মহাভারতের চরিত্র অবলম্বনে অঙ্কিত ছবি

মহাভারতের চরিত্র অবলম্বনে অঙ্কিত ছবি

মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৪৮

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৫, ২০২১

সমাজ সংস্কারক কখনো কখনো জনগণের মধ্য থেকে উত্থিত হন। যেমন রাজা রামমোহন রায় কিংবা বিদ্যাসাগর। প্রথমজন ভারতবর্ষে বর্বরতম প্রথা সতীদাহের বিরুদ্ধে এবং দ্বিতীয়জন নারীশিক্ষা ও বিধবা-বিবাহের পক্ষে সামাজিক আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু তাদের উদ্যোগের বাস্তবায়ন করতে হয়েছিল শাসককে, অর্থাৎ ইংরেজ গভর্নরকে। যেমন সতীদাহ প্রথা রদকে আইনি স্বীকৃতি দেন গভর্নর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক এবং বিধবা-বিবাহকে বড়লাট লর্ড ক্যানিং। আর খোদ শাসক যদি সংস্কারকের ভূমিকায় আসেন, তবে তো কথাই নেই, খুব দ্রুত গতিতে সাধিত হয় সংস্কার। যেমন হচ্ছে সৌদি আরবে, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে। সৌদির স্কুলে পড়ানো হবে রামায়ণ-মহাভারত। এ এক বড় আনন্দের সংবাদ, এক যুগান্তকারী ঘটনা, এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

স্মরণে এলো চার্লস-অগাস্টিন সাঁত বভ-এর সেই কথা, যিনি বলেছিলেন, ‘মর্ত্যলোকের অমরালয়ে সকলের আগে যাঁর আসন থাকবে তিনি হলেন দেবতার মহিমায় দীপ্যমান হোমার। কিন্তু তাঁর পরেই দেখা যাবে আরও তিনজন হোমারকে। এশিয়ার প্রাচীন জাতিসমূহের জন্য তাঁরা মহাকাব্য রচনা করেছেন―ভারতীয়দের বাল্মিকী ও ব্যাস এবং ইরানিদের ফেরদৌসি।’ বাল্মিকীর রামায়ণ ও ব্যাসদেবের মহাভারতের গুরুত্ব ঠিক ধরতে পেরেছিলেন অগাস্টিন। এই দুটি মহাগ্রন্থ বাংলা-ভারতের কত বড় সম্পদ, অনেক বাঙালি তো নয়ই, অনেক ভারতীয়ও জানে না; আরব তো বহু দূরের পথ। বাংলা-ভারতের অনেকে গ্রন্থ দুটিকে মনে করে স্রেফ ধর্মগ্রন্থ। কাব্য হিসেবে এদের স্থান কোথায়, তা তারা জানেই না। আরবে আরও আগেই গ্রন্থ দুটির মহাত্ম্য পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। পৌঁছেছেও। তবে কবি-লেখকদের মধ্যে শুধু, এভাবে গণপর্যায়ে পৌঁছেনি। পৌঁছেনি কুপমণ্ডুকতার কারণে, বৈশ্বিক জ্ঞানকে অগ্রাহ্য করার কারণে। সেই কুপমণ্ডুকতা থেকে বেরিয়ে আসছে সৌদি, সালমানের নেতৃত্বে―এটা অনেক বড় একটি ঘটনা।

উসমানীয় সামরিক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক যেমন তুরস্ককে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বদলে দিয়েছিলেন, তেমনি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বদলে দিচ্ছেন সৌদি আরবকে। ইসলামের উন্মেষের দেশ, কট্টর ইসলামি রাষ্ট্র সৌদি আরবের এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কি গোটা মুসলিম বিশ্বে একটা পরিবর্তন আসবে না? নিশ্চয়ই আসবে। তুরস্কের পরিবর্তনের অভিঘাত পড়েছিল গোটা মুসলিম বিশ্বে। সৌদি আরবকে মুসলিম বিশ্ব ‘কেবলা’ মানে, মক্কার দিকে ফিরে মুসলমানরা প্রার্থনা করে। সেই কেবলায় পরিবর্তন এলে মুসলিম বিশ্বে যে অনিবার্যভাবেই পরিবর্তন আসবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সৌদির এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। কী কী পরিবর্তন করেছেন বা করবেন তিনি? রক্ষণশীলতার খোলস থেকে সৌদিকে বের করে মধ্যপন্থী, উন্মুক্ত ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি বহু আগেই। দেশের অর্থনীতিকে খোল-নলচে বদলে দিচ্ছেন। তেল নির্ভরতা কমিয়ে নয়া উদারনীতির দিকে যাচ্ছেন। বিশ্বের সব ধর্মের মানুষের জন্য সৌদি আরবের দরজা খুলে দিচ্ছেন। ৫০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে মিশর ও জর্দানের সঙ্গে গঠন করছেন স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক জোন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদির সম্পর্ককে করেছেন আরও নিবিড়। মস্কোর সঙ্গেও দীর্ঘ দিনের শত্রুতা ঘুচিয়ে বন্ধুত্বের পথে হাঁটা শুরু করেছে রিয়াদ। বহু বছরের শত্রুরাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্যও খুলে দিয়েছে সৌদির আকাশ।

