইছেন।

তাদের কাছে যে পরীমনি আরাধ্য হইছেন, এই তথ্য তারা পরীমনিকে জানাইলে পরে, সেইসূত্রেই পরীমনি তার ইচ্ছা মোতাবেক কোনও কোনও দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগে বা বিদেশভ্রমণে রাজি হইছেন।

মানুষ প্রসিদ্ধি বা মৌন গ্লামারকে সামনে থেকে দেখতে চায়, পাইতে চায়। এটা মানুষের আদি-সাইকোলজি। ফলে মানুষ যখন চর্মচক্ষে কোনও গ্লামারকে পাইলো বা ধরলো, সেটা গ্লামারের বদান্যতা হিসেবেই পাঠ করা লাগবে। কারণ, আদতে তা-ই ঘটে। যা মিডিয়ার ব্যাড ভাইবের ফলে কেউই দেখতে পায় না।

লেখক: কবি