মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৫১

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : মে ০৪, ২০২১

কথাসাহিত্যিক মশিউল আলমের মতে, ‘লেখক নেই। সাংবাদিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যাংকার, পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা ইত্যাদি পেশার কিছু মানুষ লেখালেখি করেন। শুধু ‘লেখক’ বাংলাদেশে নেই।’

আচ্ছা মশিউল ভাই, লেখককে শুধুই লেখালেখি করতে হবে, আর কিছু করা যাবে না, লিখেই সংসার চালাতে হবে―এই দিব্যি তাকে কে দিয়েছে? এই শর্তই বা কোথা থেকে এলো? পৃথিবীর বহু বিখ্যাত লেখক চাকরি করেছেন, পাশাপাশি লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। কথাশিল্পী ফ্রানৎস কাফকা রাতের বেলায় লেখালেখি চালিয়ে যেতে এবং প্রতিদিনের খরচ মেটাতে একটি মেকানিক্যাল চাকরি খুঁজছিলেন। চাকরি না পেয়ে একটি আইনি প্রতিষ্ঠানের কেরানির চাকরি নেন। সপ্তাহে ষাট ঘণ্টা কাজ করতে হতো বলে কাজটি ছেড়ে যোগ দেন একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। পাশাপাশি তাঁর বাবার ব্যবসা দেখাশোনার কাজও করতেন।

স্যার আর্থার কোনান ডয়েল কর্মজীবন শুরু করেন ডাক্তার হিসেবে। রোগী দেখার ফাঁকে গল্প লিখতেন। এভাবেই লেখা হয় তাঁর উপন্যাস ‘অ্যা স্টাডি ইন স্কারলেট’। আইরিশ কথাসাহিত্যিক ও কবি জেমস জয়েস মেডিকেলের ডিগ্রি না নিয়ে বেছে নেন গায়ক ও পিয়ানো বাদকের পেশা। পরে ইতালি ও ক্রোয়েশিয়ায় ইংরেজি শিক্ষকের কাজে যুক্ত হন। এ কাজেও তাঁর মন বসেনি। স্ত্রীকে নিয়ে আয়ারল্যান্ডে ফিরে চালু করেন সিনেমা হল। এ ব্যবসায়ও লসের মুখে পড়ে আবার ফিরে যান শিক্ষকতায়, চালিয়ে যেতে থাকেন লেখালেখি।

রহস্যসাহিত্যের স্রষ্টা আগাথা ক্রিস্টি মিলিটারি হাসপাতালের নার্স হিসেবে কাজ করেছেন প্রায় চার বছর। যুক্তরাজ্য যখন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তখন তিনি এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। তার কাজ ছিল যুদ্ধে আহত সৈন্যদের সেবা দেওয়া। দু-বছর বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেন এবং পরের দু-বছর নিয়মিত নার্স হিসেবে বার্ষিক ষোলো ডলার করে বেতন পেতেন। প্রায় আট বছর ধরে হার্পার লি একটি ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স কোম্পানির টিকিট রিজার্ভেশন ক্লার্ক হিসেবে কাজ করেন। অবসর সময়ে লিখতেন গল্প। চার্লস ডিকেন্সের অল্প বয়সেই তাঁর বাবা জোর করে তাঁকে শু পলিশ কারখানায় বৈয়ামে লেবেল সাঁটার কাজে লাগিয়ে দেন। সপ্তাহে মাত্র ছয় শিলিংয়ের বিনিময়ে এ কাজ তাঁকে করতে হয়েছে বেশ কিছুদিন।

ইংরেজ কবি, প্রাবন্ধিক ও নাট্যকার টি. এস. এলিয়টের প্রথম জীবনের পেশা ছিল কেরানির। লয়েডস ব্যাংক অব লন্ডনের একজন কেরানি হিসেবে আট বছর কাজ করেন তিনি। নোবেল বিজয়ী আমেরিকান সাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনার লেখকজীবন শুরু করার আগে ছিলেন একজন পোস্টমাস্টার। মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি পোস্ট অফিসের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে পূর্ণ মনযোগ দেন লেখালেখিতে। আমেরিকান কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক কার্ট ভনেগাট পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে আমেরিকার প্রথম সাব-ডিলারশিপের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, যদিও সেই ব্যবসায় সফল হতে পারেননি। এর আগে তিনি স্পোর্টস ম্যাগাজিনের রিপোর্টার, পিআর এজেন্ট এবং বিজ্ঞাপনী সংস্থায়ও কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন।