অপরদিকে সাড়ে ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে সৌদিতে হবে ‘নিওম’ নামে একটি শহর। লোহিত সাগরের উপকূলীয় এলাকায় নির্মিতব্য শহরটি হবে গোটা বিশ্বের প্রযুক্তি গবেষণার রাজধানী, সামাজিক বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত ও যানজটমুক্ত একটি শহর। নিওম হবে ভবিষ্যৎ বিশ্বের স্বপ্নদ্রষ্টাদের শহর। এই শহরে উত্তর-আধুনিক বিশ্বের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন বিন সালমান। ‘নো রেসট্রিকশন, নো ডিভিশন, নো এক্সকিউজেস, এন্ডলেস পোটেনশিয়ালস’ নীতিতে চলবে এই শহর। কোনো বিধিনিষেধ নয়, কোনো বিভাজন নয়, কোনো অজুহাতও নয়; শুধু সীমাহীন সম্ভাবনার শহর হবে নিওম। এই শহরে পুরুষের সঙ্গে নারীরাও একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে। তাদের মাথায় থাকবে না কোনো হিজাব। সৌদি আরবে নারীর অধিকারের প্রশ্নেও এসেছে পরিবর্তন। নারীরা ভোট দিতে পারবে এবং নির্বাচনে প্রার্থীও হতে পারবে; নারীরা গাড়িও চালাতে পারছে এখন। সৌদি আরবের সকল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীরা মোবাইল ব্যবহার করতে পারছে, যা আগে পারত না। স্টেডিয়ামে বসে নারীরা দেখতে পারছে খেলাও।

কী অভাবনীয় পরিবর্তন! বিন সালমান এসব পরিবর্তন কেন করছেন? পশ্চিমা দেশগুলোকে খুশি করবার জন্য? বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবার জন্য? হোক খুশি করবার জন্য, হোক আকৃষ্ট করবার জন্য। যে কারণেই হোক এই পরিবর্তন ইতিবাচক, শুভ। সৌদি আরবের এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একদিন দেশটিতে বহুত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ সহাবস্থান করতে পারবে, শিয়াদের ওপর নিপীড়নও বন্ধ হবে। তার মানে একটা প্রদীপ জ্বলে উঠেছে সৌদি আরবে। এই প্রদীপ মুসলিম বিশ্বের অন্ধকারকে কিছুটা হলেও কমাবে। পৃথিবীর কট্টর মুসলমানরা তাদের কট্টরতার পক্ষে এতদিন সৌদি আরবকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করত। আর পারবে না। ধীরে ধীরে তারা সমবেত হতে থাকবে ওই প্রদীপের তলে। এছাড়া আর পথ খোলা থাকবে না তাদের। সৌদির এই পরিবর্তনের অভিঘাত নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশেও পড়বে। এ অনেক বড় ঘটনা।

বাংলাদেশে উগ্রবাদের আঁতুড়ঘর কওমি মাদ্রাসাগুলোকে যে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছে, করছে সৌদি আরব ও তার মিত্র দেশগুলো, তা দিবালোকের মতো সত্য। অস্বীকার করার উপায় নেই। এসব মাদ্রাসা তো সরকারের কাছ থেকে কোনো অর্থসহায়তা পায় না। বরং তারা গর্ব করে বলে, ‘আমরা সরকারের কোনো সহায়তা চাই না।’ তাহলে এত বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো চালানোর মতো অর্থ আসে কোথা থেকে? আসে সৌদি আরব ও তার মিত্র দেশগুলো থেকে। গত চল্লিশ বছর ধরে এসেছে, এখনো আসছে। বিন সালমানের প্রচেষ্টায় ভবিষ্যতে আসার পথটা বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধের পদক্ষেপ নেবেন তিনি, একবার সেই ঘোষণা দিয়েছেনও। নানা কারণে এখন বন্ধ করতে পারছেন না। তবে পারবেন নিশ্চিত। বাংলাদেশের বড় বড় কওমি মাদ্রাসাগুলো তখন পড়বে বিপাকে। উগ্রবাদের অতলান্ত কূপগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হবে। ইতিহাসে মোহাম্মদ বিন সালমান নিজের নামটিকে অক্ষয় করতে চলেছেন। তাকে অভিনন্দন।

আশাবাদ, সৌদি আরবের মতো একদিন বাংলাদেশের স্কুলেও পড়ানো হবে ইলিয়াদ, অডিসি, রামায়ণ, মহাভারতসহ পৃথিবীর সকল জ্ঞান ও রসকাণ্ডের গ্রন্থগুলো। একটি উন্নত জাতি গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা পাল্টাতেই হবে। বৈশ্বিক জ্ঞানের সঙ্গে পাঠ্যসূচিকে সম্পৃক্ত করতেই হবে। নইলে এই জাতি রয়ে যাবে রবীন্দ্রনাথের সেই বাঙালি, যাদের নিয়ে তিনি আক্ষেপ করেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষেরে হে মুগ্ধ জননী/রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।’

একদিন আমাদের আশার বাস্তবায়ন দেখতে পাবই। আমরা সেই শুভদিনের প্রতীক্ষায়। চলবে

২৪ এপ্রিল ২০২১