মনি হায়দারের ‘গল্প পঞ্চাশ’

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুলাই ০৪, ২০২০

ছোট আকারের গল্পকেই আমরা সাধারণত ছোটগল্প বলি। তবে এত সহজে ছোটগল্পের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যায় না। ছোটগল্পের সংজ্ঞা নিয়ে বিশ্বব্যাপী অনেক বিতর্ক আছে। যেমন, এডগার অ্যালান পো বলেছেন, যে গল্প অর্ধ হতে এক বা দুই ঘণ্টার মধ্যে এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়, তাকে ছোট গল্প বলে। অন্যদিকে এইচ জি ওয়েলসের ভাষায়, ছোটগল্প সাধারণত ১০ হতে ৫০ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয়।

যদিও উপরের দুটি সংজ্ঞা আমাদের সাহিত্য বোদ্ধাদের অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। ছোটগল্পের যে ধারণাটি মোটামুটি বাঙালি সাহিত্য সমাজে বহুল আলোচিত ও স্বীকৃত, সেটির প্রণেতা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি `সোনারতরী` কাব্যের `বর্ষাযাপন` কবিতার মধ্যে ছোট গল্পের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে:

ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা
নিতান্ত সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারটি অশ্রু জল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।

ছোটগল্পের সার্থক রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর গল্পগুচ্ছের গল্পগুলো ছোটগল্পের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাছাড়া মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, জগদীশ গুপ্ত, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, মনোজ বসু, হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবালসহ অনেকেই বাংলা ভাষায় সার্থক ছোটগল্প রচনা করেছেন।

প্রেমবিষয়ক, সামাজিক, প্রকৃতি ও মানুষ, অতিপ্রাকৃত, হাস্যরসাত্মক, উদ্ভট, সাংকেতিক বা প্রতীকী, ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক, গার্হস্থ্য, মনস্তাত্ত্বিক, মনুষ্যতর, বাস্তবনিষ্ঠ, ডিটেকটিভ গল্প, বিদেশি পটভূমিকাযুক্ত গল্পের মতো অনেকগুলো বিষয়ে ছোটগল্প লিখিত হয়েছে ও হচ্ছে। একজন গল্পকার সবগুলো বিষয়ের উপরেই গল্প লিখতে পারেন, আবার না-ও লিখতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপরের বিষয়গুলোর বেশিরভাগ বিষয়েই গল্প লিখেছেন। গল্পগুচ্ছ পড়লে আমরা কি তা দেখতে পাইনে?

আমি `গল্প পঞ্চাশ` নামে আরেকটি বই পড়ছি। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মনি হায়দারের দুশো গল্পের মধ্য থেকে বাছাই করা পঞ্চাশটি গল্প নিয়ে মলাটবদ্ধ হয়েছে `গল্প পঞ্চাশ` নামের একটি সার্থক ছোটগল্পের বই। বইটি পাঠ করার সময় মনে হচ্ছে, আমি যেন আমার জীবনেরই ভিন্ন ভিন্ন পটভূমির টুকরো টুকরো গল্প পড়ছি। অসম্ভব ভালোলাগার অনুভূতি হচ্ছে হৃদয়ের গহীনে। সুখানুভূতি ছড়িয়ে যাচ্ছে রক্তের তরঙ্গে। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বইটি কেনার পর ছয়টি গল্প পড়ে আমি অন্য একটি বই পড়াতে মনোনিবেশ করি। ইচ্ছে ছিল ধীরে ধীরে বইটি পড়ব। যাতে বইটির গল্পগুলো মনে রাখতে পারি।

বড় আশ্চর্যের বিষয়, বইটি আমি দীর্ঘদিন ধরে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বাসার আনাচে কানাচে সবজায়গায় খুঁজি। বইয়ের আলমারিতে, কাপড়ের আলমারিতে, খাটের নীচে, আলনার পাশে, আলমারির পেছনে, উপরে, নিচে। কোথাও খুঁজতে বাকি রাখিনি। আমি খুঁজেছি, সীমা খুঁজেছে, আমার ভাই অপু খুঁজেছে, তবুও বইটি পাচ্ছিলাম না। সীমার অভিযোগ, তুমি বইটি অফিসে নিয়ে যাবার পথে হারিয়ে ফেলেছ। অফিসে যাবার পথে ব্যাগে বই রাখি আমি। অফিসে আসা-যাওয়ার সময়ে বা অফিসে কাজের ফাঁকে বইটি পড়ি। সেসব ছোট বই। হালকা ওজনের বই। তার উপর লকডাউন চলছিল। এত বড় বই আমি কোথাও নিয়ে যাইনি।

তবুও সীমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। এমনকি আমার নিজের উপর নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না। বই কেউ ধারও নেয়নি। তবে কী বইটি চুরি হলো? কে করবে চুরি, কেন করবে চুরি? সেটাও অসম্ভব! আমি কোনও কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ১৭ এপ্রিল ২০২০ তে ফেসবুকে বইটি নিয়ে এই পোস্টটি দিই। ‘প্রতিটি মানুষের দুটি চোখ থাকে। সে চোখ দিয়ে তারা সামনের দৃশ্য দেখে। পথ চলে। পথে খানাখন্দ আছে কিনা দেখে নেয়। খাবারের কাকড়, মরিচ বেছে ফেলে দেয়। সে চোখের সামনে বই ধরে পড়ে। পছন্দের মানুষটির হাসিমুখ দেখে খুশি হয়। কালোমুখ দেখে বেজার হয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ, নিজের শরীর দেখে গর্বে বুক ফুলিয়ে ফেলে। আড়চোখে পাশের বাসার প্রিয়মুখ দেখে মুখটিপে হাসে। আবার এ চোখ দিয়েই দেখে দেয়ালে লেখা রয়েছে, চোখ সামলাও, পাপ কম হবে।