নোবেল বিজয়ী কথাসাহিত্যিক জন স্টেইনবেক একজন ফুলটাইম লেখক হওয়ার আগে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষানবিশ চিত্রশিল্পী, বাগানে ফল তোলার কাজ, স্টেট কেয়ারটেকার এবং ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার এফ স্কট ফিটজেরাল্ড প্রেমিকা জেলদা সাইরাকে খুশি করতে গিয়ে নিজেই একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা খুলে বসার মনস্থির করেন। সে জন্য একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কিছুদিন কাজও করেন। সেখানে তাঁর কাজ ছিল প্রমোশনাল স্ট্নোগান লেখা। কিন্তু মাসে মাত্র নব্বই ডলার আয় করে কীভাবে সংসার চালাবেন ফিটজেরাল্ড, এই ভয়ে প্রেমিকা তাকে ছেড়ে চলে যান এবং ভগ্নহৃদয়ে ফিটজেরাল্ড আবার লেখায় মনোনিবেশ করেন। তবে এর মাঝে পেট চালানোর দায়ে তিনি গাড়ির ছাদ সারাইয়ের কাজে লিপ্ত ছিলেন কিছু সময়।

বিট জেনারেশনের অন্যতম প্রধান কবি, কথাসাহিত্যিক জ্যাক কেরুয়াক গ্যাস স্টেশন ও তুলার ক্ষেতে কাজ করেছেন। এ ছাড়াও নাইটগার্ড, রেল সড়কের ব্রেকম্যান, ডিশ ওয়াশার, নির্মাণ শ্রমিক এবং জাহাজের ডেকবয় হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। কবিখ্যাতি পাওয়ার আগে ল্যাংস্টন হিউজ ছিলেন বাসবয়, হোটেলের রান্না-সহযোগী। কখনও কাজ করেছেন লন্ড্রিতে। এ ছাড়া আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের জাহাজেও কাজ করেছেন কিছুদিন। জাপানি সাহিত্যিক হারুকি মুরাকামি কলেজজীবনে রেকর্ড স্টোরের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগে তিনি ও তাঁর স্ত্রী টোকিও শহরে পিটার ক্যাট নামের একটি কফি হাউস ও জ্যাজবার চালাতেন।

ইংরেজ সাহিত্যিক জর্জ ওরয়েল সাহিত্যজীবন শুরু করার আগে ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত বার্মার পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন প্রায় পাঁচ বছর। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ব্রিটেনে ফিরে গিয়ে তিনি ওই চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। ঔপন্যাসিক বালজাক ছিলেন আইনজীবীর মুহুরি। আন্তন চেকভ ছিলেন গ্রাম্য চিকিৎসক। বাংলা ভাষার গল্পকার সুবোধ ঘোষের কর্মজীবন ছিল বৈচিত্র্যে ভরা। বাসের কন্ডাক্টর হিসেবে কর্মজীবনের শুরু। এছাড়াও ট্যুইশন, ট্রাক ড্রাইভার, সার্কাস পার্টিতে ক্লাউনের ভূমিকায় এবং আরও বহু কর্মের অভিজ্ঞতা নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগের সহকারীর চাকরি নেন। ক্রমে সিনিয়র অ্যাসিট্যান্ট এডিটর, অন্যতম সম্পাদকীয় লেখক। খোদ রবীন্দ্রনাথও কি শুধু লেখালেখি করে সংসার চালিয়েছিলেন? তাঁকেও দেখাশোনা করতে হয়েছিল জমিদারি।

আরো উদাহরণ দেব? আচ্ছা থাক। আর বাংলাদেশের কোন লেখক চাকরি করেননি? জসীম উদ্দীন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নির্মলেন্দু গুণ, হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ, শহীদুল জহির প্রমুখ―কে চাকরি করেননি? তাঁরা কি লেখক ছিলেন না? হালে যাঁরা লিখছেন, তাদের কে চাকরি করছেন না? যাঁরা লিখছেন, পাশাপাশি চাকরি করছেন, তাঁরা কি লেখক নন? তাঁদেরকে কেন লেখক বলা যাবে না? মশিউল ভাই, লেখক লেখকই। তাকে শুধু লিখেই টাকা রোজগার করতে হবে এমন কোনো শর্ত নেই। তিনি মূলত লেখেন, পাশাপাশি চাকরিও করেন। যেমন আপনি। আপনি মূলত কথাসাহিত্যিক, পাশাপাশি সাংবাদিকতার চাকরি করেন। সুতরাং এভাবে বলা যায় না যে, ‘শুধু লেখক বাংলাদেশে নেই।’ হ্যাঁ, শুধু লিখে টাকা রোজগার করা এখন বাংলাদেশে অসম্ভব। একটা সময় সম্ভব হবে। অবশ্যই হবে। আমরা আশাবাদীদের দলে। পাশাপাশি এও প্রশ্ন, কেবল টাকা রোজগার করাই লেখকের একমাত্র উদ্দেশ্য? লিখে টাকা রোজগার করলেই কেবল তাকে লেখক বলা যাবে? তাহলে তো কমলকুমার মজুমদার কোনো লেখকই ছিলেন না।

কথাটি কার ভুলে গেছি, মনে পড়লে যোগ করে দেব, যিনি বলেছিলেন, আমরা এমন লেখক চাই, যিনি একই সঙ্গে লিখতে পারেন এবং তাওয়ায় রুটিও ভাজতে পারেন। চলবে

৪ মে ২০২১