এ বিশ্ব প্রকৃতির বনভূমি, নদী, পাহাড়, সমুদ্র, দর্শনীয় স্থাপনা, প্রাণ বৈচিত্র আরো কত কী যে দেখে মানুষ এ দুটো পোড়া চোখ দিয়ে তা বলে শেষ করা যাবে না। এ সব দেখা, সাধারণ মানুষের দেখে। আমজনতার দেখা। লেখকের এ দুটি চোখের আড়ালে আরো একটি চোখ থাকা চায়। প্রাচীন ঋষি পুরুষের যে চোখ ছিল। মহীয়সী নারীর যে চোখ আছে। সন্তানের প্রতি মায়ের যে চোখ থাকে। সেই চোখ। সেই অদৃশ্য নয়ন। সেই ত্রিনয়নের একটি। সেই মহার্ঘ্য চোখটি লেখকের থাকা চায়। কল্পনার সে চোখ দিয়ে লেখক প্রাণ-প্রকৃতি, পরিবেশ-প্রতিবেশের মধ্য থেকে নতুন কিছু দেখে। মানুষের মুখের লাবণ্যই শুধু নয়, তার কদর্য ভেতরটিও দেখে। কিংবা কঠিন রূঢ় মানুষের মুখ দেখে তার ভেতরের কুসুম কোমল মনটি দেখতে পায়।

এই দেখার বাইরে দেখার যে গুণ, এই চোখ দিয়ে মন দেখার যে গুণ, সেটা যে লেখকের যত বেশি থাকে, সে লেখক তত মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। মানুষের অন্তরে জায়গা করে নেয়। পাঠক যখন সেই লেখকের লেখা পড়ে, তখন মনে মনে ভাবে; আরে, এ যে আমাকে নিয়েই লিখেছে। কিংবা গল্পের চরিত্র তার নিজের চরিত্র বলেই কল্পনা করে। অথবা পাঠক গল্পের চরিত্রের মানুষটি হতে চায় বা গল্পের চরিত্রের মতো করে নিজেকে বদলে ফেলতে চায়। পাঠককে সম্মোহিত করার ক্ষমতা যে লেখকের যত বেশি, সে লেখক তত বেশি সার্থক। ততই বেশি হৃদয়গ্রাহী।

`আহীর আলমের বাম পা`, `আসুন, আমরা আবদুল খালেকের একটা ছবি আঁকি,’ `জয় বাংলা`, `গৃহপালিত চিড়িয়াখানা গড়ে উঠবার প্রণালি`, `জিহ্বার মিছিল` ও `দেশ জানুয়ারি ১৯৭২`। গল্প ছয়টি পড়বার সময় আমার মনে হলো, লেখক তন্ময় হয়ে তার তৃতীয় চোখে ঘটনা প্রবহ দেখেছেন। আমাদের সামনের অতি সাধারণ ঘটনা, অতি সাধারণ দৃশ্যের বাইরে যে কথা থাকে, যে দৃশ্য থাকে, তাকে তিনি নিপুণভাবে তুলে এনেছেন। নিবিড় পরিচর্যা করেছেন এবং গল্পে রূপান্তরিত করেছেন।

আমাদের সামনে এমন অনেক লেখক আছেন, যাদের এই গুণটি আছে। লেখক মনি হায়দার তাদের মধ্যে একজন। উপরে যে গল্পগুলো উল্লেখ করেছি সেগুলো লেখক মনি হায়দারের `গল্প পঞ্চাশ` এর গল্প। এরপর যতদূর মনে পড়ছে, বইটি তুলে রাখি আলমারির মাথায়। অথচ বইটি আর খুঁজে পাই না। বইটির কী ডানা গজালো? আমার মনে অতিপ্রাকৃত একটা ভয় ঘাপটি মেরে বসে। অতঃপর প্রায় দুই মাস পরে বইটি খুঁজে পাই বইয়ের আলমারিরই ভেতরে। আমি যারপরনাই বিস্মিত। এই আলমারিতে বইটি কতবার খুঁজেছি, পাইনি। এখন কোথা থেকে বইটি আসল?

আমার কাছে এর কোন উত্তর নেই। মস্তিষ্ক এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ। কোন বই ভালো লাগলে সেটা পড়ার জন্য যে কতটা ব্যাকুল হতে পারে পাঠকের হৃদয়ে, সেটা নিজেকে দিয়ে খুব ভালোকরে বুঝলাম। বইটি ফিরে পাবার পর আর অপেক্ষা করিনি। দীর্ঘদিনের অতৃপ্ত হৃদয় তৃপ্ত হচ্ছে বইটির এক-একটি গল্প পড়ে।

বহুদিন এত আনন্দ পাইনি। এই বইটি ফিরে পেয়ে, বইটির গল্পগুলো পড়তে পেরে, যত আনন্দ পাচ্ছি। আমার মনে হয়, আমার মতো সকল পাঠকেরই বইটি পড়তে ভালো লাগবে।

একুশে বইমেলা ২০১৮